মানচিত্রকার ও ভূগোলের মহাকাব্য
'সবকিছুই আছে এমন একটি মানচিত্র যদি পেতে চান তাহলে আপনি তা পেয়ে গেছেন, তার নাম পৃথিবী'- স্কট মোরহাউস।
স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি :
২৩ বছর বয়সী এক নারী ওন্টারিও থেকে টেনোরমরি যাচ্ছেন। গন্তব্যস্থলের ভূপ্রকৃতি ও চারপাশ তার অজানা, কাজেই একান্ত অনুগত গাড়িচালকের মতো তিনি তার গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করছেন। তিনি পর্দায় মানচিত্র ও ডিরেকশন অনুসরণ করছেন। চোখ তুলে আর দেখেননি গাড়ি কোথায় যাচ্ছে। গাড়ি গিয়ে পড়ল জর্জিয়ান উপসাগরের বরফশীতল জলে। ভাগ্য ভালো তিনি বেরোতে পেরেছেন এবং সাঁতার কেটে তীরে উঠেছেন, কিন্তু গাড়িটি তখন ঢেউয়ের অতলে।
৬৭ বছর বয়স্ক এক বেলজিয়ান নারী ঘন্টায় ৯০ মাইল গতিতে জিপিএস নির্দেশনা অনুসরণ করে জার্মান রওয়ানা হয়ে বেশ ক'ঘন্টা পর বাইরে তাকিয়ে দেখলেন ক্রোয়েশিয়ান হরফ, তার মানে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো দেশে চলে এসেছেন।
জিপিএস নির্ভরতা মানুষের মনের ভেতরের মানচিত্র ও কম্পাস ডি-একটিভেটেড করে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে বলে আসছিলেন আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রে একটি অলীক ব্ল্যাক বক্স আছে, তাতে মানচিত্র ও কম্পাস আছে, কিন্তু জিপিএস-এর ব্যবহার ওসবের সহজাত কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়েছে। এতোটাই কমিয়ে দিয়েছে যে প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে মানুষ নিজের মনে যে মানচিত্রের ইমেজ ধারণ করত তাও এখন বিলুপ্ত হবার পথে। অতিরিক্ত ক্যালকুলেটর ব্যবহারকারীদের বেলায় যা হয়, সামান্য যোগ করার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেরেন। জিপিএস হচ্ছে মানচিত্রের প্রযুক্তিগত বিকাশের একটি পর্যায়। এখন জিপিএস স্ক্রিনের দিকে নজর রাখতে হচ্ছে, ড্রাইভারশূন্য গাড়ি নিজেই জিপিএসের নির্দেশ মানতে জানে।
একালের মানচিত্র জিআইএস-ভিত্তিক আর জিআইএস হচ্ছে পৃথিবী নামের গ্রহের স্নায়ুতন্ত্র। জ্যাক ড্যাঞ্জারমন্ড লিখছেন 'জিআইএস ব্যবহার করে মানচিত্র তৈরি করা পিয়ানো বাজানোর মতো একটি বিষয়। যন্ত্র তৈরির কঠিন কাজটি আপনার জন্য কেউ না কেউ করে রেখেছে, কারণ কখন কোন বোতাম চাপবেন আপনার ওইটুকু জানলেই চলবে।' আর আগামীতে, তা না জানলেও চলবে, আপনার ব্যবহৃত যন্ত্র নিজেই জেনে নেবে।
গিলবার্ট গ্রসভেনর বলছেন, 'মানচিত্র হচ্ছে সকল মহাকাব্যের মধ্যে মহত্তম। মানচিত্রের রেখা ও রঙ মহান স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রকাশ করে থাকে।'
একের ভেতর তিন
মানচিত্র একই সাথে তিনটি কালকে ধারণ করে: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। পিটার গ্রিনওয়ে লিখেছেন, মানচিত্র ও মানচিত্র বিদ্যাও আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে রাখে। মানচিত্র আপনাকে বলে দেয়, আপনি কোথায় ছিলেন, এখন কোথায় আছেন এবং আপনি কোথায় যাচ্ছেন- এক অর্থে একের ভেতর তিনটি কাল।
আদিম আরণ্যক যুগে দ্বিপ্রহরে অরণ্যের আলোছায়ায় যে পথ ধরে হিংস্র প্রাণী ভিন্ন ভিন্ন পথে তাদের শিকারযোগ্য প্রাণী পদচিহ্ন রেখে ছুটে বেড়িয়েছে সেই পদরেখা অনুসরণ করেছে তাতেই কি মানচিত্রের প্রথম দাগ অঙ্কিত হয়নি?
দ্য এক্সাটটিটিউড অব সায়েন্স-এ কী কথা বলেছেন হর্হে লুইস বোর্হেস: পশ্চিম মরুভূমিতে এখনো মানচিত্রের ছিন্নভিন্ন অংশের দেখা মিলবে যেখানে বাস করত জন্তু জানোয়ার এবং দীনহীন ভিক্ষুক। সমস্ত ভূমিতে ভূগোল শাস্ত্রের আর কোনো ধ্বংসচিহ্ন মেলেনি।
রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড পাঠ করে যাদের কৈশোরের সূচনা তারা জানেন: যারা মানচিত্রকে পাত্তাই দেবেন না অথচ গুপ্তধন আবিষ্কার করতে যাবেন-এটা মোটেও বিশ্বাস করা যায় না।
মানচিত্রের মোদ্দা কথাটি কি? প্রত্যেকটি জিনিসই একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত, তবে কাছের জিনিসটি দূরেরটির চেয়ে বেশি সম্পর্কিত। এই সম্পর্ক রেখা টানতে টানতেই মানচিত্র সৃষ্টি হয়ে যায়।
মানচিত্র নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তু নিরপেক্ষ নয়, এটি সাবজেক্টিভ বা বিষয়ানুগত। পৃথিবীর সকল মানচিত্র কোনো না কোনো উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সেই উদ্দেশ্যের আলোকসম্মাত ঘটেছে রেখায় ও রঙে, কখনো কাগজে কখনো ক্যানভাসে। আধুনিক প্রযুক্তি বিশেষ করে জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমস), গ্রাফিক সফটওয়ার, ইন্টারনেট, বহুমাত্রিক মুদ্রণ পদ্ধতি মানচিত্রকে অ্যাকিউরেসি বা যথার্থতা যেমন দিয়েছে তেমনি দিয়েছে নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য। মানচিত্র এখন যে যথার্থতা অর্জন করেছে তা ক্লডিয়াস টলেমিকেও বিস্মিত করত।
কোনো সন্দেহ নেই জরিপ ও মানচিত্র তৈরিতে জিআইএস বিপ্লব ঘটিয়েছে, কিন্তু সেই জিআইএস-এর প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয় যারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন তাদের কল্পলোকের সীমাবদ্ধতাই জিআইএস-এর সীমাবদ্ধতা।
মাটির মানচিত্র না আকাশের মানচিত্র
২০০০ বছর আগে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় বসবাসকারী বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ক্লডিয়াস টলেমি। এই বিজ্ঞানী খালি চোখে দেখার যুগের মানুষ। টেলিস্কোপ তখনো দূরের বস্তুকে দেখার সুযোগ করে দেয়নি। খালি চোখেই যতটা সম্ভব দেখে এবং যতটা সম্ভব অংক কষে গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তনে আকাশের ছবি তিনি এঁকেছেন। গ্রিকদের জিওসেন্ট্রিক বা পৃথিবীকেন্দ্রিক মৌল ধারণাকেই তিনি মেনে নিয়ে কেন্দ্রে মানুষ রেখে বিশ্লেষণ করেছেন। পৃথিবীকেন্দ্রিক বা মানবকেন্দ্রিক মৌলধারনাকেই এই লালিত ধারনা গ্যালিলিওর হাতে ভয়ঙ্কর ধাক্কা খায়।
টলেমির আকাশের মানচিত্রে অন্তত আশিটি ছোট বৃত্তাকার কক্ষ চিহ্নিত হয়েছে, সূর্য এবং আর টলেমির সময় পর্যন্ত জ্ঞাত পাঁচটি গ্রহের আবর্তন তাতে দেখানো হয়েছে।
১৫৪৩ সালে সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে হিসেবের প্রস্তাব দেন পোলিশ জ্যোর্তিবিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস, এটাই হেলিওসেন্ট্রিক যা খ্রিস্টিয় ধর্মবিশ্বাসের উপর মারাত্মক আঘাত হানে। একালের বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের বিষয়টি টলেমি বুঝেছিলেন, কিন্তু এটা নিয়ে বিতর্ক তুলতে চাননি বরং জিওসেন্ট্রিক পরিমাপ পদ্ধতিকে হিসেবের জন্য ব্যবহার করেছেন।
টলেমির জিওগ্রাফি গ্রন্থের অষ্টম খন্ডে পূর্ববর্তী খন্ডসমূহে বর্ণিত স্থানসমূহের নাম ও অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংসের ভিত্তিতেই উক্ত স্থানসমূহের মানচিত্র আঁকা হয়েছে। সে কালে মাটির চেয়ে আকাশের দিকেই বেশি নজর ছিল। বিজ্ঞানী দার্শনিক এবং কবিদেরও কেউ কেউ ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
মানচিত্র কথন
১. খ্রিষ্টজন্মের ১১৬০ বছর আগে মিশরে প্যাপিরাসে যে মানচিত্র তৈরি হয়েছে সম্ভবত এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম রোডম্যাপ। এই মানচিত্রে দেখানো হয়েছে মিসর থেকে মানুষ নদীপথে কোথায় কোথায় পৌঁছাতে পারবে।
২. পৃথিবী তো অধিবৃত্তাকার। কিন্তু মানচিত্র সমতল। সুতরাং সম্পূর্ণ যথার্থ মানচিত্র পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। খানিকটা হলেও বিকৃত করতে হয়। আর এ বিকৃতির ধরনটা কেমন হবে তা নির্ভর করে কী উদ্দেশ্যে মানচিত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছে তার ওপর।
৩. ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানীরা কিছুকাল আগে মলিন হয়ে যাওয়া ১৪৯১ সালের একটি মানচিত্র মাল্টিস্প্রেকট্রাল ইমেজ ব্যবহার করে পরীক্ষা করলেন।
মনে করা হয় আমেরিকা যাত্রা করার আগে ক্রিস্টোফার কলম্বাস এই ম্যাপটিই ব্যবহার করেছিলেন। মানচিত্রের একটি স্পট হচ্ছে এখনকার জাপান। কলম্বাস সেদিকে যাত্রা করেই গিয়ে উঠলেন 'নিউ ওয়ার্ল্ড' তাদের অজানা আমেরিকায়।
৪. এল ডোরাডো নামের শহরটি যে ফিকশনাল গল্পকথার তা অনেকেরই জানা নেই, এমনকি ম্যাপ-কারিগরদেরও না। ১৮০৮ সালের একটি মানচিত্রেও এল ডোরাডো দেখানো হয়েছে।
৫. আমরা বইপত্র খবরের কাগজ ইত্যাদির সেন্সরশিপের কথা বলি। কিন্তু মানচিত্রে সেন্সরশিপ ঐতিহাসিকভাবে চলে আসছে আর এ নিয়ে তেমন, কোনো হইচইও নেই। যেমন সামরিক স্থাপনাসমূহ কোথায়, নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট কোথায় এসব মানচিত্রে লুকোনোই থাকে। এমনকি পারমানবিক বর্জ্য কোথায় ফেলা হয় তাও জিওলজিক্যাল সার্ভে ম্যাপ দেখানো হয় না, কারণ তা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
৬. ১৯৭০-এর দশক থেকে আমেরিকার গ্যাস স্টেশন (আমাদের পেট্রোল পাম্প) থেকে ভ্রমনকারীদের বিনামূল্যে মানচিত্র বিতরণ করা শুরু হয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ৮ বিলিয়ন মুফত্ মানচিত্র বিলিয়েছে। পর্যটক সমৃদ্ধ প্রায় সকল দেশই বিনামূল্যে তা দিয়ে থাকে।
৭. এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানচিত্র 'আর্থ প্লাটিনাম'। ৬ ফুট দীর্ঘ ৪ ফুট প্রস্থ, ওজন ৪৪০ পাউন্ড। এর ৩৯টি কপি রয়েছে। একটি কেনার চিন্তা করতে হলে কয়েক লক্ষ ডলার হাতে নিয়ে এগুনো ভালো।
৮. উপমহাদেশ ভারতের জন্য বিশেষ খ্যাতিমান মানচিত্রকার জেমস রেনেল ১৮৯৮ সালে আফ্রিকার মানচিত্রও তৈরি করেন। এই মানচিত্রে পূর্ব থেকে পশ্চিমে টানা একটি দীর্ঘ পার্বত্যভূমি দেখিয়েছে-মাউন্টেনস অব কঙ বড় পর্বতমালা। আসলে এ ধরনের কোনো পর্বতমালার অস্তিত্বই নেই। জেমস রেনেল কোথাও একটা বড় ভুল করে ফেলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী অন্তত ১০০ বছর আফ্রিকার যত মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে তাতে কঙ্ পর্বতমালা দেখানো হয়েছে।
৯. পেপার টাউন হচ্ছে মানচিত্রে দেখানো ভুয়া শহর। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো মানচিত্রে নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে অ্যাগলো নামের শহর দেখানো হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়াতে হোয়াইটওয়াল এবং ফ্লোরিডাতে রেলেসেন্ট। বাস্তবে এই তিনটি শহরের কোনো অস্তিত্বই নেই।
তাহলে মানচিত্র প্রকাশকের এই কৌতুকের কারণ কি?
একটা কারণ স্পষ্ট, তাদের ভাষ্য কপিরাইট আইন লংঘন করা অসৎ ব্যবসায়ীরা এই মানচিত্র ছেপে বিক্রি করে। তারা ভুয়া শহরগুলোও রেখে দেয়। ফলে চোরাই ম্যাপটা ধরা সহজ হয়।
১০. খ্রিষ্টজন্মের ৬০০ বছর আগের ব্যাবিলনে তৈরি বিশ্বমানচিত্র অনেকটাই প্রতীকী। সে সময় পারস্য ও মিশর সম্পর্কে ব্যাবিলনের মানচিত্রকররা যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। কিন্তু তাদের মানচিত্রে এই দুটি স্থানকে গোলাকারবৃত্তে রেখে চারদিকে পানির সীমানা দিয়ে দ্বীপ বানিয়ে রাখা হয়েছে। পারস্যবাসী কিংবা মিশরীয়দের উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে এটা করা হয়নি বরং একালের গবেষকরা মনে করে দুটো স্থানই ব্যাবিলনবাসীর কাছে ধর্মীয়ভাবে বিশেষ সম্মানের। সম্মান জানাতেই এভাবে মানচিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১১. মানচিত্রের 'উত্তর' দুটি। একটি ভৌগলিক উত্তর অন্যটি কম্পাসের উত্তর- ম্যাগনেটিক নর্থ।
বিধিবদ্ধ সতর্কতা: গ্লোব কিন্তু পৃথিবীর মডেল নয়।
আনু রায়হান আল বেরুনি (৯৭৩-১০৪৮) হাজার বছর আগে ত্রিকোনমিতির হিসেব কাজে লাগিয়ে সমতল এবং পর্বতশিখর থেকে মৌলিক মাপ নিয়ে পৃথিবীর ব্যাসার্ধের পরিমাপ দাখিল করেছেন ৬৩৩৯.৬০ কিলোমিটার। এ কালে আধুনিক পরিমাপ যন্ত্র ও m~² হিসেব পদ্ধতি ব্যবহার করে যে ব্যাসার্ধ পাওয়া গেছে তা হচ্ছে ৬৩৫৬.৭৫ কিলোমিটার, আল বেরুনির হিসেবের চেয়ে মাত্র ১৭.১৫ কিলোমিটার কম। ১০৩৭ সালে প্রকাশিত কোডেক্স ম্যাসুডিকাসে আল বেরুনি তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী বিশাল মহাসাগরের সাথে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড রয়েছে, এটিই আসলে আমেরিকা। এই ভূখণ্ডে মানববসতি রয়েছে বলে তিনি তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইউরেশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিমের যে ভূখণ্ডের কথা বলেছেন তা আমেরিকা ও জাপান।
পৃথিবী কেমন?
এই বর্ণনা ভূবিজ্ঞানীরা প্রথম জেনেছেন একজন সাহিত্যিকের কাছে। সেই সাহিত্যিক ইলিয়াড ও অডেসির প্রণেতা হোমার। হোমার কাহিনীকার, বিজ্ঞানী নন, ভূপর্যটক নন, মানচিত্রকার নন। তিনি তার পৃথিবীটাকে যে ভাবে দেখেছেন সেই বর্ণনাই দিয়েছেন। তার বর্ণনায় পৃথিবী হচ্ছে বৃত্তাকার একটি চাকার মতো ভূখণ্ড, চারদিক থেকে যা সমুদ্রবেষ্টিত। পর্বত শিখর থেকে দেখলে কিংবা সমুদ্রের তীর থেকে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করলে এমনই মনে হবার কথা। তার বর্ণনা গ্রিকরা সত্য বলেই গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে মিশর, লিবিয়ান মরুভূমি, এশিয়া মাইনর এতেই সীমিত ছিল, গ্রিসের বাইরের পৃথিবী মানে কৃষ্ণ সাগর নিয়ে কিছু উপকথা; বাস্তবে নিজ দেশের সীমানায় এজিয়ান সাগর। এশিয়া ও ইউরোপের উল্লেখ হোমারের রচনায় নেই। কাছাকাছি সময়েই অন্যান্য রচনায় পৃথিবীটা বড় হতে থাকে। নীল ও দানিয়ুব নদীর দেখা মেলে, বসফরাসের তীর দেখা যায়, সিসিলি দ্বীপও পৃথিবীর সেই চাকতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
খ্রিষ্টজন্মের সাড়ে পাঁচশত বছর আগে অ্যানাক্সিমেন্ডার প্রথম মানচিত্র তৈরি করেন, তবে তার কল্পনার কিংবা বাস্তবের পৃথিবীটা ছিল সিলিন্ডারের মতো মহাশূন্য থেকে ঝুলানো পাথুরে খুটির মতো। তারও প্রায় অর্ধশতক বছর পর হেমাটেয়াস অ্যানাক্সিমেন্ডারের মানচিত্রের পরিবর্তিত একটি সমকালীন সংস্করণ তৈরি করেন। অ্যানাক্সিমেন্ডারের ছাত্র অ্যানাক্সিমেনেন শিমকের পৃথিবীর আকার তত্ত্ব অস্বীকার করলেন, তিনি মনে করলেন আসলে পৃথিবী হচ্ছে চর্তুভূজের মতো।
সঠিক মানচিত্র পাবার আগে পৃথিবীটা কেমন সেটা জানাই বেশি জরুরি। মানুষের ভূগোল ও মানচিত্র জ্ঞান প্রবল ধাক্কা দিলেন বহু অঞ্চল ঘুরে আসা মনিষী হেরোডোটাস। তিনি পৃথিবীর যে চিত্র উপস্থাপন করলেন তাতে বৃত্তাকার চাকতি প্রত্যাখ্যাত হলো। তার পৃথিবী অনিয়মিত আবৃত্তির একেক জায়গায় একে রকম তবে সমুদ্রের বেস্টন সর্বত্র। তার পৃথিবী তিন ভাগে বিভক্ত - ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা। তিনি আটলান্টিক এবং ইরিত্রিয়ান সাগরের কথা বললেন। দ্বিতীয়টি লৌহিত সাগর। নীল নদ এশিয়া ও আফ্রিকায় বিভাজক। তিনি ইউরোপের সীমানাও নির্দেশ করেন।
তারপর অনেক পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী হয়ে টলেমির আমলে পৃথিবীর একটি অনেকটাই বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় (যদিও পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণের বিষয়টি ছিল পুরোপুরি অনাআলোচিত)। আধুনিক ভূগোল ও মানচিত্র নির্মাণের তিনিই জনক। খ্রিস্ট জন্মের দু'শ বছর আগে থেকে ভৌগলিক জ্ঞানে চীনও এগোতে থাকে। চীনের বিজ্ঞানী পি জিয়াওনকে তাদের টলেমি বলা হয়। ভূগোল জ্ঞান জরিপ ও মানচিত্র প্রণয়ন বিদ্যার প্রকৃত বিকাশ ঘটে মধ্যযুগের মুসলিম শাসনে। আল বেরুনী তার গাণিতিক মেধা দিয়ে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ কত জানিয়ে দেন। ১১৫৪ সালে মুহম্মদ আল ইদরিস উপহার দেন বিশ্ব মানচিত্র। অটোমান রাজত্ব পিরিরিসি ১৫১৩ সাল সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য নেভিগেশনাল মানচিত্র প্রস্তুত করেন। তারপর জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মুদ্রণ ব্যবস্থা মানচিত্রে নতুন যুগের সূচনা করে।
ভূউপগ্রহ পৃথিবীর বাস্তব চিত্র পাঠাতে শুরু করে। একালের আধুনিক মানুষের হাতের মুঠোয় গুগল আর্থ খুঁটি নাটিসহ বিশ্ব মানচিত্র। এ এক ভিন্ন অধ্যায়।
কতোটুকু ওজন গুগল বিশ্বমানচিত্রের?
এতটুকুও না, শুধু স্মার্ট ফোন থাকলেই যথেষ্ট। আর মানচিত্র এখন বিনে পয়সায় সম্ভবত পাওয়ার দিন ফুরিয়ে আসছে।
***
'মানচিত্র মানুষকে বলে আমি করতলে তোমার পৃথিবী। বেরিল মার্কহ্যাম। আলবার্ট আইনস্টাইন জ্ঞানের নবায়ন ও মানচিত্রের নবায়নকে সমার্থক করে তুলেছেন: নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করতে হলে পুরোনো মানচিত্র ব্যবহার করলে চলবে না।
কথা সাহিত্যিক হোসে সারামাগো মানচিত্রের শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন: মানচিত্র দেখিয়ে দেয় সীমিত পরিসরে কী করা সম্ভব। এখানে কী ঘটবে তারা আগাম জেনে যায়।
নিকোলাস কেইন বলেন অস্তিত্বের রহস্যসূত্র মানচিত্রের নিজস্ব ভাষায় লিখিত থাকে।
কলেরার মানচিত্র
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে কলেরা মহামারি ব্যাপক আকার ধারন করে এবং মৃত্যুর মিছিল সামলানোর সমস্যা দেখা দেয়। সে সময় জন স্নো নামের উৎসাহী ব্যক্তি কলেরা প্রকোপ অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করেন। আর তা অনুসরণ করতে গিয়ে দেখেন একটি দূষিত সরকারি পানির পাম্প থেকে কলেরার জীবাণু ছড়াচ্ছে। এই আবিষ্কার লন্ডনে কলেরা মহামারী দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং পৃথিবীর জন্যও একটি দিক নিদের্শনা দিয়ে যায়।
কোভিড ম্যাপ ১১ মার্চ ২০২১
করোনা ভাইরাস আক্রান্ত পৃথিবীর মানচিত্র
২০২০ থেকে আতঙ্কিত মানুষ যে মানচিত্র দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে কোভিড ম্যাপ। এই ভাইরাস পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর অহংকারের এবং নাগরিকদের সুরক্ষার মানচিত্রও বদলে দিয়েছে।