নারীর চোখে নারীর যুদ্ধ
শাহীন আখতারের প্রথম গল্পগ্রন্থ শ্রীমতীর জীবনদর্শন (১৯৯৭) পড়ে আবিষ্কার করেছিলাম এমন এক লেখককে, যিনি নারীর জীবন নিবিড়ভাবে জানেন, পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত এই সমাজে নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে যাঁর ধারণা স্বচ্ছ ও সংশয়মুক্ত; এবং তার চেয়েও বড় কথা, যিনি এইসব বিষয় নিয়ে গল্প লেখায় হাত দিয়েছেন এসব বিষয়ে নিজের উপলব্ধি ও অনুভব ভাষার মাধ্যমে অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করার শৈল্পিক কলাকৌশল রপ্ত করার পরে। এমনও নয় যে তিনি গল্প লিখতে লিখতে কথাশিল্পের কলাকৌশল শিখে নিচ্ছিলেন। শ্রীমতীর জীবনদর্শন তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ হলেও বইটিতে আমি এমন গল্প পাইনি, যা পড়তে গিয়ে মনে হতে পারে এর লেখক নবীন, গল্প লেখা আরম্ভ করেছেন মাত্র, হাত মকশো করছেন। তিনি সম্ভবত শেখা বা হাত মকশো করার পর্বটি আগেই সেরে নিয়েছেন; লোকচক্ষুর অন্তরালে। যখন পাঠক সমক্ষে হাজির হয়েছেন তখন তিনি একদম প্রস্তুত একজন কথাশিল্পী।
শ্রীমতীর জীবনদর্শন প্রকাশের তিন বছরের মাথায় ২০০০ সালে বেরয় তাঁর দ্বিতীয় বই আর প্রথম উপন্যাস পালাবার পথ নেই। ক্ষুরধারী এই ছোটগল্পকার যে দা ধরতেও পারঙ্গম, উপন্যাস নামক বৃহৎ ব্যাপার যে তাঁর হাতেও নির্মিত হতে পারে তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল পালাবার পথ নেই থেকে। তারপর আরও কিছু গল্প লেখার পর (বোনের সঙ্গে অমরলোকে, ২০০১) শাহীন আখতার সত্যিই ক্ষুর রেখে খড়্গহস্ত হয়েছেন: বাংলাদেশের মাপে মোটামুটি স্বাস্থ্যবান একটা উপন্যাস তিনি প্রায় তিন বছর কঠোর পরিশ্রম করে লিখে শেষ করেন। ২৫৬ পৃষ্ঠার সেই উপন্যাস তালাশ ২০০৪ সালের একুশের বইমেলায় প্রকাশ করে ঢাকার প্রকাশনা সংস্থা মাওলা ব্রাদার্স। সেই বছরই উপন্যাসটি প্রথম আলো বর্ষ সেরা বই হিসাবে পুরস্কৃত হয়। তার ১৬ বছর পর এটি বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনল আন্তর্জাতিক সম্মান। তালাশ উপন্যাসের জন্য শাহীন আখতার এশিয়ান লিটারেচার অ্যাওয়ার্ডের তৃতীয় আসরে পুরস্কৃত হলেন। ২০২০ সালের এশিয়া লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে গত ১ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। উপন্যাসটি ইতিমধ্যে দা সার্চ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তারপর এটি অনূদিত হয়েছে কোরীয় ভাষায়।
আগের তিনটি বইয়ে শাহীন আখতারের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল নারী; পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সংগ্রাম, বশ্যতা ও বিদ্রোহ, তার দুঃখ, তার অসহায়ত্ব, এক কথায় নারীজীবনের সমস্ত ড্রামা। তাঁর প্রতিটি লেখায় নারীর বিষয় এত গভীর ও ব্যাপক যে তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বড়সড় উপন্যাস নিয়ে হাজির হন তখন কৌতূহল জাগে: এবার তিনি কী করেন; কী দেখান, কী বলেন।
তালাশ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, অথবা বলা যায়, এই উপাখ্যানের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের গর্ভে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ যাবত রচিত কথাসাহিত্যের ভাণ্ডারে এমন উপন্যাস আর একটিও আছে কি না সন্দেহ। এ যাবত রচিত হয়েছে একাত্তরে বাঙালির বীরত্বগাথা। শাহীন আখতারের তালাশ বীরত্বের কাহিনি নয়। তা ছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের প্রধান কুশীলব পুরুষ (সন্দেহ নেই, যুদ্ধটা করেছিল প্রধানত তাঁরাই), শাহীন আখতারের তালাশ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রসুদ্ধ প্রধান কুশীলবের অধিকাংশই নারী। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে দুই লক্ষ বাঙালি নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। তাঁদের খোঁজ রাখা হয়নি। তাঁরা যুদ্ধের হিসাবের খাতায় নিছক একটা সংখ্যা। শাহীন আখতার এই উপন্যাসে তাঁদের তালাশ করেছেন। এই উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলেছে অনুসন্ধান..অভিযাত্রা... গ্রন্থিত ও স্বীকৃত ইতিহাসের পৃষ্ঠার বাইরে, জনপদের প্রান্তসীমাগুলোতে, সম্ভাব্য মৃতদের তালিকায়, মুখ্যত স্মৃতিতে, এমনকি বিস্মৃতিতেও। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এ এক অজানা, অনাবিষ্কৃত অধ্যায়।
কিন্তু শাহীন আখতারের বিশেষত্ব বা কৃতিত্ব সেই আবিষ্কারে নয়। তিনি তো সমাজ-গবেষক বা পরিসংখ্যানবিদ বা ইতিহাস-রচয়িতা নন। তিনি শিল্পী, আর তাঁর অন্বিষ্ট সাধারণ নয়, বিশেষ ব্যক্তির জীবন। মরিয়ম ওরফে মেরী নামের এক দুর্ভাগা নারী এ কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র, যে আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো প্রেমে পড়েছিল, '২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত যার চাওয়া ছিল আর দশটা মেয়ের মতো নানান বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তারও যেন একটা জীবন হয়, যাতে সময়মতো মা হয়ে স্বামীর সংসার করার নিশ্চয়তা থাকে'। কিন্তু সেই জীবনের স্বপ্ন তার কাছে থেকে যায় অধরা, উল্টো যুদ্ধ এসে তার জীবনটা এমন তছনছ করে দিয়ে যায় যে তা উপন্যাসের চেয়েও অবিশ্বাস্য আর রোমহর্ষক বলে মনে হয়।
তালাশ যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত এক অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনি। তখন 'প্রত্যেকের মুখে একটাই স্লোগান। প্রত্যাশাও সবার এক। অভুক্ত মানুষ, ভরপেট বা ভুঁড়িঅলা মানুষ, নাঙ্গা মানুষ, সুটবুট পরা মানুষ—একযোগে তারা চায় স্বাধীনতা। এমন এককাট্টা, জটিলতাহীন, প্রাণবন্ত শহরে জানান না দিয়ে একদিন সৈন্য নামে। গুলির শব্দে, বারুদের গন্ধে আর বুটের আওয়াজে পাখির মতো ঝাঁক বেঁধে স্বপ্নরা পালিয়ে যায়। বাদামের ঠোঙা ফেলে প্রেমিকেরা চলে যায় যুদ্ধ করতে। প্রেমিকারা অরক্ষিত, ভাসমান। শত্রু সেনা তাদের পেছন পেছন তাড়া করে ঝোপঝাড়, পুকুরপাড়, গাছতলা থেকে ক্যাম্পে ধরে আনে। তখন মৃত্যু কী গর্ভধারণ তাদের অনিবার্য নিয়তি। যুদ্ধশেষে জীবিত প্রেমিক-প্রেমিকারা শহরে আবার ফেরত আসে। তবে তাদের আর মিলন হয় না। শিরীষ অরণ্যে পুরোনো স্বপ্নের খোঁজে প্রেমিকার দুপুর-বিকেল কচুপাতা থেকে জলের ফোঁটার মতো পড়িয়ে পড়ে যায়।' (পৃষ্ঠা ১৯৪-১৯৫) এই প্রেমিকাদের একজন মরিয়ম ওরফে মেরী যুদ্ধের প্রাক্কালে আবেদ নামের এক ছাত্রনেতার প্রেমে পড়ে, কিন্তু যুদ্ধ এসে আবেদকে বদলে দেয়, সে মেরীকে ভৎর্সনার সুরে বলে, 'তোমার মতো মেয়েরা ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে, রোদে দাঁড়িয়ে লেফট-রাইট করছে, গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে, আর এদিকে তোমার মুখে বিয়ে ছাড়া কোনো কথা নাই।' (পৃষ্ঠা ১২) বেচারি মেরীর জন্য সেই প্রথম থেকেই বড্ড মায়া জাগে, করুণা হয়। আবেদের সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে থাকার শেষ চেষ্টা স্বরূপ সে অন্তঃসত্তা অবস্থায়ও কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাতেও তার শেষরক্ষা হয় না। আবেদ তাকে ফেলে যুদ্ধে চলে যায়, কলেজছাত্র ছোটভাই মন্টুকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে মেরী তাকেও শেষ পর্যন্ত হারায়।
তালাশ-এর কাহিনি বেশ দীর্ঘ। এতে মুক্তিযুদ্ধকে প্রায় একটা পূর্ণ অবয়বেই পাওয়া যায়। অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। জায়গায় জায়গায় আছে রাজনীতির কথাও, যেমন: 'পতাকা তো একখণ্ড কাপড়, ত্যানা। ওড়ানো-নামানো দুমিনিটের ব্যাপার। এদিকে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সাথে যে সেনাপতি আর সামন্তদের বিরাট লটবহর নিয়ে এখন ঢাকায়! আর জলপথেও ভারি ভারি অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসছে। এ সবের ভিতর শুধু শুধু কতগুলি দিন আলোচনার নামে সাবাড় হচ্ছে। মূল্যবান একেকটা দিন। এর দাম কে দিবে? রুমের মধ্যিখানে স্তূপ করা মশারির স্ট্যান্ড, লাঠি, রড, সুরকি, হাতবোমা বানানোর প্যাকেটভর্তি মালমশলা সব ধরে ধরে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে বাইরে। এসব দিয়ে হবে যুদ্ধ! ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে শেখকে জিগ্যেস করা দরকার, তিনি এভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে কত দিনে দেশটা স্বাধীন করবেন। নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব ত্যাগ করতে পারছেন না এখনো, এত কিছুর পরও? তিনি জনগণকে বলছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, আন্দোলন অব্যাহত রাখো। আর নিজে প্রেসিডেন্ট ভবনে বসে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে মাছ কেনার মতো দরকষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন!' যুদ্ধের বর্ণনা, পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে বাঙালি নারীদের অমানুষিক নির্যাতন ও অপমানের করুণ বিবরণ, বীরাঙ্গনাদের টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টার বিবরণও রয়েছে ঢের। সেখানেই থেমে থাকেনি, যুদ্ধের পরের বছরগুলি, বঙ্গবন্ধুর পুত্রের বিয়ে, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জেলহত্যা, ৭ নভেম্বরের ক্যু-পাল্টা ক্যু, বিরানব্বইয়ের গণআদালত, এমনকি টানবাজার পতিতাপল্লী উচ্ছেদ, মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির সম্মাননা ইত্যাদি নানা ঘটনার বিবরণও রয়েছে এ উপন্যাসে। উপন্যাসের কাহিনীকাল মোটামুটি ২৮ বছর। ঘটনা আগুপিছু করে কাহিনীর সরলরেখাকে ভেঙেচুরে এমন এক আখ্যান নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে যা পাঠকের মনকে আলোড়িত করে, ভাবায়, অনেক জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়।
তালাশ উপন্যাসের আখ্যানশৈলী আধুনিক, নিরীক্ষাপ্রবণ। কাহিনি বর্ণনার প্রচলিত সরলরৈখিক ঢঙ যে শাহীন আখতারের স্বভাবে নেই তার স্বাক্ষর আগেই তাঁর গল্পগুলোতে পাওয়া গেছে। এই উপন্যাসে তিনি তাঁর নিজস্ব ভাঙচুরের টেকনিক আরও দক্ষভাবে ব্যবহার করেছেন এবং স্থান-কালের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে রেখে কাহিনিকে এলোমেলো করে দিয়েও পরিশেষে একটা পূর্ণাঙ্গতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত পড়ার পর এক পরিপূর্ণ ছবি পাওয়া যায়, তার আগে পর্যন্ত খাপছাড়া লাগে। আবার তার ফলে কৌতূহলও বেড়ে যায়, ওই খাপছাড়ার একটা পরিণতির প্রত্যাশায় পাতার পর পাতা পড়ে যেতে হয়। কাহিনির কথক একজন ইশ্বরতুল্য বর্ণনাকারী নয়, বরং অনেকগুলি কণ্ঠে খণ্ডখণ্ডভাবে বিভিন্ন আখ্যানভাগ বর্ণিত হয়েছে। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ লেখকের শক্তিশালী অস্ত্র। কৌশলের একটা বিশেষ অভিনবত্ব মুক্তি নামে এক ২৮ বছর বয়সী তরুণী সমাজকর্মীর চরিত্র, যে স্বাধীনতার ২৮ বছর পরে পঞ্চাশোর্ধ বীরাঙ্গনা মরিয়ম ওরফে মেরীকে আবিষ্কার করে, মূলত তারই বরাতে কাহিনিটা জানা যায়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন নিরাবেগ, এতটা নির্মোহ উপন্যাস বাংলায় বিরল। বাঙালির মহত্তম অর্জন যে স্বাধীনতা, তার জন্য প্রাণপণ লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে মানুষগুলি পরস্পরের সঙ্গে কেমন আচরণ করে সেটাই গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করেছেন লেখক। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সাধারণভাবে এমন আবেগ কাজ করে যে, এ এক মহান ঘটনা, যখন বিশ্বাসঘাতক ছাড়া প্রতিটি বাঙালি মহৎ সংগ্রামী হয়ে উঠেছিল, ত্যাগী হয়েছিল, স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ বাজি রেখে যারা যুদ্ধ করতে গেছে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমাদর-সমর্থনের সীমা ছিল না; এই উপন্যাস এই সাধারণ ধারণা সম্পর্কে সন্দেহ জাগায়। এখানে গৃহস্থের দ্বার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবারিত নয়, আর পরিস্থিতির বিচারে, বর্ণনার সততায় যুদ্ধকবলিত সাধারণ মানুষের শঙ্কা, উদ্বেগ, ভীরুতাসহ যাবতীয় হীনতাকে অনভিপ্রেত মনে হলেও অবিশ্বাসযোগ্য ঠেকে না। এই উপন্যাসে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে, কিন্তু একজন বীরেরও দেখা মেলে না। বরং লেখক এমন ঘটনাও বাছাই করেন যা পড়ে হতাশ লাগে: 'সেই রাতে বর্ডার পেরিয়ে মন্টুদের দল রাজাকার ধরার অভিযান চালায়। রাজাকারকে বাড়ি না পেয়ে তারা তার টাট্টু ঘোড়াটা ধরে নিয়ে আসে ক্যাম্পে। এর পিঠে চড়ে লোকটা ধানের মৌসুমে ভিক্ষা করতে বেরুত। ফেরার সময় তারা পাঁচটা গ্রেনেডের চারটাই ভিক্ষুকের খালি উঠোনে দমাদ্দম ছুঁড়ে দৌড়াতে শুরু করে, যার ভিতর একটাই শুধু বিকট শব্দে ফেটেছিল। তারা ছুটছে, সঙ্গে ঘোড়াটাও। দেশের মাটিতে ক্ষণকাল তিষ্টানোর সাহসও তাদের নেই। তাড়াহুড়োয় গ্রেনেডের পিন খুলতেও ভুলে গিয়েছিল। ভারতের সীমানায় ঢুকে তবেই তারা দৌড়ানো থামায় এবং ভাবে, তারা চোর, ঘোড়া চোর। আর চোরের মতোই হলো তাদের জীবনের প্রথম অপারেশন।' (পৃষ্ঠা ৭০)
লেখক বীরের সন্ধান করেননি, হয়তো-বা এ কারণে যে মুক্তিযুদ্ধাশ্রিত গল্প-উপন্যাসে ইতিমধ্যে তাদের দেখা মিলেছে প্রচুর সংখ্যায়। শাহীন আখতার বরং মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ মানুষ বলেই মনে করেন, যাদের মধ্যেও মানবিক দুর্বলতাগুলো ছিল। 'সমস্যা হলো, অপারেশনের রাতে বেশির ভাগ সময় টার্গেট বাড়ি থাকে না। কী করে যেন আগেভাগে খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। তবে মন্টুরা সেসব বাড়ি থেকে খালি হাতে কদাচ ফেরে না। গরুটা, ছাগলটা যা তাদের ক্যাম্পের একঘেঁয়ে খাবার খেতে খেতে পচে-যাওয়া মুখের রুচি ফেরাবে, সেসব গোয়াল থেকে বের করে আনে। সেই সাথে সংসারের টুকিটাকি জিনিস দিয়ে উঠোনে বসে বোঁচকা বানায়। যুদ্ধের ময়দানে এসব জিনিস কী কাজে দেবে জানে না, তবে লোভে পড়ে অথবা দালালদের শায়েস্তা করার জন্যই হয়তো মালাসামান তারা লুট করে। কিংবা একেবারে খালি হাতে ফেরার মধ্যে পরাজয়ের যে গ্লানি থাকে, লুটপাটের ভিতর তা ধামাচাপা পড়ে যায়।' (পৃষ্ঠা ৭২)
মুক্তিযুদ্ধের পুরো ব্যাপারটি সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি তীক্ষ্ণভাবে বিচারি। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি এখনো জ্যান্ত, এখন তালাশ পড়তে পড়তে সাধারণ পাঠক ধন্দে পড়ে ভাবতে পারেন: এটা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের বই নয় তো? কারণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাঠকেরা যেসব গল্প-উপন্যাস পড়ে অভ্যস্ত, সেগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য উদ্বুদ্ধকারী সাহিত্যের। বিচারি বাস্তববাদের দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা হয়নি। শাহীন আখতার তাই করেছেন। তাঁর দৃষ্টি খুব বিচারী। যেমন রাজনৈতিক দিকে, তেমনি মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। আবেগের জায়গা তেমন চোখে পড়ে না।
তবে এই সমস্ত কিছুই আনুষঙ্গিক। তালাশ উপন্যাসে এ মুক্তিযুদ্ধ শাহীন আখতারের লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ্য বিশেষ। মরিয়মের জীবনটা যেমন হয়েছে, যুদ্ধ ছাড়াও তেমন হতে পারত। 'শুধু যুদ্ধ বলে নয়, যুদ্ধহীন শান্তির সময়েও নারীর জীবনকে যদি ভাবা হয় চার চাকার গাড়ি, তবে দেহ তার সারথি। নিয়মের বাঁধানো সড়ক থেকে দেহ এক চুল সরে গেলে আস্ত দেহটাই গর্তে, আবর্জনায় মুখ থুবড়ে পড়ে। জীবনের পতন ঘটে। নারী পতিত হয়' (পৃষ্ঠা ৭)। মরিয়ম ও অন্য বীরাঙ্গনারা পতিত হয়েছে। তাদের তুলবার কোনো চেষ্টা করেনি কেউ; না রাষ্ট্র, না সমাজ। উপন্যাসের বিস্তৃত কাহিনিজুড়ে দেখা যাবে, মরিয়ম ও অন্যান্য বীরাঙ্গনাদের দুঃখ আর অপমান মোচনের কোনো রাস্তাই যেন আর খোলা নেই। তারা বীরাঙ্গনা, পাকিস্তানি মিলিটারি তাদের সম্ভ্রম লুটেছে। যুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বজাতির পুরুষদের কাছে তারা যে অমানুষিক আচরণের শিকার হয়েছে তা পাকিস্তানি সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার চেয়ে কম কিছু নয়। 'রমিজ শেখের মৃত্যুতে মরিয়ম শোকগ্রস্ত হয়েছিল যুদ্ধের বহু বছর পর, যখন সে বুঝতে পারে, তার শত্রু-লাঞ্ছিত দেহটা স্বাধীন বাংলাদেশের পুরুষেরাও একইভাবে ব্যবহার করবে, কোনোদিন তাকে আপন করে ভাববে না।' (পৃষ্ঠা ৬৩)
যুদ্ধের পরে পাকিস্তানিরা চলে যায়, কিন্তু এই নারীরা আর হারানো মান-মর্যাদা ফিরে পায় না। বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা অফিসে গিয়ে বলেন, 'তোরা আমার মা। তোরা বীরাঙ্গনা।' কিন্তু বীরাঙ্গনাদের আপন বাপ-মা, স্বজনদের কাছে তারা লজ্জাজনক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বীরাঙ্গনা অফিসে বাবা এসে বলে যায়, 'মা, পরে এসে নিয়ে যাব। আর দুইডা দিন অপেক্ষা কর।' কিন্তু এই কথা বলে সেই যে চলে যায় বাবা, আর নিতে আসে না।
নারীজীবনের ব্যাপারে শাহীন আখতারের ভাবনা প্রায় একটা দর্শনের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তালাশ উপন্যাসের কাহিনিতে মুক্তি নামে যে সমাজকর্মীর চরিত্র আছে, তার মারফতে লেখকের অনেক ভাবনাচিন্তা পরিষ্কারভাবে ধরা যায়। যেমন, 'মুক্তির মনে হয়, এক্ষেত্রে মরিয়ম প্রকারান্তরে মেরী একটি উদাহরণ মাত্র। তার দুর্ভাগ্যের কারণ হয়তো নারীর প্রজনন অঙ্গটি, যা বংশরক্ষার সূচিমুখ, তার পবিত্রতা, যা শুধু একজন পুরুষের ব্যবহারের জন্য এবং বৈধভাবে। সেটি অরক্ষনীয় হয়ে যায় যুদ্ধের বছর। শত্রুর পুরুষাঙ্গ তাতে ঢুকে পড়ে। বীর্য ডিম্বাশয়ে চলে যায়। ভ্রূণগুলি দ্রুত বাড়তে শুরু করে। বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করেও নারীদেহের পবিত্রতা পুনরুদ্ধার হয়নি।' (পৃষ্টা ৪৭)
এটাই আসলে নারীজীবন সম্পর্কে শাহীন আখতারের মোদ্দা কথা বা দর্শন।
বলা কঠিন, এই দর্শন মনের মধ্যে নিয়ে, তাকে সত্য প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যেই শাহীন আখতার তালাশ-এর আখ্যান সাজিয়েছেন কি না। তবে এই জিজ্ঞাসা মনে জাগে। সত্যিই কি জীবন এত নির্মম? এমন নিষ্করুণ? মরিয়ম বা অন্য কোনো চরিত্রের জীবনে এমন কোনো ঘটনার কথা তালাশ-এ নেই যা থেকে মানুষের মানবিক গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষের সদগুণের ব্যাপারে বড্ড সংশয় রয়েছে শাহীন আখতারের। লেখক তো ঘটনা বাছাই করেন, তাঁর মধ্যে বাস করেন একজন সম্পাদক, যাঁর হাতে সম্পাদিত জীবনের রূপটিই লেখক হাজির করেন। শাহীন আখতারের ভিতরের সেই সম্পাদকের কাজ হয়তো একটা দর্শনের প্রভাবে এমন হয়েছে। জীবনের নির্মম দিকটাই হয়ে উঠেছে বড়। তালাশ একটা ট্রাজেডি, এমন বিষাদময়, নিষ্করুণ উপান্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা আমার বেশি নেই। মরিয়ম ও অন্য বীরাঙ্গনাদের এ কাহিনি চূড়ান্ত এক অসহায়বোধের জন্ম দেয়, এক ক্ষমাহীন অপ্রতিকার্য পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নির্বাক করে দেয়। কথাশিল্পী হিসেবে শাহীন আখতারের সার্থকতা বোধ করি এখানেই। তালাশ–এর নিষ্ঠুর, নিষ্করুণ জীবন বাস্তবে সম্ভবপর বলে মনে হয়।
বইটির ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে 'উপন্যাসকে সত্য কথনের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া আশু জরুরি'। এ কথার মানে হয়তো এই যে, উপন্যাসের লক্ষ্য ইতিহাসের বাস্তব নয়, সাহিত্যের বাস্তব। কিন্তু তালাশ আগাগোড়াই সত্যকথন করে গেছে।