ইন্ডিয়া হাউজের নথিতে ভারতবর্ষের মহামারী
"রাস্তাঘাট ভরে গিয়েছিল ফেলে রাখা লাশের ভারে" এ কথাটি অতিরঞ্জিত নয় একদম। পুরনো নথি থেকে ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী ভারতে কিভাবে ধ্বংসজজ্ঞ চালিয়েছিল, তার বিশদ জানা যায়।
'প্রায় প্রতিটি বাসায় ছিল মৃতদের জন্য আহাজারি, আর আতংক ও বিভ্রান্তি রাজত্ব করছিল সর্বত্র।'
দুই বছর আগে, ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি আঘাত হানার একশো বছর পূর্ণ হয়। পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে ভারতে এর প্রভাব ছিল সবচেয়ে আগ্রাসী। আনুমানিক প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে এই মহামারীতে। সে বছরের মে ও অক্টোবর মাসে, দুই পর্যায়ে এই রোগটি হানা দেয়।
"ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস" এর সরকারী নথিগুলোতে এই মহামারির প্রাদুর্ভাব, বিস্তৃতি ও পরিণামের বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এই মহামারী মোকাবেলা করার জন্য ভারতের কোন ধরণের কোন প্রস্তুতিই ছিল না। উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারত সবচেয়ে খারাপভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। সরকারী নথিগুলোতে আরো পাওয়া যায় দেশব্যাপী নিয়োগপ্রাপ্ত স্যানিটারি কমিশনারদের লেখা বিভিন্ন রিপোর্ট, যেমন পাঞ্জাব থেকে পাঠানো এই রিপোর্টটি:
'অক্টোবর মাসে রোগটির চরিত্র পুরোপুরি পালটে যায়, এবং পাঞ্জাবের বাসিন্দারা আক্রান্ত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম মহামারীতে। ভয়াবহ এই রোগটি যেন সাক্ষাত শয়তানের কাছ থেকে এসেছিল! সে শিকার হিসেবে বেছে নেয় অল্পবয়সী যুবক যুবতীদের। এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে একটি বিচিত্র ধরণের প্রাণঘাতী নিউমোনিয়া আবির্ভুত হয়, এবং ফলশ্রুতিতে অক্টোবর ১৫ থেকে নভেম্বর ৮ এর মধ্যে পাঞ্জাবে এক বর্ণনাতীত, মর্মান্তিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ফ্লুয়ের অবিশ্বাস্য ও দ্রুত বিস্তারের কারণে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থার নাভিঃশ্বাস উঠে গিয়েছিল সেখানে; হাসপাতালগুলোতে লাশের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে সেগুলোকে সরিয়ে অর্ধমৃতদের চিকিৎসার জন্য কোন জায়গাই বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। শহরের প্রতিটি সড়কের মোড় এবং অলিগলি ভরে গিয়েছিল মৃত এবং মরণাপণ্ণ মানুষে; ডাক ও টেলিগ্রাফ সেবা পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছিল। শুধু রেল সেবা চালু ছিল, কিন্তু প্রতিটি স্টেশানে মূলত একটা কার্যক্রমই চালু ছিল, যা হচ্ছে ট্রেনের বগি থেকে মৃত এবং মরণাপন্ন মানুষদেরকে অপসারণ করা। কোন শ্মশান কিংবা কবরস্থানে পা ফেলারও জায়গা ছিল না; সৎকার না হওয়া লাশের স্থান সংকুলান করাই হয়ে গিয়েছিল দুষ্কর—আর অপেক্ষমান ছিল আরও অনেক লাশ। আগে থেকেই ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা চিকিৎসা ব্যবস্থা এই ভয়াবহ মহামারীর মুখে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে; চিকিৎসার জন্য অপেক্ষমান মানুষদের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল ন্যুনতম সেবাগুলো পাচ্ছিল। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কেউ না কেউ মারা গিয়েছিল, এবং প্রবল ভীতি ও বিভ্রান্তির মাঝে চলছিল তাদের জন্য শোকপালন।'
বোম্বাই শহরের কমিশনার এই সংক্রামক ব্যাধির দ্রুত বর্ধনশীল প্রকৃতি বর্ণনা করেন দু'টি ঘটনার মাধ্যমেঃ
'জনৈক উকিল ট্রেনে করে ধুলিয়া থেকে পুনায় যাওয়ার সময় স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হন। তিনি ৮ই জুলাই সকালে ধুলিয়াতে পৌছান। ১০ তারিখ সকালে তার স্ত্রী, চার সন্তান এবং একজন চাকর একই রোগে আক্রান্ত হন। তারা কেউ ধুলিয়া থেকে অন্য কোথাও যাননি। এছাড়া তাদের পাশের বাসার সাত জনও একই দিনে আক্রান্ত হয়।'
'কল্যাণ থেকে একজন হিন্দু মহিলা তার দুই সন্তানকে নিয়ে ৮ তারিখে ধুলিয়াতে আগমন করেন; আর সেদিনই, সন্ধ্যা বেলায় তারা ফ্লুতে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয় যে তারা এই রোগের জীবাণু সাথে করে বহন করে নিয়ে এসেছিলেন। ১০ তারিখে একই বাসার আরো দুইজন বাসিন্দা আক্রান্ত হন।'
তখনকার প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কুইনাইন, তপ্ত হুইস্কি এবং এসপিরিন। কিন্তু এগুলোর ব্যবহারে শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হোত না। এসবের চেয়ে অন্য, আরও ব্যবহারিক ব্যবস্থাগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু মাদ্রাজের কমিশনার খুবই গতনুগতিকভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করেন। তিনি নিম্নলিখিত পন্থাগুলো অবলম্বন করেছিলেনঃ
১। বিপুল পরিমাণে মহামারীর বিস্তারিত বর্ণনা সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করা
২। অতিরিক্ত ঔষধালয় চালু করা
৩। মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরদের মানুষের বাসা পরিদর্শন করতে পাঠানো। তাদের সাথে এম্বুলেন্স কর্মী, সোশ্যাল সার্ভিস কর্মী, বেতনভূক ও স্বেচ্ছাসেবক স্বাস্থ্য কর্মী এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী কর্মীরাও গিয়েছিলেন।
৪। গরীবদের মাঝে বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা
৫। স্কুল ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা, এবং নাট্যমঞ্চে সব ধরণের পরিবেশনা নিষিদ্ধ করা
৬। বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের একসাথে কাজ করানো
তিনি আরো উল্লেখ করেন যে বিভিন্ন ব্যবহারিক সমস্যার কারণে এসব কার্যক্রম গ্রামাঞ্চলে চালু করা যায়নি।
মহামারী অতিক্রান্ত হবার পর কর্মকর্তাগন আত্মবিশ্লেষণে বসেন। তাদের মূল চিন্তা ছিল যে কি কি বিকল্প উপায়ে তারা পরিস্থিতিটির মোকাবেলা করতে পারতেন, যা তখন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কাজ শুরু করার আগে থেকেই তাদের মাঝে বিরাজ করছিল পরাজয়ের সুর।
তারা ভাবছিলেন, আমেরিকা কিংবা ইউরোপের মত মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্র যদি মহামারী রুখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভারতের মত দেশের কতটুকুই বা আশা রয়েছে তা প্রতিহত করার উপায় খুঁজে পাবার? জীবনের গুণগতমানের অভাবনীয় উন্নতি ছাড়া ভারতের মত দেশ ভবিষ্যতেও অনুরূপ মহামারী সংক্রমণের বিরুদ্ধে অরক্ষিত অবস্থাতেই থাকবেই, এই সিদ্ধান্তে তারা উপনিত হলেন খুব সহজেই।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোত্রের বীরত্বপূর্ণ সহায়তা ছিল সেবারের মহামারী থেকে প্রাপ্ত একমাত্র উল্লেখযোগ্য সাফল্য। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন গোত্রের নেতারা এবং সরকারী কর্মকর্তাগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছিলেন, এবং অনেকে বিভিন্ন মাত্রার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন এই মহামারী মোকাবেলায়।
তাদেরকে পরবর্তীতে সরকারী ভাবে সম্মাননা জানানো হয় চিঠির মাধ্যমে। ব্যারিস্টার জর্জ ডিককে নাগপুরের ডেপুটি কমিশনার ধন্যবাদ জানান এভাবেঃ
'আপনি জেনে সুখী হবেন যে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী তিরোহিত হয়েছে। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে, এবং ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এই মহামারী মোকাবেলায় আপনার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সকল ধরণের সহায়তামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। আপনার মত অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের সহায়তা না পেলে পরিস্থিতি আরো অনেক খারাপ দিকে মোড় নিতে পারত।'
দিল্লীর প্রধান স্বাস্থ্যকর্মকর্তা স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের উদ্দেশ্যে লেখেনঃ
'আমি সকল মেডিকেল এবং সাধারণ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে, যার সদস্যরা সহায়তা প্রদান করার উদ্দেশ্যে এই মহামারী মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিলেন। এছাড়াও, আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি নিম্নলিখিত ভদ্রলোকদের, যাদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবহার করে আমি অনেক গরীব মানুষদের মাঝে খাদ্য এবং উষ্ণ গরুর দুধ বিতরণ করতে পেরেছিলামঃ
১। স্যার কৈলাস চন্দ্র বসু – ১০০ রুপী
২। রায় হাজারীমূল বাহাদুর – ১০০ রুপী
৩। রায় ওঙ্কারমাল বাহাদুর - ১,০০০ রুপী
৪। বাবু শ্রী চাঁদ শর্মা – ২০০ রুপী
৫। বাবু শ্রী চাঁদ বাহিয়া – ২০০ রুপী
৬। বাবু ভৈরব দাস নেওয়ার – ১০০ রুপী
৭। রায় বাহাদুর বিশ্বেস্বর লাল হালওয়া সিয়া – ১০০ রুপী
কমিশনারগণ একমত হয়েছেন যে স্থানীয় সহযোগিতা না পেলে স্প্যানিশ ফ্লু পরিস্থিতি আরো অনেক বেশি খারাপ হোত।