৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ সেনাবহর সুগঠিত হয়ে এগোচ্ছে, কিয়েভে মূল অভিযান কি এবার শুরু?
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার দিনকয়েক পরেই আলোচনায় আসে কিয়েভ অভিমুখে রুশ সেনাবাহিনীর ৪০ মাইল দীর্ঘ এক বহর। স্যাটেলাইট থেকে তোলা চিত্রে দেখা যায়, বহরে আছে- ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, কামানবাহী যান, স্বচালিত কামান, অস্ত্র-গোলাবারুদ এবং রসদবাহী অজস্র ট্রাক।
ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের মুখে বহরটির অগ্রগতি থমকে গেছে বলে দাবি করে ইউক্রেনের সরকার এবং পশ্চিমা বিশ্ব । বিপুল সেনা ও সরঞ্জামবাহী যানের এ সাড়ি অবশ্য হপ্তাখানেকের বেশি সময় সত্যিই বেশ ধীরগতিতে এগিয়েছে। তবে এবার সেনা বহরটি পুনর্গঠিত হচ্ছে বলে জানা গেছে মাক্সার টেকনোলজিসের স্যাটেলাইটে তোলা চিত্রে। বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) ছবিগুলো তোলে মাক্সারের কৃত্রিম উপগ্রহ। তাতে দেখা গেছে, বিশাল এ কনভয়ের বড় অংশ ছড়িয়ে পড়েছে এবং সংগঠিত হচ্ছে।
এই ছড়িয়ে পড়ার অর্থ- বহরের সরঞ্জামগুলো দিয়ে মাঠ পর্যায়ের বেজ (সম্মুখঘাঁটি) স্থাপন করা হচ্ছে। আরো থাকবে- জ্বালানি ও রসদের ডিপো, ক্ষতিগ্রস্ত যান মেরামতের সাময়িক স্থাপনা, আহতদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ফিল্ড হসপিটাল ইত্যাদি। আর সবকিছু পরিচালনা করবে একটি অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার।
আর পুনর্গঠিত হওয়ার অর্থ, অভিযান পরিচালনাকারী যান- সেনাবাহী ট্রাক, ট্যাংক, সাঁজোয়া যান এখন তাদের কম্যান্ড চেইন অনুসারে ছোট ছোট বাহিনীর আকারে গঠিত হচ্ছে। হামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞরা এর ফলে কিয়েভে রুশ বাহিনীর মূল অভিযান শুরুরই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ইউক্রেনের প্রতিরোধ বাহিনীও প্রমাদ গুনছে। কারণ তাদের এবার অনেক সুগঠিত হামলার মুখে পড়তে হবে। আর তা হতে পারে প্রচণ্ড ও সর্বাত্মক।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বলেছেন, শুরুর দিকে গতি হারানো এ কনভয় এখন আক্রমণাত্মক শক্তিতে রূপ নিচ্ছে।
এবিষয়ে শুক্রবার (১১ মার্চ) যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সর্বশেষ বুলেটিন জানায়, "রাশিয়া তার বাহিনীকে সুগঠিত করে, নতুন নতুন স্থানে মোতায়েনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে ইউক্রেনে অভিযানের কথা মাথায় রেখেই প্রস্তুতিগুলো সম্পন্ন হচ্ছে। আসন্ন অভিযানগুলোর মধ্যে কিয়েভ অভিযানও রয়েছে।"
এদিকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের উপর থেকে মেঘের আচ্ছাদন কমে যাওয়ায় মহাকাশ থেকে রুশ বাহিনীর আরো সুপষ্ট ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে মাক্সার। সংস্থাটির দাবি, কিয়েভমুখী কনভয়ের অনেক অংশ লুবিয়াঙ্কা এলাকার স্থানীয় জঙ্গলে ঘাঁটি গড়ছে।
একটি স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে, কিয়েভ থেকে ১৭ মাইল উত্তরপশ্চিমে ওজেরা নামক একটি শহরের আবাসিক এলাকার রাস্তায় অবস্থান করছে বেশকিছু রুশ সমরযান। ওজেরা রাশিয়ার দখলীকৃত অ্যান্টোনভ বিমানঘাঁটি থেকে কিছুটা উত্তর দিকে অবস্থিত।
হস্টোমল বিমানবন্দরে অ্যান্টোনোভ ঘাঁটিটি। এখান থেকে ৩ মাইল উত্তরপশ্চিমে দেখা গেছে, কামানবাহী যানসহ অন্যান্য সামরিক বাহন।
এ ঘটনা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, দীর্ঘস্থায়ী অভিযানের জন্য হস্টোমলকে গুরুত্বপূর্ণ বিমানপথে রসদ সরবরাহের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এজন্য এটিকে আরো সুরক্ষিত করতে সেনাদের দিয়ে একটি রক্ষাব্যূহ তৈরি করা হচ্ছে।
কিয়েভে গোলাবর্ষণের প্রস্তুতি নিতেও বিভিন্ন পয়েন্টের দিকে এগিয়ে চলেছে বাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশ। মাক্সারের তোলা একটি ছবিতে জ্বালানিবাহী ট্রাক এবং মাল্টিপল রকেট লঞ্চার যানের একটি সাড়ি অবস্থান নিতে দেখা গেছে বিমানবন্দরটি থেকে আরো ১০ মাইল পশ্চিমের একটি ফাঁকা মাঠে।
হস্টোমল বিমানবন্দরটিকে রুশ বাহিনীকে মেরামত করতে হবে। যুদ্ধে ধবংস হয়ে গেছে অ্যান্টোনভ ঘাঁটির জ্বালানি ট্যাঙ্ক। স্যাটেলাইট চিত্রে জ্বালানি পোড়া কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা গেছে।
রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের শুরুর দিকেই হস্টোমলের দখল নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়।
রুশ কনভয়ের শেষ প্রান্তের কিছু ট্রাক ও সরঞ্জাম এখনও ইভানকিভ অঞ্চলের উত্তরপূর্বের রাস্তায় অবস্থান করছে।
উপগ্রহের তোলা ছবিতে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি:
উত্তর থেকে কিয়েভ যেতেই পথে পড়ে শহর চেরনিভ। এই শহরটি যুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্যাটেলাইট চিত্রে একই রকম ক্ষয়ক্ষতি দেখা গেছে রাজধানী কিয়েভের উত্তরপশ্চিমের শহরতলী এলাকায়।
কিয়েভের বোরোদনিকা এলাকায় বেশকিছু অ্যাপার্টমেন্ট ভবন গোলার আঘাতে ধবংস হয়ে গেছে। এর আগে সিএনএন-সহ পশ্চিমা গণমাধ্যম জানায়, রাশিয়ার গোলার আঘাতেই এমনটি হয়েছে।
ইউক্রেনের রাজধানীর শেষপ্রান্তের একটু বাইরে অবস্থিত স্টোয়িঙ্কা এলাকার একটি গুদামঘরও আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
চেরনিভ শহরে এপিসেন্টার কে নামের একটি বড় সুপারমার্কেটেও আগুনে পুড়ে গেছে। আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে শহরটির দক্ষিণে শিল্প এলাকাগুলোয়।
রাশিয়ার রণপরিকল্পনায় এবার সুগঠিতভাব ফিরেছে:
বিশ্বের সবচেয়ে স্বনামধন্য বেসরকারি প্রতিরক্ষা তথ্যপ্রদানকারী সংস্থা জেনস- এর বিশ্লেষক থমাস বুলক বলেন, "যুদ্ধের প্রথম ৫-১০ দিন রাশিয়ার সরবরাহ কনভয়ে হামলা চালানোর ইউক্রেনীয় কৌশল ভালো কাজে দিয়েছে। তাদের কৌশল এবং রুশ বাহিনী যেভাবে তখন চালিত হচ্ছিল- তাই ইউক্রেনীয়দের সফলতা এনে দেয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।"
"ইউক্রেন আগ্রাসনের প্রথমদিকে রুশ বাহিনী দ্রুত অনেক লক্ষ্যবস্তু দখলের নীতি নেয়। এজন্য তাদের অগ্রযাত্রার লাইন সুবিন্যস্ত ছিল না। কোনো কোনো এলাকা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত না করেও তারা এগোতে থাকে। ফলে তাদের রসদবহনকারী যানবাহনে লুকিয়ে থাকা ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা সহজে হামলা করতে পেরেছে।"
বুলকের মতে, "দ্রুত জয় নিশ্চিতের ব্যর্থতার পর রাশিয়া এখন তার বাহিনীকে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছে। এই কৌশল কতোটা কার্যকর হয়- তা আসছের দিনগুলোয় প্রমাণ হবে।"
- সূত্র: সিএনএন