বিল গেটসের রহস্যময় ছবি: ইমরান খানের সেনাবাহিনী-সংকটের ব্যাখ্যা
গত মাসে বিল গেটসের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের ছবি প্রকাশ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান ইমরান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীরা তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেন: গোলাকার টেবিলটিতে আসন ১৩টি, কিন্তু মানুষ বসা ছিলেন মাত্র ১২ জন।
ফাঁকা আসনটিতে ছিল একটি ভূতের মতো অবয়ব। দেখে মনে হচ্ছিল অবয়বটি আশপাশের অন্যদের সঙ্গে কথা বলছে। এরপর প্রশ্ন উঠে গেছে, ছবিটিতে কোনো কারিকুরি খাটানো হয়েছে কি না। এরপর স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর বের হয়, পাকিস্তানের গুপ্তচর-প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আনজুমকে মুছে দেওয়া হয়েছে ওই ছবি থেকে।
এ নাটকের শুরু চার মাস আগে, যখন আনজুমকে ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রধান নিযুক্ত করেন সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া।
কিন্তু ইমরান আনজুমকে নিয়োগ দিতে বিলম্ব করতে থাকেন। আইএসআইউ-প্রধান হিসেবে প্রকাশ্যে জেনারেল ফাইজ হামিদকে সমর্থন জানান তিনি। হামিদ আবার ইমরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। কয়েক সপ্তাহের রেষারেষি শেষে অবশেষে জিত হয় সেনাপ্রধানের।
পাকিস্তানের বেসামরিক নেতাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের রেষারেষি। তবু সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য বারবারই সমালোচিত হয়েছেন ইমরান।
হামিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে বেশি সমালোচিত হয়েছেন ইমরান। আইন অনুসারে, আইএসআই প্রধানকে সেনাবাহিনীর সুপারিশে নিয়োগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ হামিদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে দুর্নীতি করে এক বছর পরের নির্বাচনের ফল ঘুরিয়ে দেয়ার অভিযোগ তুলে ইমরানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বারবার।
ইমরানের নিজের উদ্যোগ কাজে আসেনি। হামিদকে আইএসআই-তে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। পাশাপাশি এক জনসভায় সেনাপ্রধানের সঙ্গে একান্ত আলোচনার কথা উল্লেখ করেন। সেনাবাহিনী যে দাবি করে, তারা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না—এই দাবির মূলে আঘাত করেছে ইমরানের এ তথ্য।
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন প্রধান শায়েস্তা তাবাসসুম বলেন, 'রাজনৈতিক ফোরামে প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর নাম নেওয়াটাই এই সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল।'
তিনি বলেন, ইমরান ও তার মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে টেনে নিয়ে আসছেন। বলছেন, সেনাবাহিনী তাদের পেছনে আছে বা তারা সেনাপ্রধানের সমর্থন পায়।
এসব কথার জেরেই গত মাসের মধ্যাহ্নভোজের ছবি থেকে উধাও হয়ে যায় আনজুমের ছবি। আনজুম মিডিয়াকে তার সব ধরনের ছবি বা ভিডিও প্রকাশ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার জেরেই পাকিস্তান সফরে যাওয়া বিল গেটসের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের ছবিতে ওই অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায়।
অস্বাভাবিক ছবিটিই সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরানের পর্দার অন্তরালের ঝগড়ার আভাস দেয়। এ রেষারেষির জেরেই সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে গেছেন ৬৯ বছর বয়সী প্রাক্তন ক্রিকেট তারকা। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই মুহূর্তেই বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আস্থা ভোটের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে।
এমনকি ইমরান যদি ক্ষমতাচ্যুত না-ও হন, শীর্ষ জেনারেলদের সঙ্গে তার রেষারেষির কারণে মাসের পর মাস ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতে পারে। ওই অস্থিতিশীলতাই হয়তো স্থির করে দেবে বিশ্বের পঞ্চম জনবহুল দেশটি চীন-রাশিয়ার দিকে আরও সরে যাবে নাকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দিকে ঝুঁকবে।
মধ্যাহ্নভোজের ছবিটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী এখন ইমরানের প্রতি কেমন 'নিরপেক্ষ' আচরণ করছে। ছবিটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছে, সেনাবাহিনী আর ইমরানকে সমর্থন দিচ্ছে না। গত বছর পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরীক্ষায় সেনাবাহিনীর নীরব সমর্থন ইমরানকে একই ধরনের চ্যালেঞ্জ থেকে বাঁচতে সাহায্য করেছিল।
টিভি টক শোতে ইমরানের সমালোচনাকারী কিছু রাজনীতিবিদদের প্রায়ই ডেকে পাঠিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য হুঁশিয়ারি দেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, এখন আর এই নিষেধাজ্ঞা নেই।
২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার অভিযোগকে সেনাবাহিনী ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তারা দাবি করেছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাজনীতির সম্পৃক্ততা নেই। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ইমরানের অফিসে এ-সংক্রান্ত প্রশ্ন পাঠিয়েছে।
সেনাবাহিনীর কাছে একসময় ইমরান ছিলেন স্থিতিশীলতার প্রতিনিধি। পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনের প্রতিটি কাজে শীর্ষ জেনারেলরা বক্তব্য দিতেন। বাজওয়া ও অন্যান্য জেনারেলরা নিয়মিত শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বৈঠক করতেন।
কিন্তু কিছু সেনা কর্মকর্তার পদোন্নতিতে নাক গলান ইমরান। এটি সেনাবাহিনীর পছন্দ হয়নি। আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তাছাড়া একসময় মার্কিন অস্ত্রের শীর্ষ গ্রাহক ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। পরে তারা অস্ত্রের জন্য ক্রমেই চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
গত এপ্রিলে ইমরানকে তার জলবায়ু সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাননি বাইডেন। ফোনেও ইমরানের সঙ্গে কথা বলেননি। আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণ করার পর দুদেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। ওই সময় ইমরান বলেছিলেন, তালেবান "দাসত্বের শেকল ভেঙেছে।"
গত বছরের ডিসেম্বরে ইমরানকে গণতন্ত্র সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে শান্তির স্থাপনের ইঙ্গিত দেন বাইডেন। কিন্তু চীনের কাছ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প পেয়ে বাইডেনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন ইমরান। এরপর থেকে ইমরান রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছেন। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার কয়েক ঘণ্টা পরই পুতিনের সঙ্গে দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো শীর্ষ-স্তরের বৈঠক করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে ক্ষমতা গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছেন পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দলের নেতা শেহবাজ শরীফ। জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন যে, আস্থা ভোটের আগে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থেকেছে। এ দাবিটি বেশ গুরুত্ব বহন করে, কেননা তার বড় ভাইকে ১৯৯৯ সালের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর নওয়াজ শরিফ বর্তমানে লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন।
ভোটের আগে ইমরান নিজ দায়িত্বে বহাল থাকার অঙ্গীকার করেছেন। রোববার তিনি ইসলামাবাদে হাজার হাজার সমর্থকদের নিয়ে সমাবেশ করেন। সেখানে দাবি করেন, "বিদেশী বাহিনী" তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মাঠে নেমেছে।
তবুও গত মাসের এক জরিপে দেখা যায়, ইমরানের জনপ্রিয়তা ৪০% থেকে কমে ৩৬%-এ নেমে এসেছে। আর নওয়াজ শরিফের জনপ্রিয়তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ৫৫% হয়েছে। গত ডিসেম্বরে একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে এক স্থানীয় নির্বাচনে হেরে যান ইমরান। ওই আসনে আট বছর ধরে জিতছিলেন তিনি। ওই সময় তার দলের আইনপ্রণেতারা ভোটের আগেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন।
একটি বড় কারণ অর্থনীতি। ইমরান আইএমএফের সঙ্গে একটি ৬ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি চালাচ্ছেন। আইএমএফ ইমরানকে কর বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু আইএমএফের আহ্বান উপেক্ষা করে এ মাসেই তিনি জনগণকে শান্ত করার জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম কমিয়েছেন।
ইমরান জিতলে সমালোচকদের মুখ—যাদের দাবি, তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে জিতেছেন—বন্ধ করে দেওয়া যাবে। অন্যদিকে তিনি হারলে ২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক মন্দার জন্য তাকেই দায়ী করা হবে।
তবে ইমরান যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকেও যান, তাহলে আরও বড় একটি প্রশ্ন থেকে যাবে—তিনি কি জেনারেল বাজওয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে তার মেয়াদ বাড়ানোর অনুমতি দেবেন? বাজওয়ার মেয়াদ শেষ হবে নভেম্বরে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, বাজওয়ার বদলে ইমরান প্রাক্তন আইএসআই-প্রধান হামিদকে শক্তিশালী বন্ধু হিসেবে সেনাপ্রধানের আসনে বসাতে চান।
লাহোরভিত্তিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভি বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ "পাকিস্তানের রাজনীতিতে এবং সামরিক বাহিনীতে নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে।" তা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনী নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যাওয়ার জন্য ইমরান নিজেই দায়ী বলে মন্তব্য করেন রিজভি।
তিনি বলেন, 'ইমরান মানবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না—তিনি অপ্রয়োজনীয় ভাঙন তৈরি করেন।'
- সূত্র: ব্লুমবার্গ