খনির কালোসোনা কয়লা
কল্পলোকের অমর লেখক জুলে ভার্ন দেড়শত বছর আগে লিখে গেছেন, শিল্প হচ্ছে কার্বনখেকো প্রাণী, সঠিক খাবারই তার চাই। কয়লা ছাড়া শিল্পের পাকস্থলি টিকে থাকতে পারে না।
কাহলিল জিবরান কয়লার রূপান্তরের দৃশ্যটি দেখেছেন। তিনি বললেন, সময়ের সংজ্ঞায় কয়লাই হচ্ছে হীরক খন্ড।
দেড়শত বছর আগে দার্শনিক লেখক রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন বলেছেন, কয়লা হচ্ছে কালের বহনযোগ্য পরিবেশ।
কোনো সন্দেহ নেই সভ্যতা বিনির্মাণ করেছে কয়লা, কিন্তু এ কালের বিশেষ করে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা প্রকৃতির বিনাশী রূপ এবং মানবদেহের অনেক রোগবালাই ও অসামর্থতার জন্য কয়লাকেই দায়ী করেছেন।
কয়লার খনিমুখ
সভ্যতার পেছনে সর্বপ্রধন শক্তিই জ্বালানী শক্তি আর আগুন আবিষ্কারের পর থেকে এ যাবত সেই শক্তির যোগান দিয়েছে কয়লা এবং এখনও যোগান দিয়েই যাচ্ছে। তবুও বিশেষ করে কয়লা জ্বালিয়ে কার্বনমনোক্সাইড গ্যাস অবমুক্ত করে ওজন স্তরের ক্ষতিসাধন পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মানুষের শুভ দৃষ্টি থেকে কয়লা ছিটকে পড়েছে; এর আরো একটি কারণ বিভিন্ন বিকল্প শক্তি ও জ্বালানীর অভ্যুদয়। কয়লাকে এখন খলনায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তারপরও কয়লার উৎপাদন কিন্তু কমছে না। ২০১৯ সালের হিসেবে পৃথিবীতে উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ ৭৯২১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। উৎপাদনের শীর্ষে থাকা পাঁচটি দেশের বার্ষিক উত্তোলন :
কোন দেশ কি পরিমাণ উত্তোলন করে:
চীন ৩৬৯৩ মিলিয়ন টন
ভারত ৭৬৯ মিলিয়ন টন
যুক্তরাষ্ট্র ৬৪০ মিলিয়ন টন
ইন্দোনেশিয়া ৬১৬ মিলিয়ন টন
অস্ট্রেলিয়া ৫০৩ মিলিয়ন টন
২০০০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চীনে উত্তোলন বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। ইন্দোনেশিয়ায় বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ, ভারতের বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কমেছে।
উৎপাদন ও ভোগ
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কয়লা উৎপাদনকারী এবং সর্ববৃহৎ ভোক্তাদেশ হিসেবে কয়লার যে কোনো আলোচনায় চীনের নাম এসেই যায়। প্রেসিডেন্ট লি জিনপিঙ ঘোষণা করেছেন ২০৩০ থেকে চীনে কার্বন নিঃসরণ কমতে থাকবে এবং পরবর্তী ৩০ বছরে ২০৬০ সালে চীন কার্বন নিরপেক্ষ একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃত হবে। কোনো সন্দেহ নেই এটি একটি সময় পিছিয়ে দেওয়ার উচ্চাকাঙ্খী টার্গেট। এখনই কোনো কার্বন নিঃসরণ কমানো শুরু করা যাবে না প্রশ্নে প্রত্যক্ষ উত্তর চীন দেবে না। তবে পরোক্ষভাবে এটা তো বলে যাচ্ছেই, সবার আগে উন্নয়ন। করোনাকালে জিডিপিও প্রবৃদ্ধি ৬ হতে হবে; দেশের উন্নতি চাই, মাথাপিছু ঋণ কমিয়ে আনতে হবে।
চীনের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ কাঠামো কয়লা শক্তির উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কেবল নিজদেশে নয়, উন্নয়নশীল কিছূ দেশেও কয়লা শক্তির পাওয়ার প্লান্ট করে দিয়েছে, প্রতিশ্রুত পাইপ লাইনে রয়েছে আরো অনেকগুলো পাওয়ার প্লান্ট। কেবল প্রযুক্তি সহায়তা নয়; প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা ও অপারেশনের জন্য চীন টাকাও সরবরাহ করে থাকে। ২০২০ সালেই চীনের বাইরে কয়লা শক্তির পাওয়ার প্লান্ট তৈরিতে ৪৭৪ মিলিয়ন ডলার অর্থ ছাড় করেছে।
চীনের আবহাওয়া পরিবর্তন বিভাগের পরিচালক লি শাও বলেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উপর দৃষ্টি রাখা হচ্ছে, ১৫ বছর আগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর ৭২.৪ ভাগ কয়লা উৎপাদিতই ছিল, ২০২০ এ তা ৫৬.৮ ভাগে নেমে এসেছে।
তারপরও পৃথিবীতে উত্তোলিত কয়লার অর্ধেকেরও বেশি চীন একাই ভোগ করে থাকে। ২০১৯ সালের হিসেবে ৫০.৫ ভাগ চীনের দখলে চলে যায়, ভারত ভোগ করে ১১.৩ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্র ৮.৫ ভাগ, জার্মানি ৩.০ ভাগ, এবং রাশিয়া ২.৭ ভাগ এবং জাপান ২.৫ ভাগ।
মাথাপিছু ভোগের হিসাবটিও যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক: মাথাপিছু বার্ষিক ৫ হাজার কিউবিক ফিটের উপরে আছে একটি দেশ অস্ট্রেলিয়া (৫৩৪৩ কিউবিক ফিট), ৪ হাজার কিউবিক ফিটের উপরে আছে ৬টি দেশ : কাজাখস্তান (৪৮৫৯), সার্বিয়া (৪৮৭৮), চেক রিপাবলিক (৪৬৫৪), বুলগেরিয়া (৪৯২৬), নিউ ক্যালিডোনিয়া (৪২১৩), আর ৩ হাজারের উপরে আছে ৭টি দেশ: চীন (৩০৫৫), জার্মানি (৩১৩৩) দক্ষিণ আফ্রিকা (৩৫৯৯), দক্ষিণ কোরিয়া (৩০৮১), পোল্যান্ড (৩৯১৬), তাইওয়ান (৩০৭৬), গ্রিস (৩৫৮৭)। আর বাংলাদেশের মাত্র ১৩ কিউবিক মিটার।
কয়লার ব্রিকফিল্ড ও বায়ৃদূষণ
কয়লার ভূ-রাজনীতি
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে এখনো ব্যাপকভাবে বহুল ব্যবহৃত জ¦ালানি হচ্ছে কয়লা। স্টিল ও সিমেন্ট উৎপাদনে এখনো শ্রেষ্ঠ সহযোগী কয়লা। আবার এটাও সত্য যে কয়লা কার্বনডাই অক্সাইড বিযুক্ত করে পরিবেশ দূষণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১৯ সালের হিসেবে পৃথিবীতে মোট কয়লার উৎপাদন ৭৯২১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি কয়লা উৎপাদনকারী দেশের সংখ্যা মাত্র পাঁচটি। চীন ভারত যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। এর মধ্যে শেষ চারটি দেশ যত কয়লা উৎপাদন করে চীন একাই করে তার দেড় গুণ। কয়লার উৎপাদন ব্যবহার, কয়লা নিয়ে খবরদারি, রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক সব মিলিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানে কয়লাই রাজনীতির অন্যতম ঘুটিতে পরিণত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াকে পরিচিত করাতে তাদের দেশবাসীই বলে থাকেন: উই তার এ কোল কান্ট্রি। খনি শ্রমিকের সংখ্যা এতো বেশি যে সম্মিলিত হয়ে তারা একদিকে ঝুঁকলে রাষ্ট্রও সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। তারাই হয়ে উঠে কিং মেকার। কয়লার রাজনীতিতে অস্ট্রেলিয়া এবং চীন কি ভূমিকা রাখছে তা জানা দরকার। কয়লা অস্ট্রেলিয়ার বড় ব্যবসা; এই কালো সোনার রফতানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেশের অর্থ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী যোগানদার। নোংরা এবং পরিবেশ দূষণের কারণ কয়লা, গালাগালও খায় সবচেয়ে বেশি। অস্ট্রেলিয়া বহু বছর কয়লা আষক্ত জাতি হিসেবে চিহ্নিত ছিল, এখনো কয়লা রফতানি করছে। চীনের সাথে ভারতও অস্ট্রেলিয়া কয়লার অন্যতম খদ্দের। এদিকে কয়লা ব্যবহার বন্ধ করতে ভারতকে নসিহত করে চলেছে অস্ট্রেলিয় পরিবেশবাদীরা। ভারতের উন্নয়ন কর্মীরা দেখাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায় মাথাপিছু কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ বার্ষিক ১৮ টন, আর ভারতের মাত্র ১.৫ টন।
২০১৮ থেকে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার কয়লাভিত্তিক সম্পর্ক খারাপের দিকে এতোটাই গিয়েছে যে তা দু'দেশের জন্যই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। প্রয়োজনীয় কয়লা না পাওয়ায় চীনের কয়েকটি শহরে ডিসেম্বরে লাগাতার ব্ল্যাকআউট ছিল। এ সব অঞ্চল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু চীন অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লার জাহাজের আগমন ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে। নিজেদের বৃহত্তম বাজারের দরজা বন্ধ হওয়া অভ্যন্তরীণ সঙ্কট বাড়িয়ে তুলেছে। এতে চীনের বৈরি হিসেবে পরিচিত ভারত অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতায় এগিয়ে যায় এবং আমদানি বাড়ায়।
২০১৮-তে অস্ট্রেলিয়া অভিযোগ করল চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১০ এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়া প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন চীনের উহানকে ইঙ্গিত করে করোনাভাইরাসের উৎস নিরুপণ করতে আন্তর্জাতিক তদন্তানুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন।
এরপর চীন কেবল কয়লা প্রত্যাখানেই বসে থাকেনি। অস্ট্রেলিয়ার বার্লির উপর বড় অংকের ট্যারিফ বসিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার গরুর মাংস নিষিদ্ধ করেছে, অস্ট্রেলিয়ার মদের উপর অ্যান্টিডাম্পিং তদন্ত চেয়েছে, আমদানিকারকদের নির্দেশ দিয়েছে তারা যেন অস্ট্রেলিয় তুলা এবং চিংড়ি না আনেন, অস্ট্রেলিয় কাঠ আমদানি নিষিদ্ধ করেছে, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক মূল্যের অস্ট্রেলিয় কয়লা খালাস করা মাসের পর মাস স্থগিত রেখেছে। এই ধাক্কায় অস্ট্রেলিয়ার ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। তবে লৌহ আকরিক রফতানি বেড়ে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতিটা তেমন অনুভূত হয়নি। কয়লা পরিবেশ দূষণের জন্য যত দায়ীই হোক কয়লার চাহিদাতে এখনো ভাটা পড়েনি। ফলে চীন ও অস্ট্রেলিয়াকে সামনে রেখে পৃথিবীতে 'কোল পাওয়ার্ড পোলারাইজেশন' হতে যাচ্ছে।
২০১৮ সালের হিসেবে শীর্ষ ১০ দেশের কয়লা রফতানি ও আমদানির চিত্রটি দেখা যেতে পারে :
রফতানি মিলিয়ন টন
ইন্দোনেশিয়া (৪৭২ মিলিয়ন টন) অস্ট্রেলিয়া (৪২৬) রাশিয়া (২৩১) যুক্তরাষ্ট্র (১১৫) কলম্বিয়া (৯১), দক্ষিণ আফ্রিকা (৮৮) মঙ্গোলিয়া (৩৯), কানাডা (৩৭) এবং মোজাম্বিক (১৬)।
আমদানি (মিলিয়ন টন)
চীন (২৮১ মিলিয়ন টন), ভারত (২২৩), জাপান (১৮৯) দক্ষিণ কোরিয়া (১৪৯), তাইওয়ান (৭৬), জার্মানি (৪৪), নেদারল্যান্ডস (৪৪), তুরস্ক (৩৮), মালয়েশিয়া (৩৪), থাইল্যান্ড (২৫)।
পৃথিবীর মোট উত্তোলনের অর্ধেক যে দেশ উত্তোলন করে থাকে, সেই চীনও কয়লা আমদানি করে থাকে।
মালয়েশিয়ার কয়লাভিত্তিক পাওয়ার স্টেশন
কয়লাভিত্তিক শিল্প : স্বাস্থ্য ও পরিবেশ
অধিকাংশ সময়ই আলোচনা কার্বন নিঃসরণ এবং ওজন স্তরের ভাঙ্গনের মধ্যে সীমিত থাকে। পানি ও বায়ুদূষণ বর্জ্য সৃষ্টি, ফ্ল্যাই গ্যাস, বটম গ্যাস, ফ্লু গ্যাস, ডিসালফারইজেশন, ধাতু মল, নিঃসৃত মার্কারি, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, আর্সেনিক ও অন্যান্য ভারী ধাতব অনালোচিত রয়ে যায়। ২০০৮ সালের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে কয়লার কারণে সরাসরি ১০ হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়। আর অসংখ্য মানুষের আয়ুষ্কাল কমে যায়। ইউনাইটেড স্টেটস এনভারমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মানতে রাজি নয়, তাদের হিসেব, কয়লার কারণে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই মৃত্যু ২৪,০০০। তারা হিসেব করে আরো দেখিয়েছে প্রতি বছর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের বদলে যদি সোলার ফটোভল্টাইক জেনারেশন গ্রহণ করা হয় তাতে যুক্তরাষ্ট্রে ৫১,৯৯৯ জনের জীবন রক্ষা পাবে।
খনি থেকে কয়লা উত্তোলন স্ট্রিপ মাইনিং বা সারফেস মাইনিং যে পদ্ধতিতেই করা হোক খনি সংলগ্ন ভূমি এবং তার চারপাশের পরিবেশ মনুষ্যবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। খনি খনন অজ্ঞাতসারে ভূমিকম্পনকে আমন্ত্রণ জানায়, খনি নিকটবর্তী জলাশয়সমুহের পানির স্তর নামিয়ে দেয়, পানিকে দূষিত করে। ফ্লাই অ্যাশ ও অন্যান্য অবমুক্ত উপাদান পানি দূষিত করে। সারফেস মাইনিং বন্যপ্রাণীর অনেক বেশি ক্ষতি করে। কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড মিথেন ও মার্কারি বাতাস, পানি, বিভিন্ন বায়ুস্তর কয়লা প্রজ্জ্বলনে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওজন স্তরের ভাঙ্গন মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। খনির শ্রমিক এবং খনি সন্নিহিত এলাকার মানুষের মরণাপন্নতা বেশি।
কয়লার খনিতে দুর্ঘটনা
অনুন্নত দেশে তো হয়ই এমন কি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সর্বোচ্চ উন্নত দেশগুলোতেও খনি দুর্ঘটনা কোনো অবাক করা সংবাদ নয়। সাধারণভাবে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত: খনির ভেতর বিষাক্ত গ্যাস, যেমন হাইড্রোজেন সালফাইড; বিস্ফোরক প্রাকৃতিক গ্যাস যেমন মিথেন, ডাস্ট এক্সপ্লোশন, খনি ধস, খনিজ উত্তোলন জনিত ভূ-কম্পন, খনির ভেতর বন্যার পানি প্রবাহ, যান্ত্রিক গোলযোগ ও ত্রুটি, অনুপযুক্ত বিস্ফোরক ব্যবহার, নাশকতা ইত্যাদি।
চীনের খনি
১৯৪২ সালের ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে চীনের লিয়াও নিং প্রদেশে বেনজিও কয়লা খনিতে প্রাথমিকভাবে একটি অগ্নি প্রজ্জ্বলন থেকে দুর্ঘটনার সূত্রপাত, তাতে ১৫০০ অধিক খনিশ্রমিক নিহত হয়। সে সময় চীনের এ অংশ কার্যত জাপানের দখলে ছিল। তারা খনি শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করছিল। আগুনের শিখা দেখার পর তা যেন আর না ছড়ায় এবং নিভে যায় সে জন্য তার অক্সিজেন চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে তারা ভেন্টিলেশন শ্যাফট বন্ধ করে দেয়, তারপর বন্ধ করে খনিমুখ। এ কাজের আগে কেবল অল্প কিছু সংখ্যক শ্রমিককে খনি থেকে বেরোবার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এটা ঠিক আগুন ভেতরের অক্সিজেন পুড়িয়ে দেয়, কিন্তু বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইডের সৃষ্টি হয় এবং তা ভেতরে ছড়িয়ে যায়। আগুন নিভে যাবার পর খনি মুখ খুলে ভেতরে আটকা পড়া আর কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নিহতদের ১৫১৮ জন চীনা এবং ৩১ জন জাপানি। অধিকাংশ লাশ একটি গণ কবরে সমাহিত করা হয়। যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি বিশেষজ্ঞ দল তদন্ত করে জানায়, মৃত্যুর কারণ অগ্নিকান্ড নয়, খনির ভেতরে আগুনের কারণে সৃষ্ট কার্বন মনোঅক্সাইড এতোগুলো মানুষের জীবন হরণ করেছে।
শানজি কোল মাইন
২৮ মার্চ ২০১০ শানজি কয়লার খনিতে ফাটল ধরে পানি প্রবেশ করে। এতে সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ২৬৯ জন খনি শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তবে বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটি আরো বড়। দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ জানায় তারা ১০৮ জন শ্রমিককে উদ্ধার করেছে এবং ১৪৩ জন খনিতে আটক পড়ে আছে। ৫ এপ্রিল তার আরও ১১৫ জনকে উদ্ধার করে। বেঁচে আসা কয়েকজন জানায় তারা পুরোপুরি ডুবে গেলেও খনির ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে নিজেদের বেল্ট খনির পাথরের সাথে আটকে স্রোতে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়।
খনি দুর্ঘটনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রও লুকিয়েছে। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার খনিতে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসেবে ৩৬২; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ৫০০র কাছাকাছি।
ফ্রান্সের খনি
১০ মার্চ ১৯০৬ ফ্রান্সের কুরিয়ার্স খনি দুর্ঘটনায় ১০৯৯ জনের মৃত্যু ঘটে। দুর্ঘটনার কারণ ভূগর্ভে একটি কয়লার স্তরের আগুন থেকে ব্যাপক বিস্ফোরণ হয়। আগুন সনাক্ত হয় খনির ২৭০ মিটার গভীরে। কোনো খনি শ্রমিকের ল্যাম্প থেকে মিথেন গ্যাসে আগুন ধরলে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং বিস্ফোরণ ঘটলে খনির ভেতরের সকলেই এবং খনি বাইরে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকের মৃত্যু ঘটে।
জাপানের খনি
মিতশুবিশি হোইও কয়লা খনি জাপানের কিউসু দ্বীপে। ১৫ ডিসেম্বর ১৯১৪ খনির ভেতরে গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটলে ভেতরে ও বাইরে ঘন কালো বিষাক্ত ধোয়া ছড়িয়ে পড়ে, তাতে ৬৮৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
৯ নভেম্বর ১৯৬৩ জাপানের মিৎসুই মাইক কয়লা খনিতে বিস্ফোরণ ৪৫৮ জনের মৃত্যু ঘটে এবং ৮৩৩ জন আহত হয়। খনির ৫০০ মিটার তলদেশে বিস্ফোরণে খনন করা টানেল ধসে পড়ে, তাতে অনেকেই চাপা পড়ে যায় তবে বৃহদাংশের মৃত্যুর কারণ বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস।
জিম্বাবের খনি
৬ জুন ১৯৭২ জিম্বাবের ওয়াঙ্কি কয়লা খনি বিপর্যয় ৪২৬ জনের মৃত্যু ডেকে আনে। দুর্ঘটনা ঘটে এবং সেকেন্ড মাইন শ্যাফটে, যুগপৎ বেশ ক'টি বিস্ফোরণ ঘট। তবে শ্রমিকদের মৃত্যু হয় মিথেন ও কার্বন মনোক্সাইডে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে
ভারতের খনি
ভারতে ঝাড়খন্ড রাজ্যে ধানবাদের কাছাকাছি চাসনালা কয়লার খনিতে কোল ডাস্ট এক্সপ্লোসনে খনির উপরিভাগ এবং একটি পানির রিজার্ভার ধ্বংস হয়ে যায়। খনির ভেতরে পানি ঢুকে পড়ে। ৩৭২টি মৃত্যুর অধিকাংশই ঘটেছে পানির অতলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। ভারতের চিনাকুরি খনি দুর্ঘটনায় ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ সালে ১৮২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
প্রসঙ্গ : বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে নিকটবর্তী কয়লার খনিটি ঢাকা থেকে আকাশপথে ২০০ মাইল দূরে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের রানিগঞ্জে। ১৭৭৪ সালে প্রথম এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়। ১৯০৩ সালে ভারতে উত্তোলিত মোট কয়লার পাঁচ ভাগের দু'ভাগেরও বেশি রানিগঞ্জ খনি থেকে। রানিগঞ্জ সন্নিহিত এবং একই ধরনের ভূ-তাত্ত্বিক গঠনের অঞ্চল বলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলও কয়লা সমৃদ্ধ বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। ১৯৬৯ সালের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ থেকে বেরিয়ে আসে জয়পুরহাট মহকুমার (এখন জেলা) জামালগঞ্জ-পহাড়পুর ভূগর্ভে ১০০০ মিলিয়ন মেট্রিক টনেরও বেশি কয়লা মজুত আছে। জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রের পরিমান প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার।
কয়লার প্রধান ব্যবহার বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বাংলাদেশে কয়লা ভিত্তিক নির্মিত ও নির্মিয়মান পাওয়ার স্টেশন ২৯টি। তবে প্রকৃতপক্ষে নির্মিত কোল ফায়ার্ড পাওয়ার স্টেশন একটি- দিনাজপুরের দুর্গাপুরের বড়পুকুরিয়া পাওয়ার স্টেশন। এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। নির্মিয়মান তিনটি হচ্ছে: কক্সবাজার মহেশখালির মাতারবাড়ি পাওয়ার স্টেশন (১২০০ মেগাওয়াট) পটুয়াখালির কলাপাড়ার পায়রা থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট (১৩২০ মেগাওয়াট) এবং বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট (১৩২০ মেগাওয়াট)। রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্টে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষতি কি হবে তার বিবরণ দেওয়া আন্দোলনের রেশ এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
দেরিতে হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রী বলছেন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। সুতরাং ২০০৮ সালে তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দেওয়া ১৮টি কোল পাওয়ার্ড পাওয়ার প্ল্যান্টের ১০টি ১৩ বছর পর বাতিল করেছেন। যে কারণগুলো বলেছেন সেগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সবার আগে বাতিল হবার কথা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
একটি কয়লা চুরি উপাখ্যান
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের কর্তাব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লার অগ্রহণযোগ্য ঘাটতি সৃষ্টি করে আত্মসাৎ করেছেন, এর মধ্যে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার মেট্রিকটন আত্মসাতের মামলা হয়েছে। কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশন স্বতোপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে দেখা যায় চুরি কিংবা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি করে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে কয়লা বিক্রির নীতিমালা তৈরি করায় ঢালাওভাবে কয়লা খোলা বাজারে বিক্রি অব্যাহত রাখে, কোল ইয়ার্ডে কয়লার কোনো মজুদ না থাকার পরও মজুদ আছে দেখিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়: বাস্তবে না থাকায় বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় এবং উত্তরবঙ্গ বিদ্যুৎ সঙ্কটে পড়ে। অগ্রহণযোগ্য সিষ্টেম লসের হিসেব দেখিয়ে ৫.৫৮ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লা হদিসবিহীন হয়ে যায়। প্রতিবেদনে বোঝা যায় স্বেচ্ছামূলক ময়েশ্চার মাত্রা কমিয়ে বিপুল পরিমাণ কয়লা সিস্টেম লসের উপর দিয়ে আত্মসাতের ফাঁদ তৈরি করা হয়। ধোঁয়াটে এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে খনিজ সম্ভাবনাও জনগণের লাভবান হবার সম্ভাবনা দুই দুর্নীতির কারণে বিনষ্ট হচ্ছে।
একটি ব্যক্তিগত পাদটীকা
ষাটের দশকে প্রথমার্ধে একদিন অফিস-ফেরত আমার বাবার কাছে শুনলাম, আর চিন্তা নেই। বগুড়াতে কয়লার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে (এখনকার ভৌগলিক পরিচিতিতে জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জে)।
সে কালে অনেকেই কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতেন। সুতরাং আমি ধরেই নিলাম দাঁত মাজার কয়লার আর অভাব হবে না।
কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা
কিন্তু আমার উচ্চাভিলাষী ও স্বপ্নপ্রবণ বাবা বললেন ভিন্ন কথা- কয়লার খনিতেই হীরা পাওয়া যায়। কোহিনূর-এর মতো কিছু হীরা পেলে বাঙ্গালিদের আর পায়কে? এই খনিই আমাদের সবার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবে।
কয়লা যে জ্বালানি শক্তি, বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে স্টিম ইঞ্জিন চালানো, ইস্পাত বানানো, ইটের ভাটায় আগুন জ্বালানোসহ হাজারো কাজ করে তার কোনোটিই আমাদের আলোচনায় এলো না। আমার বাবা দেখলেন আলো ছড়ানো মহামূল্য হীরকখন্ড। আমি দেখলাম কয়লার গুঁড়োপ্রলিপ্ত দাঁত।
দাঁত মাজতে কয়লার চাহিদা ফুরিয়ে গেছে যদিও বড় পুকুরিয়া কয়লার খনিতে সাগরচুরির মতো কয়লা লোপাটের ঘটনার পর একটি কোলাজ কার্টুন বেরিয়েছিল- ছিন্নবস্ত্র একজন বিপন্ন নারী কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছে আর বড় পুকুরিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যবস্থাপক বলছেন, এ ভাবেই এই নারী খনির লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লার অপচয় কিংবা আত্মসাৎ করেছে।
হীরকের স্বপ্ন
বাকী রয়ে গেল হীরকের স্বপ্ন। কিন্তু তাও ভেঙ্গে গেল যখন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে পড়লাম কয়লার খনিতে হীরক পাবার ব্যাপারটি একটি জনপ্রিয় মিথ মাত্র। কয়লার সাথে হীরার কোনো সম্পর্ক থাকার কারণ নেই। কয়লার সৃষ্টি জৈবিক প্রক্রিয়ায় বৃক্ষ থেকে, আর পৃথিবীর সর্বশেষ আবিষ্কৃত হীরক খন্ড কিংবা হীরকচূর্ণও পৃথিবীর সর্ব প্রথম বৃক্ষের চেয়ে লক্ষ বছর বেশি বয়সী। পৃথিবীর প্রথম আবিষ্কৃত হীরক খনিতে কিম্বারলাইট পাথরেই মেলে হীরক।
কয়লার খনিতে হীরক সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে। সত্যটি তিনি জেনে যাননি। আর কয়লার বেপরোয়া ব্যবহার যে পৃথিবীকে অনেকটা বিপন্ন করে ফেলেছে এটা তিনি বিশ্বাস করেননি। বরাবরই বলেছেন, এসব ধনী দেশের ষড়যন্ত্র, নিজেরা কয়লা ব্যবহার করে উন্নত হবে, গরীব দেশগুলোকে কয়লা ব্যবহার করতে না দেবে না।