এখন যেভাবে পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হবে
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পরামর্শে সংসদ ভেঙে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
আজ রোববার (৩ এপ্রিল) জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জানান, তিনি রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
খান তার দেশের মানুষকে ভোটের জন্য প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন প্রয়োজন যাতে জনগণ ঠিক করতে পারেন তারা ক্ষমতায় কাকে দেখতে চান।
এর আগে আজ দেশটির ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট শুরু হওয়ার পর ডেপুটি স্পিকার কাশিম খান সুরি অনাস্থা ভোট প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এই পদক্ষেপ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫-এর বিরোধী বলে এ সিদ্ধান্ত জানান তিনি।
বিশ্বের গুটিকয়েক পারমাণবিক শক্তিধারী দেশসমূহের মধ্যে পাকিস্তান একটি। বর্তমান সংকটের কারণে দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। ইমরান খান নতুন নির্বাচনের কথা বলেছেন। জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এ নির্বাচন প্রক্রিয়াটি সংগঠিত হবে।
পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের নিয়মনীতি
পাকিস্তানভিত্তিক ইংরেজি গণমাধ্যম দ্য ডন-এর ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, পাকিস্তানে 'অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার' গঠনের জন্য সংসদের বাইরের কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্ষমতায় থাকা সরকার মেয়াদ শেষ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা হয় না।
ডেমোক্রেসি রিপোর্টিং ইন্টারন্যাশনাল (ডিআরআই) নামের একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বরাত দিয়ে দ্য ডন আরও জানিয়েছে, পাকিস্তানই বিশ্বের একমাত্র দেশ যেটি নির্বাচনের জন্য এ পদ্ধতিটি অবলম্বন করে।
পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো একটি স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা।
একইসাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এটিও নিশ্চিত করে যে সংসদ ভেঙে যাওয়া ও নতুন নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে দেশটির সরকারি ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে যেন কোনো প্রকার স্থবিরতার সৃষ্টি না হয়।
বলা বাহুল্য, এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে এবং এটি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবে না।
২০২১ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের কুড়িতম সংশোধনী আনা হয়। এ সংশোধনী অনুযায়ী কোনো প্রেসিডেন্ট তার পছন্দ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা রাখেন না।
তার বদলে ওই সংশোধনীতে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভেঙে যাওয়া সংসদের বিরোধী দলের নেতা, এবং প্রতিটি প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয়।
২০তম সংশোধনীতে আর্টিকেল ২২৪এ নামের নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়। ওই ধারা অনুযায়ী যদি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে যদি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে না পারেন, তখন ব্যাপারটি একটি সংসদীয় কমিটিতে হস্তান্তর করা হবে। সরকারি দল ও বিরোধী দল থেকে সমান সংখ্যক সদস্য নিয়ে ওই সংসদীয় কমিটি গঠন করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এ কমিটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে।
প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলিগুলোতেও একই ভাবে দুই প্রধান দল থেকে সৃষ্ট ছয় সদস্যের পার্লামেন্টারি কমিটি প্রতি প্রদেশে অন্তর্বর্তীকালীন মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ দেবে।
যদি ও কমিটিও তিন দিনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি ইলেকশন কমিশন অব পাকিস্তান (ইসিপি)-এর কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ কমিশন দুই দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে আইন অনুযায়ী বাধ্য থাকবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকর্তাদের নির্বাচন করার পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বিভিন্ন প্রদেশের তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রীদের পরামর্শে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রীসভা গঠন করা হবে।
দেশটির ষষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মির হাজার খান খোসো প্রথমবারের মতো এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২০ সংশোধনী ছাড়াও, ১৮তম সংশোধনী ও দেশটির নির্বাচন কমিশনের কোড অব কন্ডাক্ট ফর পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যান্ড ক্যান্ডিডেটস (২০১৩)-ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সহায়তা করে।
২০১০ সালে আনা ১৮তম সংশোধনীর কয়েকটি উপধারা অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীরা, তাদের স্ত্রী ও সন্তানেরা, এবং অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রীসভার সদস্যরা পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
অন্যদিকে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের কোড অব কন্ডাক্ট ফর পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যান্ড ক্যান্ডিডেটস- ২০১৩-এর নিয়ম অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীরা, প্রেসিডেন্ট ও গভর্নরেরা, এবং একই সাথে সরকারের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্বাচন ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণে নিষেধ করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব
পাকিস্তানের নির্বাচন আইন ২০১৭-এর অনুচ্ছেদ ১৪ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিম্নোক্ত দায়িত্বগুলো পালন করে:
- তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজগুলো পরিচালনা করবে; বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য সহায়তা করবে; কেবল রুটিন, জরুরি, ও বিতর্ক তৈরি করে না এমন কাজের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে।
- জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। এমন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না যার ফলে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারকে তার জন্য সমস্যায় পড়তে হয়। কোনো বড় চুক্তিও করতে পারবে না তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এবং এ সরকার এমন কোনো কাজ করার চেষ্টা করবে না যাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব সদস্যকে ক্ষমতা গ্রহণের তিন দিনের মধ্যে ব্যক্তিগত ও স্ত্রী-সন্তানের সম্পদের হিসাব নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে।
যারা ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর প্রধান
গুলাম মুস্তফা জাটোই (৬ আগস্ট ১৯৯০ - ৬ সভেম্বর ১৯৯০)
মির বালাখ শের মাজারি (১৮ এপ্রিল ১৯৯৩ - ২৬ এপ্রিল ১৯৯৩)
মইন আহমদ কুরেশি (১৮ জুলাই ১৯৯৩ - ১৯ অক্টোবর ১৯৯৩)
মালিক মেরাজ খালিদ (৫ নভেম্বর ১৯৯৬ - ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭)
মোহাম্মদ মিঞা সমোরো (১৬ নভেম্বর ২০০৭ - ২৫ মার্চ ২০০৮)
মির হাজার খান খোসো (২৫ মার্চ ২০১৩ - ৫ জুন ২০১৩)
নাসির উল মালিক (১ জুন ২০১৮ - ১৮ আগস্ট ২০১৮)
- সূত্র: দ্য ডন