‘কোভিডের অগ্নিপরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র’
কোভিডের আক্রমণে ভূতুরে নগরী হয়ে ওঠা দিল্লিতে আপনি যদি সুস্থ থাকার মতো সৌভাগ্যবান হন, তাহলে চারপাশের পরিবেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করবেন। আপনি বুঝতে পারবেন, ভাইরাসও আরোপ করেছে এক অঘোষিত লকডাউন। চিরকাল কোলাহল মুখর নগরীতে আজ পাখির ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই।
আরেকদিকে, চরম মাত্রা লাভ করা মানবিক সঙ্কটের প্রতিটি খাঁজ-ভাঁজ উঠে আসছে সামাজিক গণমাধ্যমের জালে। কেউ পোস্ট করছেন হাসপাতালের শয্যা চেয়ে, কারো বা মিনতি আপনজনের জন্য প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে। বন্ধু ও পরিচিত জনেরা একে-অন্যের কাছে বাড়িতে থাকা রোগীর জন্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর- এর সন্ধান করছেন। এক কথায়, সকলেই কোনো না কোনোভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে জীবন রক্ষার যুদ্ধ করছেন।
তবু মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেই কী সবাই? এই সমীকরণে ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র কোথায়? উত্তরটাও জানা- কোথাও নেই এই সর্বময় কর্তৃপক্ষ। তাই আরও একবার বিপর্যয়ের মুহূর্তে সাধারণ নাগরিকরা অনুভব করছেন, সরকার যেন তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে, পরিত্যাগ করেছে দায়। নজিরবিহীন এই জরুরি অবস্থার মধ্যেও একে-অন্যের দিকে ব্যর্থতা আরোপের চিরকালীন কাঁদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা। সেই তুলনায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না।
সঙ্কটের ব্যাপকতা অস্বীকার করাই হয়ে উঠেছে প্রধান আনুষ্ঠানিক নীতি। মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে এমনকি সরকারি আইনজীবীরাও বলছেন, অক্সিজেন আর হাসপাতালের শয্যার নাকি কোনো সঙ্কটই নেই! কিন্তু, আসল অবস্থা সকলেই খালি চোখে দেখতে পারছেন। এজন্য কারো বিশেষজ্ঞ হওয়ারও দরকার নেই।
ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মতো অঞ্চলে পরিস্থিতি আরও ন্যাক্কারজনক। স্থানীয় সরকারের অস্বীকার আর তথ্য লুকানোর চালে প্রকৃত বিপর্যয়ের চিত্র আমরা হয়তো আরও কয়েক মাস পর্যন্ত জানতে পারব না। মৃত্যুর সংখ্যা অনেকগুণ কম দেখাচ্ছে রাজ্য প্রশাসন, আবার দিয়েছে অনলাইনে সঙ্কট বাড়িয়ে দেখানো তথাকথিত গুজবমূলক পোস্টের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি। এমনকি পরিবারের মুমূর্ষু কোনো সদস্যের প্রয়োজনে অক্সিজেন চাহিদার কথা লিখে পোস্ট করলেও পড়তে হতে পারে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের নির্মম বেড়াজালে।
আসলে ভারতীয়দের অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং ভারতের এই মারাত্মক দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছ থেকে আমাদের ভালো কিছু আশা করাটাই ছিল ভুল। কিছু প্রশ্ন তোলা উচিৎ, ২১ শতকে ভারত রাষ্ট্রের মৌলিক পরিচয়ের বিপরীত দশা নিয়ে; যেখানে একদিকে দেশটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি, উচ্চাভিলাষী এবং প্রগতি সন্ধানী, আবার সরকারও বিপুল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে। আরেকদিকে, এই একই দেশ এখনও দরিদ্র, মাথাপিছু আয় চীনের মাত্র পাঁচভাগের একভাগ। তাই রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সক্ষমতা ভারতের শত কোটির বেশি জনসংখ্যার মধ্যে অনেক কম হয়ে বণ্টন হয়েছে।
তবে যে ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো; স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় প্রায় সব সময়েই ছিল হতবাক করে দেওয়ার মতো কম। উত্তর প্রদেশের উদাহরণই দেওয়া যাক, সেখানে গ্রামাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষের চাহিদা হয়তো মেটায় চার-পাঁচটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র- যার একটিতেও কোনো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত চিকিৎসক নেই।
আজ এই সঙ্কটকালে নাগরিকদের মৌলিক চিকিৎসারও বেশি কিছু প্রয়োজন। দিল্লির স্থানীয় সরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণে তাদের বরাদ্দ নিয়ে প্রায়শ'ই গর্ব প্রকাশ করে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এমন স্থাপনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, সেগুলো উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি, যেমনটা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সবচেয়ে বেশি দরকার। ২ কোটি অধিবাসীর জন্য দিল্লিতে আছে মাত্র ৫ হাজার ব্যবহারযোগ্য আইসিইউ শয্যা, আজ ৩০ এপ্রিল নাগাদ এক ডজনেরও কম বেড ফাঁকা ছিল বলে রাজ্য সরকারের তথ্য অনুসারেই জানা যায়।
স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগের অভাব পূরণ করবে বেসরকারি খাত, দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয়রা এই বিশ্বাস করে এসেছেন। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সময় ভারতীয়দের নগদ অর্থ দিতে হয়। অনেক সময় অর্থের ব্যবস্থা করতে তারা ব্যক্তিগত সঞ্চয় ভাঙান নাহলে ব্যক্তিগত মহলে হাত পাতেন। এভাবে ভারতের স্বাস্থ্যখাতের ৬০ শতাংশ ব্যয়ই বর্তমানে রোগীর পরিবার বহন করছে। একারণেই, রাষ্ট্রের আশা ছেড়ে বিপদের কালে আরও একবার বন্ধু, স্বজন আর ফেসবুকের দিকে ছুটছেন ভারতীয়রা।
কিন্তু, মহামারি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ বেসরকারি খাতকে সহায়তা দেওয়ার জন্যও রাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে। এই বাস্তবতা সবচেয়ে স্বাভাবিক সময়ের জন্যেও সত্য, আর এখনতো সবচেয়ে খারাপ সময়; এই মুহূর্তে বেসরকারি চেষ্টাকে সমন্বয় করার যোগ্যতাসম্পন্ন একটি সরকারের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই প্রয়োজন অনুসারে প্রতিটি হাসপাতালে চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ ব্যবস্থার। অথচ, তা না করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ অক্সিজেন পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, পরিস্থিতির উন্নতির দাবি করে যে হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে অপেক্ষমাণ রোগীর সংখ্যা কম, সেখানকার উদাহরণ দিচ্ছেন।
অপ্রতুল অর্থ ও জনবল নিয়ে ভারতের রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারগুলোর কেউই জনস্বাস্থ্য দুর্যোগের কালে বাড়তি সক্ষমতা নিয়ে মানুষের পাশে থাকার ক্ষমতা রাখে না। তাই শুধু বেসরকারি খাতের উপর ভর করে সঙ্কট কাটাবে এমন চিন্তাও দুরাশার নামান্তর। শুধুমাত্র রাষ্ট্রই পারে স্বল্প সময়ের নোটিশে বাড়তি সক্ষমতা তৈরি করতে।
অথচ বিপদে পড়ার পর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, এমনটা হওয়ার দরকার ছিল না। দক্ষিণ ভারতের দুই রাজ্য কেরালা এবং তামিলনাড়ু কয়েক দশক ধরে উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর তুলনায় অনেক ভালো মানের স্বাস্থ্যখাত গড়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য দুটি কোভিড-১৯ সংক্রমণ সংখ্যা কমানোসহ হাসপাতালের উপর চাপ কমাতে উন্নত ও বিস্তৃত একটি অনলাইন সেবাও চালু করেছে।
করোনাভাইরাসের অতি-সাম্প্রতিক ধরনটির সন্ধান মিলেছে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে। সংক্রমণের উষ্ণকেন্দ্র হয়ে ওঠা এ শহরে মহারাষ্ট্র সরকারের তৎপরতার কারণেই প্রতি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তৈরি হয়েছে জরুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা এসব পরিচালনা করছেন, এবং কোন হাসপাতালে শয্যা খালি আছে, কোথায় গেলে ওষুধ পাওয়া যাবে তার খোঁজখবর রোগী ও তার স্বজনদের জানাচ্ছেন। হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে দীর্ঘসময় লাগলেও, রাজ্য সরকার অন্তত অতি-জরুরি রোগীরাই যেন সেগুলো পান অন্তত সেটাই নিশ্চিতের চেষ্টা করছে।
তাই হয়তো মুম্বাইয়ের অধিবাসীরা তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ, নিশ্চিতভাবেই তারা পরিত্যাক্ত হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করছেন না। সঙ্কটের ভয়াল দশাকে সামলে ওঠার আশার আলো দেখাচ্ছে শহরটি। অন্যদিকে, দিল্লিতে আপনি বা আপনার প্রিয়জন বাঁচবেন কিনা- তা নির্ভর করছে আপনার ফোনবুকে কোন প্রভাবশালীর নাম্বার আছে তার উপর।
এই অবস্থা ন্যায্য নয়, কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার ঐতিহাসিকভাবে নিগৃহীত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অবহেলিত জাত ও বর্ণের মানুষ। একটু সুনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র এমন বৈষম্য হতেই দিত না, সকলকেই দিত সমান সুযোগ। দুর্বল একটি সরকার ন্যায্যতা সৃষ্টি করতে না পারলেও, চেষ্টাটা অন্তত করতে পারে। সেই চেষ্টাও নেই। আছে শুধু নৈরাজ্যের রাজত্ব। সব মিলিয়ে ভারতের অনেক অঞ্চল অন্ধকারের দিকে পিছিয়ে পড়ে আরও ভয়ানক মৃত্যু উপতক্যায় রূপ নিতে চলেছে।
- লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত