‘মহামারি মোকাবিলায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি দায়িত্ব এড়াচ্ছেন পাশ্চাত্যের অতি ধনীরা’
ধনী-গরিবের যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান থেকে শুরু করে চিকিৎসা, মহামারির সময় এ বিষয়টি আরও নগ্নভাবে চোখে পড়ে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ব্রাঙ্কো মিলানোভিচ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, করোনাভাইরাস মহামারির সময় সম্পদের বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। এই সংকটের মাঝে যারা সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছেন, যাদের সম্পদের পাহাড় আরও বেড়েছে, তারা দেশের প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সম্প্রতি ফরাসি পত্রিকা ডার স্পিগেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব জানিয়েছেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ।
পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
ডার স্পিগেল: ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো মহামারির আঘাতে বিপর্যস্ত। দরিদ্র দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহের হারও কম। করোনাভাইরাস মহামারি কি ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আরও বাড়াচ্ছে?
মিলানোভিচ: এমনটাই আশঙ্কা করছি। তবে, দ্রুত পরিস্থিতির পরিবর্তন আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি মহামারির সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়া দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় উল্লেখযোগ্যভাবে এ অবস্থার পরিবর্তন এসেছে।
ডার স্পিগেল: বিগত কয়েক দশকে পুরো বিশ্বজুড়ে বৈষম্য কমেছে, যা মূলত চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে জড়িত। মহামারির পরও কি এ ধারা বজায় থাকবে?
মিলানোভিচ: না, চীন বর্তমানে গ্লোবাল মিডল-ক্লাসের একটি দেশ। সাম্প্রতিক সময়ের মতো চীনের দ্রুত বিকাশ বজায় থাকলে বৈশ্বিক বৈষম্য কমবে না, বরং বাড়বে। গত ৪০ বছর ধরে এমনটাই হয়েছে। একই সময়ে, ভারতের মতো দেশগুলোতে আগামী দুই বছরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে পারে। এক কথায়, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
ডার স্পিগেল: আমাজন ও গুগলের মতো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এই সংকটকালীন সময়েও বিলিয়ন ডলা আয় করছে, অন্যদিকে অন্যান্য খাতের চাকরিজীবীরা তাদের চাকরি হারাচ্ছেন। ভাইরাস কি দরিদ্রদের আরও দরিদ্র এবং ধনীদের আরও ধনী করে তুলেছে?
মিলানোভিচ: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নয়, তবে এখনো এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার সময় আসেনি। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, সরকারি সহায়তা কর্মসূচির জন্য অনেক পশ্চিমা দেশেই বৈষম্য কমে আসছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলোর অতি ধনীরা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলছেন এমনও দেখা যাচ্ছে। তারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি রাখছেন না।
ডার স্পিগেল: এর অর্থ?
মিলানোভিচ: আমার এখনো মনে পড়ে, বিশ্বের এসব বিত্তশালীরা ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তারা জরুরি প্রয়োজনে, বিপদের সময় মোকাবিলায় তাদের সম্পদের একাংশ দিয়ে পাশে থাকবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিগত কয়েক মাসে এ ধরনের তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। তাদের কথা ও কাজের পার্থক্য অনেক বেশি।
ডার স্পিগেল: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ধনীরা আরও ধনী হয়েছে।
মিলানোভিচ: উচ্চ বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জিত আয় ও একইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে তাদের ক্রমবর্ধমান আয়- দুইভাবেই পাশ্চাত্যের ধনীদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। শীর্ষ চিকিৎসাবিদ, জনপ্রিয় আইনজীবী বা সফটওয়্যার ডেভেলপারদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন। এই ব্যাপারটিও নতুন। ১৯ ও ২০ শতকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেখা যেত, শুধু উদ্যোক্তা ও পুঁজিবাদীরাই আয় কাঠামোর শীর্ষে ছিলেন। আমরা যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হওয়া সত্ত্বেও মহামারির কারণে এটি বেড়েছে।
ডার স্পিগেল: এ বিষয়টি ধনী গরিবের ব্যবধান বাড়িয়ে তুলছে।
মিলানোভিচ: অবশ্যই। তবে এ পরিবর্তনেরও ইতিবাচক দিক আছে, কারণ এটি মূলধন ও শ্রমের পুরনো বিভেদকে কিছুটা কমিয়ে আনে। একইসঙ্গে, এটি ধনীদের- প্রায় ১০ শতাংশকে লোকসান থেকে সুরক্ষা দেয়। কারণ একাধিক উৎস থেকে তাদের আয় হয়। এর ফলে এই শ্রেণির মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, বৃদ্ধি পায় তাদের রাজনৈতিক প্রভাবও।
ডার স্পিগেল: অন্যদিকে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিগত কয়েক দশক ধরেই অর্থনৈতিক লোকসানের মুখে আছে। এ অবস্থা কী আরও খারাপ হতে পারে?
মিলানোভিচ: এমনটাও হওয়ার বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সাহায্যে মানুষ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে কাজ করতে পারে। ফলস্বরূপ, প্রথমবারের মতো বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চাকরির বাজার গড়ে উঠছে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন পেশার বহু গোষ্ঠী যাদের আগে কখনো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি, তাদের জন্য এটি দুঃসংবাদ বটে।
ডার স্পিগেল: আপনি কি মনে করেন বেতন আরও কমে আসবে?
মিলানোভিচ: শুধু তা-ই নয়। যারা দিল্লিতে থাকেন ও দিল্লি থেকেই ই-মেইলের মাধ্যমে ডুসেলডর্ফে তাদের রিপোর্ট পাঠান, তাদের জীবনধারণের ব্যয় ডুসেলডর্ফে কর্মরত সহকর্মীদের চেয়ে কম। এখানেই একটি বৈপরীত্য তৈরি হতে পারে, বিশ্বজুড়ে সমতা তৈরি হতে থাকলেও পাশ্চাত্যের মধ্যবিত্ত সমাজ সংকটে পড়বে।
ডার স্পিগেল: আপনার 'দ্য ক্ল্যাশ অব ক্যতাপিটালিজম' বইতে আপনি দুই ধরনের পুঁজিবাদের বর্ণনা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উদারবাদী মেধাভিত্তিক পুঁজিবাদ ও চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। কোনটি এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কমাতে তুলনামূলক বেশি উপযোগী বলে মনে করেন?
মিলানোভিচ: দুটি দেশেই বিগত ২০ বছরে বৈষম্য বেড়েছে। চীনের একেবারে প্রথম থেকে সব শুরু করা এবং দ্রুত গতিতে শিল্পায়ন ও শহরায়নই মূলত এর প্রধান কারণ। এছাড়া, আর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উচ্চশ্রেণির সংমিশ্রণ দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা আরও ধনী হয়েছে। তবে দলের অংশিদারত্ব সহায়ক হবে, বিশেষ করে ধনী উদ্যক্তাদের জন্য।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিকভাবে উচ্চশ্রেণির মানুষ নিজেদের সুবিধার ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করে নিতে পেরেছে। রাজনীতিবিদরা এ ক্ষেত্রে পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে আমি আশাবাদী। চীনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আশাদায়ক। আমি মনে করি, বৈষম্য বাড়লে কিছু না করে থাকা যে সম্ভব নয়, দুটি দেশের রাজনীতিবিদরাই তা বুঝতে পারেন।
ডার স্পিগেল: যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে ইউরোপ। প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক জোটের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার মধ্যে ইরোপিয়ান সামাজিক কাঠামো সেকেলে হয়ে গেল?
মিলানোভিচ: অভিবাসনের কারণে ইউরোপ অবশ্যম্ভাবীভাবেই চাপের মুখে আছে। তবে একইসঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীন ও ভারতের প্রবেশের ফলে পুঁজির তুলনায় শ্রমের দাম কমেছে। অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপ বেশি উদারবাদী। ১৯৭০'র দশকের চেয়েও বেশি, শ্রমিক ইউনিয়নের প্রভাবও কমে এসেছে। তবে ইউরোপিয়ান চিন্তায় রাষ্ট্রের উন্নতি অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ যা কখনোই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এটি বেশ ভালো দিক।
ডার স্পিগেল: মহামারির কারণে আফ্রিকা অর্থনৈতিকভাবে আরও পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে আছে। এমনটা হলে তা ইউরোপের জন্য কী ফল বয়ে আনবে?
মিলানোভিচ: ইউরোপ ও আফ্রিকান ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের মধ্যে আয়ের যে ব্যবধান, তা মহাদেশ দুটির শত বছরের সম্পর্ককে ফুটিয়ে তোলে। এ কারণেই অনেক বেশি মানুষ আফ্রিকা থেকে জার্মানি, ফ্রান্স বা সুইডেনে ছুটে যাচ্ছেন যেখানে তারা আগের চেয়ে বেশি উপার্জন করতে পারবেন। এর ফলে অভিবাসনের প্রবণতা বাড়ছে। আফ্রিকার পরিস্থিতির উন্নতিতে ইউরোপেরই সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হওয়া উচিত।
ডার স্পিগেল: এর সর্বোত্তম পন্থা কোনটি?
মিলানোভিচ: ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত আফ্রিকায় বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া ও চীনের সঙ্গে সহযোগীতামূলক সম্পর্ক বাড়িয়ে তোলা। এর পরিবর্তে জোটটি অভিবাসী নীতির কারণে তুরস্কের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
ডার স্পিগেল: আফ্রিকা মহাদেশকে চীনের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয় ইউরোপের?
মিলানোভিচ: অনেক পশ্চিমা দেশ মনে করলেও, চীন নব্য ঔপনিবেশিক শোষক রাষ্ট্র নয়। চীনের সম্পৃক্ততার ফলে আফ্রিকার অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এর ফলে ইউরোপিয়ানরাও লাভবান হচ্ছে।
ডার স্পিগেল: ধন্যবাদ আপনার সাক্ষাৎকারের জন্য।
- জার্মান পত্রিকা ডার স্পিগেল থেকে সাক্ষাৎকারটি অনূদিত