‘তথ্য যুদ্ধ’: মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নতুন কৌশল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ফেক অ্যাকাউন্ট' খুলে মিথ্যাচার চালানোর অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। জাতিকে নির্বাচনী জালিয়াতি থেকে বাঁচাতে জান্তা সরকার ক্ষমতা দখল করেছে, এমন বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ওইসব ফেক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সুচি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি উইন মিন্টের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেয় করে দেশটির সেনাবাহিনী। এর প্রতিবাদে জনগণ রাস্তায় নেমে আসলে তাতে কঠোরভাবে বাধা দেয় জান্তা সরকার। এরপর এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন 'তথ্য যুদ্ধের' কর্মসূচি হাতে নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। জান্তা সরকারের এই কৌশলের কথা বার্তাসংস্থা রয়টার্কে নিশ্চিত করেছে ৮ জন ব্যক্তি, যাদের মধ্যে ৪ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাও রয়েছেন।
সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে জান্তা সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালানো-সহ বিরোধীদের কঠোর সমালোচনা করার দায়িত্ব দিয়েছে। এমনকি যারা নির্বাসিত সরকারের পক্ষে কথা বলছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার প্রোপাগান্ডা চালানোর হচ্ছে এসব ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে।
একটি তথ্যসূত্র রয়টার্সকে জানায়, জনগণের মাঝে জান্তা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতেই খোলা হয়েছে এইসব ফেক অ্যাকাউন্ট। সেইসঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের চিহ্নিত করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক বলে আক্রমণ করাও সামরিক বাহিনীর প্রচার অভিযানের একটি অংশ।
গত ফেব্রুয়ারির শেষে বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগদানের জন্য সেনাবাহিনীর পদ ছেড়ে আসেন ক্যাপ্টেন নি থুটা। জান্তা সরকারের 'তথ্য যুদ্ধ' কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, "সৈন্যদের ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে এবং তারা কে কোন বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করবে সেজন্য আলাদা আলাদা বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
"তারা অনলাইনে সবার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে এবং অভ্যুত্থান বিরোধীদের চিহ্নিত করতেই অনলাইন গ্রুপগুলোতে যোগ দিয়েছে," আরও যোগ করেন তিনি।
৩১ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন থুটা ফেব্রুয়ারির শেষে সেনাবাহিনী ছেড়ে আসার আগপর্যন্ত জান্তা সরকারের প্রচার অভিযানের অংশ ছিলেন এবং সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বক্তৃতা লিখতেন। অর্থাৎ, তার প্রেস উইং এর একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন।
তবে ফেক অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে জান্তা সরকারের এক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বার্তাসংস্থা রয়টার্স চলতি বছরে হাজার হাজার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট পর্যালোচনা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, প্রায় ২০০ জন সামরিক কর্মী ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার ও টেলিগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে, নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলছে এবং অভ্যুত্থান বিরোধী সমালোচনা করে বিভিন্ন বার্তা বা ভিডিও প্রকাশ করছে নিয়মিত।
তাদের বার্তায় জান্তা বিরোধিতাকারীদের 'রাষ্ট্রের শত্রু' ও 'সন্ত্রাসী' হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে বলা হচ্ছে, তারা দেশের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ধর্মকে ধ্বংস করতে চায়।
অন্যদিকে, অভুত্থান বিরোধীরাও কয়েক হাজার ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধীদের সেই দলের নাম দেওয়া হয়েছে 'টুইটার টিম'। রয়টার্সের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
আক্রমণাত্মক বক্তব্য মুছে দিয়েছে ফেসবুক কতৃপক্ষ:
জাতিসংঘের তথ্যমতে, অভ্যুত্থানের পর থেকে এপর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এক হাজারেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে; সেইসঙ্গে কারাগারে পাঠিয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। যদিও সেনাবাহিনীর দাবি, এসব তথ্য অনুমান নির্ভর ও অতিরঞ্জিত।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে ফেসবুকের পাবলিক পলিসি পরিচালক রাফায়েল ফ্র্যাঙ্কেল রয়টার্সকে বলেন, ফেসবুক 'সক্রিয়ভাবে' মিয়ানমারে তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় ৯৮ শতাংশ 'হেট স্পিচ' বা আক্রমণাত্মক বক্তব্য মুছে দিয়েছে।
তিনি বলেন, "এটি একটি জটিল সমস্যা এবং আমরা যথাযথভাবে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
ফেব্রুয়ারির অভুত্থানের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক।
তথ্যযুদ্ধ:
নি থুটা ও লিন টেট অং বলেন, রাজধানী নেপিদো থেকে সেনাবাহিনীর পাবলিক রিলেশনস অ্যান্ড ইনফরমেশন প্রোডাকশন ইউনিট (কা কা কম) এই তথ্যযুদ্ধ পরিচালনা করছে। কা কা কমের মিশন পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছে শত শত সৈনিক।
জান্তা সরকারের দলত্যাগকারীদের মতে, দেশজুড়ে আঞ্চলিক সামরিক পর্যায়ে নিয়োজিত করা হয়েছে কয়েক ডজন ছোট ছোট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দল। আর সেই দলগুলোর কার্যক্রম নিয়মিত সমন্বয় করছে দেশটির কেন্দ্রীয় ইউনিট।
নি থুটা আরও বলেন, নির্বাচনের আগে ও অভ্যুত্থানের পরে মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও তাদের পরিবারের সদ্যদের অং সান সু চির সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু লিখতে নিষেধ করা হয়েছিল। এছাড়া, যারা তার মতোই সেনাবাহিনী ছেড়ে এসেছে, তাদেরকে জান্তা সরকারের এই অনলাইন তথ্যযুদ্ধের প্রধান টার্গেট বানানো হয়েছে।
নিজের অবস্থান গোপন রেখে, জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে একটি লড়াকু দল গঠনের চেষ্টা করছেন নি থুটা। সেনাবাহিনী ছেড়ে আসতে চায় এমন সেনা সদস্যদের জন্য তিনি একটি অনলাইন সংগঠন গড়ে তুলেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'পিপলস সোলজার' বা জনগনের সৈন্য। এখন পর্যন্ত ফেসবুকে এই গ্রুপের সদস্য আড়াই লাখ অ্যাকাউন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর প্রায় ২ হাজার সৈন্য সেনাবাহিনী ছেড়ে এসেছে।
থুটা বলেন, "সেনাবাহিনীতে তথ্যযুদ্ধের যে কৌশল শিখেছি, আমি তাদের বিরুদ্ধেই তা ব্যবহার করছি।"
সূত্র: রয়টার্স