চায়ের পিয়াসী পিপাসিত চিত্ত
গানটি যেনতেন কবির নয়, কাজী নজরুল ইসলামই লিখেছেন।
চায়ের পিয়াসী পিপাসিত চিত্ত আমরা চাতক দল
দেবতারা কন সোমরস যারে সে এই গরম জল
চায়ের প্রসাদে চার্ব্বাক ঋষি বাক-রণে হল পাস
চা নাহি পেয়ে চার পেয়ে জীব চর্ব্বন করে ঘাস।
হোক হাসির গান, ভাগ্য আমাদেরই, চা পাই বলেই তো দুপেয়ে জীব হিসেবে বহাল আছি, ঘাস চর্বণ করতে হচ্ছে না।
বনমালীর হাতের চা দিয়ে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিন শুরু হতো। চা-কৃতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ কতটা চা-পিয়াসী চীন ও জাপানের রবি-সমজদারেরাও তার সাক্ষ্য দেবেন।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যত চা-বিরোধীই হোন না কেন, চায়ের কুফল নিয়ে লেখা তার প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ একাধিক বার পাঠ করে থাকলেও বিজ্ঞানীর কথায় ইমান আনতে পারেননি। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণের কোনার্ক নামের বাড়িটির বারান্দা তো খ্যাত হয়েছে চায়ের কারণেই। বিখ্যাত সব টি-পার্টি এখানেই বসত। ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা জাতপাতের বিচারে খানিকটা হীনমানের পিরালী ব্রাহ্মণ হলেও চা পানের কৌলিন্যে খানদানি ব্রাহ্মণদের চেয়ে ঢের অগ্রগামী ছিলেন। তা ছাড়া মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমল থেকে ব্রাহ্মণের 'ণ' খসিয়ে পরিবারটি ব্রাহ্ম হয়ে যায়। বলা আবশ্যক, সে কালের নামী চা ব্যবসায়ীদের মধ্যে মতিলাল শীল ও হাজি হাশিমের পাশে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নামও এসে যেত।
চায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই রবীন্দ্রনাথ ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ লিখে ফেললেন একটি চা-সংগীত:
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল' চল' চল' হে।
টগবগ উচ্ছল কাথলিতল জল কল কল হে।
এল চীনগগন হতে পূর্ব পবন স্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ।
শ্রাবণবাসরে রস ঝর ঝর ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে।
...
এস কনসটিট্যুশন নিয়মবিভূষণ তর্কে অপরিশ্রান্ত
এস কমিটি পলাতক বিধানঘাতক এস দিকভ্রান্ত টলমল হে।
উপমহাদেশের প্রাচীনতম সজীব চা-বাগান মালনিছড়া টি এস্টেট
বাংলাদেশের চা-রাজধানীর নাম শ্রীমঙ্গল
বাংলাদেশ টি বোর্ডের হিসাবে আমাদের চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৭। চা বিক্রির পরিমাণ, চায়ের নিলাম দরÑএসব বিবেচনায় দেশের সেরা দশটি চা-বাগানের তালিকা (২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী টি বোর্ডের প্রকাশনা থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে :
খৈয়াছড়া চা-বাগান (৮৪৩৭৯০ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২৫৩.০৯ টাকা)
মধুপুর চা-বাগান (১২৫৫৭৩০ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২৪৬.০১ টাকা)
দারাগাও চা-বাগান (৭৪১৪২২ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২৩৮.১২ টাকা)
আমরাইল চা-বাগান (৯৫৮৮১৪ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২৩১.৯২ টাকা)
ক্লিভডন চা-বাগান (৬১৩৩৮৭ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২৩০.৯৩ টাকা)
কর্ণফুলী চা-বাগান (১৮৭৭৫৯০ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২১৪.০০ টাকা)
বালিচেরা চা-বাগান (১৭৩০০৩৭ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২১৯.৯৪ টাকা)
জেরিন চা-বাগান (৫৫৫১০৫ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২১০.৭৩ টাকা)
নেপচুন চা-বাগান (১০৪৭৪৪৩ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২১০.৬০ টাকা)
মির্জাপুর চা-বাগান (১০৮৫২৭২ কেজি, দর কেজিপ্রতি ২১০.৩৬ টাকা)।
পরবর্তী দশটি চা-বাগান হচ্ছে: গাজীপুর চা-বাগান, ডিনস্টোন চা-বাগান, রাঙামাটি চা-বাগান, কোদালা চা-বাগান, বারমাসিয়া চা-বাগান, রশিদপুর চা-বাগান, রাজঘাট চা-বাগান, লস্করপুর চা-বাগান, রারাউড়া চা-বাগান এবং ডিউন্ডি চা-বাগান।
আন্তর্জাতিক চায়ের বাজারে বাংলাদেশের উচ্চমান চায়ের সুনাম রয়েছে। উপমহাদেশের প্রাচীনতম সজীব চা-বাগান মালনিছড়া টি এস্টেট বাংলাদেশের সিলেট জেলাতে। ১৮৪৯ সালে লর্ড হাডসন ১৫০০ একর জমিতে এই চা-বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু সিলেটে নয় রাঙ্গামাটি ও পঞ্চগড়ের তিনটি উপজেলায় চা-বাগান রয়েছে। বৈশি^ক উৎপাদনের ৩ ভাগ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে, এই খাতে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। জাতীয় উৎপাদনের ১ শতাংশ আসে চা খাত থেকে।
বৃহত্তর সিলেট চা-গাছ জন্মের বহু শর্ত পূরণ করলেও ইউরোপীয় প্ল্যান্টাররা ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে প্রথম চায়ের চাষ করেন, ১৮৪৩ সালে পরিণত পাতা থেকে কর্ণফুলিসংলগ্ন এলাকায় প্রথম নিজ দেশে উৎপাদিত চায়ের স্বাদ মুখে তোলার সুযোগ হয়। মূলত চা ব্যবসা সম্প্রসারণের স্বার্থেই আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে সুরমা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত চালু হয়েছিল।
৪ জানুয়ারি ১৮৫৬ সিলেট চা আবিষ্কৃত হয়। প্রথম আবিষ্কারক মোহাম্মদ ওয়ারিশকে বাংলার লেফটেনেন্ট গভর্নর ৫০ টাকা পুরস্কার দেন। এর পরপরই বাণিজ্য সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় এনে ইংরেজ বণিকেরা সিলেটের দিকে আসতে থাকে।
বাংলাদেশের চায়ের বাগানে ইউরোপিয়ানদের আধিপত্যের একটি চিত্র উঠে এসেছে ১৯১০ সালে প্রকাশিত টেলর ম্যাপস অব দ্য টি ডিস্ট্রিক্টস: সিলেট উইথ ফুল ইনডেক্স-এ :
ইউরোপিয় মালিকানাধীন কোম্পানি | জমির পরিমাণ (একর) |
জেমস ফিনলে | ২৬৯৩৫ |
অক্টাভিয়াস স্টিল | ১৪৭৭৬ |
ম্যাকলিয়ড অ্যান্ড কোম্পানি | ৫৩৩৭ |
শ অ্যান্ড ওয়ালেস | ৪১৮০ |
বার্লো অ্যান্ড কোম্পানি | ৩৫৪১ |
প্লান্টার্স স্টোর্স অ্যান্ড এজেন্সি | ৩০২৮ |
কিং হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানি | ২০১৫ |
ডানকান ব্রাদার্স | ১৮৮৪ |
উইলিয়ামসন অ্যান্ড ম্যাগর | ১২৮০ |
জে ম্যাকিলিক্যাল | ১২১৯ |
ম্যাকনিল | ৮৪৯ |
অ্যান্ডু ইউল | ৭৭৯ |
গ্রিন্ডলে | ৬১৬ |
কিলবার্ন কোম্পানি | ৪০০ |
ওয়েকার | ৩২৭ |
ডব্লিউ ক্রেসওয়েল | ২৫৫ |
ন্যাশনাল এজেন্সি | ২৩৭ |
মোট এলাকা | ৬৮৭৩৭ |
জেমস ফিনলে টি এস্টেট
জেমস ফিনলে কোম্পানির একদা কর্মচারী জন মুর ১৮৮২ সালে নর্থ সিলেট টি কোম্পানি ও সাউথ সিলেট টি কোম্পানি খোলেন। সাউথ টি কোম্পানি পরে ফিনলে অ্যান্ড মুর নামে রেজিস্ট্রার্ড হলেও জেমস ফিনলে নামেই পরিচিত হয়। এই কোম্পানি ৭৭০০০ একর জমি চাষ করার জন্য ৭০ হাজার স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগ করে।
১৮৯৩ সালে ২ কোটি ৬ লক্ষ ২৭ হাজার পাউন্ড চা কেবল সিলেটেই উৎপন্ন হয়। ১৯১০ সালে চাষের অধীনে আনা চা-বাগানের ৯৫ ভাগের মালিকানা ছিল ইউরোপিয়ানদের। মাত্র ৫ ভাগ ছিল জমিদার-জোতদারদের হাতে। ১৯২০-এর দশকে স্থানীয় মালিকানা ১০ ভাগে উন্নীত হয়।
১৯১০ সালের টেলর মানচিত্রে দেশীয় এজেন্ট ও মালিকদের তালিকা :
এজেন্ট/মালিক | টি এস্টেট | টি গার্ডেন |
গগন চন্দ্র পাল | বিদ্যানগর | বিদ্যানগর, চাঁদনিঘাট রামনগর, চুনাভিগুল ও কৃষ্ণনগর |
দত্ত অ্যান্ড সন্স | দক্ষিণগুল | দক্ষিণগুল, বড়লেখা |
এস এন চৌধুরী | গোবিন্দপুর | গোবিন্দপুর |
গগন দত্ত | কালিনগর | কালিনগর, রাতবাড়ি |
ঈশ্বরচন্দ্র দত্ত এবং প্রশন্ত কুমার দত্ত | মদনপুর | মদনপুর, লাতু |
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর চা-বাগান ও চা-শিল্পে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের আগ্রহ ও বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। ১৯৬৬ সালে ১১৪টি বাগানের ৫৬টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের, ৪৭টি ইউরোপিয়ানদের এবং বাঙালি উদ্যোক্তার হাতে ছিল ১১টি। ১৯৭০ সালে ১৬২টি চা-বাগানের ৭৪টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের।
ব্রিটিশ টি পার্টি, পেইন্টিং
সেরা প্রিমিয়াম টি ব্র্যান্ড
যখন পৃথিবীতে স্বাদে-নামে ও অতুলনীয় গুণে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে ১৭৯৬ সালে টমাস টুইনিং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির টুইনিং টি। এই কোম্পানির অপর একটি ব্র্যান্ড ইংলিশ ব্রেকফাস্ট, জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হানি অ্যান্ড ভ্যানিলা। রানি এলিজাবেথের প্রিয় টুইনিং এর আর্ল গ্রে, খানিকটা দুধ মিশিয়ে চিনি ছাড়া এই চা তিনি পছন্দ করতেন।
দ্বিতীয় অবস্থানে হার্নি অ্যান্ড সন্স ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত কেনিয়া ও আসামের চা-পাতা ব্যবহার করে থাকে। ইয়র্কশায়ার টি তৃতীয় অবস্থানে। কেউ কেউ ইয়র্কশায়ার গোল্ডকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চা মনে করে থাকেন। চতুর্থ অবস্থানে ত্যাজো টির এখনকার মালিকানা ইউনিলিভারের। পঞ্চম স্থানে ১৮৭১ সালে টমাস লিপটন প্রতিষ্ঠিত লিপটন চা। ষষ্ঠ স্থানে আমেরিকার রিপাবলিক টি, সপ্তম স্থানে শ্রীলঙ্কায় প্রতিষ্ঠিত টিকরুথি; অষ্টম শ্রীলঙ্কার ডিলমাহ টি; নবম স্থানে টেটলি, ১৮৩৭ সালে শোসেফ এবং একওয়ার্ড টেটলি ইংল্যান্ডে কোম্পানি শুরু করেছিলেন। দশম স্থানে আমেরিকার সেলেশ্চিয়াল সিজনিং, হারবাল চায়ের জন্য এই ব্র্যান্ড বিখ্যাত।
চা-সংবাদ ১৯২৯-৩০ ভালো ও মন্দ
বাংলা ও আসামে রেকর্ড পরিমাণ ৩৭১ কোটি পাউন্ড চা উৎপন্ন হয়েছে। আগের বছরের চেয়ে পুরো ৩ কোটি পাউন্ড বেশি। ৩৪.১ কোটি থেকে ৩৭.১ কোটিতে উন্নয়নে চা-করগণ উন্নতির উৎসব করছে। মূলত প্রচুর সার প্রয়োগ করে তারা চা-বাগিচার এত উন্নতি সাধন করেছে। আর্থিক উন্নতি (অগ্রহায়ণ ১৩৩৭) লিখেছে: 'উৎপাদনের দিক হইতে এইবার তাহাদের সুবৎসর; কিন্তু বাজার মন্দা, চাহিদা কম, দর উঠে নাই।... চা বেশি উৎপন্ন হওয়ায় ভাল চায়ের দরও বাড়ে নাই।'
সুতরাং চায়ের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণও জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বছর কলকাতার বন্দর থেকে ১৬ কোটি ৭৮ এক ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ২৪,৭৩,৫১,৬৭৬ পাউন্ড চা রপ্তানি হয়। আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮ কোটি পাউন্ড চা বিদেশ পাঠানো হয়েছে। কলকাতা বন্দর থেকে রপ্তানি বাড়লেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হ্রাস পেয়েছে।
ভারতে পর্যাপ্ত চা উৎপন্ন হলেও বিদেশ থেকে চা আমদানি হয়। এ বছর জাভা থেকে ২২ লক্ষ পাউন্ড চা আমদানি হয়, যা আগের বছরের চেয়ে ৫ লক্ষ পাউন্ড কম।
ইংরেজদের ভারতীয় চা পান বেড়েছে। ১৯২৯-এর এপ্রিলে ভারতীয় চায়ের ওপর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করায় আমদানিকারকগণ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। এ বছর আমদানি ৫০.৯ কোটি পাউন্ড থেকে বেড়ে ৫৬.১ কোটি পাউন্ডে উন্নীত হয়েছে।
বিভিন্ন রাজ্যে অন্নাভাব থাকায় কুলির সরবরাহ বেড়েছে। ১৯২৮ সালে চা-বাগানে কাজ করা কুলির সংখ্যা দৈনিক গড়ে ৫,৪৩,৯২০ জন। ১৯২৯ সালে দৈনিক কুলি নিয়োগের গড় ৫,৫৭,৪৮৪ জন। এর মধ্যে স্থায়ী কুলি ৪,৮০,২৪১ জন।
আসাম প্রদেশে (সিলেট সংযুক্ত) কালো চা ও সবুজ চা উভয়েরই উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ পৌনে ২৬ কোটি পাউন্ড। কাছাড় ছাড়া সব জেলাতে উৎপাদন বেড়েছে। এ বছর আসামে বাম্পার ফলন হয়েছে, আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪০ ভাগ বেশি। কিন্তু চায়ের দর ছিল কম: কারণ, (১) পূর্ব বছরের অবিক্রীত মজুত ছিল, (২) চলতি বছর উৎপন্ন হয়েছে আশাতীত পরিমাণ বেশি, (৩) চায়ের চাহিদাতেও পতন লক্ষ করা যায়।
এটাও সত্য, বেশ কটি চা-বাগান তাদের উৎপাদনের খরচও ওঠাতে পারেনি।
দুঃসংবাদ
আর্থিক উন্নতির বিশেষ মন্তব্যের সারাংশ: বহুকাল ধরে ভারতীয় চা কোম্পানিগুলো একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্তু সম্প্রতি ডাচরা ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বহুসংখ্যক চা-বাগান সৃষ্টি করেছে। সুমাত্রা ও জাভার চা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় চায়ের ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। মহাযুদ্ধের পূর্বে রাশিয়া ভারতীয় চায়ের খরিদ্দার ছিল। রাশিয়ার মতো খরিদ্দার হাতছাড়া হয়ে গেছে। গত বছর চেষ্টা করেও রাশিয়াকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি সুমাত্রার ৯০,০০০ একর চা-বাগান ভারতীয় চায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। টি সেস কমিটি যদি চা-শিল্পের দিকে বিশেষ নজর না দেয়, তাহলে প্রতিযোগিতায় আত্মরক্ষা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
চা-কৃপণ ভারতবাসী খুব কম চায় খায়। বছরে মাথাপিছু মাত্র ১ ছটাক। বছরে এই গড় ১ ছটাক থেকে ১ পোয়া বা ৪ ছটাকে উন্নীত করতে পারলে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারই বিস্তর বিক্রি হতো। এ লক্ষে বাণিজ্যিক প্রচারকার্য চালানো হচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশনে, বাজারে সাইনবোর্ড-বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। চায়ের দোকানে ৪২৫০ ডজন ছাপমারা চায়ের পেয়ালা-পিরিচ দান করা হয়েছে। ১৯২৮-২৯ সালে ৩৪১টি খুচরা চা-স্টল ও পাতা বিক্রয়ের জন্য ১৩৭০টি চায়ের ব্যবহার বাড়াতে ১৯৩০-৩১ সালের জন্য টি কমিটি পৌনে আট লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছে। আমেরিকায় ভারতীয় চায়ের প্রচারের জন্য ৪০,০০০ পাউন্ড এবং চা রান্না ও গৃহস্থালি শেখানোর স্কুলে ১০,০০০ পাউন্ড ব্যয় করায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইউরোপীয়রা হীনবল ও নির্বীর্য
ক্ষিতিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 'চা স্বাস্থ্যের পক্ষে কিরূপ হানিকর তাহাও বলি। চা চলতি হবার পূর্বে ইংরেজ জাতি বেশি বলবান ও সুস্থ ছিল। বোয়ায় যুদ্ধের সময় দশ লক্ষ ইংরেজ সৈন্য হবার অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিল। অবশ্য তার কারণ শুধু চা নয়Ñচা খেতে খতে যখন নেশা আসে, তখন খুব কড়া চা নইলে চলে না। এই প্রকার কড়া চায়ে যে বিষ থাকে, তা থেকে জমায় পাকাশয়ের প্রদাহ, অম্বল, অজীর্ণতা অক্ষুধা, অনিদ্রা কৌষ্ঠকাঠিন্য, অর্শ প্রভৃতি। চা বিরোধীরা পুরুষ চা পায়ীকে নির্বীর্য, উত্থানরহিত এবং সন্তান জন্মদানে অক্ষম বলেও ঘোষণা করেছেন।'
বিলাতি বণিকের ষড়যন্ত্র: পেয়ালায় চা
চায়ের জন্য মাটির পাত্র নয়, বিলাতি পাত্র চাই। প্রতিবছর ১ কোটি টাকার বিলাতি পেয়ালা ভারতে আমদানি করা হয়। যদি এর এক-চতুর্থাংশও চায়ের পেয়ালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে চায়ের অনুসঙ্গ হিসেবে আরও ২৫-৩০ লক্ষ টাকা দেশ থেকে বিলেতে চলে যায়।
মধ্যবিত্ত লোকেরা চায়ের দোকানে আর পাঁচজনের সাথে খোশগল্প ও অশ্লীল তামাশা জুড়ে দেয়। একটু আগে যে কাপে মুসলমান চা খেয়েছে, কুলীন হিন্দু খানিক বাদেই তাতে চা খেলে, তার ধর্ম নাশ হয়ে যায়।
চায়ের বদলে
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাক্তার সুন্দরীমোহন বাবুর বাতলে দেওয়া সমাধানের ওপর আলোকপাত করেছেন, 'চায়ের বদলে গম কড়া করিয়া ভাজিয়া গুড়া করিয়া রাখিয়া দাও। তাহাই ফুটন্ত জলে দিয়ে দুধ এবং গুড়ের সঙ্গে খাও। চিনির ভিতর সার কিছু নেই, তদপেক্ষা গুড় শতগুণে পুষ্টিকর।'
চা পান না বিষ পান?
২৬ অগ্রহায়ণ ১৩৩৬ সঞ্জীবনী পত্রিকা এই প্রশ্নটিই জিজ্ঞেস করেছে, '৩৩ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে যদি সাড়ে ১৬ কোটি ভারতবাসী, অর্থাৎ অর্ধেক লোক প্রত্যহ ১ পয়সার চা পান করে বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় যে প্রতিদিন ২৫ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ মাসে সাড়ে ৭ কোটি টাকা অথবা বৎসরে ৯০ কোটি টাকা আমরা চা পানে নষ্ট করি। এদিকে ভারতবাসীর গড়ে দৈনিক আয় ৫ পয়সা পাত্র। চা বিষ প্রাতঃকালে খালি পেটে সেবন করিয়া আমরা অজীর্ণ প্রভৃতি রোগে ভুগি। চা পানের ফলে ভাত প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য বেশি খাওয়া যায় না। ১ পয়সার চায়ের লোভে আমরা আয়ু হ্রাসের ব্যবস্থা করি। ১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক চীন থেকে চা ও চীনা শ্রমিক আনিয়ে ভারতের সর্বনাশ করেছেন। তিনি সতীদাহ নিবারণ করে পূণ্য অর্জন করেছেন কিন্তু চায়ের কারণে যে সর্বনাশ হতে পারে, তিনি তা অনুধাবন করতে পারেননি। সর্বনাশের দায় ব্রিটিশদেরই। চাকে লোভনীয় করে তুলতে ব্রিটিশরা জানে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই সুন্দর সুন্দর প্যাকেটে ভারতবাসীকে চা উপহার দিতে শুরু করেছে। যুদ্ধকালে ১৯১৫ সালে কলিকাতায় চায়ের দোকান ছিল ৪৪৪টি, পরের বছরই তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১২৪টি। ভারত যে কত বড় সর্বনাশা বিষে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে, তা সহজে অনুমান করা যাবে না। এমনকি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চা পানের কুফল নিয়ে যে সতর্কবাণী দিচ্ছেন, তা-ও তাদের কর্ণকুহারে প্রবেশ করছে না।' প্রফুল্ল চন্দ্র রায় লিখেছেন: 'মুষ্টিমেয় নির্মম ধনীকের লালসা বহ্নি- তাহাতে পতঙ্গের ন্যায় আত্মহুতি দিতেছে সাধারণ জনগণ।'
সকল সতর্কবাণী পাশ কাটিয়ে চায়েরই জয়জয়কার। প্রকৃত চা-প্রেমিকরা লু তুঙ্গের মতোই বলেন, 'অমরত্ব নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমি জানতে চাই, চায়ের স্বাদটা কেমন।'