বড়িশায় অবগুণ্ঠিত জীবনানন্দের আত্মপ্রকাশ
কলকাতা মেট্রোর টালিগঞ্জ বা মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে নেমে বেহালা চৌরাস্তার বাস। মফস্বলের সরু রাস্তা, পাশে বাজার, স্কুল, বাড়িঘর পেরিয়ে বড়িশা এলাকায় বেহালা মোড়। সেখানে নেমে আরেকটু ডানে হাঁটলেই বড়িশা কলেজ; বর্তমান নাম বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেন। জীবনানন্দ এখানে পড়িয়েছেন ১৯৫২ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরপরেই চাকরিটা চলে যায়। চাকরিটা ছিল অস্থায়ী। ফলে বেশিদিন কাজ করার সুযোগ ছিল না।
২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার যখন প্রথমবার এই কলেজে যাই, তখন এটি বন্ধ। ওই সময়ে একটানা বেশ কয়েকদিন নানা কারণে কলেজ বন্ধ ছিল। সেই ছুটির ফাঁদেও বাবলু মাহাতো নামে একজন নিরাপত্তা প্রহরীকে পাওয়া গেলো। জানালেন, এই কলেজে জীবনানন্দের স্মৃতি বলতে প্রবেশদ্বারের দেয়ালে একটি ফলকই শুধু আছে। জীবনানন্দের জন্মশতবর্ষের পরের বছর ২০০০ সালের ১১ আগস্ট ফলকটি উন্মোচন করেন পশ্চিমবঙ্গ কলেজ সার্ভিস কমিশনের সদস্য ড. পবিত্র কুমার গুপ্ত। ফলকে জীবনানন্দের বিখ্যাত 'আকাশলীনা' কবিতার একটি লাইন উল্লেখ করে লেখা আছে: 'জীবনানন্দ দাশ বড়িশা কলেজে ১৯৫২ নভেম্বর থেকে ১৯৫৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। সেই সূর্যস্মৃতির লাবণ্য বিভায় স্মারকটি বিবেকানন্দ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের শ্রদ্ধার্ঘ স্বরূপ নিবেদিত।'
১৯৫০ সালে বড়িশা কলেজের যাত্রা শুরু। ১৯৫৬ সালের জুন মাসে এটি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ডিগ্রি কলেজের মর্যাদা পায়। এই সময়েই স্বামী বিবেকানন্দের নামানুসারে এই কলেজের নামকরণ করা হয় বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেন। স্থান সংকুলানের অভাবে ১৯৫৯ সালে এই কলেজের একটি অংশ চলে যায় ঠাকুরপুকুর এলাকায়।
১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে জীবনানন্দ যখন বড়িশা কলেজে যোগ দেন, তখন বেহালা চৌরাস্তার ওপরেই বড়িশা উচ্চবিদ্যালয়ের পূর্বদিকে কাঠের পার্টিশান দেয়া চারটি ঘরে মহিলা কলেজের ক্লাস হতো। জীবনানন্দ ইন্টারমিডিয়েটের ক্লাস নিতেন।
বড়িশা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাতে প্রভাতকুমার দাস (জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ১৮৫) জানাচ্ছেন, ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত কলেজ পরিচালনা সমিতির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে পরবর্তী ২৮ নভেম্বর তারিখের সভায় তার নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যদিও এর আগেই ওই বছরের পয়লা নভেম্বর তিনি কাজ যোগ দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় দফায় ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এই কলেজে গিয়ে কথা হয় শিক্ষক স্বপ্না রায়ের সঙ্গে। জানান, কলেজের দেয়ালে একটি ফলক ছাড়া এখানে জীবনানন্দের আর কোনো স্মৃতি নেই। লাইব্রেরির একটি অংশকে 'জীবনানন্দ কর্নার' করা হয়েছিল এবং সেখানে জীবনানন্দের বইপত্র রাখা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ওই কর্নারটি মূল লাইব্রেরির সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়। ১৯৯৯ সালে জীবনানন্দের জন্মশতবর্ষে কলেজে একটি বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল। কিন্তু এখন আর তার জন্মমৃত্যু দিবস সেভাবে পালন করা হয় না।
ঠাকুরপুকুর এলাকায় বড়িশা কলেজের যে অংশটি চলে গেছে, সেটি এখন বিবেকানন্দ কলেজ। ঠিকানা ২৬৯ ডায়মন্ড হারবার রোড। বিবেকানন্দ মহিলা কলেজ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এই কলেজের সামনে থেকেই বাস বা অটোতে সহজেই যাওয়া যায়। কলেজের এই ক্যাম্পাসটি হয়েছে জীবনানন্দের পরে। কিন্তু তারপরও এই কলেজ তাকে মনে রেখেছে। তার নামে একটি ভবন করেছে। শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালের ২২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কলেজের বোর্ড সভায় জীবনানন্দের নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে রেজিস্ট্রি খাতায়, সেই খাতাটিও কলেজ কর্তৃপক্ষ সযতনে রেখেছে। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ড. তপন কুমার পোদ্দার নিজে উঠে গিয়ে আলমিরা থেকে ঐতিহাসিক সেই রেজিস্ট্রি খাতাটি বের করে দিলেন। খাতার ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় হাতেলেখা শিহরিত হবার মতো সেই লাইন: Item 6: To approve the appointment of Sri Jibanananda Das as a Lecturer in English (Temporary).
এই কলেজের অধ্যাপক নবকিশোর চন্দ পুরো ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখালেন এবং জানালেন জীবনানন্দের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা।
গোপালচন্দ্র রায় (জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ৪৮) লিখেছেন, বড়িশা কলেজের একজন ইংরেজির অধ্যাপক স্বেচ্ছায় কাজ ছেড়ে চলে গেলে পদটি খালি হয়। তখন জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দের স্ত্রী নলিনীর বান্ধবী বাণী রায়ের দাদা ওই কলেজের অধ্যক্ষ। তার সুবাদে কলেজে জীবনানন্দের চাকরিটা হয়।
১৯৫২ সালের নভেম্বরে চার মাসের লিভ ভ্যাকান্সিতে এখানে তাকে নিযুক্ত করা হয়, যেটি ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে গেলেও পুনঃনিয়োগ পাননি। কেন জীবনানন্দকে স্থায়ী করা হলো না—বাণী রায়কে এই প্রশ্ন করেছিলেন গোপালচন্দ্র রায়। জবাবে বাণী রায় বলেন, 'জীবনানন্দ পড়াতে পারতেন না। তার উপর তার বয়সও হয়ে গিয়েছিল।' তাছাড়া ছেলেদের কলেজে পড়ানো আর মেয়েদের কলেজে পড়ানোয় তফাৎ আছে বলেও বাণী রায় উল্লেখ করেন। কিন্তু এই কথার সাথে একমত নন গোপালচন্দ্র রায়। কারণ এর আগেও জীবনানন্দ একাধিক কলেজে পড়িয়েছেন। পড়াতে পারেন না—এমন অভিযোগে তার চাকরি যায়নি। তাছাড়া জীবনের শেষ সময়গুলো তিনি মেয়েদের কলেজেই (হাওড়া গার্লস কলেজ) অত্যন্ত সফলতার সাথে পড়িয়েছেন।
বড়িশা কলেজে তার সহকর্মী শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় (স্মৃতিচিত্র, উত্তরসূরি, পৌষ-ফাল্গুন ১৩৬১) লিখছেন, 'জীবনানন্দবাবু ছিলেন সলজ্জ; অবগুণ্ঠিত ছিল তাঁর আত্মপ্রকাশ। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন যাঁরা, তাঁদের কাছেই কেবল তিনি ছিলেন উন্মুখর, অধিকাংশের কাছে তিনি মিতবাক স্থিতধী।'
তবে এই সময়ে তার শরীর ও মনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বড়িশা কলেজে যোগদানের আগে খড়্গপুর কলেজ থেকে তার চাকরিটা চলে যায় প্রথমত স্ত্রীর অসুস্থতাজনিত দীর্ঘ ছুটি এবং ওই একই সময়ে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। সম্ভবত এই সময়েই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। শরীর ভেঙে যায়। ক্লান্তি ও অবসাদ ভর করে। শরীরের এরকম বেহাল দশা নিয়েই বেহালা চৌরাস্তার এই কলেজে যোগ দেন। অর্থের টানাপড়েনে জর্জরিত এই সময়ে পার্টটাইম ফুলটাইম যেকোনো কাজ হলেই বর্তে যেতেন জীবনানন্দ এবং এ কারণেই বড়িশা কলেজের এই অস্থায়ী কাজে যোগ দেন। কিন্তু প্রতিদিন বাসে যাওয়া-আসা করে শরীর আরও ভেঙে পড়ে।
শান্তিপ্রিয়র ভাষায়, 'এই সময়টা তাঁর স্বাস্থ্যও ছিল ছিল খুব ছন্ন, রক্তের চাপ অনুভব করছিলেন কিছুদিন থেকে। বাসে করে এসে অনেক দিনই নিজেকে ক্লান্ত বলে মনে করতেন, ভীত হয়ে পড়েছিলেন মনে মনে: রক্তচাপজনিত একটা মানসিক দৌর্বল্যে। ক্লাসের পূর্ব মুহূর্তে অসহায় মনে করতেন নিজেকে। তখন সহানুভূতিশীল সহকর্মীদের কেউ কেউ শিশুর সারল্যে নাড়ির গতি নির্ণয় করতেন।' শান্তিপ্রিয় লিখছেন, 'সহকর্মীর অনুমতির ওপর নির্ভর করছে তার ক্লাসে প্রবেশ করা না করা। ওই সময়ে দৃষ্টিশক্তিও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল।'
গোপালচন্দ্র রায় (প্রাগুক্ত, ৪৯) লিখেছেন, শারীরিক অসুস্থতার এই কথার সাথে একমত নন জীবনানন্দের এক ছাত্র কমলশংকর গুহ এবং বড়িশা কলেজে জীবনানন্দের আরেক সহকর্মী নিরঞ্জন চৌধুরী। তারা বলেন, জীবনানন্দকে তাদের কখনো অসুস্থ বলে মনে হয়নি। তাছাড়া বড়িশা কলেজ সংলগ্ন বড়িশা স্কুলের শিক্ষক কবি নীহারকান্তি ঘোষ দস্তিদার এ সম্বন্ধে জানান, জীবনানন্দ ও তিনি একসাথে অনেক সময় কলকাতায় থেকে ৭ নং বাসে চড়ে বড়িশায় যেতেন এবং একসাথে ফিরতেন। কিন্তু জীবনানন্দকে কখনো সেভাবে অসুস্থ মনে হত না। তাদের যুক্তি হলো, যে মানুষটি প্রতিদিন রাস্তায় ভিড়ভাট্টা ঠেলে, বাসে চড়ে অতদূর যেতে আসতে পারেন, তিনি অসুস্থ হন কী করে? তাহলে এই কলেজ থেকে জীবনানন্দের চাকরিটা কেন গেলো বা কর্তৃপক্ষ কেন তাকে স্থায়ী করলো না, সেটি আপাতত রহস্যই থাকলো।
শোনা যায়, কলেজটি সরকার অনুমোদিত ডিসপারসিয়াল প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে কোনো অস্থায়ী পদের শিক্ষককে স্থায়ী করার মতো ক্ষমতা কলেজ কর্তৃপক্ষের ছিল না। তাছাড়া কর্তৃপক্ষ নাকি তাকে স্থায়ীভাবে নিয়োগের চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু সরকারকে রাজি করাতে পারেনি। এ অবস্থায় ১৯৫৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কলেজের কার্যকরি কমিটির সপ্তম সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত: Resolved that in view of the Government's reluctance to extend the appointment the Principal be authorized to terminate temporary appointment of Das from 1st March 1953. ফলে এই সময়ের পরে জীবনানন্দ পুনরায় বেকার হয়ে পড়েন। কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বরাতে জানা যাচ্ছে, জীবনানন্দ বড়িশা কলেজে ১৯৫২ সালের পয়লা নভেম্বর থেকে পরের বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পড়িয়েছেন।
বড়িশা কলেজের এই চাকরিটা চলে যাওয়ার পরে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখে আরেকটি কলেজের শিক্ষক পদের জন্য বক্স নম্বরে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হয়ে জানতে পারেন কলেজটি ডায়মন্ড হারবার ফকিরচাঁদ কলেজ। কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলেও দূরত্বের কথা বিবেচনা করে জীবনানন্দ রাজি হননি। কেননা ওই সময়ে শরীরের যে অবস্থা ছিল তাতে প্রতিদিন কলকাতা থেকে ট্রেনে যাতায়াত কিংবা বাসে চড়ে এতদূর যাওয়া-আসা কঠিন হতো। তাছাড়া ওই সময়ে তিনি প্রাইভেট টিউশনি করতেন। ফলে প্রথমত পথের দূরত্ব এবং শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি কলকাতা শহরে বসেই টিউশনির সুযোগটা তিনি হারাতে চাননি। ফলে ওই বছরের পয়লা জুলাই হাওড়া গার্লস কলেজে যোগদানের আগ পর্যন্ত এই চার মাস তিনি কোনো নিয়মিত চাকরিতে ছিলেন না। টিউশনির সামান্য আয় বাদ দিলে এক অর্থে পুনরায় বেকারত্বেরই ঘানি টানেন।
শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ওই সময়ে জীবনানন্দ তার বন্ধুদের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেছিলেন: একটি গভীর ক্ষত। যেখানে প্রলেপ লাগাতে পারেননি তারা। অনেক সন্ধ্যায় তার বাড়িতে বসে আলাপ করেছেন কাব্য নিয়ে। কিন্তু জীবনের প্রসঙ্গ এত বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল যে, সাহিত্যের প্রশ্ন সেখানে ছিল অবান্তর।