দিন বদলের স্বপ্ন: হিমালয়ের এক চা ফ্যাক্টরি, যার মালিক-শ্রমিক কৃষকরাই
ভারতের হিমালয়ের কুমায়ূন অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইয়ং মাউন্টেইন টি কুমায়ূন টি নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।
কুমায়ূন টি একটি কৃষক মালিকানাধীন কারখানা। এতে ইয়ং মাউন্টেইন ও স্থানীয় ক্ষুদ্র কৃষকদেরও অংশীদারিত্ব রয়েছে।
কুমায়ূন টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা রাজ ভ্যাবল জানান, ইয়ং মাউন্টেইন এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের অংশীদারিত্বে উৎপাদন করা হবে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বিশেষ চা। যার ফলে এ অঞ্চলের কৃষকদের আয় যেমন বাড়বে, তেমনি এটি তাদের শিল্পের ঔপনিবেশিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসার সাহস সঞ্চার করে নতুন ধারা সৃষ্টি করবে।
ভ্যাবল বলেন, 'চায়ের গুণগত মান বাড়াতে আমরা হিমালয়ের কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছি, যাতে তারা এর মধ্য দিয়ে তাদের জীবনমান উন্নয়ন করতে পারেন। তবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য চিরাচরিত প্রথা পরিবর্তন করা।'
ইয়ং মাউন্টেইন টির যাত্রা
১৫ বছর বা তারও বেশি আগে গ্রামের সৌর বিদ্যুতায়ন নিয়ে কাজ করার সময় ভ্যাবল পাইনের সূঁচকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার একটি সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন।
তিনি একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এই উদ্যোগে যুক্ত থাকার জন্য এরপর তিনি এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজে স্নাতকোত্তর করেন এবং ফুলব্রাইট ফেলোশিপ পান।
তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন, মূলত বহু বছর ধরে আন্তঃসম্পর্কিত কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যার কারণেই ওই অঞ্চলের (কুমায়ূন) কৃষকেরা ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মুখে পড়ছেন।'
প্রথমত ওই এলাকার বেশিরভাগ যুবক পরিবারের নারীদের কৃষিজমি, বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের দেখাশোনার জন্য সেখানে রেখে তারা শহরে চলে যাচ্ছেন। ফলে এক সময়ের সমৃদ্ধ কৃষিজমি পতিত পড়ে থেকে থেকে সেগুলো বিপজ্জনক মাত্রায় ভঙ্গুর এবং বর্ষার মৌসুমে ভূমিধস প্রবণ হয়ে উঠছে।
ভ্যাবল এ বিষয়টি নিয়ে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, কেউই স্থানীয় কৃষকদের (যারা বেশিরভাগই নিজেদের জন্য পেঁয়াজ, আলু ও অন্যান্য খাদ্যশস্য চাষ করেন) কৃষি সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছেন না। তাই তিনি কৃষকদের একটি সমবায়ের কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে যান।
তিনি তাদের জানান যে, তারা যদি চা চাষ শুরু করেন, তবে তিনি সেগুলো বিক্রির জন্য একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করবেন।
ভ্যাবল ভেবেছিলেন, ভালোমানের চা উৎপাদন ও বিক্রি করে কৃষকেরা রাতারাতি তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে।
তিনি বলেন, 'আমরা আসলেই জানতাম না যে আমরা কী করতে যাচ্ছি, তবে কাজটা শুরু করেছিলাম।'
এরপর ২০১৩ সালে তিনি ইয়ং মাউন্টেইন টি প্রতিষ্ঠা করেন।
ভ্যাবলের এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই ব্যর্থতা থেকে তিনি অনেক কিছুই শেখেন।
তিনি প্রথম ফসলের উৎপাদনের খরচ মেটাতে একটি কিকস্টার্টার প্রচারও শুরু করেছিলেন, যাতে তিনি উৎপাদনকারীদের কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ১০০ বা তার বেশি পাউন্ড চা বিক্রি করতে পারেন। (তিনি প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেই কৃষকরা তাকে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন)।
তখনই তিনি ওই রাজ্যের অন্য প্রান্তে চা চাষ শুরু করার জন্য একটি সরকারি কর্মসূচির কথা জানতে পারেন। সেখানে তার পরিচয় হয় বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তরসহ দ্বিতীয় প্রজন্মের চা কৃষক ডেসমন্ড বার্কবেকের সঙ্গে।
তিনি বার্কবেককে তার উচ্চমানসম্পন্ন প্রিমিয়াম চা উৎপাদন এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তাদের কাছে সেগুলো বিক্রির পরিকল্পনার কথা জানান।
বার্কবেকের এই পরিকল্পনা ভালো লাগে এবং পরবর্তীকালে তিনি ২০২২ সালে ভ্যাবলের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন কুমায়ূন টি।
সরকার পরিচালিত কারখানাটি মার্কিন খাদ্য সুরক্ষা বিধিমালার মানদণ্ড পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই এই সুযোগে ভ্যাবল ইউএসএআইডি'র একটি অনুদান পেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি কারখানার জন্য প্রক্রিয়াজাত চা কেনা শুরু করেন।
নতুন কারখানা
ভ্যাবল যেমনটা চাচ্ছিলেন, কারখানায় সে ধরনের চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তার একটি নতুন কারখানা প্রয়োজন ছিল।
এরপর তিনি প্রোডাকশন সিস্টেমের জন্য আইনি কিছু বিষয়ে প্রায় আড়াই বছর সময় ব্যয় করেন। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল কৃষক মালিকানাধীন একটি কারাখানা চালু করা। এছাড়াও অতিরিক্ত আরও দুইটি কারখানাও চালু করেন তিন। সব মিলিয়ে ইয়ং মাউন্টেইন টিসহ কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় চারটি।
প্রথম কোম্পানিটি ছিল একটি মার্কিন সহযোগী সংস্থা, যেটি উৎপাদিত চা বিক্রির কাজ করবে। দ্বিতীয়টি ছিল ভারতের একটি সংস্থা যেটি কারখানাটির মালিকানার অংশ হবে এবং বার্কবেক হবেন কোম্পানির সিইও। সবশেষে, ভ্যাবল কারখানার মালিকানাধীন সংস্থার অংশীদার হতে কৃষকদের পক্ষে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন।
চূড়ান্ত লক্ষ্য: এই উদ্যোগের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল সিস্টেম তথা প্রথায় পরিবর্তন আনা। যে প্রথা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসছে, যেখানে কৃষকেরা উৎপাদনের লাভজনক অংশ থেকে বাদ পড়েন এবং কম দামে উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়।
ভ্যাবল বলেন, 'চা তৈরি থেকে বিক্রি পর্যন্ত আমরা একটি নতুন মডেল তৈরি করতে চাই।'
এর অর্থ হলো মালিক হিসেবে থাকা কৃষক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি পর্যন্ত একটি সমন্বিত সিস্টেম তৈরি।
ভ্যাবল জানান, কুমায়ূন চা তৈরির কৃষকদের মধ্যে ৯০ শতাংশ নারী। তারা ফসল কাটার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচগুণ উপার্জন করতে পারবেন এবং কারখানায় তাদের যৌথ মালিকানার অংশ থেকে অতিরিক্ত অর্থও পাবেন। কৃষকেরা যেহেতু জমির মালিক, তাই তারা কীভাবে ব্যবসা চালাতে হয়, তার মূল বিষয়গুলো তো শিখছেনই, পাশাপাশি পুনরুৎপাদনশীল চাষের কৌশলগুলোও শিখছেন।
এ পর্যন্ত ভ্যাবল ইয়ং মাউন্টেইন টি-সহ তার বাকি সবগুলো উদ্যোগের জন্য গঠিত তহবিলে মোট প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছেন।
এর মধ্যে কারখানার জন্য রাখা হয় প্রায় ১.৩ মিলিয়ন ডলার। এর অর্ধেক এসেছে অনুদান থেকে এবং বাকি অর্ধেক একাধিক উৎস থেকে তোলা ইক্যুইটি ও ঋণ থেকে।
মার্কিন সহায়ক সংস্থায় এটির একটি ইক্যুইটি শেয়ার রয়েছে। যার ফলে, কারখানায় তাদেরও একটি অংশ রয়েছে।
ভ্যাবল জানান, অবশেষে ৪০ ফুট বাই ৮০ ফুট আয়তাকার দ্বিতল ভবনটি তৈরি করতে সক্ষম হন তারা। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাদের উৎপাদন শুরু করার এবং সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রসেসিং করার জন্য মাত্র পাঁচজন লোক প্রয়োজন হবে তাদের।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি