আমেরিকা থেকে ভারত- গ্রীষ্মের মারাত্মক গরম, সঙ্গে তীব্র বিদ্যুৎ বিভ্রাট হবে নিত্যসঙ্গী!
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব শিগগিরই গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে চলেছে গ্লোবাল পাওয়ার গ্রিড।
যুদ্ধ, খরা, উৎপাদন ঘাটতি, কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম ইনভেন্টরি, সাথে করোনা মহামারির প্রতিক্রিয়া- সব মিলিয়ে গত বছর থেকে বৈশ্বিক জ্বলানির বাজার অস্থিতিশীল। এর ফলস্বরূপ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোগান্তিতে রয়েছেন ভোক্তারা। বিভিন্ন বিশ্লেষকের মতে, পরিস্থিতি সামনে আরও খারাপের দিকেই যাবে।
একদিকে যেমন বর্তমানে চলমান খাদ্যসংকট আরও বাড়বে, তেমনি তীব্র তাপদাহের সাথে শুরু হবে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা ব্ল্যাকআউট।
উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সাথে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে তীব্র তাপদাহ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। ইতোমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে এত বেশি গরম পড়েছে যে দিনের তাপমাত্রা কাঁচা স্যামন মাছ রান্নার জন্য যথেষ্ট। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এ বছর বাসাবাড়ি এবং ব্যবসায় এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার বাড়তে থাকায় বাড়বে বিদ্যুতের ব্যবহার।
মূল সমস্যা হচ্ছে, শক্তির সরবরাহ এতটাই ভঙ্গুর যে এত বেশি ব্যবহার করার মতো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকবে না। ফলে, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে এই গরমে ঠান্ডা বাতাস ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় ঝুঁকিতে পড়বে মানুষের জীবন।
এশিয়ার তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে ইতোমধ্যেই এই অঞ্চলে ঘণ্টাব্যাপী দৈনিক লোডশেডিং শুরু হয়েছে। পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত জুড়ে ১ বিলিয়নেরও বেশি মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এই পরিস্থিতি।
অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে গ্রেট লেক পর্যন্ত অন্তত ১২টি মার্কিন রাজ্য এই গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঝুঁকিতে রয়েছে। সাথে চীন ও জাপানে বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মুখে দাঁড়িয়ে সাউথ আফ্রিকা। এছাড়া, ইউরোপও রয়েছে অনিশ্চিত অবস্থানে। রাশিয়া যদি এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাস বন্ধ করে দেয় তাহলে তাদেরও পড়তে হবে কঠিন পরিস্থিতিতে।
ব্লুমবার্গ এনইএফ বিশ্লেষক শান্তনু জয়সওয়াল বলেন, "যুদ্ধ এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যাহত হয়েছে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ খাত। অন্যদিকে, চরম আবহাওয়া এবং কোভিড থেকে একটি অর্থনৈতিক প্রত্যাবর্তন জ্বালানির চাহিদা বাড়াচ্ছে।"
"এবারের পরিস্থিতি আগের থেকে বেশ ভিন্ন। আমার মনে পড়ে না শেষ কবে একসাথে এতগুলো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছি আমরা," বলেন তিনি।
ব্ল্যাকআউট যেভাবে দুর্ভোগ এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়ায়
বিদ্যুৎ না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষের স্বাভাবিক জনজীবন। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার ফলে সৃষ্ট অসহনীয় তাপমাত্রা থেকে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়বে। দীর্ঘায়িত ব্ল্যাকআউটের ফলে হাজার হাজার মানুষ বিশুদ্ধ পানির অ্যাক্সেস হারাতে পারে।
যদি ব্ল্যাকআউট অব্যাহত থাকে এবং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক ধাক্কারও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ভারতের অনেক রাজ্যে বর্তমানে চলমান বিদ্যুৎ বিভ্রাট ইতোমধ্যেই ২০১৪ সালের স্তরের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ২০১৪ তে ভারতে দীর্ঘায়িত ব্ল্যাকআউটের ফলে দেশটির অভ্যন্তরীণ পণ্যের উৎপাদন কমে যায় ৫ শতাংশ।
এছাড়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ চলমান না থাকলে বাড়বে ইউটিলিটি বিল এবং মূল্যস্ফীতি।
চলতি মাসে যখন টেক্সাস পাওয়ার গ্রিডে প্ল্যান্ট ফেইল করে তখন হিউস্টনে পাইকারি বিদ্যুতের দাম অন-পিক আওয়ারের গড় খরচের চেয়ে ২২ গুণ বেড়ে যায়।
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক হেনিং গ্লয়স্টেইন বলেন, "মহামারির ফলে দুই বছর ধরে চলমান বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন সংকট, ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে দেওয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়ার" প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে।
"এক্ষেত্রে প্রধান ঝুঁকি হলো, আমরা যদি এই বছর উল্লিখিত সমস্ত সমস্যার পাশাপাশি দীর্ঘায়িত ব্ল্যাকআউট দেখতে পাই, তাহলে আমরা এমন কিছু মানবিক সংকটের মুখোমুখি হবো যা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি," যোগ করেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থ হলো, চলমান তীব্র তাপপ্রবাহ ভবিষ্যতে আরও বেশি নিয়মিত হয়ে উঠবে। এতে চাপ পড়বে বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর।
সাংহাইয়ের উড ম্যাকেঞ্জি লিমিটেডের বিশ্লেষক অ্যালেক্স হুইটওয়ার্থ বলেন, "এক সপ্তাহের জন্য বৃষ্টি, ঝড় বা খরা দেখা দিলেই সরবরাহ সংকটের মুখে পড়তে হবে।"
আগামী ৫ বছরে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও যোগ করেন তিনি।
জ্বালানী ঘাটতি মোকাবেলা করার জন্য এখন আরও বেশি কয়লা পোড়ানোর ফলে ধোয়ার নির্গমন বৃদ্ধি পাবে। এতে করে তাপপ্রবাহ আরও বাড়তে থাকবে, যার চাপ পড়বে গ্রিডগুলোতে।
আমেরিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পাওয়ার-প্লান্ট জ্বালানী প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ এখন বেশ সীমিত। এতে করে বাড়ছে দাম।
নর্থ আমেরিকান ইলেকট্রিক রিলায়েবিলিটি কর্পোরেশন অনুসারে, আমেরিকার একটি বড় অংশের পাশাপাশি কানাডার কিছু অংশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিবে।
সামনে গ্রিড স্থিতিশীল রাখতে নিজেদের খরচ কমানোর কথাও বলা হতে পারে ভোক্তাদেরকে।
এছাড়া, আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়াতে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমানো হয়েছে। গত বছর পাইপলাইন ফেটে আমদানি সীমিত হওয়ায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া ইন্ডিপেনডেন্ট সিস্টেম অপারেটর এই মাসে জানায়, চরম আবহাওয়ার কারণে আগামী কয়েক বছর গ্রীষ্মে ব্ল্যাকআউটের ঝুঁকিতে থাকতে পারে এই রাজ্য।
মিডকন্টিনেন্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিস্টেম অপারেটর (এমআইএসও) দ্বারা পরিচালিত ১৫-স্টেট গ্রিডের অধীনে থাকা ১১টি রাজ্যের গ্রাহকরা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
প্রায় ৪২ মিলিয়ন মানুষকে সেবা দেওয়া এমআইএসও অনুমান করে, চলতি গ্রীষ্মে আমেরিকার মধ্য-পশ্চিম রাজ্যগুলোতে সর্বোচ্চ চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত উৎপাদন নেই তাদের। এর আগে কখনোই এ ধরনের সতর্কতা দেয়নি তারা।
কোব্যাংক এসিবি-এর পাওয়ার, এনার্জি অ্যান্ড ওয়াটার এর প্রধান অর্থনীতিবিদ টেরি বিশ্বনাথ বলেন, "বিশ্বের অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হচ্ছে আমেরিকা।"
এশিয়া
এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কেন্দ্রস্থল ছিল দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। ৩০০ মিলিয়ন মানুষের বাস পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং মিয়ানমারে এর পরিমাণ বেশি।
চলতি মাসে ভারতের একজন স্টেট অফিসিয়াল জানান, দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৬টি রাজ্যই দিনে ২ থেকে ১০ ঘণ্টা ব্ল্যাকআউটের মধ্যে থাকছে। রাজ্যগুলোতে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন লোকের বাস।
গত মার্চের শেষ থেকেই একের পর এক সিরিজ তাপদাহের দীর্ঘ চক্রে পড়েছে প্রতিবেশী ভারত। উত্তাপের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানিয়েছে, উত্তরপশ্চিম ভারতে গত এপ্রিলের তাপমাত্রা ছিল ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দাবদাহ বাংলাদেশের আশেপাশের ভারতীয় রাজ্য বিহার, ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে। এপ্রিল মাসে রাজ্যগুলিতে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়।
আইএমডির আবহাওয়া তথ্যের রেকর্ড অনুসারে, গত ২৭ এপ্রিল নাগাদ গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস, গত পাঁচ বছরের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলই ছিল সবচেয়ে উত্তপ্ত।
মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও গুজরাটে এপ্রিলের গড় সর্বোচ্চ তাপাঙ্ক ১৯৫১ সালের পর সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। দিল্লি, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে এটি ছিল ওই সময়ের পর থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্তপ্ত মাস। এসব রাজ্যগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা লাগাতার ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে, যা কিনা বছরের এই সময়ে সাধারণত যা হওয়া উচিত তার চেয়েও ৫-৬ ডিগ্রী বেশি।
ভারত সরকার সম্প্রতি তাদের সংস্থাগুলোকে ব্যয়বহুল বিদেশি কয়লার ক্রয় বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে; পাশাপাশি জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর জন্য পরিবেশগত প্রোটোকল শিথিল করেছে। তবে এই পদক্ষেপগুলো অর্থনৈতিক স্ট্রেইন কমাবে কিনা তা এখনও দেখার বিষয়।
অন্যদিকে ভিয়েতনামে চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি দেশীয় কয়লার সরবরাহ কমে যাওয়ায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ ঘাটতি নিয়ে শঙ্কিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইউটিলিটি।
এছাড়া, চীনে কয়লার ঘাটতির কারণে গত বছর বিদ্যুত সরবরাহে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। চলতি বছর যাতে সেই পরিস্থিতি না হয় সেজন্য কয়লা খনি শ্রমিকদের খনন বাড়াতে চাপ দিচ্ছে দেশটির সরকার।
এরপরও দেশটির শিল্প কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, এ বছরের গ্রীষ্মে দেশটির ভারী শিল্পোন্নত দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিতে পারে।
ইউরোপ
ইউরোপে ব্ল্যাকআউটের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। এই অঞ্চলে বাড়িতে এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা কম। কিন্তু, ইউরোপ বর্তমানে তাদের গ্যাসের স্টোরেজ পূরণে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদক নরওয়ে এই বছর তৃতীয়বারের মতো তাদের পারমাণবিক আউটপুট লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে। এটি ইউরোপের বিদ্যুৎ সংকট আরও খারাপের দিকে যাওয়াই নির্দেশ করে, বলেন রিস্টাড এনার্জির পাওয়ার মার্কেট বিশ্লেষক ফ্যাবিয়ান রনিনজেন।
অন্যদিকে, কিছু দেশ বিপুল পরিমাণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করেছে। এরমধ্যে রয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য।
কিন্তু পূর্ব ইউরোপের চিত্র আলাদা। ওই অঞ্চলের গ্রীস, লাটভিয়া এবং হাঙ্গেরিসহ বেশকিছু দেশ তাদের শক্তি উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্য গ্যাস ব্যবহার করে। এই দেশগুলো রাশিয়ান
সরবরাহের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই অঞ্চলেই ব্ল্যাকআউটের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে মন্তব্য করেন রনিনজেন।
"আমার মনে হয় না ইউরোপীয়রা এমন পরিস্থিতি কল্পনাও করতে পারে। এমনটি তাদের জীবনে কখনও ঘটেনি," বলেন তিনি।
- ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত