ফিনল্যান্ড, সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিলে ইউরোপের নিরাপত্তাব্যবস্থায় আসবে বড় ধরনের পরিবর্তন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের আগে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে তেমন কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক ছিলনা। দুটি দেশই ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সামরিক বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। আমেরিকা ও ন্যাটোর সঙ্গে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পাশাপাশি দেশটির রাজনীতিবিদরাও দীর্ঘসময় ধরেই ন্যাটোর সদস্য হওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু তারপরও ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে খুব বেশি আলোচনা কখনোই ছিলনা।
তবে পুতিনের রাশিয়া আক্রমণে বদলে যায় পুরো চিত্র। রুশ আগ্রাসনের পর উভয় দেশই নিরাপত্তা নীতিমালা নিয়ে নতুন করে ভাবছে। ন্যাটোর সদস্যপদ লাভই বর্তমানে দেশ দুটোর জন্য সবচেয়ে বাস্তবিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশগুলো ইউক্রেনেও অস্ত্র সরবরাহ করেছে। সুইডেন থেকে ১০ হাজার ম্যান-পোর্টেবল অ্যান্টিআরমার অস্ত্রসহ ইউক্রেনে যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, দুই দেশেই ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন দিন দিন বাড়ছে।
ইউক্রেন আক্রমণ করে পুতিন কেবল কিয়েভেই আধিপত্য চাইছিলেন না, একইসঙ্গে ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোতেও পরিবর্তন আনার কথা ভাবছিলেন। এবার দ্বিতীয় বিষয়ে তার মনোকামনা পূরণ হতে চলেছে। তবে পুতিন যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে নয়।
রাশিয়ার আক্রমণ ন্যাটোকে আরও সুসংহত করার পাশাপাশি ন্যাটোর সম্প্রসারণ পরিকল্পনাকেও উস্কে দিয়েছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেন এই জোটে যোগ দিলে দেশগুলো ন্যাটোর সামরিক দক্ষতা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। ফলে গোটা উত্তর ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আসবে নতুনত্ব, যা রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।
নর্ডিক নিরাপত্তা কাঠামো ও সামরিক নিরপেক্ষতা
নর্ডিক দেশগুলোর মধ্যে অসংখ্য মিল রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তারা ভিন্ন ভিন্ন নিরাপত্তা নীতি অবলম্বন করেছে। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা যুদ্ধকালে দেশগুলোর অভিজ্ঞতার ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
ডেনমার্ক ও নরওয়ে নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেও ১৯৪০ সালে জার্মান নাৎসিদের দখলদারির শিকার হয়। ১৯৩৯-৪০ সালের উইন্টার যুদ্ধকালে সোভিয়েত আক্রমণ প্রতিহত করে ফিনল্যান্ড। পরবর্তীতে দেশটি হিটলারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
নর্ডিক দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র সুইডেন যুদ্ধের ভয়াবহতা ও দখলদারির হাত থেকে পার পেয়েছিল। সুইডেনের নিরপেক্ষতা নীতি সফল হয়েছিল কেননা হিটলারের উদ্দেশ্য অর্জনে সুইডিশ অঞ্চল দখলের প্রয়োজনই ছিল না। এই অঞ্চলে অন্যান্য উপায়ে নাৎসির স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ ছিল।
যুদ্ধের পরে সুইডেন ডেনমার্ক ও নরওয়ের সঙ্গে একটি নর্ডিক প্রতিরক্ষা ইউনিয়ন গঠনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু নরওয়ের বিশ্বাস ছিল একমাত্র অ্যাংলো-স্যাক্সন সমুদ্র শক্তি নিয়ে জোট গঠনেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। ফিনল্যান্ডের পরিস্থিতির কারণে সুইডেন এ ধরনের জোটের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর তাই সে আলোচনা ভেস্তে যায়।
ইইউতে যোগদান
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। ফিনল্যান্ড ধীরে ধীরে একটি স্বাধীন নর্ডিক গণতন্ত্র হিসাবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার মাধ্যমে যুদ্ধ পরবর্তী প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রায় কাটিয়ে উঠেছিল। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া এই তিন বাল্টিক রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা হওয়ার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
১৯৯৫ সালে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করে। ফলে নিরপেক্ষতা নীতির কারণে উভয় দেশই একসময় যা অসম্ভব মনে করেছিল, তাই ঘটে।
এই দুটি দেশে ইইউতে যোগদানের অর্থ ছিল নিরপেক্ষ অবস্থানের ধারণাকে বাদ দেওয়া। কিন্তু তারপরও ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আলোচনার জন্ম হয়নি। এগুলো ঘটেছিল ১৯৮৯ সালের প্যারিস সনদের পরের বছরগুলোতে, যখন রাশিয়াকে নিয়ে একটি ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেন দুদেশই আশা করেছিল যে গণতান্ত্রিক ও সংস্কারমূলক রাশিয়ার সঙ্গে একটি গঠনমূলক নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এমনকি এক দশকেরও বেশি সময় পরে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া ন্যাটো ও ইইউয়ের সদস্যপদ লাভের পরেও সুইডেন বা ফিনল্যান্ডের সামরিক জোট বিষয়ক নিরপেক্ষতা কারোরই খুব বেশি মাথাব্যথা ছিল না।
নর্ডিক দেশগুলো ন্যাটোতে যোগ দিলে কী হবে?
ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিলে উত্তর ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামো বদলে যাবে। প্রতিটি দেশ উল্লেখ করার মতো সামরিক সক্ষমতা নিয়ে আসবে। ফিনল্যান্ড যথেষ্ট মজুদসহ একটি সেনাবাহিনী পালন করে। অন্যদিকে, সুইডেনের আছে শক্তিশালী বিমান ও নৌবাহিনী, যাদের সাবমেরিন ফোর্স অত্যন্ত দক্ষ। সুইডেনের দক্ষ গ্রিপেন ফাইটার ও এফ-৩৫স নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ড যাচ্ছে। ফলে সবমিলিয়ে অঞ্চলটিতে ২৫০টির বেশি অত্যাধুনিক ফাইটার থাকবে। একসঙ্গে অপারেশন পরিচালনা করলে তারা হয়ে উঠবে দুর্দমনীয়।
পুরো অঞ্চলের সম্মিলিত নিয়ন্ত্রণ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়ার প্রতিরক্ষাকে সহজ করে তুলবে। সুইডিশ অঞ্চল ও আকাশপথ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, এর ফলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি সংঘর্ষের সম্ভাবনাও কমবে।
তবে দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হবে ইউরোপ ও ট্রান্সআটলান্টিক প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। দুই দেশই ইইউ ও ন্যাটোর মধ্যে গভীর সমন্বয় সাধনে ভূমিকা পালন করবে। আটলান্টিকের যেকোনো নিরাপত্তা হুমকি ভাগাভাগি করে নেওয়ার সঙ্গে পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে মার্কিনিদের প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্বেও প্রভাব ফেলবে তারা।
রাশিয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন
এদিকে, ন্যাটোতে যোগ দিলেও ফিনল্যান্ড ও সুইডেন রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা হুমকিকে অযথা উস্কে না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। নরওয়ে রাশিয়াকে আশ্বস্ত রেখেই ন্যাটোকে শক্তিশালী করে তুলতে সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি করেছে। নরওয়ের এই উদ্যোগ মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
কোলা পেনিনসুলায় রাশিয়ার সেনাব্যবস্থা নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড উভয় অঞ্চলের নিকটবর্তী। রাশিয়ার নিউক্লিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র এটি। এসব কারণেই ফিনল্যান্ড কিংবা সুইডেন কেউই তাদের ভূখণ্ডে ন্যাটোর প্রধান ইউনিটগুলোর স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করতে দিবে না। এছাড়া, ডেনমার্ক ও নরওয়ের জোটে যোগ দেওয়ার সময় পারবমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যে ধরনের শর্ত আরোপ করেছিল সম্ভবত ফিনল্যান্ড ও সুইডেনও তাই করবে।
মাদ্রিদে শীর্ষ সম্মেলন সামনে রেখে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের দ্রুত সদস্যপদ দিতে চাইলে ন্যাটোকে এখনই দেশ দুটোর শর্তসমূহ বিবেচনা করতে হবে। শুধু নর্ডিক ও বাল্টিক অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে শক্তিশালী করতেই নয় বরং রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন প্রতিরোধেও বিষয়টি এখন অপরিহার্য।
- মূল লেখা: কার্ল বিল্ডট, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক ইউরোপীয় কাউন্সিলের সহ-সভাপতি ও সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
- সূত্র: ফরেন অ্যাফেয়ার্স