মিহির বোসের বাড়ি ফেরা
মাটির দেয়ালের নিচু একতলা দুটি ঘর, পাশাপাশি। মাথার ওপর ছন। সামনে উঠোন। বড় গাছের শরীর বেয়ে উঠে গেছে শিমের লতা। সুপারি গাছের জীর্ণ সাঁকো পেরিয়ে মিহির বোস যখন এসে দাঁড়ান পূর্ব পুরুষের এই মাটিতে, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন অশীতিপর এক বৃদ্ধ। একা হাঁটতে পারেন না। দুজন তাকে ধরে বাইরে বের করে আনেন। মাঝবয়সী নারী মালতী রানী বোস এসে বলেন, 'আহারে আমার কী কপাল, আপনে আইছেন এই গরিবের বাড়িতে'!
এই আত্মীয়রা দূরসম্পর্কের। তারপরও এদের দেখে মিহির বোসের চোখ দুটি কেমন যেন লাল হয়ে ওঠে, যা তার পুরু চশমাও আড়াল করতে পারে না। ৬৭ বছর বয়সে জীবনে প্রথমবার বাপদাদার ভিটেতে এসে তার যে আবেগ, যে অনুভূতি, তা অন্য কারোর পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন। আগের রাতে ঢাকা থেকে বরিশালে আসার পথে লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে মিহির বোস বলেছিলেন, 'ইটস মাই ইমোশনাল জার্নি' (এটা আমার আবেগী যাত্রা)।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার গুয়াচিত্রা বাজার থেকে বাম দিকে চলে গেছে যে ভাঙাচোরা সরু রাস্তা, সেটি ধরে চার কিলোমিটার এগোলেই রামচন্দ্রপুর গ্রাম। বোস বাড়ি। এখানে এই নামে দুটি বাড়ি আছে। এর একটি মিহির বোসের পূর্ব পুরুষের, যার সন্ধানে তিনি ছুটে এসেছেন সুদূর লন্ডন থেকে।
বিবিসির সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক ও লেখক মিহির বোসের জন্ম কলকাতায়, ১২ জানুয়ারি ১৯৪৭ সালে। তার বাবা, দাদা এবং তারও পূর্বপুরুষেরা ছিলেন এই গ্রামে। ১৯৩০ সালের পরে মিহির বোসের বাবা কিরন চন্দ্র বোস এই গ্রাম ছেড়ে যান এবং এরপরে আর কখনো ফেরেননি। মিহিরের দাদাঠাকুর ক্ষেত্রমোহন বোস আর দাদী উত্তমা সুন্দরী বোস—এদের কথা এখন আর এই প্রজন্মের কারো মনে থাকবার কথা নয়। তবে ঝালকাঠি জেলার সীমান্তঘেঁসা এই প্রত্যন্ত গ্রাম রামচন্দ্রপুরের বোস বাড়ির জায়গা-জমির কাগজপত্রে ক্ষেত্রমোহনের নাম আছে; এমনটাই জানালেন স্থানীয় শাহ মাহমুদিয়া কলেজের শিক্ষক জামাল আহমেদ।
কলকাতায় জন্ম হলেও মিহির বেড়ে ওঠেন মুম্বাই শহরে। পড়াশোনা করেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে। কিন্তু পরে ক্যারিয়ার গড়েন সাংবাদিকতায়। স্থায়ী হন লন্ডনে। এলবিসি রেডিওর সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু। এরপর যোগ দেন সানডে টাইমসে। শুরুতে ছিলেন বিজসেন রিপোর্টার। পরে হয়ে যান পুরোদস্তুর ক্রীড়া সাংবাদিক। ১৯৯৫ সালে মিহির যোগ দেন ডেইলি টেলিগ্রাফে। এরপর ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায় শুরু করেন বিবিসির স্পোর্টস এডিটর হিসেবে।
তবে বিবিসির ক্রীড়া বিভাগ যখন লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টার শহরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, মিহির তখন ওই শহরে যেতে রাজি হননি। ফলে পদত্যাগ করেন। এটা ২০০৯ সালের ঘটনা। ক্রীড়া ভাষ্যকার ও লেখক হিসেবে খ্যাতিমান মিহির বোস এ যাবত সুভাষ বসুর জীবনীসহ লিখেছেন ২৭টি বই, যার অধিকাংশই ক্রীড়া বিষয়ক। সাংবাদিকতায় পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
জীবনের প্রায় শেষ সময়ে হঠাৎ করেই তার জানতে সাধ হয়, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখতে কেমন। কতটা উন্নত অথবা পশ্চাৎপদ সেই জনপদ যেখানে তার বাবা দাদারা জন্মেছেন; বেড়ে উঠেছেন। তাছাড়া একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে এই জনপদের ওপর দিয়ে যে পাকিস্তানি হানাদারদের স্টিম রোলার চলেছে, সেই কথা মিহির জেনেছেন নানা বইপত্রে। পূর্বপুরুষের ভিটায় আসতে চাওয়ার এটিও একটি কারণ।
২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর মিহির বোস ঢাকায় আসেন। সঙ্গে স্ত্রী ক্যারোলিন। গণমাধ্যমের খবর দেখে ক্যারোলিনের ধারণা হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রায়ই লঞ্চ ডুবে শত শত মানুষ মারা যায়। এ কারণে লন্ডন থেকে তারা বরিশালে যাবার ব্যাপারে যখনই ফোন করতেন, বারবার জিজ্ঞেস করতেন, বরিশালে বিমানে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না? তাদের এই বলে আশ্বস্ত করতে হত যে, ঢাকা-বরিশাল রুটে যেসব লঞ্চ ও স্টিমার চলে, সেগুলো খুবই নিরাপদ এবং হেমন্তকালে এত বড় লঞ্চ ডুবে যাওয়ার আশংকা নেই। তাছাড়া এই ভ্রমণ খুবই আরামদায়ক।
ক্যারোলিনেরে আরেকটা ভয় ছিল বাংলাদেশে নারীদের অবাধ চলাফেরা নিয়ে। তাকে বলা হয়েছিল এবং নানা সূত্রে তিনি একটু আধটু যা পড়েছেন, তাতে তার মনে হয়েছিল যে, বাংলাদেশ অত্যন্ত কট্টরপন্থী মুসলিম দেশ। এখানে মেয়েদের বোরকা ও হিজাব পরে বের হতে হয়। ক্যারোলিন বললেন, 'এই দ্যাখো, আমি সব ফুল স্লিভ জামা কাপড় নিয়ে এসেছি।' এ কথা শুনে লঞ্চের ভেতরে হাসির রোল পড়ে যায়।
২৭ নভেম্বর খুব ভোরে লঞ্চ ভেড়ে বরিশাল টার্মিনালে। রাস্তায় তখনও ওই অর্থে যানবাহন চলাচল শুরু হয়নি। চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস। সুনসান নিরবতা। লঞ্চ ঘাট থেকে বরিশাল ক্লাবের দূরত্ব হাঁটা পথ। আমরা রিকশা নিয়ে সেখানে যাই। রাস্তার দু পাশে পুরনো দিনের বাড়িঘর, বিশাল বৃক্ষরাজি। সব মিলিয়ে বরিশাল শহরের এই ক্লাব রোডটি অনন্য।
বরিশাল ক্লাবের গেস্ট হাউজে ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম। তারপর সকালের নাশতা সেরে সাড়ে নয়টার দিকে যাত্রা মিহির বোসের পূর্বপুরুষের ভিটা রামচন্দ্রপুরের দিকে। গড়িয়ারপাড় থেকে গাড়ি বামে মোড় নেয়ার পর সরু রাস্তা, কিন্তু ভালো। দুপাশে বাংলার চিরায়ত সবুজ। সোনালি ধানের ক্ষেত। সবজির বাগান। দুয়েকটা স্কুল। খানিক বাদে ছোট ছোট বাজার। সেখানে হাতে গোনা কিছু দোকান। খোলা মাঠ। খাল। কখনো ইঞ্চিন চালিত ভ্যান অথবা টমটম হুস করে চলে যায় পাশ দিয়ে।
রামচন্দ্রপুর গ্রামের কাঁচাপাকা রাস্তায় ঢুকতেই মিহিরের চোখ আটকে যায় ফসলের ক্ষেতে। একজন কৃষক একটি গরু ও ঘোড়া দিয়ে হালচাষ করছিলেন। মিহিরের কাছে এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। তিনি গাড়ি থেকে নেমে ছবি তুললেন। বললেন, 'আই নেভার সিন ইট'। জানা গেলো, ওই কৃষকের নাম আনসার। বললেন, এখানে আরও অনেকেই গরু ও ঘোড়া দিয়ে হালচাষ করেন।
মাঠ ছাড়িয়ে একটু পশ্চিমে গেলে হাতের বাঁয়ে চোখ পড়ে সুপারি গাছের জরাজীর্ণ সাঁকো। স্থানীয়রা বললেন, সাঁকোর ওইপাড়ে যে দুটি ঘর, সেটিই বোসদের বাড়ি। মিহির ও তার স্ত্রী ক্যারোলিন সাবধানে সাঁকো পার হন। বিলাতি মেম কিছুটা ভয় পান। বললেন, 'ইটস এক্সাইটিং'।
শাহ মাহমুদিয়া কলেজে যখন মিহির ও তার স্ত্রী এসে পৌঁছান, তখনই এই বাড়িতে খবর আসে, লন্ডন থেকে এক ভদ্রলোক এসেছেন যিনি এই বাড়িরই উত্তরপুরুষ। তবে এমন আগমনে বাড়িতে যে আনন্দ আর হৈ হুল্লোড় পড়ে যাবার কথা, তা হয়নি। কারণ বাড়িতে থাকেন হাতে গোনা কয়েজন, যাদের অধিকাংশই বয়স্ক মানুষ। আর আর্থিক অবস্থা যা, তাতে বিদেশি অতিথিদের আতিথেয়তা করানোটাও বিলাসিতা। সুতরাং, মিহির ও তার স্ত্রী যখন বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ান, তখন উঠোনে বসেছিলেন বিমান সরকার, এই বাড়ির আরেক কর্ত্রী শংকরিনী বোস; তারা মিহির বোসেরই আত্মীয়স্বজন। এক কিশোর তরতর করে উঠে যায় নারকেল গাছে। চারটি ডাব পেড়ে আনে। ঘ্যাচ করে কেটে কাঁচের গেলাসে ঢেলে ডাবের বিশুদ্ধ পানিতে আতিথেয়তার প্রাণান্ত চেষ্টা। মিহির কথা বলেন পূর্বপুরুষের স্মৃতিময় আঙিনায় দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গে।
বেশ কিছু সময় তিনি বাড়িটা ঘুরে দেখেন। কী যেন খোঁজার চেষ্টা করেন। জিজ্ঞেস করি, কিছু খুঁজছেন? বলেন, 'নাথিং'….। তারপর মিহির বিদায় নিতে চান। শংকরিনী বোস বললেন, 'দুফরাইয়া বেলা দুগ্গা ভাত খাইয়া গেলে খুব খুশি অইতাম'। মিহির বললেন, বরিশাল শহরে যাবেন। আরও কিছু কাজ আছে। আর মালতি রানীর কথা,'আমনেরা আইছেন, এয়া মোগো সৌভাগ্য। আবার আইবেন।' ক্যারোলিনের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, 'আহারে মেম সাইবেরে কিছু খাওয়াইতে পারলাম না।'
না খাওয়াতে পারার এই আকুতি নিয়ে সুপারি গাছের জীর্ণ সাঁকো পয্ন্ত এগিয়ে দিয়ে যান মালতী ও শংকরিনী। কিছুটা এগিয়ে আসেন বিমান সরকার। যে ছেলেটা গাছ থেকে ডাব পেড়ে এনেছিল, লুঙ্গির কাছা খুলে সেও হেঁটে আসে জীর্ণ সাঁকো অবধি। মিহির ও ক্যারোলিন উঠে পড়েন সাদা গাড়িতে। ইটবিছানো ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে গাড়ি পুবদিকে রওনা হলে হাতের বাঁয়ে ছো্ট্ট খালের পাড়ের জমিতে দেখা যায় কৃষক আনসার মিয়া একটি ঘোড়া ও একটি গরু দিয়ে হালচাষ করছেন। গাড়ির শব্দের সঙ্গে ক্রমেই দূরবর্তী হতে থাকে সুপারি গাছের জীর্ণ সাঁকো, ফসলের মাঠ এবং মিহিরের পূর্ব পুরুষের বোস বাড়ি।