আবারও ফিলিপাইনের ক্ষমতায় আসতে চলেছে একনায়ক মার্কোস পরিবার?
ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট, একনায়ক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে মার্কোস জুনিয়র। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে হারের ৬ বছর পর এবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। এবারও ভোটের মাঠে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছেন লেনি রোব্রেডো।
আগামী ৯ মে মার্কোস জুনিয়রের জয় হলে তিন দশকেরও বেশি সময় পর আবারও মালাকানাং প্রাসাদ ফিরে পাবে মার্কোসরা। দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কারণে গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়ার আগে কোষাগার লুণ্ঠনের অভিযোগ রয়েছে পরিবারটির বিরুদ্ধে।
মার্কোস জুনিয়রের ক্ষমতায় বসা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সেই সময়ে মার্কোস পরিবারের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়াদের স্বজনেরা। যদিও যথেষ্ট ব্যবধানে জুনিয়র মার্কোস জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, এরইমধ্যে বেকার সমস্যার সমাধানসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন "বংবং" হিসেবে পরিচিত মার্কোস জুনিয়র।
মার্কোস জুনিয়র নির্বাচনী প্রচারে তার বাবার শাসনামলকে 'সোনালি যুগ' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সম্প্রতি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, মার্কোস জুনিয়র তার বাবার প্রশংসা করে, তাকে 'সর্বোচ্চ রাজনীতিবিদ' হিসেবে দাবি করেন।
মার্কোসদের সমর্থকদের মতে, ফার্দিনান্দ মার্কোসের সময় হাসপাতাল, রাস্তা এবং সেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো নির্মাণ হয়েছে।
সমালোচকদের কথা অবশ্য ভিন্ন। তাদের মতে, প্রকল্পগুলোয় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছিল। এদিকে, মার্কোসের বছরের পর বছর ধরে চলা অত্যাচার এতো সহজই কীভাবে সাধারণ মানুষ ভুলে তা নিয়ে তা নিয়ে এখনও আতঙ্কিত ভুক্তভোগীরা। মার্কোসের উত্তরাধিকারী ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি আবারও কেমন হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে তাদের।
মার্কোসের রাজনীতিতে প্রবেশ
১৯৮০ সালে ২৩ বছর বয়সে দেশটির উত্তরের প্রদেশ ইলকোস নর্তের গভর্নর হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মার্কোস জুনিয়র। এমন একটি সময়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি, যখন দেশটি প্রায় এক দশক ধরে চলা সামরিক শাসনে পর্যুদস্ত। সরকারের সমালোচনা করে একদিকে হাজার হাজার মানুষ কারাগারে বন্দি, অন্যদিকে, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রচুর মানুষ।
দেশটির রাজধানী ম্যানিলার কাছে কুইজন শহরের একটি স্মৃতিস্তম্ভের একটি "ওয়াল অফ রিমেমব্রেন্সে" তাদের নামগুলো সোনা দিয়ে খোদাই করা আছে। বনিফাসিও ইলাগানের নামে স্বৈরাচারী শাসন থেকে বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তার বোন রিজালিনা পি. ইলাগানকে ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিট অপহরণ করে। সেইসময় আরও নয়জন নেতাকর্মীর সঙ্গে নিখোঁজ হন তার বোন।
২৩ বছর বয়সে, মার্কোস শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকেও আটক করা হয়েছিল এবং কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছিল। এমনকি মার্কোসের শাসনামলে কখনও মানবাধিকার নিয়ে চিন্তা করা হয়নি বলেও জানান তিনি। এ সময় বনিফাসিও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মানুষের জন্ম-মৃত্যুও তাদের হাতে ছিল বলে মনে করতো তৎকালীন মার্কোস ও সরকার সংশ্লিষ্টরা।
১৯৮৬ সালে বিপ্লবের পর ক্ষমতাচ্যুত হন মার্কোস। সেইসময় তারা হাওয়াই চলে যায়। এর তিনবছর পর নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যু হয় মার্কোস সিনিয়রের। পরে ১৯৯১ সালে জুনিয়র মার্কোস ও তার পরিবার দেশে ফিরে আসে, আবারও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে পরিবারটি। ধারাবাহিকভাবে ইলকোস নর্তে প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন তারা।
ক্ষমতায় থাকাকালে অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে মার্কোস পরিবার। ফলে দেশটির ঋণ বেড়ে যায় এবং লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হয়।
অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন দেশটির সাবেক ফার্স্ট লেডি ও মার্কোস সিনিয়রের স্ত্রী ইমেল্ডা মার্কোস। সহস্রাধিক জুতা জোড়া সংগ্রহে থাকার কারণে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন এই নারী। বিরল ২৫-ক্যারেট গোলাপি হীরা এবং কার্টিয়ার হীরার গয়না নিয়ে দেশ ছেড়ে পালান তিনি, যার মূল্য ছিল প্রায় ২১ মিলিয়ন। তবে পরে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বিভাগের কাছে ধরা পড়েন তিনি।
তাদের পতনের প্রায় ৪০ বছর পরে, ফিলিপাইন সরকার এখনও বিলিয়ন ডলার চুরি করা তহবিল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ধারণা করা হয়, প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার জনগণের কাছ থেকে চুরি করা হয় ওইসময়। এনিয়ে এখনও অনেক মামলা চলমান রয়েছে। যদিও পরিবারটি বারবার রাষ্ট্রীয় তহবিল ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এখনও মার্কোস পরিবারের ৩.৯ বিলিয়ন মূল্যের অমীমাংসিত 'এস্টেট ট্যাক্স' রয়ে গেছে।
তবে তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে, মার্কোস জুনিয়র নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টারে তার শৈশবের ডাকনাম "বংবং" বা "বিবিএম" এবং তার ছবি ব্যবহার করছেন। তার বাবার শাসনামলকে সমৃদ্ধি এবং জাতীয় গৌরব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সিএনএন প্রতিবেদনে জানিয়েছে, "মার্কোস যুগ ফিলিপাইনের স্বর্ণযুগ", এ বিষয়টি তরুণদের ভেতর ছড়িয়ে দিতে ইউটিউবের জনপ্রিয় কন্টেন্ট নির্মাতাদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করছেন তিনি। প্রথমবারের মতো যারা ভোট দেবেন, সেইসব তরুণ ভোটারদের জন্য টিকটক ভিডিও বানাচ্ছেন।
মার্কোস জুনিয়রের জনপ্রিয়তা
মার্কোস তার প্রচারণায় বেশ এগিয়ে রয়েছেন বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গ্লেন মার্ক ব্লাস্কেজ নামে ৩৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি সিএনএনকে জানিয়েছেন, আগামী ৯ মে ইন্টারনেট, রাস্তা, কৃষি এবং শিপিংয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রত্যাশায় তিনি মার্কোসকে ভোট দেবেন। তিনি বলেন, উন্নয়নের জন্য আমাদের গতি দরকার, এজন্য এমন একজনকে প্রয়োজন যিনি এ দেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
লুজোনের রিজাল প্রদেশের ৩৩ বছর বয়সী দোকানদার জেরাল্ড ক্রুজ জানিয়েছেন, তিনিও মার্কোস জুনিয়রকে ভোট দিচ্ছেন। কেননা, দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতের্তের অবকাঠামোগত উদ্যোগ চালিয়ে যাওয়ার এবং বিদ্যুতের খরচ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্কোস।
কেমন হতে পারে মার্কোস প্রেসিডেন্সি
মার্কোসের শাসন ১৯৮০-এর দশকে শেষ হলেও এখনও তার সমর্থকরা মনে করেন মার্কোস শাসনামলে কোনো দুর্নীতি হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জুনিয়র মার্কোস ক্ষমতায় এলে সেই আমলে শুরু হওয়া বিচার প্রক্রিয়া থেমে যাবে।
সিএনএন ফিলিপাইনকে মার্কোস জুনিয়র জানান যে, তিনি যদি রাষ্ট্রপতি হন তবে দুর্নীতি রুখতে উদাহরণ তৈরি করবেন।
তিনি বলেন, "শুধু মার্কোস পরিবারই নয়, অন্য আত্মীয়দের ভেতরও কেউ যদি দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে, তবে তাদেরও বিচার করা হবে।"
তবে সামরিক শাসন থেকে বেঁচে যাওয়া ইলাগানের মতে, মার্কোস জুনিয়র ক্ষমতায় এলে, তৎকালীন ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচারের আশা বন্ধ হয়ে যাবে।
- সূত্র- সিএনএন