রাশিয়ান জেনারেলদের হত্যায় ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে আমেরিকা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অনেক রাশিয়ান জেনারেল ইউক্রেন বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। তাদের হত্যায় রাশিয়ান বাহিনী সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমন তথ্য জানিয়েছেন মার্কিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
ইউক্রেনের দেওয়া তথ্যমতে সম্মুখযুদ্ধে তারা ১২ জন রাশিয়ান জেনারেলকে হত্যা করেছে। এত বেশি সংখ্যক রাশিয়ান জেনারেল নিহত হওয়ার ঘটনায় আশ্চর্য হয়েছেন বিশ্বের সামরিক বিশেষজ্ঞরাও।
যুদ্ধক্ষেত্রের গোপন খবরাখবর ইউক্রেনকে সরবরাহের বাইডেন প্রশাসনের গোপন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই জেনারেলদের টার্গেট করা বিষয়ক গোয়েন্দা তথ্য দেওয়া হয়। এসব গোয়েন্দা তথ্যের মধ্যে আরও রয়েছে ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ান বাহিনীর সম্ভাব্য গতিবিধির খবর। মার্কিনীদের গোয়েন্দা তথ্যের সুবাদে ঠিক কতজন রুশ জেনারেল নিহত হয়েছেন তা জানাতে অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়ান সেনা কর্মকর্তাদের মারার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ও নিজেদের গোয়েন্দা তথ্যের সমন্বয় করেছে ইউক্রেন বাহিনী। এর পাশাপাশি তারা রাশিয়ান বাহিনীর নিজেদের মধ্যকার গোপন যোগাযোগ তথ্যও বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ রাশিয়ান সেনা কর্মকর্তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে আর্টিলারিসহ অন্যান্য হামলা চালিয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে ইউক্রেনীয়রা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে যেমন নিশ্চিত হতে পেরেছে, তেমনিভাবে নতুন লক্ষ্য সম্পর্কে জানতেও পেরেছে।
এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কিছু মার্কিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তসাপেক্ষে রাজি হয়েছেন। তবে তারা বেশিরভাগ তথ্যই গোপনে রাখতে চেয়েছেন এ ভয়ে যে এর ফলে ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও বিস্তৃত করতে পারেন। কীভাবে এ গোয়েন্দা তথ্যগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা প্রকাশ করতেও রাজি হননি এই কর্মকর্তারা।
তবে রাশিয়ান বাহিনীর গতিবিধি শনাক্ত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে গোপন স্যাটেলাইট ও বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের মতো প্রযুক্তি।
এর আগে গত মাসে মার্কিন ডিফেন্স সেক্রেটারি তৃতীয় লয়েড জে. অস্টিন বলেছেন, 'আমরা রাশিয়াকে এমনভাবে দুর্বল হতে দেখতে চাই যাতে ভবিষ্যতে এটি ইউক্রেন আক্রমণের মতো কোনো কাজ করতে না পারে।'
ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করার বিষয়ে জানতে চাইলে পেন্টাগনের মুখপাত্র জন এফ. কার্বি বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলব না।' তবে তিনি স্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে।
তবে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার পরে এক বিবৃতিতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল-এর একজন নারী মুখপাত্র আড্রিয়েনো ওয়াটসন বলেন, 'রাশিয়ান জেনারেলদের মারার অভিপ্রায়কে সামনে রেখে' ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা হয়নি।
তবে রাশিয়ান জেনারেলদের লক্ষ্য করে সব আক্রমণ মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হানা হয়নি। রাশিয়ান বাহিনীর সর্বোচ্চ পদাধিকারী অফিসারদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে কোনো গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের ব্যাপারে খোদ আমেরিকারই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
কিন্তু অন্যান্য জেনারেলদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে স্বীকার করেছেন কর্মকর্তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত মিত্রদেশও ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে।
বাইডেন প্রশাসনের দেওয়া নতুন অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে ইউক্রেন আগের চেয়েও ভালোভাবে রাশিয়ান গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারবে। সুইচেবল ড্রোনের ছোট সংস্করণগুলো দিয়ে যেকোনো একক ব্যক্তিকে চিহ্নিত ও হত্যা করা সম্ভব। এগুলো ব্যবহার করে ফ্রন্টলাইনে নেতৃত্ব দেওয়া বা গাড়িতে করে যাতায়াতরত জেনারেলের ওপরে সহজেই হামলা চালাতে পারবে ইউক্রেন।
এর আগে মার্কিন কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে তারা ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার আক্রমণের মোটামুটি আগে থেকেই ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করছে। আক্রমণ শুরুর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো উত্তর কিয়েভের হস্তোমেল বিমানবন্দরে আসন্ন রাশিয়ান হামলার ব্যাপারে ইউক্রেনকে সতর্ক করে।
এর ফলে ওই বিমানবন্দরের প্রতিরক্ষা বাড়াতে সক্ষম হয় ইউক্রেন। বিমানবন্দরটি দখলে রাশিয়ান ছত্রীসেনারা চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি তারা।
তবে ইউক্রেনের এসব বড় শিকারের ক্ষেত্রে রাশিয়ান জেনারেলদেরও কিছুটা অবদান আছে। এই জেনারেলরা প্রায় অনিরাপদ ফোন ও রেডিও ব্যবহার করে যোগাযোগের কাজ সারতেন বলে জানিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা। অনিরাপদ এ ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোতে খুব সহজেই আড়িপাতা যায়।
রাশিয়ান বাহিনীর সমরকৌশলের কারণেও তাদের শীর্ষ অফিসাররা যুদ্ধের ময়দানে ঝুঁকিতে থাকেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর ক্ষমতায়নে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক সিদ্ধান্ত অপেক্ষাকৃত নিম্নপদস্থ অফিসারেরা নিয়ে থাকেন। কিন্তু রাশিয়ান বাহিনীতে এখনো ক্ষমতাকাঠামো পদাধিকারবলে নিচ থেকে ওপরের দিকে বেশি ভারী। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক সমস্যা সমাধানে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাশিয়ান জেনারেলদের বাধ্য হয়ে ফ্রন্টলাইনে সরাসরি উপস্থিত হতে হয়।
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা ইভিলিন ফারকাস বলেন, 'এটা পরিষ্কার যে আমরা চাই রাশিয়া জানুক আমরা ইউক্রেনকে এই মাত্রা পর্যন্ত সাহায্য করছি এবং ভবিষ্যতেও তা চলমান থাকবে। যুদ্ধে জেতার জন্য আমরা ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সবকিছু দেব এবং এ নিয়ে পুতিনেে প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে আমরা ভীত নই।'
তবে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা সাহায্যের একটি নিরাপদ উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ এটি দেখা যায় না, স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই, এবং চাইলে নিদেনপক্ষে সাহায্যের ব্যাপারটি অস্বীকার করা যাবে।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস