ঢাকার পুরোনো বিষয়আশয়
বাংলা যখন সত্যিই গর্ব করে বলার মতো বাংলা ছিল, তখনকার মানচিত্রটি কল্পনা করা যাক, এবং একই সঙ্গে ভাবুন সেই বাংলার রাজধানী ঢাকা:
আজকের বাংলাদেশ পুরোটাই+ পশ্চিম বঙ্গ+ভুটান+নেপালের পূর্ব প্রান্তের দুটি প্রদেশ+ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য+ভারতে আসাম+আন্দামান-নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ, অরুনাচল প্রদেশ+সিকিম+মনিপুর+নাগাল্যান্ড+উড়িষ্যা+মিজোরাম+ঝাড়খন্ড ও বিহারের কিছু অংশ।
বাংলা তিন সুলতানের রাজত্ব: সোনারগাও সরকার, লখনৌ বা গৌড় সরকার এবং সাতগাঁও সরকার। ঢাকা বা কোলকাতার গোড়াপত্তনের আগে অন্তত তিনটি রাজধানী শহরের অস্তিত্ব ছিল।
১৩৪৬ সালে ইবনে বতুতা বাংলার যে শহরে অবতরণ করেন তার নাম সাদাকাওন--চাটগাঁও, যথেষ্ট বড় শহর হিসেবে এটি তার কাছে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলায় প্রথম ইউরোপিয় বসতি কোলকাতায় নয়, ঢাকায়ও নয়। কোলকাতায় শহরপত্তনের অনেক আগে, চট্টগ্রামে। ৯ মে ১৫১২ চারটি জাহাজের বহর পর্তুগিজ নাগরিক বোঝাই করে চট্টগ্রাম সৈকতে অবতরণ করে, বসতি স্থাপন করে এবং তাদের অনুসরণে আসা পর্তুগিজরা মিলে অনেকটা পর্তুগিজ টাউন সৃষ্টি করে। তাদের অবস্থানকাল ১৬৬৬ পর্যন্ত।
ভারত সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলেই (শাসনকাল ৩ নভেম্বর ১৬০৫ থেকে ২৮ অক্টোবর ১৬২৭) বিহারের সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি খান ১৬০৭ সালে বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব নেন। তিনি সাহসী ছিলেন, ধার্মিক ছিলেন এবং নিষ্ঠুর ছিলেন। সম্রাটের কর্তৃত্বও কখনো কখনো অস্বীকার করতেন। চার্লস স্টুয়ার্ট লিখেছেন, ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই তার মৃত্যু বাংলার মানুষের জন্য স্বস্তির কারণ হয়েছে কারণ তারা তার নিষ্ঠুরতা পূর্ণমাত্রায় দেখার সুযোগ পাননি। আবারও বিহারের সুবাদারকে বাংলার সুবাদার করে পাঠানো হলো। রাজধানী তখন রাজমহল। ৩৮ বছর বয়সী সুবাদার রাজমহলে এসে বাংলার সঙ্কট ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করলেন। ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খাঁসহ বহু সংখ্যক বিদ্রোহী জমিদার ও সামন্তরাজদের সার্বক্ষণিক মোকাবেলা ব্যস্ত থাকতে হবে। অন্যদিকে দক্ষিণ থেকে আগত পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যু এবং আরাকানিদেরও প্রতিরোধ করতে হবে। রাজমহল থেকে তা করা সম্ভব নয়। সুতরাং রাজধানী স্থানান্তর করে ঢাকায় নেবার অনুমোদন পেতে তার সমস্যা হলো না। সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন কেবলই রাজকুমার সেলিম তার সেই বয়সের সঙ্গী ইসলাম খান চিশতি।
বাংলার খণ্ড খণ্ড অংশ মোগল কর্তৃত্ব মেনে নিলেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল দুর্বিনীত ও সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ বর্হিভূত। সুবাদার ইসলাম খান চিশতি ১৬১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ঢাকার রাজধানীর গোড়পত্তন করেন, সেনা ও নৌবাহিনী শক্তিশালী করেন, চট্টগ্রাম ছাড়া বাংলার পুরোটাই মোগল সাম্রাজ্যের আওতায় নিয়ে আসেন, ঢাকা নামটি আগে থেকেই ছিল, সম্রাটকে সম্মান জানাতে এবং সন্তুষ্ট করতে ঢাকার নতুন নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। পাঁচ বছর সুবাদার থেকে (ঢাকায় অবস্থানকাল তিন বছরের বেশি) ১৬১৩ সালে ইসলাম খান ঢাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন। মির্জা নাথানের বাবা মালিক আলী, পরবর্তী সময় ইহতিমাম খান খেতাবপ্রাপ্ত, ইসলাম খানের নৌবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। মির্জা নাথানের বাবার সাথে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি এসে যে ঢাকা দেখেছেন তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল : কলতাবাজার, বাংলাবাজার, গোবিন্দগঞ্জ (দয়াগঞ্জ), মোহনগঞ্জ, পাটুয়াটুলি, সূত্রাপুর, নারায়িনদিয়া (নারিন্দা), রুকনপুর, তাঁতীবাজার, কালুয়ানগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, শাখারীবাজার, কামারনগর, কুমারতলী, রায়সাহেব বাজার, লক্ষ্মীবাজার, শাখারীবাজার, কামারনগর, কুমারতলী, রায়সাহেব বাজার, লক্ষ্মীবাজার, ফ্রেঞ্চগঞ্জ (ফরাসগঞ্জ) আলমগঞ্জ ও পোস্তগোলা।
সুবেদার ইসলাম খানের সময় সম্প্রসারণ:
চকবাজার, মনোহর খান বাজার, কেল্লিয়া বাজার (কিল্লাবাজার, লালবাগ) বংশীবাজার, বকশীবাজার, দেওয়ান বাজার, বাজার মীর মুরাদ, বাজার করতলব খান (বেগম বাজার), এনায়েতগঞ্জ, সুলতানগঞ্জ, বুরানগঞ্জ (বোরহানগঞ্জ), চাঁদনীঘাট, সোয়ারীঘাট, ইসলামপুর, নবাবপুর, নিমতলী, ঢাকেশ্বরী, লালবাগ, পূর্ব দরওয়াজা (ইসলাম খানের কেল্লার পূর্ব ফটক, সাবেক সেন্ট্রাল জেল), ফুলবাড়িয়া, ফুলমান্দি, আজিমপুর, পাকুরতলী, আমলীগোলা, নবাবগঞ্জ, নবাব বাগিচা, হাজারীবাগ, জাফরাবাদ, আতিশখানা, মোগলটুলী, চৌধুরী বাজার, ইমামগঞ্জ, মালীটোলা, মাহুতটুলী, কায়েতটুলী, পিলখানা, মীরপুর।
(আবদুল করিমের মোগল রাজধানী ঢাকা থেকে উদ্ধৃত)।
বিদ্রোহী সামন্ত নেতা, দুর্বিনীত জমিদার এবং পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যু ছিল বলেই ঢাকা বাংলার রাজধানী হতে পেরেছে। শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। যদি তা না হতো তাহলে জলদস্যুর নাগালের বাইরে হয়ত চাপাই নবাবগঞ্জ কিংবা ঠাকুরগাঁয়ে হতো জাতীয় সংসদ ভবন, সচিবালয় এবং প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দফতর।
ঢাকায় প্রথম দিককার বিদেশি
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের বর্ণনা অনুযায়ী ১৬৬০ সালের দিকে ঢাকায় ইংরেজরা আসতে শুরু করে। ফরাসি পর্যটক জে বি ট্যাভার্নিয়ার (১৬০৫-১৬৮৯) প্রথমবার ঢাকায় এসেছিলেন ১৬৪০ সালে, কিন্তু সে সময়কার কোনো বৃত্তান্ত লিখে যাননি, তবে দ্বিতীয়বার ১৬৬৬ যখন আসেন বেড়ে উঠা শহর হিসেবে ঢাকার প্রশংসা করেন। তিনি ১৪ জানুয়ারি ১৬৬৬ তিনি সুবাদার শায়েস্তা খানের সাথে দেখা করেন এবং তার কাছে মূল্যবান পাথর বিক্রয় করেন। সে সময় সুবাদার বাস করতেন দেয়াল ঘেরা একটি তাবুতে। তখন নদীর তীরে বাড়ি করার একটি প্রবনতা থাকার কারণে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে শহর গড়ে ওঠে। সে সময় তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির প্রধান মিস্টার প্র্যাটের সাথেও দেখা করেন।
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার জেমস টেলরের টপোগ্রাফি অব ঢাকা থেকে উদ্ধৃত করেন: ১৬৭৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট সুলতান মোহাম্মদ তাজিমকে ২০০০ পাউন্ড বখশিস দিয়ে ঢাকায় বিনা শুল্কে অবাধে বাণিজ্য করার অধিকার আদায় করে নেন। কিন্তু শায়েস্তা খান ১৬৮৬ সালে কোম্পানির ফ্যাক্টরি বাজেয়াপ্ত করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলায় কোম্পানির সব সম্পদ তিন বছরের জন্য আটক ছিল এবং তখন ইংরেজদেরও কারাগারে আটক করা হয়। ১৭৬০ সাল পর্যন্ত কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারি সংখ্যা পাঁচ অতিক্রম করেনি। ১৭৭৮ সালে ঢাকায় বসবাসকারী ইংরেজের সংখ্যা ছিল ৩৭ জন আর ১৮৩৮ সালে তা বেড়ে ৪৭-এ পৌঁছে। ১৮৮৭ সালে ম্যাজিস্ট্রেট রিপোর্ট করেন ঢাকায় ইউরোপিয়ান, ইস্ট ইন্ডিয়ান এবং আর্মেনিয়ান নাগরিকের সংখ্যা ৬৯ জন--তা অবশ্য শহরের ভেতরে।
১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে ঢাকা জেলায় ইউরোপিয়ান ও ইস্ট ইন্ডিয়ানের সংখ্যা ৫৮২০। হান্টার উল্লেখ করেন আর্মেনিয়ান জনগণের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তাদের সম্পদও হ্রাস পাচ্ছে। এক সময় তাদের সংখ্যা এবং তাদের রমরমা অবস্থা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ১৮৭১ সালে আর্মেনিয়ানদের সংখ্যা একশতের নিচে নেমে আসে, তাদের মধ্যে ৬ জন ভূ-স্বামী, ২ জন ব্যবসায়ী, ৪ জন দোকানদার, বাকীদের বিভিন্ন পেশা। ১৮৭২ এর আদমশুমারির মতে সর্বমোট আর্মেনিয়ান ১২১; তারা তাদের রক্ষনশীলতা ত্যাগ করে ইউরোপিয় অভ্যাস ও আচরন রপ্ত করার চেষ্টা করছে। ঢাকার কালেক্টর বলেছেন, এটা বরং তাদের জন্য ভালো হয়েছে।
ঢাকা শহরে গ্রিকদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ১৮৭২-এর আদমশুমারিতে গ্রিকের সংখ্যা মাত্র ১৪; এতো কম যে তাদের জন্য পৃথক গ্রিক চার্চ অযৌক্তিক হয়ে পড়ে। ফলে তা ক'বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পরিবার প্যানিরতদের পর্যাপ্ত ভূ-সম্পত্তি রয়েছে, কিন্তু তার সবই বাকেরগঞ্জ (জানা আবশ্যক বাকেরগঞ্জ ১৮১৭ পর্যন্ত ঢাকা ট্যাক্স কালেক্টরেটের অধীনই ছিল) আর্মেনিয়ানদের মতোই ঢাকার গ্রিকদের সংখ্যা ও সম্পত্তি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
ঢাকা থেকে হিন্দুদেরও অভিবাসন হচ্ছে, তারা মৃত্যুবরণ করার জন্য বেনারস, বৃন্দাবন কিংবা অন্য কোনো পবিত্র স্থানে যাচ্ছে। মুসলমানরাও তাদের ধর্মীয় তীর্থে যায়, কিন্তু তাদের সংখ্যা সামান্য, তারা ফিরে আসে।
ব্রিটানিয়া ১৯৩৪
কোলকাতা তখন ভারতের প্রথম সিনেমা হলটি নির্মিত হয়েছিল চৌরঙ্গিতে--'চ্যাপলিন সিনেমা' নাম। ১৯০৭ সালে জামশেদজি ফ্রমিজি মদন এটি নির্মাণ করেছিলেন। এখন আর এটির অস্তিত্ব নেই। ১৯১৩ -১৪ সালে একটি পাটের গুদামকে থিয়েটারের রূপান্তর করে নাম দেওয়া হয় পিকচার হাউস; সন্দেহ নেই এটিই বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল।
প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালে লেজার নামের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক আর্মানিটোলা এলাকায় গুদামটি থিয়েটারে রূপান্তরিত করেন। কেউ মনে করেন এটি আসলে নবাব ইউসুফ খানেরই স্থাপনা, পরবর্তী সময়ে লেজার এটি কিনে নেন। ১৯২৪ সালে সদরঘাটে নির্মিত হয় দ্বিতীয় সিনেমা হল পিকচার প্যালেস। পঞ্চাশের দশকে পিকচার হাউস সংস্কার করে আধুনিক সিনেমা হলে পরিণত করা হয়; এটিই বিখ্যাত শাবিস্তান সিনেমা হল। নতুন সহস্রাব্দে সেই শাবিস্তান আর নেই। আর একটি সিনেমা হলের বর্ণনা দিয়েছেন কবীর চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরের পাঁচটি পুরোনো সিনেমা হলের চারটি পিকচার প্যালেস, মুকল, রূপমহল এবং লায়ন আর 'একটির কথা সব সময় সবার মনে থাকে না, তার অস্তিত্ব আর এখন নেই, নতুন পুরাতন কোনো নামেই নেই। সেটা ছিল বিচিত্র একটি হল, পল্টনের বিরান এলাকায় নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা একটা লম্বা প্রেক্ষাগৃহ, উপরের ছাদ যতদূর মনে পড়ছে ছিল টিনের। চারপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই, কোনো খাবারের স্টলও নেই। সে হলে কোনো ম্যাটিনি শো হতো না। ছবি দেখানো হতো শুধু সন্ধ্যা ছ'টায় ও রাত ন'টায়। ওই সিনেমা হলের বৈশিষ্ট্য ছিল যে সেখানে শুধু ইংরেজি ফিল্ম দেখানো হতো। ওই হলে আমি ও আমার ভাই মুনির অনেক ইংরেজি ছবি দেখেছি বহু প্রসিদ্ধ তারকার অভিনয় দেখ চমৎকৃত হয়েছি: রবার্ট টেইলার, ক্লার্ক গ্যাবল, স্পেন্সর ট্যাসি, এরল ফ্লিন, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, মার্লিন ডিয়েট্রিচ, বেটি ডেভিস, গ্রেটা গার্বো, মেরিলিন মনরো, জেন ফন্টেইন এবং আরো কত কত অভিনেতা অভিনেত্রী। এই সিনেমা হলটির নাম ছিল ব্রিটানিকা এখন এই রকম নাম খুব হাস্যকর মনে হয়। তখন কিন্তু কোনো কিছুই মনে হয়নি। ব্রিটানিকায় দর্শক সংখ্যা খুব অল্প হতো। এখন ভাবি কেমন করে মালিক তার ব্যবসা চালাতেন। নিশ্চয়ই তার আয়ের অন্য উৎস ছিল। এটা ছিল তার একান্ত সুখের কারবার। (কৈশোরের ঢাকা)
কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত লিখেছেন তার ছেলেবেলার ঢাকা শহরের তিনটি সিনেমা হলের কথা--আরমানিটোলায় পিকচার হাউস, সদরঘাটে সিনেমা প্যালেস এবং জনসন রোডে তদানীন্তন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারির অনতিদূরে মুকুল সিনেমা। তিনটির মধ্যে পিকচার হাউসই ছিল সর্বাপেক্ষা প্রাচীন প্রেক্ষাগৃহ। এই হলে মহিলাদের বসবার আলাদা ব্যবস্থা ছিল হলের এক কোনো পর্দাবেষ্টিত জায়গায়, কেননা হলটি ছিল এক তলা। আমার জীবনের প্রথম বায়োস্কোপ আমি দেখেছিলাম এই হলেই... তখন ছিল সিনেমার নির্বাক যুগ। সিনেমা হলের সামনের দিকে একাধারে পিয়ানো ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজাবার জন্য যন্ত্রীরা উপস্থিত থাকতেন এবং গল্পের সিচুয়েসান অনুযায়ী যন্ত্রসঙ্গীত বেজে চলত যাতে দর্শক হৃদয় উদ্বেলিত হয়। করুণ দৃশ্যে বেহালা ও পিয়ানোর সহযোগে করুণ সুর, যুদ্ধ বা লড়াইয়ের সময় রণদামামার শব্দ সৃষ্টি এবং আনন্দ কোলাহলের দৃশ্যকে দর্শক মনে পৌঁছে দেবার জন্য দ্রুতলয়ে যন্ত্রসঙ্গীত চালনা এসবই আমাদের মতো বহু কিশোরের মনে গভীর রেখাপাত করত। (গলিপথে হাঁক: মুশকিল আসান)
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেছেন রমনার ব্রিটানিয়াসহ চকবাজারের তাজমহল, আরমানিটোলার নিউ পিকচার প্যালেস, ইসলামপুরের লায়ন, ওয়াইজঘাটে মায়া (পরিবর্তিত নাম স্টার) বংশাল রোডে মানসী (পরে নিশাত) সদরঘাটে রূপমহল, নবাবপুরে মুকুল, জনসন রোডে নাগরমহল (পরে চিত্রামহল), তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানা (সাবেক) থেকে একটু সামনের একটি সিনেমা হলের কথা বলেছেন যা সবার আগে বন্ধ হয়ে যায়। ৭৫ মিলিমিটার স্ক্রিনের প্রথম সিনেমা হল মুনের কথাও তিনি লিখেছেন।
গণী মিয়ার চা খানা
শুধু সুপেয় পানি সরবরাহ নয়, ঢাকাবাসীর মন-মানসিকতার আধুনিকায়নে গাটের পয়সা খরচ করতেন নওয়াব আবদুল গণী। তিনি ঢাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে চা খাওয়া শিখিয়েছেন। যারা চা পানের মাহত্ম্য বোঝেন না, বিলেতিদের কাছে তারা তখন আনসিভিলাইজড। হাকিম হাবিুর রহমানের গ্রন্থ থেকে তুলে ধরা হচ্ছে:
"আমি খুব ছোটবেলায় গণী মিয়ার চা খানার নাম শুনেছি। অর্থাৎ নবাব আবদুল গণীর বাড়িতে সকালে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা চায়ের টেবিলে জমা হতো এবং চা পান করতেন। এটা তেমন কিছু গুরুত্ববহ নয়। কিন্তু বাড়তি ব্যাপার এই যে ঐ টেবিলে শহরের নামকরা বাইজীরা (তাওয়াসেফ) উপস্থিত হতো। তাদের সফরসঙ্গীরা অন্য কামরায় থাকত। যদি ইচ্ছে হতো তা হলে কেউ কিছু রাগ আলাপ করত। এভাবে শ্রবণ সুখও লাভ হতো। বাইজী যারা টেবিলে উপস্থিত হতো তাদের এক লম্বা তালিকা রয়েছে। নবাব সাহেবের সরকার থেকে তাদের মাসিক বেতন দেয়া হতো।'
হাকিম সাহেব তিন ভগ্নি বাইজি--আন্ন, গান্ন ও নওয়াবীনের নাম শুনেছেন, সবচেয়ে কমবয়সী নওয়াবীন সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আবেদি বাইজি পাটনার, সন্তানহীন পিয়ারী বিহারের, লখনোর মেয়ে আচ্ছি একজন নৃত্য পটিয়সী, দাসু পাটনার, খুব প্রগলভ ছিলেন। হাকিম সাহেব তার মেয়ে জমরদের ওস্তাদী গান বাল্যবয়সে শুনেছেন, বৃদ্ধাবস্থায় হীরার নাচ দেখেছেন; পান্নার সুনাম ছিল গজলে, একমাত্র পান্নাই উত্তর ভারতে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে গেছেন। অন্যরা সমাহিত হয়েছেন। তিনি আমীর জান, অতুল বাই, লক্ষ্মীবাই এবং রাজলক্ষ্মী বাইর কথাও বলেছেন।
হাকিম হাবিবুর রহমানের শৈশবে ঢাকা শহরে একটি চায়ের দোকানও ছিল না--শুধু মাত্র মোগল, আর্মেনীয় এবং কাশ্মীরী সভ্রান্ত ব্যক্তিরা চা সেবন করতেন। তবে একজন চাওয়ালা প্রজ্জলিত সমোভার নিয়ে রাত বারোটায় চা ফেরি করতেন। তবে গণী মিয়ার চা খানাই অভিজাত পরিবারে চায়ের প্রচলনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে।
নিত্যসঙ্গী চা
ভারতে চায়ের কাটতি বাড়াতে টি সেস কমিটি বার্ষিক প্রচারণা ব্যয় ৫ লাখ টাকা থেকে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে বার্ষিক পৌনে আট লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করেছে। রেলস্টেশনে বিনামূল্যে গরম চা খাইয়ে গরিব মানুষদের নেশাসক্ত করে তুলছে। চা-এর ওপর বক্তৃতা ও নসিহত করার জন্য বিশেষ মিশন বার্মায় পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই চায়ে মশুগুল হয়ে পড়েছে। গবির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছোট ছোট চায়ের প্যাকেট বাজারজাত করা হয়েছে। 'মোট কথা কমিটি বুঝিতে পারিয়াছে, এত বড় ভারতবর্ষের লোকদের যদি চাখোর করা যায়, তাহা হইলে শেতাঙ্গ চা-করজিকে (টি ট্যাক্স কালেক্টর)আর বিদেশে বাজার জুড়িয়ে অস্থির হইতে হইবে না।'
২৮ অগ্রহায়ণ ১৩৩৬ 'সঞ্জীবনী' পত্রিকা প্রশ্ন রেখেছে চা পান না বিষ পান? '৩৩ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে যদি সাড়ে ১৬ কোটি ভারতবাসী অর্থাৎ অর্ধেক লোক প্রত্যহ ১ পয়সার চা পান করে বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় তবে প্রতিদিন ২৫ লাখ টাকা অর্থাৎ মাসে মাসে সাড়ে ৭ কোটি টাকা অথবা বৎসরে ৯০ কোটি টাকা আমরা চা পানে নষ্ট করি। এদিকে ভারতবাসীর গড়ে দৈনিক আয় ৬ পয়সা মাত্র। চা-বিষ প্রাতকালে খালি পেটে সেবন করিয়া আমরা অজীর্ণ প্রভৃতি রোগে ভুগি। চা পানের ফলে ভাত প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য বেশি খাওয়া যায় না। ১ পয়সার চায়ের লোভে আমরা আয়ু কমের ব্যবস্থা করি।'
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বঙ্গলক্ষ্মীতে' চায়ের কুফল লিখেন যে, যে চা পানে সর্বনাশা অভ্যাসটি এবার হয়ে গেল তা ক্রমশ বেড়ে যায় এবং এক সময় দৈনিক দশ বারো কাপ চা খেতে হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন দেখল বিলেতিদের চায়ের জন্য স্বাধীন দেশ চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়, তারা মতলব আঁটলেন ব্রিটেনের অধীন ভারতবর্ষে চায়ের উৎপাদন শুরু করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮৩৪ সালে চীন থেকে চীনা চা-শ্রমিক আনিয়ে চায়ের কাজে লাগিয়ে দিলেন। বেন্টিঙ্ক সাহেব সতীদাহ বন্ধ করে যে পুণ্য কামালেন, চায়ের অপব্যাবহারের যে মর্মদাহ সৃষ্টি করলেন তাতে তার পুণ্য ঢাকা পড়ে গেল।
চা প্রচলনের বিরুদ্ধে লেখালেখি যতই হোক, কাজ হল না। ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলার মানুষ চা না খেয়ে দিনটা শুরু করতে পারে না। সেকালে আরও লেখা হয় চা সঙ্গদোষের সৃষ্টি করে- এ চায়ের দোকানেই যত বখাটে ছেলের আড্ডা হয়। এখানে যত অসৎ প্রবৃত্তির উৎপত্তি। তবুও চাপান বেড়েই চললো।
ঢাকা পাচাস বারস পহেলে
বইয়ের নাম পঞ্চাশ বছর আগের হলেও হাকিম হাবিবুর রহমানের এ ঢাকা ১২৬ বছর আগেকার (১৮৯৫)। তিনি মসলিনের কথা বলেছেন: আমার বাল্যাবস্থায় এমন কোনো তাঁতি জীবিত ছিল না যে, মসলিনের জন্য সুতা তৈরি করতে পারত। অবশ্য হাতে প্রস্তুত সুতার কিছু প্রাচীন ভান্ডার রয়ে গিয়েছিল যা দিয়ে এক আধখান (কাপড়) তৈরি হতে পারত। আমার বাল্যকালের অনেক আগে থেকেই বিলেতি সুতার আগমন শুরু হয়েছিল এবং তা থেকে মসলিন বানানো হতো--তাও মসলিনের সব ধরন নয়, যেমন: শবনম, আবরওয়া প্রস্তুত হতে পারত না। মোহাম্মদ রেজাউল করিম অনূদিত এই গ্রন্থের পাদটীকায় যতীন্দ্রমোহন প্রণীত তালিকার অনেক ধরনের মসলিনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
ঝুনা, রং, সরকার আলী, খাসা, শবনম আবরোয়ান, আলাবান্নে, তঞ্জেব, নয়নসুখ, বদনখাস, সরবন্দ, সরবতি, কুমিস, ডুরিয়া ডোরাকাটা, রাজকোটন, ডাকান, পাদশাহীদার, কুস্তিদার, কাগজাহি, কলাপাতা ইত্যাদি), কারখানা চেক (নন্দনশাহী, আনারদানা, কবুতর খোপা, আকুতা বাছাদার, কুন্ডিদার), জামদানিগোত্রের তাড়াদার, করেলা, বুটিদার, তেরছা, জললার, পান্নাহাজার, মেল, দুবলিজাল, ছাওয়াল, বালাআর, ডুরিয়া, গেদা, সাবুরগা, মলমল খাস ইত্যাদি।
লেখকের বেতন
যত লেখালেখিই করি না কেনো, কেউ কেউ লেখক হিসেবে চেনার পরও, এমনকি বইপত্র থাকার পরও জোর দিয়ে বলতে পারি না আমি লেখক--আই অ্যাম অ্য রাইটার। কিন্তু কোম্পানি আমলে নিয়োগপত্র দেখিয়ে বলা যেত যে আমি লেখক। তবে সেই রাইটারের কাজটা ঠিক গল্প উপন্যাস লিখা নয়, খাতাপত্র লিখা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠিতে রাইটার ছিলেন ৫ জন, তাদের মাসিক বেতনও নির্ধারিত ছিল :
গরীব বখশ ১০ টাকা, প্রতিমাসে
গুজর মল ১০ টাকা, প্রতিমাসে
ভিশন মল ৭ টাকা, প্রতিমাসে
রাম রাম সেন ৬ টাকা, প্রতিমাসে
গুরু দয়াল ৫ টাকা প্রতিমাসে
তেজগাঁও-এর জন্যও দু'জন লেখক ছিলেন:
ভোলা দাস ১০ টাকা প্রতিমাসে
শংকর ৪ টাকা প্রতিমাসে।