একাত্তরের ইথার-বন্ধু মার্ক টালি
মাতৃভাষা অবশ্যই মায়ের ভাষা, মাতৃস্তন্য অবশ্যই মায়ের দুধ, মাতৃস্নেহ অবশ্যই মায়ের স্নেহ। মাতৃভূমি কি মায়ের জন্মভূমি নয়? অবশ্যই। এই সত্যটি যদি আমরা স্বীকার করে নিই তা হলে মার্ক টালির মাতৃভূমি অবশ্যই বাংলাদেশ।
মার্ক টালির মা বাংলাদেশেই জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮৫৭-র সিপাই বিদ্রোহের আগেই ভারতবর্ষে আসেন মার্ক টালির নানার দাদা। তিনি আফিম ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিলেন। উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে আফিম এজেন্ট ছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহের ভয়াল সময়ে যখন ইংরেজ মাত্রই সিপাহি এবং ভারতীয় বিপ্লবীদের টার্গেট, সেই ভয়ঙ্কর সময়ে তিনি নৌকায় চড়ে নিরাপদ বিবেচনা করে কোলকাতা চলে আসেন। নানার বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। আর মার্ক টালির নানার ছিল পাটের কারবার। সুতরাং সে কালের সোনালী আঁশ অঞ্চলই তাকে বেছে নিতে হয়েছে। সেজন্য পূর্ব বাংলাই ছিল উত্তম। এখানেই তার মায়ের জন্ম।
মার্ক টালির বাবার সাথে তার মায়ের প্রথম দেখা কোলকাতাতেই, তার বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৩৫ সালে টালিগঞ্জে মার্ক টালির জন্ম। ছয় সন্তানের একজন হিসেবে তিনি বেড়ে উঠেন, কোলকাতায় হলেও তার শৈশব ছিল 'ভেরি ব্রিটিশ চাইল্ডহুড'। একেবারে ছোটবেলা থেকেই তিনি যে ইন্ডিয়ান নন বরং ব্রিটিশ এই শিক্ষাই পরিবার থেকে পেয়েছেন এবং এ কথা তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহের সাত দিন পুরো ২৪ ঘণ্টাই ব্রিটিশ ন্যানির নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে থাকতে হতো। ভারতীয় ড্রাইভারের কাছ থেকে শোনা শব্দ উচ্চারণ করার কারণে ন্যানি তার মাথায় চাটিও মেরেছে। যে সব ইংরেজ শিশুদের বাবা মার খাস ব্রিটিশ ন্যানি ভরণপোষণের সামর্থ ছিল না, তাদের সন্তানের জন্য ভারতীয় কিংবা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ন্যানি রাখতে হতো। কিন্তু মার্ক টালির এই বিলেতি ন্যানির শাসন এতোটাই কড়া ছিল যে তাকে এবং তার পরিবোরের শিশুদের এ ধরনের ন্যানি-লালিত শিশুদের সাথে মিশতে দিতেন না।
ভারতীয় জাত-পাত ও বৈষম্যের সাথে আর একটি ভিন্ন রূপ এর সাথে যোগ হয়েছিল কোলকাতায়। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের (আইসিএস) সদস্যদের মনে করা হতো ব্রাক্ষ্মণ, ভারতীয় সেনা সদস্যদের মনে করা হতো রাজপুত (যোদ্ধা শ্রেণী) আর আমার ব্যবসায়ী বাবা তাদের কাছে ছিলেন বৈশ্য। নাক উঁচু আইসিএস আর সামরিক বাহিনীর কাছে তিনি ছিলেন কেবল একজন ব্যাপারি।
'আমার বন্ধুরা প্রায় সবাই ভারতীয়। আমার কন্যার জামাতা এবং পুত্রবধু উভয়েই ভারতীয়। আমি ভারতীয় একটি ভাষা জানি। আমি আরো ভালো জানতে পারতাম যদি ভারতীয়রা আমার সাথে সাক্ষাতের সময় হিন্দিতে কথা বলতেন।' পাছে তিনি না বোঝেন এজন্য তারা ইংরেজি বলেন, এতে চর্চা হয়ে উঠে না। গোড়াতেই ইউরোপিয়ান ন্যানির কঠোর প্রহরা ছিল যেন তিনি হিন্দি শব্দ মুখে তুলে না নেন। একমাত্র ইংরেজিই ছিল তার কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষা।
ভারতে আসা ব্রিটিশদের তখনকার বিধান ছিল ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ার বয়সে পৌঁছলে তাদের ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, লন্ডনে বোমা পড়ছে। প্রাথমিক বিদ্যালযের শিক্ষা গ্রহণের জন্য মার্ক টালিকে দার্জিলিং পাঠানো হলো। 'সেগুলো ছিল আমার জন্য বিষ্ময়কর আনন্দের দিন। জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়ে যায়, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। সার্বক্ষণিক চোখে চোখে কেউ রাখত না। হেডমাস্টার ছিলেন খুব উদার। স্বাধীনতভাবে বাজারে ঘুরে বেড়াতাম।'
এ সময় তার বাবার ম্যানচেষ্টারে চাকরি হয়ে যাওয়াতে তাকে শৈশবের বাকী অংশটুকু কাটাতে হয় ব্রিটেনেই, বোডিং স্কুলে। ভারত তখন রয়ে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে। তাছাড়া ভারতের পাট তো চুকিয়েই চলে এসেছেন। সেই ভারতে তার আর কখনো ফেরার কোনো কারণ ছিল না।
তিনি আন্তরিকভাবেই সিদ্ধান্ত নিলেন ধর্মযাজক হবেন। সে উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালনয়ে ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। কিন্তু আর্চবিশপ সন্দিহান হলেন এই যুবক কৌমার্য ধারণ করে যাজক হতে পারবে না। তিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। মার্ক টালি একটু আহত হলেও ভাবলেন তার কারণে চার্চের ভাবমূর্তি তো নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। পরবর্তী কালে তিনি স্বীকার করেছেন আর্চবিশিপের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।
তিনি চার বছর একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে বিবিসিতে যোগ দিলেন- কিন্তু মোটেও সাংবাদিক হিসেবে নয় প্রশাসন শাখাতে পার্সোনেল ম্যানেজার হিসেবে। তিনি সাংবাদিক হবেন, এ চিন্তা কখনো তার মনে আসেনি। পরের বছর ১৯৬৫ সালে তিনি আকষ্মিকভাবে বিবিসি দিল্লি ব্যুরোতে কনিষ্ঠ প্রশাসনিক সহকারীর পদে বদলি হলেন। তিনি তার স্মৃতিময় জন্মস্থানে ফিরে এলেন যদিও জন্মস্থান সম্পর্কে এক বৈরি মন আগেই তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি।
মার্ক টালি মনে করলেন ভারতে ফিরে আসাটাই নিয়তি 'আমার ভারতে ফেরার কথা ছিল, তা ঘটে গেছে। পরের বছর সদরদফতর থেকে পদোন্নতি দিয়ে তাকে বিবিসির নিউজ করেসপন্ডেন্ট করা হলো। দিল্লিতে অফিস, কিন্তু তাকে কাভার করতে হবে গোটা দক্ষিণ এশিয়া- ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা নেপাল। তখন বাংলাদেশ পাকিস্তানেরই অংশ। পূর্ব পাকিস্তান।
বিবিসি সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। সরকারের মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমের উপর অনেকেরই বিশ্বাস নেই। মার্ক টালি সঠিক সংবাদের জন্য এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়াতেন। সঠিক সংবাদ বের করা তার আনন্দময় অভিযানের অংশ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে মার্ক টালি
সাংবাদিকতাই হয়ে উঠে তার নিয়তি।
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার সময় মার্ক টালিসহ ৪০ জন বিদেশি সংবাদদাতাকে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হয়। উনিশ মাসের জরুরী অবস্থার ১৮ মাসই তিনি ছিলেন ভারতের বাইরে। জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হলে তিনি দিল্লিতে বিবিসির ব্যুরো চিফ হিসেবে যোগ দেন। বিবিসি প্রধান জন বার্টের সাথে বিরোধের জের ধরে তিনি ১৯৯৪ সালে পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন জন বার্ট বিবিসি চালান ভয় দেখিয়ে কিংবা চাটুকার বৃত্তির মাধ্যমে। ২০০২ সালে ব্রিটেন তাকে নাইটহুড প্রদান করে- স্যার মার্ক টালি।
রেডিও ছাড়ার পর তিনি দীর্ঘদিন বিবিসি টেলিভিশনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
একাত্তরের বাংলাদেশকে কাভার করা তার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা- 'এতে আমার নাম ও খ্যাতি বেড়ে যায়। তিনি ভারতে পরিচিত হয়ে উঠেন 'ভয়েস অব ট্রুথ' বা 'সত্যের স্বর' হিসেবে।
মার্ক টালির যে সময় টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তখন জন্ম সনদ দেবার ব্যবস্থা ছিল না। তখন টালিগঞ্জ ছিল কোলকাতা কর্পোরেশনের বাইরে। ৭৮ বছর বয়সে তিনি জন্মসনদ নিলেন এবং এটি ব্যবহার করে ওভারসিজ সিটিজেনশিপ অব ইন্ডিয়া গ্রহণ করলেন।
মার্ক টালি এখন ৮৫ পেরোলেন। তিনি এখন লেখক হিসেবেই বেশি পরিচিত। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে ভারতের সব প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি হয়েছেন। বিস্তৃত তার স্মৃতির ভান্ডার। লেখার ধরনের কারণে তাকে হিন্দি ভাষার লেখকরা বলে থাকেন ইংরেজ প্রেমচাঁদ। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবেদন করার সময় হিন্দু মৌলবাদিরা তাকে হত্যা করার জন্য অভিযান চালিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ ভারতের প্রধান ঘটনা ও দুর্ঘটনার শ্রেষ্ঠ প্রতিবেদনগুলো তার হাতেই প্রণীত হয়েছে। ভারত সরকার তাকে 'পদ্মশ্রী' ও 'পদ্মভূষণ' খেতাবে ভূষিত করেছে, ব্রিটেন দিয়েছে 'অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার' এবং নাইটহুড। সংবাদকে মানবিকীকরণ মার্ক টালির অন্যতম প্রধান অবদান।
তার রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে- No Full Stops in India, The Heart of India, Devide and Quit, Last Children of the Raj, From Ray to Rajib, Mother (১৯৯২)Upcountry Tales: Once Upon A Time In The Heart Of India (২০১৭) তাঁর উপন্যাস Hindutva, Sex and Adventure তাঁকে খানিকটা বিতর্কিত করেছে।
ঢাকা থেকে পাঠানো তার দুটি প্রতিবেদন, একটি ভাষ্য এবং দুটি পর্যালোচনার অনুবাদ উপস্থাপন করা হল।
ঢাকা থেকে মার্ক টালি
১ জুলাই ১৯৭১
ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনার পর এটা আমার কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সর্বশেষ রাজনীতিক কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আরও হতাশাব্যঞ্জক। যেসব মন্তব্য আমি মানুষের কাছে শুনেছি, তার সারকথা হচ্ছে-প্রেসিডেন্টের ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছুই নেই। অনেকেই মনে করেন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এবং সশস্ত্র বাহিনীকে উৎসাহ জোগানোর জন্যই প্রেসিডেন্টের ভাষণটি তৈরি করা হয়েছে। যারা সত্যিই সমস্যার একটি সমাধান খুঁজছিলেন-প্রেসিডেন্টের ভাষণে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রতি নিন্দাসূচক বক্তব্য তাদের হতাশ করেছে। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য তার ভূয়সী প্রশংসাকেও ভীষণ সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের ভাষণে ইসলাম ধর্মের ওপর জোরালো বক্তব্য সময়োচিত হয়নি। যেসব হিন্দু এখনও এখানে আছে তা তাদের ভয় বাড়িয়ে দেবে এবং তা নিশ্চয়ই শরণার্থীদের দেশে ফিরে আসতে উৎসাহ দেবে না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যুক্তিসঙ্গত কারণেই বাঙালিরা সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করে না। ঢাকা থেকে ৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে আটটি গ্রাম ধ্বংস করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সন্দেহাতীতভাবে আবার প্রমাণ করেছে প্রতিহিংসায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তারা বন্ধ করেনি। সেনা-নির্যাতনের যে গুজব ঢাকা ও চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে সেনাবাহিনী নির্মমভাবে মানুষকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে আনছে, তারা আর ফেরত যাচ্ছে না, ধর্ষণ সমানে চলছে, বলপূর্বক অর্থ আদায় ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ছিনিয়ে নেওয়া অব্যাহত রেখেছে--এইসব সেনা-আচরণ সবসময় হাতেনাতে প্রমাণ করা না গেলেও সারাবিশ্বই তাদের এসব অপকর্ম সম্পর্কে অবহিত।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর পক্ষে জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া আস্থা ফিরে পেতে তাদের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও দেখা যাচ্ছে না। রাস্তায় ভীতসন্ত্রস্ত সশস্ত্র পাঞ্জাবি পুলিশের টহল, মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনীকে দেখা যায় মেশিনগান উঁচিয়ে টহল দিচ্ছে। টেলিগ্রাফ অফিসে ঢোকার সময় লোকজনকে তল্লাশি করা হচ্ছে, রাস্তাঘাটেও তল্লাশি চলছে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে পাছে সেনাবাহিনীর চোখে পড়ে যায়। বাজারে তুলনামূলকভাবে অল্পকিছু চাঞ্চল্য রয়েছে, বাজারে লোকের সংখ্যা আগের চেয়েও অনেক কম আর রাত্রিকালীন রাস্তাঘাট জনশূন্যই থাকছে। অফিসে হাজিরা কিছুটা বেড়েছে, তবে দেখা যাবে হিন্দু কর্মচারীদের কেউই অফিসে ফেরেনি। আসলে সেনাবাহিনী যে ক্ষতিসাধন করেছে তা পূরণের কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। উর্দুভাষী ও বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ অত্যন্ত তীব্র। এ অবস্থায় মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত একটি সরকার যে জনগণের আস্থা ফিরে পাবে তা একেবারেই অসম্ভব।
৫ জুলাই ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। গত শুক্রবার ইলেকট্রিসিটির সঞ্চালন লাইন আবার নাশকতার শিকার হয়েছে, কিন্তু এবার ঢাকায়। ঢাকার একাংশে চব্বিশ ঘণ্টা কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। সপ্তাহান্তে ঢাকায় বেশক'টি বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে ময়মনসিংহের উত্তরে সরিষাবাড়ি বাজারে বেশ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এ কারণে সেনাবাহিনী এসে পুলিশ স্টেশন অধিকার করে বসে আছে এবং সরিষাবাড়ি পাটকলে গাঁট বাঁধার কাজ পুরোপুরি থেমে আছে।
পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসছে। শুক্রবার রাতে পাবনায় অগ্নিকাণ্ড ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে রাজশাহীতে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবার রাতেও সেখানে অগ্নিকাণ্ড ও বোমার বিস্ফোরণ হয়েছে। রাজশাহীর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ভারতের দিক থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের গঙ্গানদী অতিক্রমের প্রচেষ্টা চলাকালে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু কিছু গোলাগুলি সেদিকে হয়ে থাকলেও অন্যদিক থেকেও গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। গেরিলা অভিযানগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করা বেশ শক্ত: কারণ কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং অনেক কিছুই চেপে যাচ্ছে। এটা ঠিক, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব খবরের আনুষ্ঠানিক সূত্র উল্লেখ করা যাচ্ছে না, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে লোকজন যাতে সরকারকে সহযোগিতা করতে না পারে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যাতে বাধাগ্রস্ত করা যায় সে লক্ষ্যে অন্তত এ ধরনের বিক্ষিপ্ত সহিংসতা চলতেই থাকবে।
৭ জুন ১৯৭১।
পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমস্যা
রোববার (৬ জুন) ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, পাকিস্তানের শাসকদের এটি বোঝানো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব যে, সশস্ত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রের জন্য মানুষের তাড়নাকে দাবিয়ে রাখা যায় না। এখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাটি ভারতের জন্য বৈধ একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চল্লিশ লাখ শরণার্র্থী এসে গেছে, বিপুল সংখ্যায় প্রতিদিনই আসছে--ভারতের জন্য অভ্যন্তরীণ হলেও সমস্যাটি অতিকায়। ভারত সরকার মনে করে, যত শিগগির সম্ভব এবং শরণার্থীদের অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে হবে; কারণ এদের স্থায়ীভাবে ঠাঁই দেওয়ার মতো স্থান কিংবা সম্পদ কোনোটিই তাদের নেই। কিন্তু ভারত এটাও মনে করে, যতক্ষণ-না তাদের মনে এই আস্থা জন্মাবে যে, পূর্ব পাকিস্তান তাদের জন্য নিরাপদ ততক্ষণ এই শরণার্থীদের ফিরে যেতে রাজি করানো সম্পূর্ণ অসম্ভব।
ভারত সরকার মনে করে শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য--আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির যৌক্তিকতা রয়েছে।
পাকিস্তান সরকার যে সমস্যার মুখোমুখি, তা হচ্ছে কেমন করে পূর্বাঞ্চলে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনবে; প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দু'সপ্তাহ আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শিগগিরই তিনি বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেবেন। সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এর মধ্যেও ইসলামাবাদ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি। পাকিস্তান সরকারের অবস্থানটি হচ্ছে--গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ বৈধই রয়েছে। তবে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে যারা অভিযুক্ত তাদের পরিষদের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সংবাদদাতাদের কাছ থেকে যেসব প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আশাপ্রদ কোনো কিছু মনে হচ্ছে না যে, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব করা কোনো সমাধানে সমর্থন জোগাতে আওয়ামী লীগের সদস্যরা এগিয়ে আসবেন।
বেসামরিক কোনো সরকারের অধীন সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে প্রশাসন চালানোর ভার নিতে পারলেও তা আদৌ সম্ভব হবে কি-না, এ নিয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। কারণ সেনাবাহিনীর প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আদৌ কোনো বিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না।
ভারত সরকার এবং বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন মনে করে, পাকিস্তানকে সাহায্যদাতা দেশগুলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সাহায্য দিতে অস্বীকার করার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যদি-না প্রেসিডেন্ট সন্তোষজনক কোনো রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হন। স্পষ্টতই এ প্রস্তাবের সবচেয়ে বড় অসুবিধাজনক দিক এখানে অনুমান করা হচ্ছে যে সমস্যাটির একটি সন্তোষজনক সমাধান রয়েছে। দ্বিতীয় অসুবিধাটি হচ্ছে পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে সাহায্য বন্ধ করার মানে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানকে সাহায্য করা। তৃতীয় অসুবিধাটি হচ্ছে, সাহায্যদাতা দেশগুলো উদ্বিগ্ন--সাহায্যকে আবার-না রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। তা সত্ত্বেও কোনো সন্দেহ নেই পাকিস্তান সরকারের অন্যান্য কাজের জন্য যেমন, পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতেও সাহায্যের প্রয়োজন হবে।
যেসব দেশ পূর্ব পাকিস্তানের বিষয় নিয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, সেসব দেশ পাকিস্তানের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কিছুই করতে যাবে না। জাতিসংঘও পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ কার্যক্রমকে সহায়তা করা ছাড়া আর কিছু করতে পারছে বলেও মনে হয না। কাজেই সমস্যাটির যে প্রকৃতি তাতে এটা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিজেকেই সমাধান দিতে হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান যদি দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে হাত না-দেন তাহলে ভয়ের কথা হচ্ছে ভারত সরকার শরণার্থীর এই চাপ সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানের ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বসবে।
২৯ মার্চ, ১৯৭১
মার্ক টালির ব্রিটিশ প্রেস পর্যালোচনা
আজও আবার ব্রিটেনের প্রধান পত্রিকাগুলোতে পাকিস্তান পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। ঢাকায় সংঘটিত ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ছাড়াও সম্পাদকীয় মন্তব্য এবং এই সংকটের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
'দ্য টাইমস' শিরোনাম-সংবাদে বলেছে, পাকিস্তানের পরবর্তী কার্যক্রম কী হওয়া উচিত কিংবা কী হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। কিন্তু টাইমস মনে করে, ভারত সতর্ক পদক্ষেপ নেবে। কারণ এ পরিস্থিতিতে উদ্ভূত জটিলতা ভারত এড়াতে চাইবে, নতুবা এ ধরনের আরও অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। যদি গেরিলাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে চীনের প্রভাব বেড়ে যেতে পারে। টাইমস আরও মনে করে, এই সংকট থেকে দুই বাংলা এক করার একটি আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে যা উভয় অঞ্চলের জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পরিগণিত হবে। টাইমস লিখেছে, মিসেস গান্ধীর সমস্যা ইয়াহিয়া খানের সমস্যার চেয়ে কম নয়।
পিটার হ্যাজেলহার্স্ট টাইমসে ভুট্টোকে নিয়ে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী শক্তিশালী সংখ্যালঘু অংশের স্বার্থ রক্ষা করছে। ঠান্ডা মাথার কোনো পাকিস্তানি ভুট্টোর মতো বিশ্বাস করে না যে, গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার এখনও সুযোগ রয়েছে। হ্যাজেলহার্স্ট মনে করেন, পশ্চিম পাকিস্তান তার অঞ্চলের জন্য আশা করতে পারে সীমিত একনায়কতন্ত্র আর পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্মম সামরিক শাসন। হ্যাজেলহার্স্ট বলেন, সাংবিধানিক আলোচনার সময় ভুট্টোর আচরণ বাঙালিদের চরম সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে (বিশেষ করে যখন তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রভাবিত করে জাতীয় সংসদের ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত করিয়ে দিলেন এবং চাপ সৃষ্টি করে জানালেন যে, কোনো অন্তর্বর্তী সরকারে তার দলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে)। হ্যাজেলহার্স্ট বলেন, ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খানকে মনে রাখতে হবে শেখের বিচার করা মানে গোটা পূর্ব পাকিস্তানের বিচারের চেষ্টা করা।
পল মার্টিনের একটি লেখা বের হয়েছে টাইমসে। তিনি বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সহবাস সম্ভব নয় এই মতাবলম্বী চরমপন্থীদের শায়েস্তা করার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযানকে যৌক্তিক মনে করা হয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখের অহিংস আন্দোলন যেসব চরমপন্থীকে ম্লান করে দিয়েছে তাদের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
গার্ডিয়ানের মার্টিন অ্যাডেনি ঢাকা থেকে ফিরে এসে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি বলেন, এ সময় সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম ছাড়া সর্বত্র নিজেদের হাতে ক্ষমতা রাখতে চাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে নকশাল আন্দোলনের ব্যাপ্তি খুবই কম এবং তাদের ভালো অস্ত্রও নেই। সেনাবাহিনী এখন শক্তি বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নিচ্ছে; এখন পূর্ব পাকিস্তানে তিন ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। গত সপ্তাহে সেনাবাহিনী চট্টগ্রামে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে তাতে প্রেসিডেন্টকে বোঝানো হয়ে থাকতে পারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নিচ্ছে, যদিও সঠিকভাবে বলতে গেলে আওয়ামী লীগের ভেতর যথেষ্ট শৃঙ্খলা রয়েছে। অ্যাডেনি মনে করেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাঙালিরা বেশ বুঝতে পারছে, সেনাবাহিনী তাদের দেশটা অধিকার করে নিয়েছে। কিন্তু তারা এটাও বরাবরই বোঝে যে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি।
তিনি লিখেছেন, সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঠিকভাবে আমলে নিতে চাচ্ছে না। কারণ তাদের অফিসার বরাবরই বাঙালিদের ব্যাপারে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ দেখিয়ে আসছে। প্রেস্টন মনে করেন, এখন আর সমঝোতার কোনো পথ খোলা নেই। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খান আনাড়ির মতো সব ভণ্ডুল করে দিয়েছেন, স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি রক্ষণশীল আন্দোলনকে তিনি শেষ পর্যন্ত একটি বিপ্লবে পরিণত করে দিয়েছেন। সেনাবাহিনীকে দিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করিয়েছেন, তাকে জাতিসংঘের মোকাবেলা করতে হবে।
দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দূরপ্রাচ্যের সংবাদদাতা চার্লস স্মিথ তার পত্রিকায় লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক সমস্যার একটি কারণ হচ্ছে যে, এটি পাকিস্তানের অংশ। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে পাট ও কাপড়ের কল এবং উর্বর জমি ছিল, পশ্চিমে মূলত কোনো শিল্পই ছিল না, আর জমি ছিল শুষ্ক। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানই পশ্চিমের মূল্যবান উৎপাদন সামগ্রীর সুবিধাজনক বাজারে পরিণত হয়েছে।
স্মিথ মনে করেন, স্বল্পমেয়াদে সেনাবাহিনী সফল হবে এবং চীন-রাশিয়া কিংবা ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। তবে স্মিথ বলেন, সামরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তানের সমস্যা মেটানো যাবে না। এর জন্য দরকার উভয়পক্ষের ধৈর্য, সময় ও পারস্পরিক সংযম।
একটি শিরোনাম-নিবন্ধে ডেইলি টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্বাঞ্চলকে ক্রমাগত উপেক্ষা করা থেকেই বর্তমান ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়েছে। টেলিগ্রাফ বলেছে, সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে পারবে না। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আবার আলোচনায় বসতে হবে অথবা পূর্ব পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাবে। তবে সাংবিধানিক আলোচনা শুরু করতেও অলৌকিক একটা কিছু ঘটতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যদি আলোচনা শুরু না করে অবর্ণনীয় রক্তপাতের মধ্য দিয়ে পূর্বাঞ্চল বেরিয়ে আসবে, আর তাতে পশ্চিমাংশের উপকৃত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
আজকের ব্রিটিশ পত্রিকা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সংবাদে ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। এতে রয়েছে স্পট রিপোর্ট, বিশ্লেষণ, ফিচার এবং সম্পাদকীয়।
সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যুদ্ধের জন্য কাকে দোষ দেওয়া যায় সেটা সনাক্ত করে তেমন কোনো লাভ নেই। পত্রিকাটি আশঙ্কা করছে যুদ্ধের ফল হবে অখন্ডতা বিনষ্টকারী, নৈরাজ্য এবং অন্তহীন ভোগান্তির। সানডে টাইমস এর মতে সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক সমাধান একটিই পাকিস্তান শেখ মুজিবকে নিয়ে স্বায়ত্বশাসিত একটি পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি করুক, তাতে শরণার্থীদের ফিরে আসার পথ সুগম হবে। আর তা করতে হলে ইয়াহিয়াকে তার প্রেসিডেন্টের পদটি অন্য কারো কাছে অর্পণ করতে হবে। কিন্তু সবার আগে যুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার। নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি আলোচনার জন্য গ্রহণ করায় সানডে টাইমস উদ্যেগটিকে স্বাগত জানিয়েছে।
অবজারভার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছে যুদ্ধ একটি অবর্ণনীয় দুঃখের কারণ হবে। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হবে যদি বাকী পৃথিবী চুপচাপ কেবল এই উন্মত্ততা দেখতে থাকে। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সামরিক সমাধান খুঁজতে যাওয়াতেই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়া থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর জড়িয়ে পড়ায় গণযুদ্ধ হতে এটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধে পরিণত হতে যাচ্ছে।
অবজার্ভার মনে করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ ছিল উভয় অংশের মধ্যে ফেডারেল কাঠামো ঠিক রেখে পূর্বাঞ্চলকে সর্বোচ্চ প্রকৃত স্বশাসনের সুযোগ প্রদান করা। যদি এটা কার্যকারী না হয় দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সমাধান হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের হস্তক্ষেপের বাইরে রেখে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন দেশ হিসেবে অভ্যুদয়ের সুযোগ দেওয়া। তাদের এখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ থামানোর আলোচনার সাথে সাথে শরণার্থীদের বাঁচাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৃহদাঙ্কের সাহায্য প্রদান কর উচিত।
সানডে টাইমস মনে করে বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে যদি সঙ্কটের সুরাহা করতে না পারে তা হলে সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হতে সহযোগিতা করাই হবে উত্তম প্রস্তাব।
সানডে টাইমস বলেছে যদি কূটনৈতিক পদক্ষেপের কোনো ভূমিকা না থাকে তাহলে যুদ্ধে ভারতের দ্রুত বিজয়ই অধিকতর সন্তোষজনক একটি সমাধান এনে দেবে।
টেলিগ্রাফ বলেছে বড় শক্তিগুলো যদি কূটনৈতিক সমাধান নিশ্চিত না করতে পারে তাহলে তারা যেন কোনো পক্ষকেই অস্ত্রের যোগান না দেয়।
সানডে মিরর মনে করে ধনী দেশগুলোর যুদ্ধ ঠেকানোর কোনো ক্ষমতা নেই এবং এই সংকট সমাধানে তাদের অবদান অতি নগন্য। সানডে মিরর বলেছে পাকিস্তানের উপর জাতিসংঘ কিংবা চীনের চাপ পাকিস্তানকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখবে। আর নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর ভাষ্য যেহেতু ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই কমনওয়েলথ সদস্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্কট নিরসনে মধ্যস্ততা করা উচিত।
অবজার্ভারের উপমদেশীয় চিফ রিপোর্টার সিরিল ডানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী উপমহাদেশে স্থিতবস্থার জন্য কাশ্মীর পাকিস্তানের সাথে চলে যাওয়া উচিত। আর যুদ্ধ অব্যহত থাকলে পূর্ব পাকিস্তানে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটবে, ফলে এই দেশ হিন্দু শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তণ ঠেকাবে এবং বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে অপারগ হয়ে পড়বে।
সানডে টাইমস পত্রিকায় জন গ্রিগ লিখেছেন, যুদ্ধের প্রেক্ষাপট হচ্ছে ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়া শরণার্থীর বোঝা। এর আর্থিক ব্যয় মেটানো ভারতের সাধ্যাতীত এবং এই পরিস্থিাততে উদ্ভুত সামাজিক দ্বন্দ্বের পরিণতি ভয়াবহ। তিনি মনে করে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অভ্যন্তরে নিয়মিত সৈন্যবাহিনী পাঠাতে ইন্দিরা গান্ধী নিরুৎসাহিত থাকার কথা। কিন্তু যখন নিশ্চিত হলেন ইয়াহিয়া খানকে তার অবস্থান বদলাতে বহৃৎশক্তিগুলো কোনো চাপই দেবে না, এছাড়া তার আর কোনো বিকল্প থাকল না। এখন ব্রিটেনের উচিত ভারতকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা।
সানডে টাইমস-এর অ্যান্থলি ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন, গত আট মাসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হতাশাব্যাঞ্জক সাড়ায় শরণার্থী সমস্যা দূর করতে যুদ্ধই একমাত্র সমাধন হিসেবে সামনে চলে এসেছে। আমেরিকা সরকারের পাকিস্তনকে চাপ দিতে ব্যর্থতা দেখে ভারত হতাশ হয়েছে। কাজেই যুদ্ধই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ভারত সরকার হিন্দু শরণার্থীদের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু রাজ্যগুলো আর্থিক সক্ষমতার ঘাটতির কথা বলে সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করেছে। শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিতে ভারত শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ কমে আসবে। গায়ের জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে ধরে রাখার বাসনাই পাকিস্তানকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।