বিটলসের এক ভারতীয় যোগী ও কানাডিয়ান ব্যাকপ্যাকার
"সার্জন্ট পেপার'স লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড" এর অভাবনীয় সাফল্যের পর বিটলসরা যখন কিছুদিনের অবসর যাপনে ঠিক তখনই আকস্মিক ভাবে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ হয় ভারতীয় যোগ শাস্ত্রের গুরু মহাঋষি মহেশ যোগীর সাথে। সময়টা ছিল ১৯৬৭। এই ঘটনা বিটলসদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তাঁরা প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়, যদিও জর্জ হ্যারিসন আরো আগে থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং যোগ শাস্ত্র নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। ফ্যাব ফোরের পরবর্তী এ্যালবামে তার প্রভাব পরিলক্ষিতও হয়।
ঋষি মহেশ যোগী ছিলেন নিজস্ব রীতিতে পরিচালিত একজন ধ্যান সাধক। তিনি যোগ, অতীন্দ্রিয় ধ্যানের মাধ্যমে বিক্ষত মনের নিরাময়ের প্রবক্তা এবং তার আধ্যাত্ববাদ বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার নিমিত্তে বিশ্ব ভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন।
লন্ডনে অবস্থান কালে জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী প্যাটি হোটেল হিলটনে ঋষি মহেশ যোগীর কয়েকটি ধ্যান পর্বে অংশ গ্রহণের জন্য জর্জ হ্যারিসনকে আমন্ত্রণ জানান। জর্জ যেহেতু আগে থেকেই প্রাচ্যের জ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন তিনি বিটলসদের অন্য সদস্যদেরও সঙ্গে নিয়ে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
হ্যারিসন দম্পতি, পল ম্যাকার্টনি, জন লেনন এবং জেইন অ্যাসর ঋষি মহেশের সেই বক্তৃতা সেশনে অংশ নেন, এবং ঋষি মহেশ যোগী তাঁদের বেশ প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। তবে দলের সদস্য রিঙ্গো স্টার তাঁর স্ত্রী মউরিনের সন্তান প্রসবের কারণে সেই ঋষির বক্তৃতা সেশনে অংশ নিতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
'বাসায় এসে দেখি জন লেনন বার্তা পাঠিয়েছে—আমরা সেই মানুষটিকে দেখলাম, মহাঋষি দারুণ মানুষ, আমরা তাঁর সাথে ওয়েলসে যাচ্ছি তুমিও যেতে পারো।'
পরবর্তীতে বিটলস দলের সদস্যরা মহাঋষি মহেশ যোগীর সাথে নব্বই মিনিটের এক সেশনে তাঁর দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পরে আরও বিভিন্ন সভায় ধ্যানে অংশ গ্রহণ নেন। তাঁরা ঋষির সাথে ওয়েলস, ব্যাঙ্গর ট্যুর করেন। তাঁরা ব্যাঙ্গরে দুই রাত্রি সদলবলে থেকে ধ্যানে অংশগ্রহণ করেন।
সেই সময়টাতে বিটলসের সদস্যরা নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। মহাঋষির সাথে তাঁদের এই আকস্মিক সাক্ষাতে তাঁরা ড্রাগ যে সমস্যার কোন সমাধান না তা স্বীকার করেন। এর পরপরই তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের ধ্যানের ব্যাপারে আগ্রহ এবং ড্রাগ ছেড়ে দেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এ প্রসঙ্গে ঋষি মহেশ যোগী বলেন,
"আমার একটা বক্তৃতার পরেই তাঁরা মঞ্চের পেছনে চলে আসেন আর বলেন, 'প্রথম জীবন থেকেই আমরা একটা আত্মিক মুক্তির পথ খুঁজছিলাম। ড্রাগ নিয়ে তা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন কাজে দেয়নি।'তাঁরা এতো বাস্তববাদী এবং বুদ্ধিমান ছেলে ছিল যে মাত্র দুই দিনে তাঁরা তাঁদের আত্মিক মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল।'
মাদক ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে পল ম্যাকার্টনি বলেন:
"সবসময় তুমি ড্রাগ নিতে পার না। মঞ্চে এক সাথে পনেরটা অ্যাসপিরিন নিয়ে যখন উঠছ তখন কিন্তু তোমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমরা এমন কিছু খুঁজছিলাম যা প্রাকৃতিক এবং সেই অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি। তাই আর কোন ড্রাগ নয়, আমাদের এটার আর কোন প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয় আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পথ খুঁজে পেয়েছি।'
বিটলসদের ম্যানেজার ব্রায়ান এপ্সটেইনেরও ব্যাঙ্গর যাত্রায় অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও তাঁর আর যোগ দেয়া সম্ভব হয়নি, কারণ অতিরিক্ত মাত্রায় ড্রাগ গ্রহনের ফলে তিনি তাঁর লন্ডনের বাসায় মারা যান। এ ঘটনায় বিটলসদের বিচলিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু মহাঋষির দর্শন এবং ধ্যান তাঁদের তা হতে দেয়নি। সংবাদ সম্মেলনে জন লেনন বলেন:
"আমরা তাঁকে ভালবাসতাম এবং আমাদের একজন মনে করতাম। মহাঋষির শিক্ষা আমাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে এবং আমরা সবাই স্থির এবং শান্ত থাকতে পেরেছি।
আমরা সবাই এটা উপলব্ধি করছি কিন্তু অতীন্দ্রিয় ধ্যান আমাদের শক্ত থাকতে সাহায্য করেছে। আমরা কখনই মর্মাহত হই না যখন কোন শিশু কৈশোরে উপনীত হয় বা কোন কিশোর যৌবনে বা কোন যুবক বার্ধক্যে উপনীত হয়। ব্রায়ান কেবলই একটা পর্যায় শেষ করে পরবর্তী পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।'
এরপরই বিটলস সদস্যরা মহাঋষি মহেশ যোগীর আমন্ত্রণে ভারতে তাঁর আশ্রমে তিন মাস থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। অতীন্দ্রিয় ধ্যানের মাধ্যমে বিটলসদের যন্ত্রণা দগ্ধ মনের নিরাময়ের নিশ্চয়তা দেয়ায় 'ফ্যাব ফোর' সেই গুরুর আশ্রমে আসেন।
ভগ্ন হৃদয়ের কানাডিয়ান ব্যাকপ্যাকার
ভারতের হৃষীকেশের আশ্রমে থাকাকালীন সময়ে বিটলস দলের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে একজন কানাডিয়ান ভ্রমণ পিয়াসীর। শব্দ প্রকৌশলী এই কানাডিয়ানের জীবনে এই সাক্ষাৎ বিশেষ প্রভাব ফেলে। পঞ্চাশ বছর পর এই ঘটনার উপর তৈরি করেন আলোচিত এক তথ্যচিত্র।
ভারত ভ্রমণ কালেই কানাডা থেকে তাঁর বান্ধবী সম্পর্কোছেদের সংবাদ জানায়। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এই ভ্রমণকারী। ভগ্ন হৃদয় সংস্কারের জন্য রেলগাড়ি, নৌকা, ট্যাক্সি যোগে বহু পথ পার হয়ে তেইশ বছর বয়সী সেই যুবক পৌছে হৃষীকেশের আশ্রমে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মহাঋষির কাছে থেকে তাঁর মনের ক্ষত ভালো করা।
কিন্তু আশ্রমে পৌঁছালে তাঁকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না কারণ ভেতরে তখন অবস্থান করছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিটলসের তারকা শিল্পীরা। অনেক সাধাসাধির পর আশ্রমের এক সাধু তাকে ভেতরে যাবার ব্যবস্থা করে দেন। এই নাছোড়বান্দা ভ্রশণকারীটি ছিলেন এমি পুরস্কার জয়ী প্রখ্যাত কানাডিয়ান চলচিত্রকার পল স্যালজম্যান।
এ প্রসঙ্গে স্যালজম্যান বলেন,'আমার উদ্দেশ্য ছিল ধ্যান করে আমার মনকে শান্ত করা।'
স্যালজম্যান ভেতরে ঢুকেই এক ঘন্টার একটা ধ্যান পর্ব শেষ করেন। ধ্যান শেষ করে তার মন অনেকটা শান্ত হয়ে এলে তিনি প্রফুল্ল মনে বাইরে আসেন।
'মন ভাঙার কষ্টটা চলে গিয়েছিল তাই বাইরে বের হয়ে আমি বনের মধ্যে ঘুরছিলাম চারদিক দেখার জন্য,' স্যালজম্যান সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে একথা বলেন।
'ঠিক তখনই বিটলস দলের সাথে প্রথম সাক্ষাত হয়। জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, রিঙ্গো স্টার আর জর্জ হ্যারিসন। তাদের গায়ে ভারতীয় পোশাক, বসে ছিলেন ছোট একটা পাহাড়ের চূড়ায় লম্বা একটা টেবিলে।। সাথে ছিল তাদের কারো কারো স্ত্রী, কারো বা বান্ধবী। যেমন- সেখানে ছিলেন অভিনেত্রী মিয়া ফ্যারো, 'বীচ বয়েজ' এর মাইক লাভ আর ফোক শিল্পী ডোনোভ্যান। তারা সেই আঠারো একর বিস্তীর্ণ পরিত্যক্ত ভূমির উপর তৈরি আশ্রমে তিন মাসের মানসিক শ্বশ্রুষা নেয়ার পরিকল্পনা করে এসেছেন তারা।' স্যালজম্যান তাদের সাথে বসতে চাইলে পল ম্যাকার্টনি একটা চেয়ার এগিয়ে দেন।
'আমি তাদের সাথে বসার সাথে সাথে মস্তিষ্কে একটা চিৎকার শুনতে পেলাম: আমি বিটলসের পাশে বসে আছি!' আটাত্তর বছর বয়স্ক এ্যামি বিজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক পল স্যালজম্যান সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করেন ঠিক এভাবে।
বিটলসদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার ঠিক চার বছর আগে স্যালজম্যান ম্যাপল লিফ গার্ডেন, টরেন্টোতে এই তারকাদের প্রথম দেখেন। আঠার হাজার দর্শকের চিৎকারে পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামের সেই অভূতপূর্ব ঘটনা মুহূর্তে তাঁর মাথায় খেলে যায়। আনন্দ বিস্ময় নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের দলটির সামনে।
বিটলসদের সাথে পরিচয় হওয়ার মুহূর্ত সম্পর্কে স্যালজম্যান বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মাঝের বরফ গলতে শুরু করে।
প্রথমেই লেনন জিজ্ঞেস করেন,'আপনি আমেরিকান?'
'না, আমি কানাডিয়ান,' স্যালজম্যান লেননকে বলেন।
লেনন দুষ্টুমি করে বলেন,'আরেহ, উনিতো তো কলোনি থেকে!'
দলের সবাই লেননের দুষ্টুমিতে হো হো করে হেসে উঠে।
লেনন আবার দুষ্টুমি করে বলে,'তো আপনারা এখনো মহামান্য রাণীকে মান্য করেন?'
"না, ব্যক্তিগত ভাবে আমি তা করি না,"স্যালজম্যান উত্তর দেন।
এবার ম্যাকার্টনি এবং রিঙ্গো স্টার লেননের সাথে যোগ দেন, "কিন্তু তোমাদের টাকায় তো রাণীর ছবি… "
"হ্যাঁ, আমাদের টাকায় রাণীর ছবি আছে কিন্তু তিনি তোমাদের সাথে থাকে!"
পরের একটা সপ্তাহ সেই ব্যাকপ্যাকার বিটলসদের সাথে ঘুরলেন। গঙ্গার নিরিবিলি পাড় ধরে বহুদূর পর্যন্ত এই ভ্রমণে চলে একই সাথে ধ্যান, গান, নিরামিষ খাবার আর আড্ডা।
হৃষীকেশ আশ্রমের এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় পর পল স্যালজম্যান 'ফ্যাব ফোর' কে নিয়ে তৈরি করেন ঊনআশি মিনিটের এক তথ্যচিত্র 'মিটিং দ্য বিটলস ইন ইন্ডিয়া'। মর্গান ফ্রীম্যানের বর্ণনায় আর ডেভিড লিঞ্চের পরিচালনায় সেই চলচ্চিত্র অন্য অনেক কিছুর সাথে স্যালজম্যানের তোলা বিটলস দলের খুব দূর্লভ কিছু ফটোগ্রাফ প্রদর্শিত হয়। সেগুলো ছিল খ্যাতির শীর্ষে থাকা রক স্টারদের নিরাভরণ, নিরাপত্তা বলয়হীন, প্রশান্তিময় জীবনের এক টুকরো তৃষিত শিল্প। বলা হয়ে থাকে বিটলসদের এমন ছবি আর কখনো পাওয়া যায়নি।
"সেটা ছিল নিখাদ এক যাদুকরী সাক্ষাত। তাঁদের সঙ্গীত আমি ভালবাসি কিন্তু তাঁদের তারকা খ্যাতিতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাইনি আর তাঁরাও খুব স্বাভাবিক সহজ ব্যবহার করেছে, কোন অহম ছিল না, কোনো তারকা সুলভ আচরণও ছিল না, " স্যালজম্যান এভাবেই নিরহঙ্কার বিটলস তারকাদের কথা স্মরণ করেন।
তাঁর সস্তা প্যানটাক্স ক্যামেরা দিয়ে তিনটা আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের ছবি তোলেন। চুয়ান্নটা ছবির মধ্যে তিরিশটা ছবিতেই কোন না কোন বিটল উপস্থিত ছিলেন।
এর পরই তিনি দেশে ফিরে যান আর ছবির কালার স্লাইডগুলো বাক্সবন্দী করে বাসার বেইজমেন্টে রেখে দেন। বত্রিশ বছর ধরে সেগুলো বেইজম্যান্টেই পরে ছিল যতদিন না তাঁর কন্যা তাঁকে সেই স্লাইডগুলো নিয়ে কিছু তৈরি করতে তাড়িত করলেন। এরপরই তিনি ২০০৫ সীমিত আকারে একটা বই বের করেন যেখানে তিনি কিছু ছবি অন্তর্ভুক্ত করেন।
আশ্রমে রিঙ্গো স্টার স্যালজম্যানকে একটা ১৬মিমি ক্যামেরা আর ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ফিল্ম দিয়ে দলের জন্য কিছু ফুটেজ রেকর্ড করে সেটা তার কাছে রেখে দিতে বলেন সাথে এও বলেন,' প্রয়োজনে অর্থও দেয়া যেতে পারে। " তিন মিনিটের সেই ফুটেজ স্যালজম্যান সাথে নিয়ে ফিরেছিলেন কিন্তু আর খুঁজে পাননি, সেটা হারিয়ে গিয়েছিল।
স্যালজম্যান পরবর্তীতে বলেছিলেন,"আমি আসলে ভাবতে পারিনি ঐ ছবিগুলো এবং ফুটেজটা আমার কোন কাজে আসবে। এরপর আমি বার বছর ধরে বিটলসদের একটা প্রজেক্টের জন্য চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তাঁরা কখনোই সাড়া দেননি আর আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।"
ছায়াঘেরা বনবীথি আর পাখির কলতানে মুখর আশ্রমেই জন্ম নিয়েছিল বিটলসদের একমাত্র দ্বৈত অ্যালবাম 'দ্য হোয়াইট অ্যালবাম' যা তাদের সমালোচকদেরও বিভক্ত করে দিয়েছিল। এই এ্যালবাম বিটলস ভক্তদের অবাক করে দেয়, তাঁদের আনন্দিত করে আবার বিভক্তও করে। কারো কারো মতে এই এ্যালবামটি বিটলসদের মাস্টারপিস, তাঁদের দারুণ সব ধারনার বিস্ফোরণ যা বলে দেয় দলটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা নয় আবার কেউ বলে এটি সম্পূর্ণ একটি জঞ্জাল।
স্যালজম্যান তিরিশ থেকে আটচল্লিশ পর্যন্ত গানগুলোকে চিহ্নিত করেন যেগুলো সেখানে থাকাকালীন সময়ে বিটলসরা লিখেছিলেন। যার মধ্যে অনেকগুলো তারা নতুন রেকর্ডিংয়ের অন্তর্ভুক্ত করেন। সেগুলোর মধ্যে আছে Back in the USSR, Happiness is a Warm Gun, Dear Prudence, Ob-La-Di, Ob-La-Da, Sexy Sadie, Helter Skelter and Revolution
Ob-La-Di, Ob-La-Da জন্ম হয়েছিল একটা নীচু ছাদের একটা কুটিরের সিঁড়ির উপর। একদিন, স্যালজম্যান স্মৃতি রোমন্থন করেন, সেই কুটিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লেনন এবং ম্যাকার্টনিকে সিঁড়িতে বসে একোস্টিক গিটারে এর সুরের স্ট্রিমিং করতে শুনেন।
স্যালজম্যান দৌড়ে ক্যামেরা নিয়ে ফিরে আসেন আর সিঁড়িতে বসা দুই তারকার ছবি তোলেন ছোট একটা ফটকের পিছন থেকে।
স্যালজম্যানের এখনো মনে আছে তারা "over and over again, going fast and slow, having fun" এই গানটার প্রথম দু'টো লাইন তাঁরা গাইছিলেন। ম্যাকার্টনি স্যালজম্যানকে বলেন, "এটাই আমাদের 'রিফ' কিন্তু এখন কাউকে কিছু বলা যাবে না।"
রিঙ্গো স্টার ছাড়া বিটলসের সদস্যরা ভারতে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করেন। রিঙ্গো স্টার তাড়াতাড়িই ফিরে গিয়েছিলেন। আর বাকি সদস্যদের জন্য হৃষীকেশের সেই আশ্রম তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল।
স্যালজম্যান বিটলদের সাথে তার এই সাক্ষাতকে 'জীবন-পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা" হিসেবে মনে করেন। তাঁর চলচিত্রে তিনি সেই সময়কে ইলাসট্রেশন, ফটোগ্রাফ, আশ্রম আর সাক্ষাতকারের বাস্তব ফুটেজ দিয়ে পরিবেশন করেছেন।
জন লেনন ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মজার, বুদ্ধিদীপ্ত তির্যক মন্তব্যের দ্বারা মজা করতেন সব সময়, রিঙ্গো স্টার দলের সবচেয়ে ধীরস্থির এবং বিবেচক সদস্য, জর্জ হ্যারিসন শান্ত এবং সবসময় আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলতেন এবং পল ম্যাকার্টনি হলেন দলের সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ ও হাসিখুশি মানুষ।
বিটলস ভক্তদের তীর্থস্থান হৃষীকেশের আশ্রম
অতীন্দ্রিয় ধ্যানের মাধ্যমে আত্মার প্রশান্তির জন্য বিটলসরা ভারতের যে আশ্রমে বেশ কয়েক সপ্তাহের জন্য অবস্থান করেছিলেন সেই আশ্রম ভক্তদের জন্য এক তীর্থস্থান এখন।
সাতষট্টি বছর বয়সী এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক হৃষীকেশের সেই আশ্রমের বনানী শোভিত পাহাড়ি এলাকায় গাছের ছায়ার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন। একটা পরিত্যক্ত ভূমিতে তৈরি সেই আশ্রমের উদ্দেশ্যেই তিনি হাঁটছিলেন যেখান কোন এক সময় তাঁর প্রিয় দল বিটলস সময় কাটিয়েছিলেন।
বিটলসদের এই ভক্ত সুদূর ব্রিটেন থেকে তাঁর পরিবার নিয়ে এসেছেন শুধু মাত্র গঙ্গার ধারের এই আশ্রম দেখতে কারণ, অর্ধশত বছর আগে তাঁর প্রিয় গানের দল এখানে বসেই 'দ্য হোয়াইট' এ্যালবামের জন্য গান লিখেছিলেন, সুর করেছিলেন। তখন এই আশ্রমের পরিচালনা করতেন মহাঋষি মহেশ যোগী।
এই ব্রিটিশ ভদ্রলোকের সাথে বিটলসদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৬৩ সালে। লন্ডনের সমুদ্র উপকুলের এক রিসোর্টে অনুষ্ঠিত গানের অনুষ্ঠানে। তিনি ছিলেন উপস্থিত দুইশ শ্রোতার একজন। সেই ব্রিটিশ পর্যটক বলেন,
"এই জায়গাটি বিটলস ভক্তদের জন্য একটি তীর্থস্থান। তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে আসে। আমিও আমার পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি।"
যদিও দলের সদস্যরা আশ্রমে তিন মাস থাকার পরিকল্পনা করে এসেছিলেন, কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রিঙ্গো স্টার দশ দিনের মাথায় ফিরে যান মশলাযুক্ত খাবারের অভিযোগে। যদিও তিনি সুটকেস ভরে নিয়েছিলেন ভাজা বিন। তাছাড়া তাঁর স্ত্রী মউরিনের মাছি ভীতি ছিল এবং সন্তানদের জন্য তাঁদের খুব খারাপ লাগছিল।
পল ম্যাকার্টনি এক মাসের মত ছিল কিন্তু জন লেনন এবং জর্জ হ্যারিসন ছয় সপ্তাহের মত ছিলেন। অর্থনৈতিক ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে বিতর্ক ছিল আর অসমর্থিত সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় মহাঋষি অন্য এক অতিথি মিয়া ফারাওকে যৌন হেনস্তা করেছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেনন পরে একটি তির্যক গান লেখেন, "Sexy Sadie, what have you done? You made a fool of everyone," যেখানে তিনি গুরুকে সেক্সি স্যাডি বলেছেন।
ব্রিটিশ পর্যটক বলেন, চলচ্চিত্রকার স্যালজম্যান বিটলসদের অবস্থানকালীন সময়ে চারদিক কেমন সবুজ ঘাস আর গাছপালায় ছাওয়া ছিল, গাছে গাছে বানরেরা ঘুরে বেড়াতো আর সবুজ টিয়া পাখিরা উড়ে বেড়াতো তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁর কোন চিহ্নই নেই, আশ্রমে পরে আছে সেই সময়ের ভূতুড়ে ধ্বংসাবশেষ।
বড় বড় ঘাস আর আগাছার মাঝে ছত্রাক পরা বিচ্ছিরি পাথর আর কংক্রিটের দেয়ালগুলো বের হয়ে আছে। জায়গাটা এখন জাতীয় উদ্যানের অংশ যেখানে ঘন জঙ্গলে অন্তত ১৭০০ হাতির সাথে সাথে চিতা ও বাঘ রয়েছে। তবুও জায়গাটা বিটলস ভক্তদের খুব প্রিয় একটা জায়গা। একটা জরাজীর্ণ ধ্যানঘর যা ভক্তরা এখন 'দ্য বিটলস ক্যাথেড্রাল গ্যালারী'তে পরিণত করেছে যা ধ্বংসাবশেষের মাঝে টিম টিম করে জ্বলা বাতি। এর দেয়াল জুড়ে উজ্জ্বল বর্ণের গ্রাফিতি। ছাদ থেকে উঠে গেছে পলেস্তারা, জীর্ণ ফাটা দেয়াল চুয়ে নামে সূর্যের আলো।
একজন রাশিয়ান ভক্ত তাঁর প্রিয় দল বিটলসকে বলে' পজিটিভ এনার্জি', যখন একজন অস্ট্রেলিয়ান ছাত্র গ্রাফিতিটার প্রশংসা করে বলে, বিটলসরা বিপ্লবী ছিল।
বিটলস ভক্তদের এই তীর্থস্থান ১৯৫৭ সালে মহাঋষি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছিলেন। গুরু এবং তাঁর অনুসারীরা এটা ছেড়ে চলে যান ১৯৭০ সালে। তখন থেকেই জায়গাটা প্রকৃতির দখলে। ঋষি মহেশ যোগী মারা যান ২০০৮ সালে।
'প্রভু সেই কবেই স্থান পরিত্যাগ করেছেন কিন্তু তাঁর ভক্তরা এখনো এখানে আসেন,' মূল ফটকে দাঁড়ানো প্রহরী বিষণ্ণ মনে বলেন।
পপ সঙ্গীত জগতের অবিস্মরণীয় নাম 'দ্য বিটলস' এর সদস্যদের সাথে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও আধ্যাত্মবাদের যোগসূত্রটা হয়েছিল মূলত জর্জ হ্যারিসনের কারণে যিনি বাহামায় 'হেল্প' এর শুটিং এর সময় সর্ব প্রথম ভারতীয় চিন্তা আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে পরিচিত হন। রবিশংকরের কাছে সেতারের শিক্ষা গ্রহণ তাঁকে এগিয়ে দেয় আরেক ধাপ। পরবর্তীতে অতীন্দ্রিয় যোগ শিক্ষা গ্রহণে দলের সব সদস্যের হৃষীকেশের আশ্রমে অবস্থান তৈরি করে এক অধ্যায়।
সূত্র: বিবিসি