দুধ চায়ের শক্তি
এককালে এশিয়ায় চা পানীয় নয়, দাওয়াই ছিল। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় উপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো পা রাখার পর চা চলে এল পণ্য বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক লুটপাটের অগ্রভাগে। এটা অনেকটাই ঔপনিবেশিক পানীয়তে পরিণত হলো।
তবে একবিংশ শতকে এশিয়াজুড়ে তৃণমূল পর্যায়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের স্লোগান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে দুধ চা। এবার চা হয়ে উঠেছে এশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী শাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। চীনের নয়া সিল্ক রোড ও উইঘুরদের ওপর অত্যাচার, ভারতের করপোরেট কৃষি আইন, মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান, থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্র, হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ও গণতন্ত্রের ওপর দমন-পীড়ন, ইন্দোনেশিয়ার সাম্রাজ্যবাদ এবং পশ্চিম পাপুয়ার কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনসহ অসংখ্য আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে দুধ চা।
ঔপনিবেশিক পণ্য হিসেবে চা
অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে চা হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয় পণ্য। ইউরোপের উদীয়মান মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে ব্যাপক চাহিদা ছিল এই পানীয়ের।
সে সময় চীন ছিল কৃষিপ্রধান স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ব্রিটিশ বণিকদের কাছে চীনের চা, সিল্ক এবং চিনামাটির বাসন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল। কিন্তু চীনারা কেবল রুপার বিনিময়ে পণ্য বিক্রি করত। ফলে ব্রিটেনের প্রচুর রুপা চলে যায় চীনের কাছে। এটা ঠেকাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও অন্য ব্রিটিশ বণিকেরা ভারতে উৎপাদিত আফিম অবৈধভাবে চীনে পাচার করতে শুরু করে। এর বিনিময়ে তারা রুপা নিত। সেই রুপা দিয়ে কিনত চীনের চা, সিল্ক। একসময় চীনের জনগণ ব্রিটিশদের কাছ থেকেই আফিমকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা শেখে। ফলে আফিমের চাহিদা আরও বেড়ে যায় দেশটিতে।
আফিমের এই মারাত্মক প্রতিক্রিয়া বুঝতে পেরে চীনের রাজা আফিম আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই নিয়ে চীন-ব্রিটেনের মধ্যে বেধে যায় যুদ্ধ, যা পরিচিত আফিমের যুদ্ধ নামে। যুদ্ধে চীন হেরে যায়। চীনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বন্দর ব্রিটিশদের ছেড়ে দিতে হয়। সেই সঙ্গে গোটা চীনে ব্যবসা করার অনুমতি পায় ব্রিটিশরা। হংকংকে যুক্ত করা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। বাংলা ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আফিম যেত চীনে।
চায়ের মতো পপিও দাওয়াই হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যাপক পরিসরে আফিম চাষ শুরু করে। ফলে পপি পরিণত হয় অর্থকরী ফসলে।
হংকংয়ে চা জনপ্রিয় পানীয়তে পরিণত হয়। তবে দুধ চা আবিষ্কারের কৃতিত্ব কর্মজীবী শ্রেণির।
দ্বীপ উপনিবেশটিতে তাজা দুধের খুব অভাব ছিল। কেবল বিত্তবান উপনিবেশ স্থাপনকারীদেরই তাজা দুধ পানের সৌভাগ্য হতো। সাধারণ মানুষ প্রথমে ঘনীভূত দুধ ও পরে কনডেন্সড দুধ খেত। দুই ধরনের দুধই আসত কৌটায় করে। কৌটার দুধ হিমায়িত না করে সহজে উন্মুক্ত স্থানেই সংরক্ষণ করা যেত। ইংরেজরা কাপে বা চা-পাত্রে টি-ব্যাগ ডুবিয়ে চা তৈরি করত। কিন্তু হংকংয়ের রাঁধুনিরা নতুন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করে। তারা প্রথমে পানিতে চা-পাতা ফুটিয়ে তারপর এর সঙ্গে ঘনীভূত দুধ যোগ করত। এ ছাড়াও চা ছাঁকা হতো মেয়েদের মোজা দিয়ে। এটাও হংকংয়ের কর্মজীবী শ্রেণির রাঁধুনিদের আবিষ্কার।
এভাবেই দুধ চায়ের জন্ম। হংকংয়ের কর্মজীবী শ্রেণির এই আবিষ্কারের ফলে চা চলে এল সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে।
পানীয় হিসেবে চায়ের জয়যাত্রা কিন্তু উপনিবেশ বিস্তারের ফলেই হয়েছে। উপনিবেশের সীমানা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের চক্রে আসাম, দার্জিলিং ও শ্রীলঙ্কায় (তৎকালীন সিলন) ব্যাপকভাবে চা এস্টেট তৈরি হতে থাকে। ব্রিটিশরা উপমহাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত কৃষক-শ্রমিকদের ব্যবহার করে চা ব্যবসা চালিয়ে যায় মহাসমারোহে। ফলে চায়ের বাজারে চীনের একচেটিয়া কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে যায়।
তবে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে অদ্ভুত ইংরেজ রুচি ও উপনিবেশবিরোধী মনোভাবের কারণে উপমহামদেশের মানুষ চা পানে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। অনেকেরই ধারণা ছিল, ইংরেজরা উপমহাদেশের মানুষের দুধ ও ঘোল পানের অভ্যাস ভোলাতে ষড়যন্ত্র করে চা-কে জনপ্রিয় করে তুলছে।
তবে এটাও ঠিক যে চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য ব্রিটিশরা অনেক প্রোপাগান্ডামূলক প্রচারণা চালিয়েছে। ঔপনিবেশিক এই পানীয়ের কাছে প্রথম আত্মসমর্পণ করে কলকাতার অভিজাত বাবুসমাজ। ১৯৩০-এর দশকে পানীয়টির জাতীয় ভাবমূর্তি সৃষ্টির জন্য ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ডকে ঢেলে সাজানো হয়। ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত 'সঠিক পদ্ধতিতে' চা বানানোর বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এর ফলে বেড়ে যায় চা-পাতা বিক্রি।
একপর্যায়ে আবির্ভাব ঘটে চা-ওয়ালাদের। মসলা, ফুটন্ত পানি, চা-পাতা ও গরম দুধসহযোগে তৈরি চা বিক্রি করতে থাকে চা-ওয়ালারা। পর্যায়ক্রমে গোটা উপমহাদেশের সব রেলস্টেশনে ছড়িয়ে পড়ে এই চা-ওয়ালারা।
এখন নানা অনুপাতে নানা ধরনের মসলা ও গাছড়া, চা-পাতা এবং দুধ (গরু, মহিষ) ব্যবহার হয় দুধ চা তৈরিতে। কালের পরিক্রমায় উপমহাদেশে এখন নিয়ম করে চা পান রীতিমতো ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবাদের স্লোগান হিসেবে দুধ চা
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এশিয়ান রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ঢেউয়ে দুধ চা প্রতিবাদের স্লোগান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়দের তাড়ানোর পর এশিয়ায় তাদের জায়গা নিয়েছে নব্য সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা। জিনজিয়াংয়ে চীন, কাশ্মীরে ভারত, পশ্চিম পাপুয়ায় ইন্দোনেশিয়া।
এই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নেমেছে 'মিল্ক টি অ্যালায়েন্স'। জিনজিয়াং থেকে কাশ্মীর- সর্বত্রই পুঁজিবাদী অভিজাত 'জাতীয়তাবাদী'দের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
মিল্ক টি অ্যালায়েন্স কী? এটা হংকং, থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানে শুরু হওয়া তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন। ২০২০ সালের এপ্রিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলনের সূত্রপাত, চীন সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে।
সেই থেকে এই আন্দোলন এশিয়া মহাদেশ থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হয়ে, এমনকি বেলারুশেও পৌঁছে গেছে এ আন্দোলনের ঢেউ।
মিল্ক টি অ্যালায়েন্সের কোনো নেতা নেই। এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত এবং বিকেন্দ্রীভূত। ২০১৯ সালে হংকংয়ের 'বি ওয়াটার মুভমেন্ট'-এ এই জোট অভিনব সড়ক প্রতিবাদের কৌশল দেখায়।
ইয়াঙ্গুন, ব্যাংকক ও হংকংয়ের রাস্তায় বেশ অনেকগুলো মিল্ক টি অ্যালায়েন্স প্রতিবাদ মিছিল বের হয়েছে। এ ছাড়া অ্যাকটিভিস্টরা টুইটার (যেমন @মিল্কটি-ইন্ডিয়া ও হ্যাশটাগ, #মিল্কটিঅ্যালায়েন্স) ও এসবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর এ আন্দোলন আরও তীব্র হয়।
তবে উপমহাদেশে দুধ চা জোট আন্দোলন এখনো তত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। যদিও ভারতে চলমান কৃষক আন্দোলনে দুধ চা-কে ভারতের কৃষক ও কৃষক শ্রমিকদের সংহতির স্লোগানের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে হওয়া আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন নারীরা। শাহিনবাগে জড়ো হওয়া আন্দোলনকারীরা মানবিকতার বন্ধন দৃঢ় করতে সেখানে চা বিতরণ করেছিলেন। দুধ চা এখানে আন্দোলনকারীদের জন্য প্রতীকী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
দিগন্তে উঁকি মারছে এশিয়া বসন্ত?
মিল্ক টি অ্যালায়েন্স সর্বএশীয় সংহতি ও রাজনৈতিক সচেতনতার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি পারবে নতুন এক যুগের সূচনা করতে।
একটা কথা ফের স্মরণ করছি, এশিয়ায় একসময় চা দাওয়াই হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমান যুগে চা এক নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। নিজের গা থেকে ঔপনিবেশিক পণ্যের তকমা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে পানীয়টি। চাইছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা অঞ্চলে সংহতি গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখতে। ট্রিন টি মিন-হা তাঁর এলসহোয়্যার, উইদিন হিয়ার বইয়ে চায়ের বদলে দেওয়ার এবং পানির 'দেয়াল' ভাঙার ক্ষমতা নিয়ে লিখেছেন। দেয়ালের শরীরী অস্তিত্ব আছে- এটি বাস্তব। এই দেয়াল হলো মানুষকে আলাদা করে রাখার জন্য একুশ শতাব্দীর কাঁটাতারের সীমান্ত। এই দেয়াল একই সাথে মানসিক দেয়ালও, যা মানুষের মননে 'আমি বনাম তুমি'র বোধ সৃষ্টি করে, অহং সৃষ্টি করে।
এই অহংকারের দেয়ালকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে চা। মিল্ক টি অ্যালায়েন্স দেখিয়ে দিয়েছে সবাই মিলে লড়লে তা অসম্ভব কিছু নয়।