জীবনানন্দের বরিশাল কলকাতা বরিশাল
জীবনানন্দ দাশের গল্প ও উপন্যাসে বারবার আমরা এমন একজন মানুষের দেখা পাই যে ঘনঘন বরিশাল কলকাতা বরিশাল করছে।
হাতে একটা সুটকেস নিয়ে বউ বাচ্চা মা বাবাকে দেশের বাড়িতে রেখে মানুষটা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। বেরোনোর আগে বাবা তাকে বলে, কলকাতা যাও কিছু একটা করো বাবা! সত্যিই কি আর কিছু করে মানুষটা নাকি কিছু করবার ভান করে। আর কেনই বা ভান করে?
একসময় কবিতা লিখত মানুষটা। এখন আর লেখে না। মধ্যে মধ্যে 'নতুন কবিতা' লিখবার কথা ভাবে। এখন গল্প উপন্যাস লিখিয়ে হিসেবে মানুষটা মাঝেমধ্যে নিজের পরিচয় দেয়। আর টিউশন পলিসি নোটলেখার মতো উঞ্ছবৃত্তি করে।
জীবনানন্দ দাশের এই পর্বের ডায়েরিও এমন কথাতেই ভর্তি। বারবার কলকাতা বরিশাল করছেন জীবনানন্দ। পয়সার অভাবে ইন্টার ক্লাস অবধি নয়, থার্ড ক্লাসে। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসের নায়ক ফার্স্ট ক্লাশ কেবিনের চাপকান পরা বাটলারের কাছে জল চাইতে গেলে সে বলে:
-দরজার কাছে এসে দাঁড়াবেন না।
একটু সরে দাঁড়ালাম।
-আপনি কোন ক্লাসে যাচ্ছেন?
-থার্ড ক্লাসে।
-ইন্টারে?
-না।থার্ডে।
-সেখানে তো ট্যাঙ্কে কল আছে।
-ফুরিয়ে গেছে।
নিখুঁত বর্ণনা সেই থার্ড ক্লাস ডেকের:যেখানে খুশি আখের ছিবড়ে ও থুতু ছিটিয়ে ফেলছে, কলার বাকল, আমের খোশা সাবধানে এড়িয়ে চলতে হয়; এক-একটি জায়গায় জমাট পেচ্ছাবের গন্ধ; এক-একটা ক্যানভ্যাস পেচ্ছাবের গন্ধে জ্বলে যাচ্ছে যেন...সমস্ত অভিষিক্ত করে বিড়ির গন্ধ, সব দিকে।
এই পর্ব ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫। তো ঠিক কোন পথে মানুষটি যাতায়াত করছেন?
মানুষটি তাঁর গল্প উপন্যাস ও কবিতায় খুব নিপুনভাবে এই পথের বর্ণনা করছেন। কখনও গভীর রাত, কখনও আধফোটা ভোর, কখনও অস্ফুট সন্ধ্যা এই পথের গর্ভে পরাগ মেলেছে।
মণীন্দ্র গুপ্ত লিখছেন:
'বরিশাল থেকে যে দিকেই যাওয়া যাক না কেন, স্টিমার ছাড়া বেরুবার পথ নেই। জীবনানন্দকে তো কলকাতায় আসতেই হত; সেই সব যাত্রায় নদী, নদীতীর, স্টিমার ও সহযাত্রীদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে তাঁর গল্প উপন্যাসে। এইসব বিবরণ যে কত নিখুঁত আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কারণ, কীর্তনখোলার নদীর সেই একই ঘাট থেকে একই জেটি পেরিয়ে উনি যেতেন গোয়ালন্দ বা খুলনায় কলকাতার ট্রেন ধরতে, আর আমি যেতাম চাঁদপুরে সুরমা উপত্যকার ট্রেনে চাপতে। আমি আঁড়িয়াল খাঁ বেয়ে মেঘনার পথ ধরতাম। উনি যেতেন পদ্মার পথে।'
কলকাতা থেকে ১০৫ মাইল দূরে খুলনা একটি প্রধান গঞ্জ ও বন্দর। ভৈরব নদ ও রূপসা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। কোনও মাঝি মধ্য রাত্রে নৌকো ভাসাবার আয়োজন করলে বনদেবতা নাকি বলে উঠতেন 'খুলো না খুলো না', তার থেকে খুলনা। 'সেনের বাজার' এখানকার একটি প্রাচীন স্থান। প্রবাদ লক্ষণ সেন নাকি এই বাজারটির প্রতিষ্ঠাতা। জীবনানন্দের সেনপ্রীতি কি এর থেকে প্রভাবিত হয়ে!
খুলনা থেকে প্রত্যেকবার মানুষটা কলকাতার জন্য ট্রেন ধরতেন। স্টিমার থেকে নেমে ট্রেন ধরা। অথবা ট্রেন থেকে নেমে স্টিমার ধরা।
'ট্রেন বদলে স্টিমারে উঠল যখন সত্যেন, তখন সেই অন্ধকার আকাশ মাঠ ভরা নদী যেন মাধুরীর মতো, মায়ের মতো, উথলে উঠে তাকে বুকের ভিতর টেনে নিয়েছে।'
'চারটের সময় স্টিমার রেলওয়ে স্টেশনে এসে থামল। সাতটার সময় ট্রেন ছাড়বে।।ঘন্টা দুই-আড়াই স্টিমারে এখনও ব'সে থাকলেও চলে।...দূর অন্ধকার কুয়াশা ও পাড়াগাঁগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের মেয়ের কথা ভুলে গেল শৈল-- নিজের বধূর কথা ভুলে গেল--জীবনের ঘাটেঘাটে যে-সব নারীরা শৈলর জীবনকে অনন্ত কালের জন্য আটকে রাখবে বলে এসেছিল-অসীম কালের জন্য অধিকার ক'রে রেখেছিল যেন, তারা চুপে চুপে এ-কুয়াশার ভিতর ভেসে উঠছে...।'
সমস্ত গল্প উপন্যাসগুলো ১৯৩২-৩৩ পর্বে লেখা। মানুষটাকে যেন এই পথ ও যাত্রা গ্রাস করে নিয়েছিল। 'প্রেতিনীর রূপকথা'র বর্ণনা তো বিশ্ব সাহিত্যেও দূর্লভ।
'একদিন কুয়াশার জন্য স্টিমার দেরি করে এসেছিল আবার; ট্রেন মিস করলাম।...এক-একটা ডাউন ট্রেন, গুদাম গাড়ি আসছিল, যাচ্ছিল, নীল জামা গায়ে কুলির দল হৈ হৈ করছিল... নিত্যদিনকার কাজকর্মের প্রতিটি অসাড় কলকব্জা ঘুরানোর জন্য আজও এদের কী গভীর উৎসাহ...কতকগুলো কুকুর ইতস্থত ঘোরাঘুরি করছে--খাচ্ছে, শুঁকছে, লালসার উত্তেজনায় পরস্পরকে বিপর্যস্ত করে ছাড়ছে; এই তাদের ঋতুর সময়। লোম ছিটিয়ে পড়ছে চারিদিকে, শরীরের নানারকম নিভৃত জায়গায় মর্মান্তিক ঘা রোদের ভিতর দগদগ করছে, ল্যাংল্যাং শরীর, ভিখিরির মতো মুখ, কিন্তু পুষ্ট মোহন্তের মতো কামনা।...
সব ছেড়ে দিয়ে অন্ধকারের কুজ্ঝটিকামাখা বনপ্রান্তরের দিকে আজীবন চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ঐ বাবলার জঙ্গলে একটা প্রেতের জীবন নিয়ে থাকলে, হত না কি?...গ্রামের তিন শ বছরের পুরোনো সাদা পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম; অশ্বথের মুখ থেকে পাঁচ শ বছরের আগের কথা শুনতাম... কানাড়া ছাদের খোঁপা, অপরূপ মুখ, এক বিষণ্ন যুবতী আজকের পৃথিবীর কলরবের কোনও কথাই জানে না...।'
বরিশাল থেকে ঝালকাঠি হয়ে খুলনা? এইসব পথেই তো ছড়িয়ে রয়েছে 'রূপসী বাংলা'। এত 'নীল' কেন রূপসী বাংলায়?
'আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে অপরাজিতার মত নীল হয়ে'
'যদি আমি ঝরে যাই কার্তিকের নীল কুয়াশায়'
'হিজলে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে'
'ভাঙ্গা মঠ নীল হয়ে আছে শ্যাওলায়'
'বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর, তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাসে আর ধানের ভিতর।
মণীন্দ্র গুপ্ত লিখছেন :
'বাংলা দেশের রং যে নীল তা এই যাত্রায় খুব টের পাওয়া যেত--আকাশ নীল, বাতাস নীল, ...তীরের পাটখেত নীল, শুপুরি-নারকেল বন নীল, গ্রামের গাছগাছালি নীল...জীবনানন্দ আরও বেশি দেখেছিলেন।'
আমার এক বন্ধু জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করেছিলেন। আমি যেতে পারিনি। বরিশাল থেকে খুলনা। গল্প করছিলেন, ভাগ্যক্রমে জীবনানন্দের ব্যবহার করা স্টিমারই তাঁরা পেয়েছিলেন। স্টিমারে সারা রাত শুটিং করেছিলেন। সেই এক 'অসহ্য গুমোট', 'স্যাঁতসেঁতে' 'পেচ্ছাপের গন্ধ', 'আঁশটে গন্ধ'।
জীবনানন্দের খোঁজে যেতে হলে এইসব পথে একদিন যেতে হবে। এই সব অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে না হাঁটলে কবির আভাস বুঝি আঁকা যাবে না।
আমি জীবনানন্দ দাশের ডায়েরি নিয়ে বসে আছি। নদীপথ-ট্রেনপথের বর্ণনা।
১৯৩০-১৯৩১-১৯৩২-১৯৩৩।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
অক্ষর নয় যেন।
সময়ের-পরমাণুর-অনিশ্চয়তার কাটাকুটি খেলা।
অরূপরতন বসুর ভাষায় 'লেখা খেলা'।
লেখার সঙ্গে যাঁরাই কোন না কোন ভাবে জড়িত...ভাবতে হয় বই কি যে... লেখার অনেকখানি জুড়েই আছে খেলা...।
আমি এক অপরূপ খেলার প্রতিভার সাক্ষী হতে চলেছি।
ভাবছি ডায়েরির সঙ্গে মিলিয়ে জীবনানন্দের 'চৌত্রিশ বছর' উপন্যাসের একটা এডিশন করব। সেখানে বরিশাল-কলকাতা যাত্রা পথের ট্রেন-স্টিমার রুটের ম্যাপ ও ছবি থাকবে। থাকবে প্রাসঙ্গিক ডায়েরির এন্ট্রি। যেতে হবে সেই পথে...কেউ হবেন সেই পথের সঙ্গী?
'চৌত্রিশ বছর' উপন্যাস লেখা হচ্ছে অগস্ট ১৯৩২। আর উপন্যাস শুরু হচ্ছে
বাবা বললেন-- কলকাতা যাও, একটা কিছু করো বাবা।
৬ জুলাই ১৯৩২ ডায়েরিতে লিখছেন জীবনানন্দ
বাবা : কলকাতা যাও, একটা কিছু করো,বাবা--
ডায়েরিতে পরেরদিন, ৭ জুলাই ১৯৩২-এর এন্ট্রি
No place in the streamer--Beddings remain bound--People starring at me and guessing--দু'জন ঝালকাঠি যাবে, তাদের আশায়--সব চেয়ে বেশি নদী আকাশের, দিকে আমি তাকিয়েছি (সমস্ত প্যাসেঞ্জারের মধ্যে)...
উপন্যাসে
স্টিমারে সমস্ত থার্ড ক্লাস-ফ্ল্যাট প্যাসেঞ্জারে তলিয়ে গিয়েছে--দাঁড়াবার জায়গা অবধি নেই--...এই নদীর প্রাণ তাকে পেয়ে বসেছে..
ডায়েরিতে
আমার খাবারের টিন নিয়ে একটা দূরন্ত শিশু...
উপন্যাসে পাশ ফিরে দেখল, মা তাকে যে খাবারের টিনটা একটু ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন, একটি ছোট ছেলে সেটাকে তুলে নিয়ে ধীরে-ধীরে বাঁধন খুলছে...
এভাবে যত ডায়েরি ও উপন্যাস ধরে মিলিয়ে মিলিয়ে এগিয়ে যাব, আমরা অবাক হয়ে দেখব, চারপাশে যা ঘটছে তা কীভাবে জীবনানন্দের লেখায় দ্রুত অক্ষর হয়ে ফুটে উঠছে।
কাফকার মতো, দস্তয়েভস্কির মতো নিটশের মতো জীবনকে বাজি রেখে জীবনানন্দ কলম ধরেছেন।
-
লেখক: জীবনানন্দ গবেষক