ভাষাবন্দনা
ভাষা বিস্তারের আরব মডেল
আফ্রিকায় আরব উপনিবেশ ও ইউরোপিয় উপনিবেশ উভয়ই সেখানকার ভাষার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ৬১৪ সালে ইসলাম ধর্মের প্রচারক মুহাম্মদ (দঃ) বহু ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের মধ্যে মক্কায় প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থানরত অনুগত ভক্তদের নির্দেশ দিলেন তারা যেন লৌহিত সাগরের দিকে চলে যান এবং সেখানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। প্রথম হিজরত হিসেবে পরিচিত প্রথম সফরে ২৩ জন মুসলমানের প্রথম দলটি আবেসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) পৌঁছালে রাজা তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানান, তাদের আচরণে মুগ্ধ হন এবং এক সময় তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। একই বছর ১০১ জনের আর একটি দল মদিনা থেকে আফ্রিকা আসেন। ৬৪১ সালে খলিফা ওমর ইবনে আল খাত্তাবের শাসনকালে মুসলমান সেনাবাহিনী মিশর দখল করে এবং পরের বছর লিবিয়াও তাদের দখলে আসে। ৬৪৭ সালে খলিফা ওসমানের সময় তিউনিসিয়া পর্যন্ত দখলে চলে আসে। উমাইয়া রাজত্বকালে এই বিজয় অব্যাহত থাকে ৬৮০ সালে আলজেরিয়া ও মরক্কোও অধিকার করে এবং মরক্কো থেকে তারা জিব্রালটার প্রণালী পাড়ি দেয়। ৭৫০ থেকে ১২৫৮ পর্যন্ত আব্বাসীয় যুগে ইসলাম ধর্ম, আরবী ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তৃতি আফ্রিকায় সুসংহত হয়।
বর্তমানে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমান অধ্যুষিত আফ্রিকান দেশগুলো হচ্ছে আলজেরিয়া (৯৮%) কোমোরোস (৯৮.৩%) জিবুতি (৯৭%) মিশর (৯৫%) গাম্বিয়া (৯৫%), লিবিয়া (৯৬.৬%), মালি (৯৪.৪%), মোরিতানিয়া (৯৯%), মরোক্কো (৯৯%), নাইজার (৯৮.৪%), সেনেগাল (৯৬.৪%), সোমালিয়া (৯৯ ভাগেরও বেশি) সুদান (৯১%), তিউনিয়িা (৯৯ ভাগেরও বেশি) পশ্চিম সাহারা (৯৯ ভাগেরও বেশি) এবং ফরাসি উপনিবেশ ম্যায়ত (৯৮.৬%)। ৫০ শতাংশের বেশি ও ৯০ শতাংশের কম মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো হচ্ছে : বুরকিনা ফাসো, চাদ, গিনি, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন। ১০ থেকে ৪৯ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ হচ্ছে বেনিন, ক্যামেরুন, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, গ্যাবন, ঘানা, গিনি বিসাউ, আইভরি কোস্ট, লাইবেরিয়া, মালাওয়ি, মরিশাস, মোজাম্বিক, তাঞ্জনিয়া, টোগো, এবং উগান্ডা। আরবদেরটাও কলোনাইজেশন বা উপনিবেশিনীকরণ কিন্তু তা চরিত্রগত ভাবে ইউরোপিয়া ঔপনিবেশিকীরনের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। এর নাম এসিমিলেশনিস্ট কলোনিয়াল সিস্টেম বা আত্মীয়করণবাদী ঔপনিবেশিক পদ্ধতি। এতে অত্যাচার, অনাচার ও রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা সামান্য, এতে ঔপনিবেশিক শক্তিকে উপনিবেশের সাথে মিলে যেতে হয়। বসতি স্থাপন করতে হয়, উভয়ের জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির বিনিময়ের পথ খুলে দিতে হয়; লুটতরাজ ও অপহরণ যে তাদের লক্ষ্য নয়, তা বিশ্বাস করাতে হয়। আরবরা এক ধরনের ইসলামিক সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, ধনী ও নির্ধনকে এক কাতারে প্রার্থনায় শামিল করিয়েছে, এক পাতে খাইয়েছে, মানুষের মর্যাদার উপর গুরুত্ব দিয়েছে, ক্রীতদাসদের মুক্তি দিয়েছে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে উপনিবেশের ধর্মীয় এ সাংস্কৃতিক জীবনে। তারা এগিয়ে এসে আরবদের ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাদের ভাষা এবং ধর্মগ্রন্থের ভাষা এক হওয়ায় সেই ভাষাকে আয়ত্ব করতে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত বোধ করেছে। স্থানীয়রা আরবদের মুখের ভাষা এতোটাই গ্রহণ করেছে যে তাতে কালক্রমে ভাষার মানচিত্রে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন এসেছে। মিশরীয় ও উত্তর আফ্রিকার বহু ভাষার স্থান দখল করেছে আরবি এবং সে সব ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ইউরোপিয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা মূলত ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এসেছে, তাদের আগমন কারো পর্তুগিজ, কারো স্পেনিশ, কারো ডাচ, কারো ফ্রেঞ্চ, কারো ইংরেজি ভাষা নিয়ে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগে ইউরোপিয় আগমন ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে। ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তার ও বিকাশ তাদের প্রাথমিক লক্ষের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পর্তুগিজরা গিয়েছে কেইপ ভার্দে, সো টোমা এবং প্রিন্সেপে যেখানে আগে থেকেই ইংরেজি ও ফরাসিদের আগমন ঘটেছে। স্থানীয় ভাষার সাথে স্থানীয়ভাবে গৃহীত এবং ইংরেজি ফরাসি, পর্তুগিজ মিলে মিশে সৃষ্টি হয়েছে ক্রেওল।
১৮৮৫ সালের বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে আফ্রিকা ব্রিটেন ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, বেলজিয়াম স্পেন ও ইতালির মধ্যে বন্টিত হয়ে যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মানি তার সব উপনিবেশ হারায়। স্পেন ও ইতালির ভাগ কম ছিল। ঔপনিবেশিকরনের হাতিয়ার হিসেবে তারা স্কুল খোলে, স্থানীয়দের মধ্যে তাদের শাসন সহায়ক সহযোগীদের তাদের পছন্দের পদ্ধতিতে এবং তাদের ভাষায় শিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নেয়। নতুন বিশ্ব থেকে আসা এই সাদা মানুষেরা বাণিজ্যের সুবিধের জন্য তাদের ভাষা শিখতে চেষ্টা করে। ইউরোপিয়দের বসতি পরিণত হয় মুনাফা ও ভোগের রাজত্বে, যেখানে নেটিভদের কোনো অধিকার ছিল না। নেটিভ ও ঔপনিবেশিক প্রভুদের মাঝখানে 'বাফার' হিসেবে অবস্থান করে সিভিল সার্ভেন্ট আমলারা। তারা দু'পক্ষের দোভাষীর ভূমিকাও পালন করে আরবির ধরনের কোনো আত্মীকরণ ঘটেনি অন্ততঃ পর্তুগিজ কলোনিতে তো মোটেও নয়।
ইগবো, ইউরুবা ও হাউমাসহ প্রায় ৪০০ ভাষার দেশকে নাইজেরিয়ার ব্যাপারটা অন্য আফ্রিকান দেশের মতো। ব্রিটিশ কলোনিই দ্বিভাজিত নাইজেরিয়াকে এক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে এবং ১৯৬০ থেকে দেশটি স্বাধীনতা ভোগ করেছে। ভাষা কোন্দল এড়াতে ততদিনে বহুল প্রচলিত হয়ে যাওয়া 'নাইজেরিয়ান ইংলিশ-ই তারা পছন্দ করে। জাতীয় ও আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে প্রধান ভাষাগুলো অন্তর্ভুক্ত হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে ইংরেজিই ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে। ইংরেজি জানা কয়েকটি প্রজন্ম গড়ে উঠায় ইংরেজিকে তারা আর ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষা হিসেবে দেখে না। বরং অক্সফোর্ড অভিধানে নাইজেরিয়ান উৎস থেকে উঠে আসা কটা শব্দে ঢুকেছে তা নিয়ে গর্ব করে।
নাইজেরিয়ার মতো আরো একটি ব্যতিক্রম আছে- সেনেগাল। ১৬৫৯ সালে সেনেগালের অংশ বিশেষ ফ্রান্স দখল করে নেয় এবং সেইন্ট লুইসে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। কালক্রমে পুরো দেশই দখল নিয়ে নেয়। ফরাসিরা ব্রিটিশদের মতো ট্রেডিং নেশন নয়। প্রায় সকল উপনিবেশেই তারা তাদের কিছু সংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রেখে এসেছে। সেনেগাল নিয়েছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। ওলোফ ও আরবি সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হলেও দাপ্তরিক কাজ কর্ম চলে ফরাসি ভাষায়। ১৯৬০ এ স্বাধীন হবার পর থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত দেশটি পরিচালনা করেন বিখ্যাত ফরাসি কবি এবং প্রেসিডেন্ট লিওপোল সেডর সেংঘর। অবসর নিয়ে তিনি আমৃত্যু ফ্রান্সেই একটি কান্ট্রি হাউসে বসবাস করতেন।
তবে ভাষার বিস্তারে আরবিয় উপনিবেশ মডেলটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সাম্রাজ্যের সংহতির জন্য এক মুদ্রা এবং এক ভাষার কথা বলেছেন। আবার এরিস্টোটলের ছাত্র হিসেবে বিজিত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিজয়ী হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন কিন্তু বিজিতের সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপের বিরোধিতাও করেছেন।
জীব বৈচিত্র্য ও ভাষা বৈচিত্র্য
জীব বৈচিত্র্য নিয়ে পৃথিবীর যে মানচিত্র, তার উপর ভিত্তি করে টেরা লিঙ্গুয়া মানের একটি ভাষা প্রতিষ্ঠান ভাষা মানচিত্র প্রণয়ন করল। এবার পাশাপাশি দুই মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে স্পষ্টই দেখা গেল যেখানে জীব-বৈচিত্র্য বেশি, ভাষা বৈচিত্র্যও সেখানে বেশি। সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ আমাজন উপত্যকা এবং পাপুয়া নিউ গিনি দ্বীপপুঞ্জ। এখনও জীবিত ভাষা সবচেয়ে বেশি পাপুয়া নিউ গিনিতে--আট শতাধিক। নৃতাত্ত্বিক ও ভাষা গবেষকরা দেখিয়েছেন জীব-বৈচিত্র্যের বিনাশ ও বৃক্ষরাজির বিনাশ ভাষার উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। বিল সাদারল্যান্ডের গবেষনায় দেখা গেছে ভাষা বিলুপ্তির হার জীব বিলুপ্তির চেয়ে অনেক বেশি। গত ৫০০ বছরে শতকরা ৪.৫ ভাগ ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে আর স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে ১.৯ ভাগ আর পাখির বিলুপ্তি ঘটেছে ১.৩ ভাগ।
প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আদিবাসীদের। পারস্পরিক পরিচর্যা মানুষ ও জীবজগতকে সুস্থতা ও আয়ু প্রদান করেছে। কিন্তু সাম্রাজ্যের নেশা এই ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়। আমেরিকান আদিবাসী সেকানিরা ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বনাঞ্চলে আমাদের জুম চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করত; নিয়মতান্ত্রিক একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে অরণ্যের একাংশ পুড়ত একাংশে নতুন বৃক্ষ বেড়ে উঠত। এতে বনখেকো গুবরে পোকাও দূরে থাকত। ব্রিটিশ কলম্বিয়া অরণ্যে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের সাথে সাথে রোগজীবাণুও প্রবেশ করে। গুটি বসন্ত মহামারীতে অধিকাংশ স্থানীয় মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বনের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা চলে যায় কাঠ ব্যবসায়ীদের হাতে। বিশাল এলাকা জুড়ে বনায়ন করার উদ্দেশ্য প্রকৃতি থেকে যতটা আদায় করা সম্ভব ছেঁকে নেয়া। ঘটনাটি ১৯৯০ দশকের। গুবরে পোকার আকস্মিক আক্রমণে সাত লক্ষ একর বন নষ্ট হয়ে যায়।
'সেকানি' ভাষাভাষী সেকানি আদিবাসীর সংখ্যা একশতের নিচে নেমে গেছে। ভাষাটির পুরোপুরি মৃত্যুর সময়ও ঘনিয়ে এসেছে এর সাথেই আদিবাসী সেকানিদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটবে চিরদিনের জন্য। ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ১০-এর নিচে নেমে গেছে এমন কয়েকটি ভাষা হচ্ছে : জিঙ্গুলু, জামবিওয়া, উরুয়াক, এনগার লুমা, জাপারো, অনগোটা, আজারু, আরাকি, বুসু, ডুমি, চামিকুরো, মুনিচি, আয়াগানেক, ম্যাকোলকল, অ্যাকুনতসু, আনাম্বে, আরাবানা। গত দশ বছরে মৃত্যুবরণ করেছে এমন ভাষার মধ্যে রয়েছে: এনগান্দি, সারে, তেহুলচে, মালদান, গুগু থেয়পান, আমুরদাগ, ইয়োরোক, আপার চিনুক, ধুঙ্গালু, আপিয়াক, আকাবু পাজেহ প্রভৃতি। কোনো ভাষার শেষ মানুষটির মৃত্যুর সাথে সাথে ভাষাটিও সমাহিত হয়ে যায়।
হিন্দি নয় সংস্কৃত হোক ভারতের রাষ্ট্রভাষা
স্বাধীন ভারতের প্রথম বিদ্যুৎ মন্ত্রী মহারাষ্ট্রের নাহার বিষ্ণু গ্যাডগিল (১৮৯৬-১৯৬৬) কংগ্রেসের একজন বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ ছিলেন। ইংরেজি ও মারাঠি ভাষায় তিনি সাতটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৯৪৯-এর ১২ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর হিন্দিকে 'জাতীয় ভাষা' (অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভাষার মতো দাফতরিক ভাষা নয়) ঘোষণা সংক্রান্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। গ্যাডগিল দাবি জানালেন হিন্দি নয়, সংস্কৃত হবে ভারতের জাতীয় ভাষা।
বাঙালি সদস্য সতীশ চন্দ্র সামন্ত বললেন হিন্দির চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা, একসময় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা শিক্ষা দেওয়া হতো। আর ভারতের স্বাধীনতার মন্ত্র বন্দে মাতরম বাংলা থেকেই এসেছে। বাঙালি অপর সদস্য শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বললেন, যদি এক ভাষা এক ভারত সৃষ্টি করা হয় তাহলে বৈচিত্র্যের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যাবে।
কৃষ্ণ সুরতি রাও এবং নাজিরউদ্দিন আহমদ জোর দিয়ে বললেন অন্য কোনো ভাষা নয়, ইংরেজি হবে ভারতের জাতীয় ভাষা। আরভি ধুলেকার মহাত্মা গান্ধীর দোহাই দিয়ে বললেন ঠিক হিন্দি নয় হিন্দুস্তানি হতে হবে ভারতের রাষ্ট্রভাষা। স্বাধীন ভারতে যদি ইংরেজি চালু রাখা হয় লর্ড ম্যাকলের প্রেতাত্মা হাসতে থাকবে।
বলা বাহুল্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত হিন্দিরই পক্ষে। গ্যাডগিল আবার বললেন, হিন্দি প্রাদেশিক ভাষা, এটা জাতীয় ভাষা হলে অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার দাবি উপেক্ষা করার কোনো যুক্তি থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সকল প্রদেশের জন্য প্রযোজ্য, শ্রদ্ধা ও সমীহের ভাষা সংস্কৃত হবে জাতীয় ভাষা। গ্যাডগিল পাঞ্জাবের গভর্নর এবং পুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। উত্তর প্রদেশের (তখনকার ইউপি-ইউনাইটেড প্রভিন্স) লোকসভা সদস্য আলগু রাই শাস্ত্রী বললেন, কোনো সন্দেহ নেই সংস্কৃতই হচ্ছে ভারতের সকল ভাষার জননী, তবে জ্যেষ্ঠ কন্যা হিন্দিই জাতীয় ভাষা হবার দাবিদার। শ্রেষ্ঠ গোবিন্দ দাস বললেন সংখ্যা গরিষ্ঠ যদি সম্মান পায় তাহলে ইংরেজি তাড়িয়ে হিন্দিকে স্থান দেওয়া হোক। যে সব ভারতীয় পরিবার সন্তানের স্বার্থে প্রাদেশিক ভাষার জন্য লড়াই না করে সরাসরি ইংরেজিকে মেনে নিয়েছেন, অন্যদের তুলনায় তারা এগিয়েছেন বেশি। এখন কেউ কেউ বলছেন ১৯৪৯-এর বরং ইংরেজিকে সমর্থন করলে হিন্দির দৌরাত্ম থেকে রেহাই পাওয়া যেত। সংস্কৃত মৃত ভাষা, কিন্তু ইংরেজিতো উজ্জীবিত।
সুপার পাওয়ার পাপুয়া নিউগিনি
এথনোলোগের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী ভাষার সুপার পাওয়ার পাপুয়া নিউগিনি। হিসেবটি সংখ্যাভিত্তিক। এথনোলোগের হিসেব নির্ভর ২৩ নভেম্বর ২০১৬-র প্রতিবেদন থেকে নেওয়া তালিকা :
দেশের নাম ব্যবহৃত ভাষার সংখ্যা
পাপুয়া নিউগিনি ৮৪০
ইন্দোনেশিয়া ৭০৯
নাইজেরিয়া ৫২৭
ভারত ৪৫৩
যুক্তরাষ্ট্র ৪৩০
চীন ৩০১
মেক্সিকো ২৯০
ক্যামেরুন ২৮০
অস্ট্রেলিয়া ২৬০
ব্রাজিল ২২৮
সংখ্যা বিবেচনায় পরের দেশগুলো হচ্ছে: কঙ্গো, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, কানাডা, সুদান, চাদ, রাশিয়া, তানজানিয়া, নেপাল ও ভানুয়াতু, ভাষাতাত্ত্বিক উইলিয়াম সাদারল্যান্ড দেখিয়েছেন বিপন্ন প্রাণীর চেয়েও ভাষার বিপন্নতা বেশি আর সে আঘাতের তীব্রতা ভাষার সুপার পাওয়ারের উপরই বেশি।
বাংলা ভাষার জন্য আরও ১১ মৃত্যু
এগারজনের বোনটির নাম কমলা ভট্টাচার্য। নিহত ভাইয়েরা হচ্ছেন: শচীন্দ্র পাল, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দেব, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, ধীরেন্দ্র সূত্রধর, তরনী দেবনাথ এবং সুনীল সরকার। যখন আসামের বাঙ্গালিদের প্রান্তে ঠেলে দেবার জন্য আসামিরা অহমিয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ঘোষণা করে বাঙ্গালিরা বিক্ষুব্ধ হয়। শিলচর ট্রেন স্টেশনের পাশে তাদের প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ঝরে পড়ে এগারটি জীবন। ভাষার জন্য এক সাথে এতোগুলো জীবনহানি পৃথিবীর কোথাও ঘটেনি।
১৯৬১-তে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া তরুণের সংখ্যা ১৯৫২-র ভাষা শহীদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। সেই এগার জনকে নিয়ে শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতা:
দশটি ভাই আর
একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল
ঐ যে ঈশান কোন--
কোন ভাষাতে হাসে-কাঁদে
কান পেতে তা শোন
শুনলি না? তো একার
এসে কুচক্রীদের ছা--
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী
আওয়াজ শুনে যা--
বাংলা আমার মাতৃভাষা
ঈষান বাংলা মা।
দাপ্তরিক ভাষা
১৭৮টি দেশে কমপক্ষে একটি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে। ১০১টি দেশে দাপ্তরিক ভাষা একাধিক। ৬৭টি দেশে ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা, যার অধিকাংশ দেশের নাগরিকদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়। বহুল স্বীকৃত ৪টি দাপ্তরিক ভাষার মধ্যে ইংরেজি ছাড়াও রয়েছে ফ্রেঞ্চ, আরবি এবং স্প্যানিশ।
দাপ্তরিক ভাষার ধারণাটি রাজনৈতিক এবং আড়াই হাজার বছরের পুরনো খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে সম্রাট দানিউস যখন মেসোপটোমিয়াকে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন, রাজকীয় আরামায়িক বা দাপ্তরিক আরামায়িক নাম দিয়ে আরামায়িক ভাষার একটি সংস্করণকে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই প্রতিষ্ঠা ঘটল ফরমানের মাধ্যমে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দাপ্তরিক ভাষা বলিভিয়াতে ৩৭টি; দ্বিতীয় স্থানে ২৩টি ভাষা নিয়ে ভারতের অবস্থান।
বাংলা
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বাংলাকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়েছে; ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি জারিকৃত একটি নির্বাহী আদেশ উল্লেখ করা সমীচীন:
'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙ্গালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন এটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উশৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এই আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা ও আধাসরকারি অফিসে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোনো অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস আদালতের কর্তাব্যক্তিরা সতর্কতার সঙ্গে এ আদেশ কার্যকরী করবেন এবং আদেশ লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির বিধান ব্যবস্থা করবেন।'
এ আদেশে সরকারি অফিসে নিম্ন আদালতে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে, কিন্তু চাকরির বাজারে বাংলাজানা প্রার্থীর কদর একটুও বাড়েনি। এখানেও বাংলাবান্ধব একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।