গণ ইসলামগ্রহণ: তত্ত্ব এবং প্রবক্তাগণ
বাঙালি মুসলিম কৃষককূলের আবির্ভাব
বাঙলায় ইসলামীকরণের ইতিহাস লিখনধারার লক্ষণীয় একটা দিক হলো আগের কিস্তিগুলোয় আলোচিত এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের যারা প্রণেতা - অভিবাসন, তরবারি, পৃষ্ঠপোষকতা, সামাজিক মুক্তি - তারা তাদের তত্ত্বকে সামান্য মাত্রায়ও মৌলিক তথ্যপ্রমাণের ওপর দাঁড় করাননি। কিংবা কখন এবং কোথায় প্রথম ইসলাম একটি জনসাধারণের ধর্মে পরিণত হলো তা প্রতিষ্ঠা করার কোনো চেষ্টাও তারা করেননি। ইসলামে গণধর্মান্তর ব্যাখ্যা করতে পারার আগে প্রথমেই যতখানি সম্ভব নিখুঁতভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে ঠিক কখন এবং কোথায় প্রথম বাঙালি মুসলমান কৃষককূলের আবির্ভাব ঘটলো, কেননা যে কোন সামঞ্জস্যপূর্ণ ঐতিহাসিক পুনর্গঠনকে অতি অবশ্যই স্থাপিত হতে হয় ভূগোল এবং সময়ক্রমের প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলোর ওপর।
কোন অভিমুখ থেকে বদ্বীপটিতে প্রথম ইসলামী প্রভাব পৌঁছুলো সে প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরের মানচিত্রের দিকে সামান্য দৃষ্টিপাতে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সামুদ্রিক সংযোগের ইঙ্গিত মিলতে পারে। এটা সত্যি যে, সুলাইমান তাজির (মৃত্যু ৮৫১), ইবন খুরদাদভি (মৃত্যু আনু. ৮৫), মাসুদী (মৃ ৯৫৬) এবং ইদ্রিসি (আনুমানিক ১১৫০) এর মত আরব ভূগোলবিদরা বাংলার বিষয়ে অবগত ছিলেন। এই ভূগোলবিদদের মাঝে মাসুদী বাংলায় মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা দশম শতকে সেখানে বাস করতেন। মাসুদী কথিত এই মুসলমানরা স্পষ্টতই দূরসমুদ্রগামী সওদাগর। ভারত মহাসাগরের বৃহত্তর জগতের সাথে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সংযুক্তিরই আরও ইঙ্গিত মেলে চন্দ্র রাজবংশের আমলে (আনুমানিক ৮২৫ -১০৩৫) দক্ষিণপূর্ব বাংলায় স্থানীয় মুদ্রার প্রচলন এবং লালমাই অঞ্চলে আব্বাসীয় মুদ্রার আবিষ্কার থেকে, এটি এমন একটা সময় যখন ওই মহাসাগরের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো আরব মুসলমানরা। যাহোক, সুন্নী ইসলামের হানাফি-শাফায়ী-মালিকি-হাম্বলি এই চারটি মজহাব দুনিয়া জুড়ে যেভাবে বন্টিত আছে তা পর্যবেক্ষণ করলে এই ইঙ্গিতই মেলে যে ইসলামীকরণ এখানে সমুদ্রপথে ঘটেনি। সাধারণভাবে ইসলামী দুনিয়ায় ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠীর মাঝে ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলটিতে ইসলামের যারা বাহক, তাদের অনুসৃত মযহাবটি গ্রহণ করার একটা প্রবণতা দেখা গেছে।
দশম শতকের পর থেকে দক্ষিণ ও পশ্চিম আরবে শাফায়ী মাজহাবের আধিপত্য ছিল, আরব উপদ্বীপের ওই অঞ্চলটিই ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত ছিল। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল, ভারতের মালাবার উপকূল এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বীপাঞ্চলে শাফায়ী আরবদের সাথে বাণিজ্যিক সংস্পর্শের মাধ্যমে ইসলামীকরণ ঘটে। ১৫০০ সাল নাগাদ এই সবগুলো এলাকাই শাফায়ী মযহাবের অনুগামী হয়। বাংলাও যদি প্রধানত শাফায়ী মাযহাবভুক্ত সমুদ্রগামী আরবদের মাধ্যমে কিংবা এই আরবদের সংস্পর্শে থাকা অন্যান্য সমুদ্রগামী মুসলমানদের মাধ্যমেই ইসলামীকৃত হতো, তাহলে বাংলার মুসলমানরাও শাফায়ী মাজহাবের অনুসারী হবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত হবার কথা। কিন্তু ১৫০০ নাগাদ এবং তার পরবর্তীকালেও বাংলার মুসলমানরা ছিলেন প্রধানত হানাফি, এখনকার মতই তখনো এটাই গাঙ্গেয় সমভূমির আরও ওপরে এবং পুরো মধ্যএশিয়া জুড়ে মহাদেশের অভ্যন্তরভাগের মুসলমানদের মাঝেও প্রাধান্যশীল মাযহাব। এটা পরিস্কার ভাবেই স্থলপথ ধরে উত্তরপশ্চিম দিক দিয়ে বাংলার ইসলামীকরণের সূত্রপাতের দিকেই ইঙ্গিত করে।
কিন্তু কখন এবং কিভাবে এটা ঘটলো? যদিও দাবি করা হয় যে, সুদূর অতীতে বাংলার মুসলিম জনসাধারণের উদ্ভব ঘটেছে, কিন্তু প্রাথমিক উৎসগত উপাদানগুলো থেকে এই প্রস্তাবনার পক্ষে কোনো সমর্থন মেলে না, অন্তত কৃষককূলের বেলায় এ কথাটি প্রযোজ্য, আর এরাই জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ। একটা মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলার মুসলিম বিষয়ে ষোড়শ শতক পূর্ববর্তী বিদেশী সবগুলো সূত্রে কেবলমাত্র অভিবাসী বা নগরবাসী মুসলমানদের - অর্থাৎ আশরাফ সমাজের, উল্লেখ মেলে। ব্যতিক্রমটি হলো ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্ত, প্রসিদ্ধ দরবেশ শাহ জালালের সাথে দেখা করবার জন্য তিনি ১৩৪৫ সালে সিলেট সফর করেছিলেন। সুখ্যাত এই আরব পর্যটক পরবর্তীকালে লিপিবদ্ধ করেন যে, "এই পাহাড়গুলোর অধিবাসীরা তার [শাহ জালালের] হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, এবং এই কারণে তিনি তাদের মাঝে থেকে গেছেন।'' কিন্তু ইবনে বতুতা এখানে একটি কৃষক জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করছেন কি-না সেটা আদৌ স্পষ্ট না। তার বর্ণনানুসারে সমতলের নয়, পাহাড়ী মানুষেরা শাহ জালালের মধ্যবর্তিতায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এই পাহাড়ের বাসিন্দারা সম্ভবত জুম চাষ করতো, কেননা তিনি এই জনগোষ্ঠীকে নিচু ভূমিতে রোপা আমন চাষ করা কৃষকদের থেকে পৃথক করেছেন বলেই মনে হয়, দ্বিতীয়োক্তদের তিনি পরিস্কারভাবেই হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ইবনে বতুতার প্রায় ৯০ বছর পর ১৪৩৩ সালে এই বদ্বীপ সফর করা চীনা রাজকর্মচারী মা হুয়ান হলেন পরবর্তী ভিনদেশী যিনি বাংলায় মুসলমানদের পর্যবেক্ষণ করেন। এই সময়ে রাজা গনেশের উত্তাল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সদ্যমাত্র থিতিয়ে এসেছে এবং সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ এমন একটি ইসলামী সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া শুরু করেছেন যেটি আবার বাঙালী প্রতিবেশ দ্বারাও বিপুলভাবে প্রভাবিত। চট্টগ্রাম থেকে সোনারগাঁও হয়ে পাণ্ডুয়া পর্যন্ত তার সফর কালে চীনা এই পরিব্রাজক ঘনবসতিপূর্ণ এবং উন্নতিশীল একটি জনগোষ্ঠীকে দেখতে পান। কিন্তু অধিবাসীদের সম্প্রদায়গত বা ধর্মীয় পরিচয় বিষয়ে তার একমাত্র মন্তব্যটি পাণ্ডুয়া নগরটির প্রেক্ষিতে রচিত, যেখানে তিনি দেখতে পেলেন "রাজপ্রাসাদ এবং অভিজাতদের বড় ও ছোট প্রাসাদ এবং উপাসনালয় সব কিছুই নগরে আছে। তারা মুসলমান।'' যে একমাত্র মুসলমানদের কথা এই বিদেশী উল্লেখ করেছেন, তারা কৃষক নন, নগরবাসী।
১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার সমুদ্রপথে ভারতে আগমনের পরবর্তী কালপর্বে ষোড়শ শতকের শুরুতে আমরা বাংলা এবং তার মানুষজন নিয়ে প্রথম দিককার ইউরোপীয় বিবরণগুলো পেতে থাকি। কিন্তু আবারো, বদ্বীপের মুসলমানদের প্রসঙ্গে এই লেখকেরা দৃশ্যত কোনোই গ্রামীন জনগোষ্ঠী নয়, কেবলমাত্র নগরবাসী মুসলমানদের বিষয়ে অবগত ছিলেন। ১৫০৩ এবং ১৫০৮ এর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে গৌড় সফর করেছেন বলে দাবি করা লুডভিকো ডি ভার্থেমা নগরটি সম্পর্কে লিখেছেন যে "এ যাবৎ আমি যতগুলো নগর দেখেছি তাদের মাঝে এটি ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ, এর বিস্তৃতি অত্যন্ত বিশাল," তিনি আরো যুক্ত করেছেন যে দুই লক্ষ সৈন্যের সমবায়ে গঠিত সুলতানের সেনাবাহিনীর সকলেই ছিল মুসলমান। ১৫১২-১৫১৫ সালের মাঝে লিখতে গিয়ে টম পিরেস - সংশয়াতীতভাবেই তার লেখার ভিত্তি ছিল বাংলায় সফরকরা বণিক ও জাহাজের অধ্যক্ষদের প্রতিবেদন - মন্তব্য করেন যে, রাজা "একজন অত্যন্ত ধার্মিক মুসলমান" এবং "এই রাজ্যের রাজারা তিনশত বছর আগে মুসলমান হয়েছেন।'' কিন্তু পিরেস সাধারণভাবে জনগোষ্ঠীর ধর্ম নিয়ে কোন কিছু উল্লেখ করেননি।
পিরেসের সমসাময়িক দুয়ার্তে বারবোসার বাংলা অঞ্চল বিষয়ক রচনাগুলোও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ নয়, পর্যটকদের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে সেগুলো রচিত। সেখানে গৌড়ের 'সম্মানিত মুর'দের অঢেল বিবরণ আছে, তার বর্ণনা অনুযায়ী যারা 'সাদা কটিবন্ধযুক্ত কুচিওয়ালা আলখাল্লা, রেশমী মস্তকাবরণ আর রুপা এবং সোনার খাপওয়ালা ছুরির বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে' হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তার লেখায় এদের উত্তম আহার্য, যথেচ্ছ ব্যয়, এবং 'আরও বহু রকমের অমিতব্যয়' প্রভৃতির উল্লেখ পরিস্কারভাবেই গ্রামীণ সমাজ নয়, নগরবাসী ধনাঢ্য বণিকদের দিকেই ইঙ্গিত করে। বস্তুত বারবোসা গৌড় নগরীকে শ্বেতকায় অধ্যুষিত একটি নগর হিসেবে বলেছেন যেখানে 'আছেন আরব, পারসি, আবেক্সিসয় এবং ভারতীয়সহ নানান দেশী আগন্তুক।' তথাপি তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন যে 'এই অংশের পৌত্তলিকরা তাদের শাসকদের আনুকূল্য পেতে নিয়মিতভাবেই মুরদের ধর্মগ্রহণ করেন"-এটাই ইসলামীকরণের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার তত্ত্বের সমর্থনে সমকালীন একমাত্র নিদর্শন হিসেবে দৃশ্যমান। কিন্তু যেহেতু তিনি রাজধানী শহরটির প্রেক্ষিত ছাড়া কখনোই মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেননি, ফলে বারবোসা দৃশ্যত এখানে কৃষকদের ইসলামীকরণ বিষয়ে বলছেন না, বরং বলছেন সেইসব হিন্দু কারিগর সম্প্রদায়ের কথা অন্যান্য উৎসগুলো যাদেরকে সালতানাতের নগরবাসী সর্বহারা শ্রেণির অর্ন্তভুক্ত করেছে।
গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ষোড়শ শতক থেকে, এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে মোঘল বিজয়ের (১৫৭৪) পর বাংলার কোন অঞ্চলে একটি কৃষক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির শক্ত নিদর্শন মেলে। সবচেয়ে পুরনো উল্লেখটি হলো ভেনেশীয় পর্যটক সিজার ফেডেরিসির, তিনি ১৫৬৭ সালে খেয়াল করেন যে, বাংলার দক্ষিণপূর্ব কোনে চট্টগ্রামের উল্টোদিকে অবস্থিত সন্দ্বীপ নামের বড়সড় দ্বীপটির সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী ছিল মুসলমান এবং এটার নিজস্ব মুসলমান 'রাজা' ছিল। ফেডরিসি সন্দ্বীপ দ্বীপটির কৃষিকর্মের অগ্রগতি দেখেও বিস্মিত হন, তার বিচারে যেটি 'পৃথিবীর মাঝে উর্বরতম দ্বীপ'।
ফেডরিসির সফরের পর খুব বেশি দিন অতিবাহিত হবার আগেই ১৫৯৯ সালের এপ্রিল মাসে ফ্রান্সিস ফার্নান্ডেজ নামের একজন জেসুইট ধর্মপ্রচারক সুসমাচার প্রচারের উদ্দেশ্যে পূর্ববাংলার মেঘনা নদীর উজান বেয়ে ভ্রমণ করেন, তিনি স্থানীয় মানুষের রীতিনীতি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ এবং তাদের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীতে পরিণত করার সম্ভাবনা যাচাই করছিলেন। দক্ষিণপূর্ব ঢাকা জেলার নারায়নগঞ্জের নিকটবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে ফার্নান্দেজ লিখেছেন যে "আমি যাচাই করা শুরু করলাম খ্রিস্ট ধর্ম বিস্তারের আদৌ কোন সুযোগ আছে কি না, কিন্তু আমি দেখলাম মানুষজন প্রায় সবাই মুসলমান।'' এটাই বদ্বীপের যথার্থ হৃৎকেন্দ্রে মুসলিম কৃষককূলের উপস্থিতির আদিতম সংশয়াতীত উল্লেখ।
সতেরো শতকের বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলার গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের দৃশ্যমানতা বিষয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছেন, এবং খেয়াল করেছেন যে, ইসলামের প্রসারটি খুব সাম্প্রতিককালের, মোঘল বিজয় থেকেই কেবল এর সূচনা। মোঘল শক্তি ইতিমধ্যে বদ্বীপে দৃঢ়ভাবেই স্থাপিত হয়ে যাবার পর, ১৬২৯ সালে অগাস্টিনিয় ধর্মপ্রচারক সেবাস্টিয়ান মানরিক লিখছেন "শুরুর দিকে বাংলার সবগুলো রাজ্যই পৌত্তলিক পূজাপদ্ধতির অনুসারী ছিলো, যেমনটা তাদের বেশিরভাগ এলাকায় এবং এখনও তাদের অধিকাংশ মানুষ অনুসরণ করে থাকে। যাহোক, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এই অঞ্চলটি মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হবার পর এরা পৌত্তলিক বিশ্বাস এবং নরকগামী কঠিন পথটি ত্যাগ করেছেন প্রশস্ততর এবং সহজতর সড়কটি গ্রহণ করতে, যেটি আল কোরানের পথ।" ১৬৬৬ সালে ফরাসি পর্যটক জঁ দ্য তেভেনো একই কথা বলেছেন এবং সতেরো শতকের ইউরোপীয়দের স্বভাবসুলভ একই রকম মুসলিম বিরোধী মনোভাবও প্রদর্শন করেছেন:
দেশটি [অর্থাৎ বাংলা] পাঠান রাজাদের অধীনে, (আমি বোঝাতে চাইছি) মুহাম্মদীয় ও মোঘলরা এর মালিক হবার আগে অনেক ভালো শৃঙ্খলায় ছিল, কেননা তখন তাদের ধর্মের অভিন্নতা ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে যে, বিশৃঙ্খলা এখানে মুহাম্মদীয় ধর্মের সাথে এসেছে এবং ধর্মের বৈচিত্র এখানে আচার-আচরণের কলুষতা এনেছে।
মানরিকের মতই তেভেনো নিজেও বাংলার প্রাকমোঘল যুগকে বুঝেছেন ইসলামপূর্ব সময় যুগ হিসেবেও, এবং বিশ্বাস করতেন যে কেবল মাত্র মোগল বিজয়ের পরই ইসলাম বাংলায় প্রাধান্যশীল হয়েছে, যে বিজয়টি ঘটেছে তার রচনার মোটামুটি এক শতাব্দী আগে। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে ইউরোপীয়রা পুরাতন, ইতিমধ্যেই হিন্দুকরণকৃত পশ্চিমভাগে নয়, কেবল দ্বীপের পূর্বভাগটিতেই ঘনসঙ্গবদ্ধ আকারে মুসলিম কৃষকদের দেখতে পেয়েছেন। কেননা ১৬৯৯ সালে, ফার্নান্দেজ ঢাকার গ্রামীন জনপদে মুসলিমদের সাক্ষাৎ পাবার ঠিক একশত বছর পর আরেকজন জেসুইট পাদ্রী মার্টিন এসজে, যিনি আমরা যতদূর জানি কেবল মাত্র পশ্চিমবাংলার হুগলি অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন, লেখেন যে, 'প্রায় পুরো দেশটিই পৌত্তলিকতার অনুসারী।''
অন্যান্য সমসাময়িক উপাত্ত থেকেও মানরিক ও তেভেনোর এই সাধারণীকৃত বিষয়টি সুনিশ্চিত হয় যে মোঘল বিজয়ের আগ পর্যন্ত জনসাধারণের মাঝে ইসলামীকরণ দৃশ্যমান হয়নি। এই বিষয়ে খানিকটা উল্লেখ পাওয়া যাবে এমন পুরনোতম পারসিক উৎসটি ১৬৩৮ সালের, যেখান বাংলায় মোঘল সুবাদার ইসলাম খান মাসহাদি আরাকানের রাজার কাছে নোয়াখালি উপকূলে পর্তুগীজদের হামলা বিষয়ে অভিযোগ করছিলেন। সেখানে সুবাদার লেখেন যে, পর্তুগীজরা 'মুসলিম জনসাধারণের ওপর লুণ্ঠন' পরিচালনা করছে। ১৬৬০ সালে আরেকটি মোঘল সূত্র কাজিম বিন মোহাম্মদ আমীন রচিত আলমগীরনামার বিবরণ অনুযায়ী ঘোড়াঘাটের অধিকাংশ কৃষক ছিলেন মুসলমান, এটি এখনকার উত্তর বাংলার রংপুর অঞ্চল।
সারসংক্ষেপ
ষোড়শ শতকের শেষ নাগাদ কিংবা তারও পরেরকার সময়ের আগ পর্যন্ত বিশাল সংখ্যায় গ্রামীন মুসলমান যদি পরিলক্ষিত না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা একটা কূটাভাষের মুখোমুখি হই - সেটা এই যে, এই গণধর্মান্তর ঘটলো এমন একটা শাসনের অধীনে, অর্থাৎ মোঘলদের অধীনে, যারা নীতিগত বিষয় হিসেবেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করায় কোন আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। তলা-ভারী একটি কৃষিনির্ভর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশাল একটি সাম্রাজ্য শাসন কালে মোঘল কর্মকর্তাদের প্রাথমিক আগ্রহ ছিল দেশটার উদ্বৃত্ত সম্পদ যতখানি সম্ভব শোষণ করে কৃষির উৎপাদনশীলতা জোরদার করা, এবং সেই সম্পদ প্রশাসনের সকল স্তরে কৃপাপ্রার্থী সৃষ্টি করার রাজনৈতিক লক্ষ্যে ব্যবহার করা। 'বিধর্মী' হিন্দুদের 'ইসলামে ধর্মান্তরিত করার সম্রাটের' 'দায়িত্ব' বিষয়ে জোরাজুরি করা রক্ষণশীল 'উলামাবৃন্দ' অবশ্য সেখানে সর্বদাই ছিলেন, তারপরও তেমন কোনো একটা নীতি বাস্তব ক্ষেত্রে বাংলায় কার্যে পরিণত করা হয়নি, এমনকি আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) রক্ষণশীল শাসনামলেও না।
কাজেই বাংলায় মোঘল আমলের প্রতি আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। এটা কি স্রেফ একটা কাকতাল যে বদ্বীপের কৃষিজীবী মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটলো মোঘল শাসনের সূচনার পর থেকে, না কি আরও গভীরতর বলসমূহ এই দুই প্রপঞ্চকে এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছিল?
(চলবে)
রিচার্ড এম. ইটন
অনুবাদ: ফিরোজ আহমেদ
[প্রবন্ধটি রিচার্ড এম ইটনের রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দা বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। বাংলা অনুবাদ স্বত্ত্ব ইউপিএল কর্তৃক সংরক্ষিত]