আর মাত্র দু'বছর পর মারা যাবেন
শেষ দু' বছরে গান লিখবেন মাত্র ৯ টি অথচ আটাত্তর বছর বয়সে পৌঁছে এক বছরেই গান লিখছেন ৪৫টি।
একটি বছর জুড়ে যে এর অধিক গান কখনও লেখেননি এমন অবশ্য নয়। আটচল্লিশ বছর বয়সে লেখা গানের সংখ্যাই তো ৭৫। হয়তো আরও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল কী এমন তাড়না যে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে এত গান লিখে যেতে হল। আর কীসব গান!
রবীন্দ্রনাথের জীবনে এইটি সেই সময় যখন তাঁর মনে হচ্ছে 'পথের নাগাল পাচ্ছি না'।
'শ্যামা'র গানগুলি আগের বছর লেখা হয়ে গেছে। এই পর্বে 'ডাকঘর'-এ যোগ করবার জন্য ৭টি গান লিখবেন। পাঁচটি কবিতার বই প্রকাশ পাবে আগামী দু'বছরে। 'নবজাতক', 'সানাই', 'জন্মদিনে', 'ছড়া' ও 'শেষলেখা'। নাটক ও উপন্যাস নেই। গল্প সংকলন বলতে 'তিনসঙ্গী' ও 'গল্পসল্প'। প্রবন্ধ বলতে ভাষণ 'সভ্যতার সংকট' ও 'আশ্রমের রূপ ও বিকাশ'। তাছাড়া আত্মজীবনী 'ছেলেবেলা' ও ভ্রমণকাহিনি 'পথের সঞ্চয়'।
তো এমন যখন নিভে আসবার সময় তখন গানে এরকম হঠাৎ জ্বলে ওঠবার কারণ কি! আর কী গানই বা লিখছেন!
কী আশ্চর্য! আটাত্তর বছর বয়সের প্রথম গানটি, 'আমার যেতে সরে না মন'!
অকারণে ফিরে আসবার কথা যে গানে বলবেন। আর বলবেন বলেই দ্বিতীয় গান, 'আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে'।
এই বছরের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী গানটি বুঝি 'প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে'!
কেন? সারাজীবন যে প্রেমের জন্য এতটা পথ তিনি হেঁটেছেন সেই প্রেমকে তাঁরা মনে হবে 'রক্তিম মরীচিকা'!
'আসা-যাওয়া' নামে কবিতাটি যখন লেখা হয় ২৮ মার্চ ১৯৪০-এ তখন তাতে ছিল 'ভালোবাসা এসেছিল এমন সে নিঃশব্দ চরণে' আর গানে এসে হয়ে গেল 'প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে'।
ভালোবাসা থেকে প্রেমেই তো পৌঁছাতে চায় মানুষ! 'egoism' (আত্মকেন্দ্রিকতা) থেকে 'altruism' (পরার্থপরতা)-য়।
'বাহির হলেম আমি আপন ভিতর হতে'। এটিও আটাত্তর বছরেই লেখা। তাই কবিতার 'একটি রক্তিম মরীচিকা' গানে হয়ে যায় শুধুই 'রক্তিম মরীচিকা'! সবিশেষ থাকে না।
মানুষ অত ভেবেচিন্তে নিশ্চয় লেখে না কিন্তু লিখনের ভিতরের না-লেখার ছাপ দুটো শব্দের বা দুটো পংক্তির অন্তর্বর্তী শূন্যতায় ধরা থাকে। দেরিদা যেমন প্লেটো নিয়ে আলোচনায় প্লেটো যা বলেছেন তার মধ্যে প্লেটো যা বলেননি অথচ বলতে চেয়েছেন তা আবিষ্কার করে আমাদের বিস্মিত করেছেন। আসলে লেখা মানে তো অন্ধকারকে খুঁড়ে আলো ফোটানোর খেলা। যে যত বড়ো লেখক তার মধ্যে এই খেলাটার বাঁক, গতি ও ট্যানজেন তত তীব্র!
আর কি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ? লিখছেন হারিয়ে যাওয়া বাঁশির কথা, স্বপ্নের অতিথির কথা, বনগন্ধ ঘুমের কথা, গন্ধের পথের কথা।
কী ওলটপালট সবকিছু! আমরা শিহরিত হই! এসে কীভাবে না আসবার কথা জানানো যায়! পলাতকা ছায়ার মধ্যে তো কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের গূঢ় তত্ত্ব লুকিয়ে আছে। রৌদ্রছায়া ও সিক্তসমীর তো না-দেখার ভেতরের দেখা।
আটাত্তর বছরে পৌঁছেই এমনটি হতে হল!
এটি এমন এক সময় যখন তিনি আধুনিক মরুভূমির গাছে দেখতে পান 'কাঁটার টেকনিক' অথবা 'বিশ্ব জুড়ে একটা নৈরাজ্য'। আর তখনই তাঁকে না বলার ঝোঁক পেয়ে বসল!
'বলা'-কে রূপান্তরিত করলেন 'চেয়ে' থাকায়।
স্বপ্নে ডুবে গেলেন। অচেতনে জেগে উঠলেন। পৌঁছাতে চাইলেন 'শেষ গানে'!
শেষবারের মতো অজানার খোঁজে বেরিয়ে পড়া এক অভিসারিকার জন্য নিজের আঙিনার দোর খুলতে চাইলেন।
মানুষ কেবলই নিজের চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে ছোটো হয়ে যায়। প্রাত্যহিকতার ধুলো তাদের মলিন করে। তারা দেখার ভেতরের দেখা দেখতে ভুলে যায়। শোনার ভেতরের শোনা শুনতে ভুলে যায়। স্পর্শের অতীত স্পর্শে পৌঁছাতে পারেনা। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে এই মোহপাশ থেকে বেরোতে চেয়েছেন। পৃথক হতে চেয়েছেন এই মোহগ্রস্ত আমিটির থেকে। জানতেন, 'এ আমার মোহের রচনা'।
অবলম্বন ভাবতেন গানকে। শেষ পারাণির কড়ি ছিল গান। গানে বন্ধন ছিঁড়তে চেয়েছেন। তাই কি শেষবারের মতো একবার জ্বলে উঠবেন!