জীবনানন্দের রকেটযাত্রা
১৯৩০ সালের ৯ মে জীবনানন্দ দাশ বিয়ে করেন খুলনার সেনহাটি গ্রামের রোহিণীকুমার গুপ্তর মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে এই লাইব্রেরির অদূরেই ঢাকা সদরঘাট টার্মিনাল থেকে নৌযানে (সম্ভবত স্টিমারে) তারা বরিশালে যান।
জীবনানন্দের গল্প উপন্যাসে বারবারই তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ঘটনাবলি এসেছে। সাধু ভাষায় লিখিত 'মৃত্যুর গন্ধ' শিরোনামে একটি গল্পের বিবরণ: 'বিবাহ করিয়া আসিবার সময় সেই স্টিমারেই তো, দুপুরের গরম অসহ্য হইয়া উঠিল নীলিমার কাছে। বড়ো নদীর উপর স্টিমারের ঘুরপাকে সে মাথা ঠিক রাখিতে পারিল না। বরযাত্রীদের কাছে সেদিন গোলাপ জল অডিকোলন নানারকম জিনিসই ছিল, লেবু কাটিয়া কাটিয়া খাইতে দেওয়া হইল। হুকুমের ভিতর নতুন বধূর পরিচর্যা সেদিন বেশ জমিয়াছিল।' এই ঘটনাটি কি জীবনানন্দের নবপরিণীতার ক্ষেত্রেই ঘটেছিলো?
জীবনানন্দদাশের ডায়েরিতেও স্টিমারযাত্রার কথা বারবার এসেছে। বারবার কলকাতা বরিশাল করছেন তিনি। পয়সার অভাবে স্টিমারের ইন্টার ক্লাসও নয়, বরং থার্ড ক্লাসে যাতায়াত করতেন। 'প্রেতিনীর রূপকথা' উপন্যাসের নায়ক সুকুমার। বরিশাল থেকে খুলনায় যাচ্ছেন। গন্তব্য কলকাতা। ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের চাপকান পরা বাটলারের কাছে জল চাইতে গেলে তাদের কথোপকথন:
— দরজার কাছে এসে দাঁড়াবেন না।
— একটু সরে দাঁড়ালাম।
— আপনি কোন ক্লাসে যাচ্ছেন?
— থার্ড ক্লাসে।
— ইন্টারে?
— না। থার্ডে।
— সেখানে তো ট্যাঙ্কে কল আছে।
— ফুরিয়ে গেছে।
থার্ড ক্লাস ডেকের বর্ণনাও রয়েছে সেখানে: 'যে যেখানে খুশি আখের ছিবড়ে ও থুতু ছিটিয়ে ফেলছে, কলার বাকল, আমের খোসা সাবধানে এড়িয়ে চলতে হয়; এক-একটি জায়গায় জমাট পেচ্ছাবের গন্ধ; এক-একটা ক্যানভ্যাস পেচ্ছাবের গন্ধে জ্বলে যাচ্ছে যেন...মাথার উপরে দরমার ছাউনির নিচে ইলেকট্রিক বাতি কেরোসিনের কুপির চেয়েও অধম, এক একবার জ্বলছে, এক একবার নিভে যাচ্ছে প্রায় জোনাকির জেল্লার মতো, সমস্ত অভিষিক্ত করে বিড়ির গন্ধ, সবদিকে।' স্টিমারের বয়লারের চারপাশে মৌমাছির মতো মানুষের দলা পাকিয়ে ঘুমানোর দৃশ্যও তার নজর এড়ায় না। একে তিনি লিখেছেন: 'একনিষ্ঠ ঘুম; ঘুমের ভান নয়—ঐকান্তিক একনিষ্ঠ ঘুম। এরা ঘুমুচ্ছে। গভীরভাবে এরা মানুষ।'
রকেট ও স্টিমার
বাংলাদেশের নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে স্টিমার (স্থানীয়দের কাছে 'রকেট' নামে পরিচিত) একটি অতিপরিচিত, জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের বাহন। স্টিমারের ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশলের কারণে এটি অন্যান্য নৌযানের চেয়ে অধিকতর নিরাপদ। আবহাওয়া যত বৈরীই হোক না কেন, বড় নদীতেও ঝড়ঝাপ্টা সামলে চলে প্যাডেলচালিত স্টিমারগুলো। শুরুর দিকে এসব স্টিমারে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হতো। আশির দশকের শুরুতে এগুলো ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তরিত করা হয়। স্টিম ইঞ্জিনের সাহায্যে বড় বড় প্যাডেল জাহাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় বলে একে প্যাডেল স্টিমার বলা হয়। যে কারণে এদের নামের আগে সংক্ষেপে পি.এস (প্যাডেল হুইল স্টিমার) ব্যবহৃত হয়; যেমন পি.এস অস্ট্রিচ, পি.এস মাহসুদ ইত্যাদি।
স্টিম থেকে স্টিমার। অর্থ বাষ্পোৎপাদক বা বাষ্পচালিত জলযান। কিন্তু স্টিমারকে 'রকেট' কেন বলা হয়? প্রথম মত হচ্ছে, একসময় নৌপথে এটিই সবচেয়ে দ্রুতগতির নৌযান ছিল বলে মানুষ এটিকে 'রকেট' বলতো। তবে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা (বর্তমানে ইউএনডিপিতে কর্মরত) জাহিদ হোসেন জানান, স্টিমারের দুই রকম সার্ভিস ছিল; রেগুলার ও রকেট সার্ভিস। রেগুলার সার্ভিস সপ্তাহে ৬ দিন সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যেতো বরিশালের উদ্দেশে এবং বরিশাল থেকে ঢাকায় আসতো। আর রকেট সার্ভিস সপ্তাহে চারদিন সকাল ১১টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে যেতো চাঁদপুর-বরিশাল-কাউখালি-হুলারহাট-মংলা-খুলনা রুটে। এই সার্ভিসের জন্যই স্টিমারগুলো 'রকেট' নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রকেট সার্ভিস ছিল এক্সপ্রেস সার্ভিস—অনেকটা ট্রেনের ইন্টারসিটির মতো। পরে এই নামটিই রয়ে যায়। অর্থাৎ স্টিমার ও রকেটের পার্থক্যটা লোকাল ও মেইল ট্রেনের মতো।
বরিশালের সন্তান এবং বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী অধ্যাপক আবদুর রব জানান, রকেট মূলত সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে বিভিন্ন ঘাট হয়ে ভোরবেলা বরিশালে গিয়ে পৌঁছাতো। সেই দিনই আবার জাহাজটি বরিশাল থেকে খুলনার পথে রওনা হতো। ১৯৬০-এর দশকে একটি জাহাজ প্রতিদিন সকাল ১০ টার দিকে ঢাকার ঘাট ছেড়ে শুধু চাঁদপুরের ঘাট হয়ে সোজাসুজি বরিশাল চলে যেতো। এই জাহাজটি ছোট ছোট স্টেশনে না ভিড়ে মাত্র আট ঘণ্টায় সূর্যাস্তের আগে বরিশালে পৌঁছে যেতো। এজন্যই এই জাহাজটিকে রকেট বলা হতো। যে জাহাজটি যেদিন যেতো, সেটিকেই সেদিন রকেট বলা হতো। রকেট সার্ভিস প্রচলন করার পরেও আগের রাত্রের সার্ভিস অব্যাহত ছিল। রকেট সার্ভিসের একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল এই যে, দিনের বেলা নদী ও নদীতীরের দৃশ্যাবলি দেখা যেতো। রকেটের ভাড়া অন্য সার্ভিসের তুলনায় কিছুটা বেশি ছিল। আবদুর রব আরও জানান, রাতের জাহাজটি লোকাল ট্রেনের মতো প্রত্যেক ঘাটে থামতো। এজন্য এটিকে বলা হতো মেইল সার্ভিস জাহাজ।
বরিশালের সন্তান এবং বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক শওকত মিল্টন বলছেন, বরিশাল-ঢাকা, বরিশাল- গোয়ালন্দ এগুলো ছিলো রকেট সার্ভিস। আর এসব সার্ভিসকে কানেক্ট করতো আরো কিছু সার্ভিস যেমন মধুমতি স্টিমার চলতো বরিশাল-পটুয়াখালী-খেপুপাড়া বা আমতলী রুটে। বরিশাল-ভোলা রুট ছিলো। এসব ছোট রুটকে বলা হতো ফিডার সার্ভিস। রকেট সার্ভিস ছিল স্টিম বা বাষ্পচালিত এবং ওই সময়ের অন্যান্য নৌযানের তুলানায় এটি দ্রুত গতির ছিলো বলে 'রকেট' সার্ভিস বলা হতো।
স্টিমারযাত্রার ইতিহাস
মো. আবু হেনা (বিআইডব্লিউটিএর সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ, পৃষ্ঠা ২৩) জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের নৌপথে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল শুরু হয় দেড়শো বছর আগে, ব্রিটিশ আমলে। 'লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক' নামে একটি অভ্যন্তরীণ স্টিমার ১৮৩৪ সালে গঙ্গা নদী দিয়ে চলাচল শুরু হয়। স্টিমারটি ছিল ব্রিটিশ সরকারের মালিকানাধীন। ১৮৪৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারিIndia General Navigation and Railway Company Ltd (IGNR) নামে প্রথম একটি অভ্যন্তরীণ স্টিমার কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১৮৮০-১৮৯০) প্রায় ৮৯৮টি নৌযান সুন্দরনের ভেতর দিয়ে প্রতি বছর কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত চলাচল করতো। বিংশ শতাব্দীর প্রথম এক চতুর্থাংশে এই সংখ্যা ৪৮০৩ টিতে উন্নীত হয়।
রোহিণী কুমার সেন (বাকলা: বাকেরগঞ্জের প্রত্নতত্ত্ব ও আধুনিক ইতিহাস, ১৯১৫, পৃষ্ঠা ২২৬ ) জানাচ্ছেন: ১৮৮৫ সালে বরিশাল থেকে খুলনায় স্টিমার চালু করে প্লোটিলা কোম্পানি। এ সময় এই কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার এই রুটে আরেকটি স্টিমার চালু করে। এ দুই প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতার পরে বরিশাল-খুলনা রুটে ভাড়া নির্ধারিত হয় ৪ আনা। কিছুদিন পর ঠাকুর পরিবার প্লোটিলা কোম্পানির কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে লাইন ছেড়ে দেয়। ফলে এই রুটে প্লোটিলা কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ধনকুবের আরএসএন কোম্পানি (River Staem Navigatio Company) লাইনে আসে এবং তারা বরিশাল শহরে স্টেশন ও কারখানা স্থাপন করে। লাখুটিয়ার খ্যাতনামা জমিদার রাজচন্দ্র রায়ের বড় ছেলে রাখাল চন্দ্র রায় এবং জলাবাড়ারি জমিদার বৈকুণ্ঠনাথ বিশ্বাস ও তার ভাইয়েরাও কয়েক মাস স্টিমার চালিয়েছিলেন।
হোসাইন মোহাম্মদ জাকি (বঙ্গীয় বদ্বীপে স্টিমার ও গোয়ালন্দ, প্রথম আলো, ২১ মে ২০২০) লিখেছেন, এ অঞ্চলের নৌপথে নিয়মিত স্টিমার চলাচল শুরু হয় ব্রিটিশ নৌবিভাগের সাবেক অফিসার জনস্টনের উদ্যোগে। ১৮২৯ সালে বাংলার নদীপথে মেরিন বোর্ড চালিত সব স্টিমারের অস্থায়ী কমান্ডার নিযুক্ত হন জনস্টন। শুরুতে স্টিমারের সংখ্যা ছিল খুবই কম। দীর্ঘ সময় অন্তর এগুলো যাতায়াত করত। যার ফলে ভাড়াও ছিল বেশি এবং বুকিং পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের বহন এবং কলকাতা থেকে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের কাজেই এগুলো ব্যবহৃত হতো।
বলাই বাহুল্য, নদী-খালবিধৌত বরিশাল অঞ্চলের যোগাযোগে স্টিমার সার্ভিস বিরাট পরিবর্তন আনে। ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ব্যবসার সুযোগ-সুবিধার জন্য তৎকালীন পূর্ব বাংলায় রেল লাইন স্থাপন করলেও বরিশাল অঞ্চলে রেললাইন স্থাপন করেনি। এর পেছনে এই স্টিমার কোম্পানিকেই দায়ী করেছেন তপন রায়চৌধুরী (জন্ম ১৯২৬-মৃত্যু ২০১৪)। তার (রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা, পৃষ্ঠা ৫৬) ভাষ্য: 'গাঙ্গেয় বদ্বীপের প্রায় শেষ সীমায় অবস্থিত এই জেলায় (বরিশাল) নদী-নালা এত বেশি যে রেলসংযোগ আর সম্ভব হয়নি। দুয়েকবার যা চেষ্টা হয়েছিল, স্টিমার কোম্পানির মালিক লর্ড ইঞ্চকেপ বিলেতে বসে কলকাঠি নেড়ে তার দফা শেষ করেন।'
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বৃটিশ সরকারের রেখে যাওয়া ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন এন্ড রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির সকল দায়-দেনাসহ গঠন করা হয় পাকিস্তান স্টিমার্স সার্ভিস। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এই সংস্থার অধীনে গাজী, অস্ট্রিচ, টার্ন, কিউই, শেলা, লালী, সান্দ্রা, মেঘলা, মাহসুদ, লেপচা নামক ১০টি স্টিমার নিয়ে চালু হয় পাকিস্তান স্টিমার্স সার্ভিস। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি)।
বাংলাদেশের নদীপথে চলা স্টিমারগুলো মধ্যে পি.এস অস্ট্রিচ, পি.এস মাহসুদ ১৯২৯ সালে, পি.এস লেপচা ১৯৩৮ সালে, পি.এস টার্ন ১৯৫০ এবং শেলা ১৯৫১ সালে নির্মিত হয়। সব কটিই নির্মিত হয় কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপইয়ার্ডে। তবে অতীতের স্টিমারগুলোর মধ্যে 'গাজী' খুব নামকরা ছিল। নানা কারণে ছোটবেলায় আমরাও মানুষের মুখে মুখে 'গাজী রকেট'-এর নাম শুনতাম। এটা মানুষের মুখে মুখে এতটাই ফিরতো যে, 'গাজী রকেট' শব্দটা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। এটিও তৈরি হয় ১৯২৯ সালে। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ডকইয়ার্ডে মেরামতকালে অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এমভি সোনারগাঁও, এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতি বিআডব্লিউটিসির বহরে যুক্ত হয়। এগুলো প্যাডেলচালিত নয় বলে নামের আগে এমভি মানে মোটর ভেসেল।
বিআইডব্লিউটিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত একদিন স্টিমার যায়। বাকি দিনগুলো বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত। এই পথে যেতে যেসব টার্মিনালে স্টিমার থামে সেগুলো হচ্ছে চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, হুলারহাট, চরখালী, বড় মাছুয়া (মঠবাড়িয়া), সন্ন্যাসী (মোড়লগঞ্জ)। এর বাইরে চট্টগ্রাম-হাতিয়া, আলেকজান্ডার-মির্জাকালু, কুমিরা-গুপ্তচরা, হাতিয়া-বয়ারচর, মনপুরা-শশীগঞ্জ, বরিশাল-মজুচৌধুরীর হাট, চরচেঙ্গা-বয়ারচর, চেয়ারম্যানঘাট, ইলিশা-মজুচৌধুরীর হাট, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে স্টিমার সার্ভিস চালু আছে। চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে সপ্তাহে একদিন স্টিমার চালু থাকলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।
অধ্যাপক আবদুর রব ব্যক্তিগত স্মৃতিকথায় লিখেছেন: '১৯২০ এর দশকে ব্রিটিশরা স্টিমারগুলো তৈরি করেছিল। আমার বাংলাদেশের জীবনে বেশিরভাগ সময় আমি বরিশাল এবং ঢাকার মধ্যে যাতায়াতের জন্য এই জাহাজ ব্যবহার করেছি। আমাদের নদীর দেশে এটাই ছিল নিরাপদ ও সস্তার পরিবহন। ডেকের উপর যাত্রীদের খুব ভিড় ছিল। সেখানে জায়গা পেতে হলে আমাকে জাহাজ ছাড়ার তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে স্টিমার ঘাটে যেতে হতো। অথবা আমার জন্য জায়গা রাখার জন্য কুলিকে পয়সা দিতে হতো। স্টিমার অনেক সময় ঝড়ের কবলে পড়তো। তখন কর্তৃপক্ষ ডেকের উপর যাতে পানি না আসে সেজন্য জাহাজের দুপাশে খোলা জায়গাগুলোতে পর্দা লাগিয়ে দিতো। তবে এই জাহাজগুলোর একটিও ঝড়ে ডুবে যায়নি।'
গবেষক গৌতম মিত্রর অনুসন্ধান বলছে, ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ পর্বে বরিশাল-খুলনা রুটে দুটি কোম্পানির জাহাজ চলত। আরএসএন (River Steam Navigation Company) এবং আইজিএন (Indian General Navigation)|RSN অপেক্ষকৃত ছোট স্টিমার এবং IGN বড়ো প্যাডেল বোট। ব্যবসায়িক কারণে পরবর্তীকালে দুটি কোম্পানি এক হয়ে যায়। জীবনানন্দ দাশ IGN-এর স্টিমার বেশি ব্যবহার করতেন। ডায়েরি ও উপন্যাস মিলিয়ে মি. মিত্র দেখেছেন, IGN -এর সময়ের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের যাত্রার সময় মিলে যাচ্ছে। তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, অস্ট্রিচে জীবনানন্দ একাধিকবার চড়েছেন। কিন্তু এই স্টিমারটি এখন আর ঢাকা-খুলনা রুটে চলে না। এটিকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। তাদের কাছে থাকা ঐতিহ্যবাহী যে চারটি (পিএস মাহসুদ, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্ন) স্টিমার রয়েছে, অস্ট্রিচ তার অন্যতম। দৈর্ঘ্য ২২৫ ফুট, প্রস্থ ৩০ ফুট এবং ড্রাফট সাড়ে ৫ ফুট। যাত্রীধারণ ক্ষমতা ৯০০ জন এবং পণ্য পরিবহন ক্ষমতা ১৫০ টন। প্রতি ঘণ্টায় এর গতি ১০ নটিক্যাল মাইল। ২০১৮ সালে এটিকে ভাসমান রেস্তোরাঁ হিসেবে ইজারা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। করপোরেশন সূত্র বলছে, ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম অস্ট্রিচে স্টিম ইঞ্জিন সরিয়ে ডিজেল ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন করা হয়। এ সময়ে এটিসহ অন্য স্টিমারগুলোর কাঠামো পরিবর্তন ছাড়াও আধুনিকায়নের কাজ করা হয়। এরপর যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিচ পুনরায় ঠিক করা হয়। পরে অস্ট্রিচের তলা ফেটে গেলে জাহাজটি মেরামতের জন্য ডকে তোলা হয়। কিন্তু আর নামানো হয়নি। শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী এই প্যাডেল স্টিমারটি শত বছরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো উপলক্ষ্যে ২০১৯ সালে এর একটি মিনিয়েচার তৈরি করা হয় এবং ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর এটি জাতীয় জাদুঘরকে দেয়া হয়।
জীবনানন্দের রকেটযাত্রা
দেশভাগের আগের বছর ১৯৪৬ সালে চূড়ান্তভাবে কলকাতায় চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জীবনের বড় সময় জন্মস্থান বরিশাল শহরে কাটিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। যদিও নিয়মিত বরিশাল-কলকাতা যাতায়াত করতেন। বিশেষ করে ১৯১৭ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আইএ পাস করার পরে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির পরে। পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবনও তিনি শুরু করেন কলকাতার সিটি কলেজে। ১৯২৮ সালে প্রথমবার বেকার হন। এরপর ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বছর বেকার। বিশেষ করে এই সময়টায় তিনি ঘন ঘন বরিশাল-কলকাতা যাতায়াত করেন। তখন বরিশাল থেকে তিনি স্টিমারে খুলনায় যেতেন এবং খুলনা থেকে ট্রেনে কলকাতায়। তাঁর গল্প-উপন্যাস ও ডায়েরির বরাতে এটা ধারণা করা যায় যে, তিনি মূলত থার্ড ক্লাসেই যাতায়াত করতেন। এর কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন একটি শিরোনামহীন কবিতায়, যেটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত 'ছায়া আবছায়া' কাব্যগ্রন্থে ঠাঁই পায়:
'স্টিমারের তৃতীয় ক্লাশ ডেক থেকে এই সব বোঝা যায়;
জীবনের বিমর্ষতা 'আজও তুমি তৃতীয় ক্লাশ?'
তার মানে জীবনের বিমর্ষতা বোঝার জন্য তিনি তৃতীয় ক্লাসে চড়তেন? সাধারণ মানুষের একনিষ্ঠ ঘুম, যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা থুতু, কলার বাকল, জমাট পেচ্ছাবের গন্ধ—এইসবই তো তাকে চিন্তার খোরাক দিয়েছে। কলকাতার রাস্তায় ভিখিরি, ইহুদি রমনী, হাইড্র্যান্ট খুলে জল পানকরা কুষ্ঠরোগী—কোনোকিছুই তো তার নজর এড়ায় না। নিজের চাশপাশের দুনিয়াকে এমন নিখুঁতভাবে আর কে দেখেছেন! তার মতো এমন সংবেদনশীল মন নিয়ে আর কে লিখেছেন জীবনের এইসব খুঁটিনাটি! ফার্স্টক্লাস কেবিনে চড়লে জীবনের এইসব 'নিভৃত কুহক' তিনি কীভাবে অনুভব করতেন? অবশ্য বেকারত্বের কালে তৃতীয় ক্লাসে চড়া ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল? 'আজও তুমি তৃতীয় ক্লাশ' বলে যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, সেই প্রশ্ন মূলত স্বগতোক্তি; আয়নায় মুখ দেখা। অর্থবিত্তে সারা জীবন একঅর্থে তৃতীয় ক্লাসই তো ছিলেন!
'রক্তমাংসহীন' গল্পেও থার্ড ক্লাসের বর্ণনা: 'ধুমধাড়াক্কার মধ্যে স্টিমারে গিয়ে প্রবেশ করি—ফিমেল থার্ড ক্লাস কেবিনে ভিড়ের মধ্যে উষার জন্য একটা জায়গা বেছে নেই, স্টিমারের ভিতর চারদিকে জীবনের কঠিন কলরব দেখে হৃদয়ের ভিতর আশা ও স্বপ্ন শুকিয়ে যায়।' অর্থাৎ এখানেও মানুষের অন্তহীন পথচলা, 'রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান', 'মধ্যবিত্ত মদির জগতে আমরা বেদহানহীন অন্তহীন বেদনার পথে'...।
জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে সেকেন্ড ক্লাস কেবিনের বর্ণনাও পাওয়া যায়: 'স্টিমারে থার্ড ক্লাস ফ্ল্যাটে বিছানা পেতে কতদিন সেকেন্ড ক্লাসের সেই ছোট্ট মেয়েদের কেবিনটা ঘুরে এসেছি, যেখানে বিনতারা কতদিন আগে রাত কাটিয়ে গিয়েছে। একটা ছোটখাট ইলেকট্রিক পাখা কেবিনের কাঠের দেয়ালে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। পাশেই মাকড়শার জাল। নদীর দিকে জালিকাটা একটা জানালা; খোলাও যায় না, বন্ধও করা যায় না। বৃষ্টির ছাঁটও গায়ে লাগে না, বাতাসও বড়ো একটা আসে না—ভারি অনতিপরিসর বেঞ্চি। এরই উপর বিছানা পাতত তারা। একটা মস্তবড় আরশি, একটা তাক। সমস্ত ঘরটা গুমোট, পরিসর বড় কম পুরনো কাঠ ও বিবর্ণ রঙের গন্ধ।'
শওকত মিল্টন জানান, জীবনানন্দ স্টিমারের চারটি ক্লাসের (১. প্রথম শ্রেণি, ২. দ্বিতীয় শ্রেণি, ৩. ইন্টার এবং ৪. তৃতীয় শ্রেণি) কথা লিখলেও এখন ইন্টার ক্লাস নেই। এটি ছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির মাঝামাঝি। সাধারণত প্রথম শ্রেণির গেটের বাম দিকে কর্নারে একটা ঘেরা দেয়া এলাকা থাকতো। কাঠের দরজা ও দেয়ালের উপরের অর্ধেক নেট দেয়া থাকতো। ভেতরে বসার জন্য চওড়া বেঞ্চি থাকতো। মধ্যবিত্তরা এর যাত্রী ছিলো। সম্ভবত নব্বইয়ের দশকে এই শ্রেণিটা তুলে দেয় স্টিমার কর্তৃপক্ষ।
স্টিমারের পরিবর্তনের কথাও জানাচ্ছেন জীবনানন্দ: 'সে স্টিমার নেই এখন আর। তার জায়গায় বড় নতুন স্টিমার এসেছে। সেকেন্ড ক্লাস এখন ঢের বেশি প্রশস্ত ও সুন্দর—অনেকগুলো কেবিন রয়েছে। কিন্তু সেসব দেখতে যাই না আজ আমি আর। ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ক্লাসের কথা মনেও হয় না। থার্ড ক্লাসের ফ্ল্যাটে বিছানা পেতে শুয়ে বিড়ি টানি—বাজারের কথা ভাবি।'
'প্রেতিনীর রূপকথা' উপন্যাসের বরাতে জানা যাচ্ছে, বরিশাল থেকে স্টিমার ছাড়তো সন্ধ্যায় এবং খুলনায় গিয়ে পৌঁছাতো খুব ভোরে। সাড়ে ৪টা ৫টার মধ্যে। খুলনা থেকে ট্রেন যেত কলকাতার শিয়ালদায়। 'মৃত্যুর গন্ধ' গল্পে জানা যাচ্ছে, দুপুর বেলা স্টিমার বড় নদী পাড়ি দেয়। তার মানে সকালে এটি ঢাকা থেকে ছাড়ে এবং বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার পরে চাঁদপুরের কাছে গিয়ে বড় মেঘনায় পড়ে। এই পথ বেশ দীর্ঘ। তারপর বরিশালের কাছাকাছি গেলে অপেক্ষাকৃত ছোট নদী কীর্তনখোলা বা জলসিড়ি।
তখনকার দিনের স্টিমারের বর্ণনাও পাওয়া যাচ্ছে এই উপন্যাসে: 'স্টিমারে একটা কি দুটো পিস্টন ছিল। বেশি জোরে চলতে পারত না। কুয়াশায় প্রায়ই দেরিতে এসে পৌঁছাতো। ভোরের ট্রেন ধরতে পারতাম না আমরা—বারোটার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত।' তার মানে স্টিমার ঘাটের কাছেই ছিল ট্রেন স্টেশন।
স্টিমার যে মাঝেমধ্যে দেরি করে আসতো, 'মৃত্যুর গন্ধ' গল্পেও সে কথা উল্লেখ আছে: 'স্টিমারটা সন্ধ্যার সময় আসিয়া পৌঁছিবার কথা ছিল। দেখিতে দেখিতে রাত অনেক হইয়া গেলো, তবু স্টিমারের দেখা নেই। কতদিক হইতে কত স্টিমার তো আসিয়া গেল, গুদামের একপাশে জেটির দরজার কাছে যেখানে সে বসিয়াছিল কতবার তো সিঁড়ি ফেলা হইল, সিঁড়ি গুটাইয়া নেওয়া হইল। দিকদিগন্তের হইতে রাজ্যেও লোক আসিল, চলিয়া গেল, ঘণ্টা বাজিল, ঘণ্টা থামিল, ঝকঝক করিয়া কত স্টিমার আসিয়া নোঙর করিল, নোঙর খুলিয়া চোঙের আওয়াজ বাজাইয়া লাল নীল বাতি জ্বালাইয়া দূর-দূরান্তের নদী ডিঙাইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু তবুও সন্ধ্যার সময় যে স্টিমারটি আসিবার কথা রাত বারোটার সময়ও তার দেখা নাই।'
স্টিমারের খাওয়া-দাওয়ারও বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে 'সাত কোশের পথ' গল্পে: 'কাল রাতেই তো স্টিমারে খেয়েছিল প্রবোধ, বাবুর্চিদের কোঠায় বসে দুথালা বালাম চালের ভাত আর দুডিশ মাংস, একটা ডিমভাজা, একখানা কাটলেট, পেঁয়াজ প্রচুর, মুসুরির ডাল, ভিনেগার চাটনি, অসহ্য গরমের রাতে পাঁচ গ্লাস জলও টানতে হয়েছে, প্রতিবারই বাবুর্চির ছোকরা জলের সঙ্গে বরফ মিশিয়ে দিয়েছে। সেই ইলেকট্রিক বাতি, স্টিমারের বাতি, নদীর জল, নদী, সে এক পৃথিবী, কিন্তু সে তার নিজের পয়সার পৃথিবী, কিন্তু সে পয়সা আজ আর নেই।'
১৯৩২ সালের ৭ জুলাই ডায়েরিতে জীবনানন্দ লিখছেন: 'স্টিমারে কোনও জায়গা নেই...বেডিং বাঁধা অবস্থায় রাখতে হল... লোকজন আমাকে লক্ষ্য করছে এবং আন্দাজ করতে চেষ্টা করছে... দুজন ঝালকাঠি যাবে, তাদের জায়গা দখল করবার লোভের আশায়... সমস্ত প্যাসেঞ্জারের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি নদী আকাশের দিকে তাকিয়েছি।'
নদী ও নদীর জলে জীবনানন্দের যে পৃথিবী—যে পৃথিবীতেই তিনি বারবার ফিরে এসেছেন, আসতে চেয়েছেন মৃত্যুর পরেও, যেখানে বারবার নিজেকে আবিষ্কার করেছেন, সেই আবিষ্কারের একটা বড় অনুষঙ্গ ছিল এই স্টিমার। 'চাকরি নেই' গল্পের নায়ক কলকাতা থেকে দেশের বাড়ি (বরিশাল) ফিরছেন: 'নদীর ডান কিনার দিয়ে পাড় ঘেঁষে স্টিমার চলছে। সাদা পাল তুলে একটা শান্ত নৌকার মতো যেন এই স্টিমার, এই গতি, নদীর জল কেমন গভীর সান্তনাময়। নদীর পথে স্টিমারের এই একঘেয়ে চলাফেরায় ঢের দেখেছিল সুকুমার, কিন্তু তবুও এই নদীগুলো, এই স্টিমার, প্রতিবারই তাকে নতুন আবিষ্কারের জন্য অপেক্ষা করতে বলত। আবিষ্কারের শেষ হয়নি আজো।'
এই গল্পে সুকুমার (মূলত জীবনানন্দ) নিজের কথাই বলছেন। ভোর না হতেই স্টিমারের মুখের কাছে এসে বসেছে সুকুমার। এই স্টিমারে চড়ে দেশের দিকে অনেকবার সে গেছে, প্রতিবারই ভোরের বেলা এমনি করে এই একই জায়গায় এসে বসেছে। চারিদিককার বন মাঠ গভীর ইন্ডিগোনীল আকাশকে আস্বাদ করেছে সে। উজ্জ্বল রোদের ভিতর নদীর জলে এক একটা মাছ লাফিয়ে উঠছে, উড়ছে যেন, এমনি মাছ হওয়া যেত যদি।...
তাঁর সময়ে স্টিমারগুলোর নাম কী ছিল? এই গল্পে তার একটা ইঙ্গিতও আছে। 'স্টিমার চলছে, কতগুলো স্টিমারের চোঙা দেখা যাচ্ছে দূরের থেকে। নদী এখানে স্টিমারের ডিপোর ভিতর চলে যাচ্ছে, এক একটা স্টিমারের নাম পেঙ্গুইন, কিংবা আফ্রিদি কিংবা চিতা।'
বরিশালের ঘাটে স্টিমার ভিড়লে তখন সেখানকার দৃশ্যপট কীভাবে পাল্টে যেত, তা জানা যাচ্ছে 'শেষ পছন্দের সময়' গল্পে: 'জেটির গরমের থেকে বেরিয়ে এক হলকা ঠান্ডা হাওয়া ও ঝিরঝিরে নদীর জলের ঘ্রাণ, বরিশাল স্টেশনের ইলেকট্রিকের বাতির সারি, দূর কেরোসিনের ডিবা জ্বালিয়ে লেমনেড আইসক্রিম…। আর একটু এগিয়ে ভাড়াটে গাড়ির সার, ঘোড়ার নাদ ও পেচ্ছাবের গন্ধ, এখন নানাদিকের স্টিমারের আসা-যাওয়ার সময়।...এমন সব জিনিস জীবনে কতবারই না সুবোধ দেখেছে। এর ভিতরকার সবচেয়ে গভীর দুর্বলতা ও ক্লেদও তার কাছে কত না নরম, মধুর।
তবে ঘাটে স্টিমার ভিড়লে কেউ যে তাকে অভ্যর্থনা জানানো বা ঘাটে যে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে না—সেই দুঃখবোধও তার ছিল। এই গল্পের শুরুটাই এরকম: 'সন্ধ্যার সময় স্টিমার নোঙর করল। সুবোধ জেটির দিকে একবার তাকাল। স্টেশনে তার জন্য কেউ কি এসেছে? কেন আসবে? কোনোদিনই কেউ আসেনি। এই পৃথিবীতে সে বিশেষ কিছু দামি জিনিস একটা নয়।'