পাঠকের সেরা পাঠক
কোভিড-১৯। খাতারনাক ভাইরাসটির আক্রমনে আরও একজন গুনী মানুষকে আমরা হারালাম। হ্যাঁ, বার্ধক্যে পৌঁছেছিলেন, অনেক বছর ধরেই অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু তারপরও ...। ক্ষনজন্মা এই মানুষটির নাম মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের কালের বাংলা তর্জমাসাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য পথিকৃৎ। শুধু অনুবাদক বললে তাঁর পরিচয়টা খন্ডিত থেকে যায়।
অনুবাদক হিসেবে খ্যাতিমান হলেও একাধারে তিনি ছিলেন একজন কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং শিক্ষক। বুদ্ধদেব বসুর পরিকল্পনায় যাত্রা করা কোলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামুলক সাহিত্য বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রই শুধু ছিলেন না উপরন্তু ছাত্রজীবন শেষে ওই বিভাগে অধ্যাপনাও করেছেন। ১৯৭৫ সালে তাঁরই পরামর্শে ওই বিভাগের স্নাতকস্তরে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল পরবর্তীকালে যাঁর রচনা বাংলায় তর্জমা করে তিনি নাম কুড়োবেন সেই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ভুবনখ্যাত উপন্যাস সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ বা 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর', নভেলা এল কোরোনেল কে নো তিয়েনে কিয়েন লে এসক্রিবা বা 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না' এবং বড় গল্প লা ইনক্রেইব্লে ই ত্রিস্তে ইস্তোরিয়া দে লা কান্দিদা এরেন্দিরা ই সু আবুয়েলা দেসালমাদা বা 'সরলা এরেন্দিরা আর তার নিদয়া ঠাকুমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনি'। বাংলা ১৩৯৭ সালের বৈশাখে প্রকাশিত 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না' নভেলার ভূমিকায় মানবেন্দ্র লিখছেন: "এ-তিনটি বই-ই সেই বিরল বইগুলোর অন্যতম, যা পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ব'লেই পাঠকের মনে বিভীষিকা জাগায়নি।" দারুন কথা। শিক্ষক ও অনুবাদক হিসেবে তাঁর দেখবার ধরনটা আমরা একথা থেকেই বুঝতে পারি।
২
ক্লাসে সরাসরি যাদেরকে পড়িয়েছেন তারা তো আছেনই, তারও বাইরে আছেন এ-মায়েস্ত্রোর অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, যারা তাঁর তর্জমাগুলি পাঠ করে নানা ভাষায় রচিত ভারতীয় ও বিশ্বসাহিত্যের রস আস্বাদন করে জগতের মানুষ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে হয়েছেন অবগত। দুনিয়ার কোথায় কী-রকম লেখা হয় বাঙালি পাঠকেরা জানতে পেরেছে তাঁর তর্জমাভান্ডারের কল্যাণে। সহজ কথায় আমাদেরকে পড়িয়েছেন মানবকাকা (আমার বড়চাচা বেলাল চৌধরীর বন্ধু বিধায় তাঁকে এ-সম্বোধনে ডেকেছি)।
একটা ছোটখাট তালিকা দেয়া যাক: শিশু-কিশোর সাহিত্যের ক্লাসিক ফরাসি ভাষার জুল ভার্ন এবং ড্যানিশ ভাষার হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেন, ছেলে-বুড়োদের প্রিয় শার্লক হোমস, ছোটগল্পের পথিকৃৎ এডগার অ্যালান পো; এস্পানিয়োল ভাষার জতৎশ্রেষ্ঠ লেখক মিগেল দে সের্বান্তেস, এস্পানিয়োল ও পোর্তুগিয ভাষায় লেখা লাতিন আমেরিকার বিদ্রোহী কবিতা, এস্পানিয়োল ও পোর্তুগিয ভাষার দিকপাল কথাসাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হুয়ান রুলফো, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, মাচাদু দে আসিস, মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস, জর্জ আমাদু, মারিয়ানো আসুয়েলা, কার্লেস ফুয়েন্তেস ইত্যাদির গল্প-উপন্যাস; এস্পানিয়োল ও পোর্তুগিয ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবিকূল নিকানোর র্পারা, হোমেরো আরিদ্হিস্, কার্লোস ড্রুমন্ড ডি আন্ডরাজি; মাইয়াদের পবিত্র পৌরাণিক গ্রন্থ 'পোপোল বু', পোলিশ কবি চেশোয়াভ মিউশ, জ্বিগ্নিয়েভ হেরবের্ট, সার্বিয়ার কবি ভাসকো পোপা, চেক ভাষার কবি মিরোশ্লাভ হোলুব, জার্মান ভাষার কবি হান্স মাগনুস এন্ৎসেন্সর্বাগার ও লেখক পিটার হান্ডকে; মার্তিনিকের আফ্রো-ক্যারিবিয়ো কবি এমে সেজেয়ার, ক্যারিবিয়ো কবি এডওয়ার্ড কামাউ ব্রাথওয়েট; মালয়ালম ভাষার কিংবদন্তিসম লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশিরের গল্প (যে-কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন) কিংবা উর্দু ভাষার মহৎ লেখিকা কুররুতুলান হায়দারের গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি ... বলাই বাহুল্য, তালিকাটা আরও দীর্ঘ।
এঁদের অনেকের লেখা তিনি যখন বাংলায় তর্জমা করেছেন তখন আমাদের অঞ্চলে তাঁদের নামও শোনা যায়নি এর আগে, এবং এঁদের অনেকেই কালের যাত্রায় খ্যাত থেকে বিখ্যাত হয়েছেন ও সাহিত্যে নোবেল জিতেছেন। দুনিয়ার তাবৎ ভাষার সাহিত্যের লুকোনো মণি-মুক্তো ঘেঁটে তিনি সেগুলিকে বাংলা তর্জমার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে হাজির করছেন। আর এ-অসামান্য কাজটি এমন সময়ে করেছেন যখন ইন্টারনেটের দৌরাত্ব্য ছিল না - আঙ্গুলের এক টিপেই উইকিপিডিয়া বা অন্য কোনো সাইটের মাধ্যমে অন্য দেশের লেখক-কবিদের সম্পর্কে অনায়াসেই তথ্য পাওয়া যেত না।
তর্জমার জন্য তাঁর নির্বাচনটা একটু খেয়াল করলে দেখব প্রধানত এমন সব লেখক-কবিদের প্রতি তাঁর দুর্বলতা যাঁরা অন্য ভাষার অন্য দুনিয়ার মানুষ, যাঁদের কথা খুব একটা উচ্চারিত হত না ইংরেজি-শাসিত দুনিয়ায়। আর ঔপনিবেশিকতার জেরে আমরা তো এখনো ইংরেজি বাদে অন্য ভাষার অন্য সংস্কৃতির কথা তেমন একটা আমলে নেই না। মানবকাকার পক্ষপাতিত্ব দুনিয়ার হাঘরে, বাদামি, তামাটে ও কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি।
৩
এত সব লেখক-কবিদেরকে যিনি তর্জমা করেছেন তাঁর নিজের পঠন-পাঠনটা ভাবতে গেলে তো দিশাহারা অবস্থা দাঁড়ায়। আমার বিবেচনায়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন পাঠকের সেরা পাঠক। অধ্যাপক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ইত্যাদি সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন মহৎ পাঠক। নিজে পড়েছেন এবং আমাদেরকে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাঁদের দুনিয়ার সাথে সংযোগ ঘটিয়েছেন। একজন তর্জমাকারীর অন্যতম কাজ তো তাই-ই - সেতুবন্ধন। অত দূরে না গিয়ে আমাদের প্রতিবেশী অহমিয়া, উর্দু, হিন্দি, রাজস্থানী, তামিল, তেলেগু, মালয়ালম, মারাঠি, বর্মী প্রভৃতি ভাষায় কী লেখা হচ্ছে, কারা লিখছেন - এই জ্ঞানটুকু যে জরুরি সেকথাও কাজের মধ্য দিয়ে বলে গেছেন মানবকাকা।
বছর আটেক আগে কোলকাতা মহানগরীর দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলের তিলজলা পুলিশ ফাঁড়ির কাছেই অবস্থিত তাঁর ফ্ল্যাটে বসে এক দীর্ঘ আড্ডায় আমাকে বলেছিলেন তর্জমার কাজে ক্লান্তি আর আনন্দ দুটোই পাশাপাশি থাকে। এও বলেছিলেন যে কাজটা করতে গিয়ে খেয়াল রাখতে হয় লক্ষ্যভাষা বাংলায় অনুদিত টেক্সট্টা কতটা উৎসভাষার মূল টেক্সট্-এর কাছাকাছি থাকছে, পাশাপাশি এও খেয়াল করতে হয় যে অনুদিত টেক্সট্টা বাংলা হচ্ছে কি না। তর্জমার রয়্যালটি প্রসঙ্গে মজার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিলেন আমাকে: যেমন ভৈকম মুহম্মদ বশির টাকার বদলে রয়্যালটি হিসেবে চেয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক আর এএল সায়গল-এর লঙ প্লে রেকর্ড।
তিনি যে-লেখককূলদেরকে তর্জমা করে আমাদেরকে চিরঋনী করে গেলেন সেই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, আলেহো কার্পেন্তিয়ের এবং হুয়ান রুলফো লিখেছেন এস্পানিয়োল ভাষায়। লাতিন উৎসজাত এ-ভাষাটি মানবকাকা পুরোপুরি না জানলেও আমাদের অনেকের চেয়ে ঢের বেশি জ্ঞান রাখতেন সের্বান্তেসের ভাষাটিতে এবং তার সংস্কৃতিগত ও ইতিহাসগত বিষয়ে। আর তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও সাহিত্যবোধের কথা নাই বা বললাম। তাঁর তর্জমা কিতাবগুলির পৃষ্ঠা খুলে 'মাইয়া', 'ক্রিস্তোবাল কোলোন' (কলম্বাসের নাম এস্পানিয়োলে), 'মেহিকো', 'কোনকিস্তাদোর,' 'লাতিফুন্দিস্তা' ইত্যাদি শব্দগুলির বানানরীতি ও ওগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা গদ্য পড়লেই বুঝা যায় এ-বিষয়ে তাঁর জ্ঞানগম্যি কতদূর ছিল। আর উত্তর প্রজন্মের আমাদেরকে এ-রীতিতে পড়তে-লিখতে তিনি উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছেন। আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হয়। প্রিয় পাঠক, খেয়াল করলেই দেখবেন তাঁর প্রতিটি তর্জমাকিতাবে রয়েছে ভূমিকা বা উত্তরভাষ, যা ওই লেখক বা সাহিত্যকে বুঝবার জন্য অপরিহার্য। এবং ভূমিকাগুলি দীর্ঘ। 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না' বইটির মোট ১০৯ পৃষ্ঠার প্রথম ৪০ পৃষ্ঠা শুধু ভূমিকাই!
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বসাহিত্যের সর্বাগ্রগণ্য লেখক-কবিদেরকে নিয়ে এসেছেন বাংলায়। আকারে ছোটখাট একজন মানুষ হলেও কাজ করেছেন মস্ত মস্ত। আমরা তাঁর তর্জমাপাঠের মধ্য দিয়ে খানিকটা শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি, আজও। বাংলা তর্জমাসাহিত্যের দিশারী এ-মানবটির বিদেহী আত্মার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁকে না পেলে বাংলা সাহিত্য অসম্পূর্ণ থেকে যেত।