সায়েন্স ফিকশনের উহান ও অন্যসব ভাইরাস
উহান
বেলজিয়ামে জন্ম আমেরিকাতে অভিবাসী হুগো গার্নজব্যাক এইচ জি ওয়েলস কিংবা জুলে ভার্ন মাপের লেখক নন। তবুও ফাদার্স অব সায়েন্স ফিকশন সনাক্ত করার সময় দুজনের সাথে তার নামটিও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কারণ সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ধারা যে সায়েন্স ফিকশন ১৯২০-এর দশকে তিনিই তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। 'সায়েন্স ফিকশন' এই কথা এবং এই ধারাটিকে কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর ম্যাগাজিন বের করে রেডিও-তে প্রচার করে এবং লিখে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছিলেন রেডিও ইলেকট্রিক বিজ্ঞানী লেখক, সম্পাদক প্রকাশক উদ্যেক্তা। তিনিই বলেছেন সায়েন্স ফিকশন লেখককে পচাত্তর ভাগই লেখক হতে হবে আর পঁচিশ ভাগ বৈজ্ঞানিকের মন ধারণ করতে হবে। সায়েন্স ফিকশনে বহুবিধ বিষয় কল্পলোকে ধরা দেয়। তবে এ করোনাকালে কেবলমাত্র ঘাতক ব্যাধি ও ঘাতক ভাইরাস নিয়ে যে সব কল্পকথা লিখিত হয়েছে তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হবে।
মারিও বেলাটিনের ফিকশনের ভাইরাস নারীদেহে নিষ্ক্রিয়, কিন্তু এ ভাইরাস যে বৈশ্বিক মহামারী সৃষ্টি করছে, তাতে পৃথিবীর সব পুরুষ বিলুপ্ত। তার বিউটি স্যালন হচ্ছে হসপিস-এখান থেকে ফেরায় পথ নেই, সামনে একমাত্র মৃত্যুর পথই খোলা।
মার্গারেট অ্যাটউড সুপ্রজন কৌশলের ভয়াবতা তুলে ধরেছেন, যেখানে প্লেগ হরণ করে নিয়েছে মানবগোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য। এমিলি সেইন্ট জন ম্যান্ডেলের উপন্যাসে ফ্লুতে পৃথিবী প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে, প্রতি একশত জনে বেঁচে থাকে কেবল একজন মানুষ। লরা ভ্যান ডেনবার্গের লেখাতে মহামারী আক্রান্ত সব রোগীর স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, যা ফিরিয়ে আনা মূল রোগ সারানোর চেয়ে আরো কঠিন হয়ে পড়ে। পেঙ্গ শেফার্ডের কাহিনীতে মহামারী আক্রান্ত রোগীরা আবিষ্কার করে তাদের কারো ছায়া পড়ে না, আলোয় যেদিকেই যাক, তারা ছায়াহীন মানুষ।
বিশ্বব্যাধির সময় কোয়ারেন্টাইনের বিধান বহু পুরনো।
কাগজ, কলম ও কল্পনা নিয়ে যখন কোয়ারেন্টিনে:
পৃথিবীর আর সব সংবেদনশীল মানুষের মতো ২০০৬-এর নোবেলজয়ী ওরহান পামুকও এখন কোয়ারেন্টিনে। সবকিছুই যেখানে বন্ধ সৃজনশীলতা দরজায় কিন্তু কেউ তালা লাগায়নি। ৯ এপ্রিল প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'আমার আশাপ্রদ বিশ্বাস যখন হাতে কলম ও কাগজ এবং কল্পনা করার মতো সময় থাকে, তাহলে বরাবরই একটি সৃজনশীল সমাধানে পৌঁছা যায়।'
ডিন কুনজের উহান ভাইরাস
ডিন কুনজের বইটির নাম 'দি আইজ অব ডার্কনেস' অন্ধকারের চোখ। প্রকাশিত হলেই তখন তার বই নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার্স লিস্টে চলে যায়। কারণ তিনি তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ঘরানার ঔপন্যাসিক নন, তার লেখায় একসঙ্গে অনেক ধরনের স্বাদ মেলে: হরর, ফ্যান্টাসি, সায়েন্স ফিকশন, মিস্ট্রি, স্যাটায়ার—আর ঠাস বুনটের একটি গল্প তো থাকবেই। বইটি প্রকাশিত হলো ১৯৮১ সালে। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, অনেক সংস্করণ হয়েছে। প্রায় চার দশক পর বইটির আবার পুনরুজ্জীবন ঘটল। ঘটাল একালের প্যানডেমিক করোনাভাইরাস। বলা হলো, ৩৯ বছর আগেই ডিন কুনজ সঠিকভাবেই এ মারাত্মক প্রাণঘাতী ভাইরাসের উদ্ভব ও ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তার বইয়ের একটি পৃষ্ঠার ছবি একালের ভাষায় 'ভাইরাল' হয়ে গেল। প্রশ্ন উঠল, একজন লেখক যদি এত বছর আগে করোনাভাইরাস নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে যেতে পারেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও ব্যবস্থাপকরা এতদিন কি করেছেন?
দি আইস অব ডার্কনেস-এ উদ্ভাবিত ঘাতক ভাইরাসটির নাম উহান ৪০০। উপন্যাসের একটি চরিত্র ডনবি একজন চীন দেশীয় বৈজ্ঞানিকের কথা বলছেন, যিনি উহান ৪০০ নামের ভাইরাস আমেরিকায় এনেছেন, এটি ঘাতক বায়োলজিক্যাল উইপন। ডনবি বললেন, এটা বোঝার জন্য কুড়ি মাস পেছনে যেতে হবে। সে সময় লি চেন নামের একজন চীনা বিজ্ঞানী চীনের এক দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ংকর নতুন এক বায়োলজিক্যাল উইপন ডিস্কেট রেকর্ডে করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসেছে। তারা এটাকে বলছে উহান ৪০০। কারণ ওহান শহরের বাইরে তাদের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে এটা তৈরি করা হয়েছে, সেই গবেষণাকেন্দ্রে মানুষের তৈরি মাইক্রোঅর্গানিজমের তালিকার এটি ৪০০তম।
আরডিএনএ: রিকম্বিন্যান্ট ডি-অক্সিরিবোনিউক্লিক অ্যাসিড (সুপ্রজন বিদ্যায় রিকম্বিনেশন, যেমন মলিকিউলার ক্লোনিং)। সাউথ চায়না মর্নিং, পোস্ট প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দি আইস অব ডার্কনেস-এর ১৯৮১ মূল সংস্করণে এ ঘাতকের নাম রাখা হয়েছিল গোর্কি ৪০০, রাশিয়ার গোর্কি অঞ্চলের নামে। বিশ্বরাজনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তনের কারণে ১৯৮৯-এর সংস্করণ থেকে এর নাম বদলে উহান ৪০০ রাখা হয়েছে।
ফিকশনের উহান-৪০০ ল্যাবরেটরিজাত, কিন্তু করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ তা নয়, ২০১৯-এর ডিসেম্বরে চীনের উহানেই এর উদ্ভব ও বিস্তার। কল্পিত উহান-৪০০-এ আক্রান্তের মৃত্যু ১০০ ভাগ নিশ্চিত। করোনায় মৃত্যুহার অনেক কম তিন-চার শতাংশের বেশি নয়। উহান-৪০০-তে নিশ্চিত মৃত্যু সংক্রমিত হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী বা বস্তুর পক্ষে উহান-৪০০ লালন ও পরিবহন সম্ভব হবে না।
উহান-৪০০-এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড ৪ ঘণ্টা এবং করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে চার-পাঁচদিন থেকে দুই সপ্তাহ।
ডিন কুনজের উপন্যাসে উহান-৪০০ মস্তিষ্কে আক্রমণ করে। অ্যাসিড যেভাবে জালি কাপড়কে গলিয়ে দেয় উহান-৪০০-এ তেমনিভাবে মস্তিষ্কক খেয়ে ফেলে। করোনাভাইরাসের প্রাথমিক আক্রমণের লক্ষ্য শ্বসনযন্ত্র। উহান-৪০০ মস্তিষ্ককে দ্রুত অকেজো করে দেয়ায় শরীরের সব স্বয়ংক্রিয় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলো হচ্ছে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট।
যেহেতু ফিকশনাল ভাইরাস, তা মোকাবেলা করতে লেখকের তেমন তাড়া ছিল না, দায়ও না।
প্লেগ অব ইনসমনিয়া:
লক্ষণগুলো হচ্ছে চোখ যথেষ্ট খোলা, বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে, ঘুমোনো পুরোপুরি অসম্ভব। ঘুমোনোর এই প্লেগটা এসেছে কলম্বিয়া থেকে। বুয়েন্দিয়ার বাড়িতে এবং মাকোন্দো শহরে এই রোগটি এনেছে আরকাদিয়ো বুয়েন্দিয়ার পালিত কন্যা রেবেকা। লোকজন যে ঘুমিয়ে আছে তাতে সমস্যা হচ্ছে না, তাদের ক্লান্তি নেই, দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সময় কিছুটা পার হতেই দেখা গেল যারা সংক্রমিত তাদের স্মৃতিশক্তি এবং পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান লোপ পেয়েছে, শেষ পর্যন্ত তারা তাদের নাম পরিচিতি সব ভুলে যায়। এই প্লেগটির বর্ণনা পাওয়া যাবে একালের পৃথিবীর বহুল পঠিত উপন্যাস গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড-এ। মার্কেস তার সহজাত ম্যাজিক বিয়েলিজম সৃষ্টি করতে অনাথ বালিকা রেবেকার মাধ্যমে প্লেগটি আনিয়েছেন। তার বর্ণিত রোগের লক্ষণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্য যে সব রোগের সাথে কম বেশি মিলে যায় তার মধ্যে রয়েছে, ইনফেকশাস এনকেফালাইটিস, এনকেফালাইটিস ল্যাথার্জিকা, ভ্যারিয়েন্ট ক্রুজফেল্ট জ্যাকবস ডিজিস, নিউরো সিস্টিসারকোসি, সেমান্টিক ডিমেনশিয়া ইত্যাদি। এতে অ্যালঝেইমার রোগের কিছু লক্ষণও আছে। তবে মার্কেসের এই অদৃষ্টপূর্ব ইনসমনিয়া প্লেগের সাথে পৃথিবীর কোনো রোগেকেই পুরোপুরি মেলানো সম্ভব নয়।
হেরোড'স ফ্লু:
১৯৯৯ সালের আলোড়ন তোলা সায়েন্স ফিকশন ডারইউন'স রেডিও-এর একটি গুরুত্ব পূর্ণ ট্যাগলাইন হচ্ছে পরবর্তী মহাযুদ্ধে হবে মানুষের নিজের ভেতরে। গ্রেগরি বেয়ারের উপন্যাসে বিজ্ঞানের বিষয় এতো বিশদ ভাবে বর্ণনা করা হয় যে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা এবং কিছু পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলে তার কাহিনীর রস পুরোটা আস্বাদন করা সম্ভব নয়। এ জন্যই তার ফিকশনগুলো হার্ড সায়েন্স ফিকশন হিসেবে পরিচিত। ডারউইন'স রেডিও এবং ডারউইন'স চিলড্রেন দুটো গ্রন্থেই ম্যালথাসের জনসংখ্যাধিক্যের সমস্যার নিয়ে আলোকপাত করেছেন।
গ্রেগ বেয়ার লেখালেখির পাশাপাশি একজন খ্যাতিমান শিল্পী। ডারউইন'স রেডিও-তে হেরোড'স ফ্লু নামের মারাত্মক বিধবংসী রোগটি ছোঁয়াচে এবং তা যৌন সংসর্গের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। হার্ভ (হিউম্যান ই হিন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস) থেকে সৃষ্ট এই রোগ নারী দেহেই কেবল ছড়িয়ে থাকে এবং গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটিয়ে দেয়। শুরুতে লক্ষণটা ফ্লুর। অতি ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস মানুষের জীবন বৃক্ষ বিপন্ন করে দেয়।
এই রোগের জন্ম ও বিস্তারের প্রক্রিয়াটির নাম 'স্ক্যাটার্ভ হিউম্যান এনডোজেনাস রেট্রোভাইরাস অ্যাক্টিভেশন', যা মানব জাতি নির্মূল করে দেবার ক্ষমতা রাখে। হেরোড'স ফ্লু সংক্রমণ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কে নিথর হয়ে পড়ে পুরো পৃথিবী।
দ্য পালস:
স্টিফেন কিং-এর সেল হরর সায়েন্স ফিকশনের অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটি ভাইরাসের নাম পালস। এটা মোবাইল ফোনের ভেতর নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। কিন্তু ক্ষমতাশালী সঠিক সিগন্যাল পেলেই তা অবমুক্ত হয়ে যায়। কারা এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস ছেড়েছে তা অজ্ঞাত তবে নিঃসন্দেহে কোনো একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। নাইন ইলাভেনের পরপরই তা ছাড়া হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং তখন থেকে তা নিষ্ক্রিয় অবস্থায়ই রয়েছে। সঠিক সিগন্যাল পেলেই তা ইনকামিং কলারের হ্যালোর সাথে সাথে তার মস্তিকের কোষগুলোকে বিচ্ছিন্ন ও এলোমেলো করে ফেলবে এবং তখন সে কে বন্ধু আর কে শ্রত্রু তা সনাক্ত করতে পারবে না। তারা পালস ভাইরাস আক্রান্ত অন্যদের সনাক্ত করতে পারবে না। সংক্রমিত কলারগণ ভয়ঙ্কর মানসিক রোগী হয়ে উঠবে। এবং পরস্পরকে হত্যা করতে ছুটবো। পৃথিবীতে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই নৈরাজ্য চলবে দু'দিন, তারপর ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়লে ধীরে ধীরে স্থিতবস্থা ফিরে আসবে।
ক্যাপ্টেইন ট্রিপস:
ক্যাপ্টেইন ট্রিপস সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেইন কিংবা উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেইন নয়- স্টিফেন কিং-এর দ্য স্ট্যান্ড উপন্যাসের একটি ফ্লু ভাইরাস।
স্টিফেন কিং-এর পাঠকদের দাবি কোভিড ১৯-এর নভেল কারোনা ভাইরাস পৃথিবীকে সংক্রমিত করার ১৬ বছর আগে তিনি এই রোগের যথাযথ বর্ণনা দিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। তার উপন্যাসের ভাইরাস আর করোনাভাইরাসের মধ্যে দারুন মিল, সংক্রমনের মাধ্যম মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। তার বইয়ের শুরুতেই এই ভাইরাস পৃথিবীর ৩.৩ ভাগ মানুষের জীবন হরণ করেছে। কাহিনির শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ৯৯.৪ ভাগ মানুষকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলে এ ভাইরাস।
শুরুটা সাধারণ ঠান্ডার মতই, তারপর নাক বন্ধ, হাঁচি ইত্যাদি। অধিকাংশ মানুষই মনে করেছে ঠান্ডা কাশির চেয়ে বেশি তো নয়! ক্যাপ্টেইন ট্রিপস সংক্রমিত হবার পর জ্বর বাড়তে থাকে, প্রচন্ড মাথাব্যথা হয়। শরীরে যন্ত্রণা হয়, শরীর কুচকে যায়। কোথাও কোথাও ফুলে যায় আর বিভ্রম চলতে থাকে। তারা ঘোরের মধ্যে থাকে, তারা সময় ও পরিসরের কাছে অচেনা হয়ে যায়। যখন মৃত্যু ঘনিয়ে আসে অল্পসময়ের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ক্যাপ্টেইন ট্রিপস ভাইরাস সংক্রমিতদের শতভাগের মৃত্যু নিশ্চিত।
সম্ববত জেনেটিক কোনো কারণে ০.৬ ভাগ মানুষ ক্যাপ্টেইন ট্রিপসকে এড়াতে সমর্থ হয়। এই ভাইরাসের কোনো টীকা আকিষ্কৃত হয়নি। ভাইরাস সংক্রমনের এক মাসের মধ্যে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সামরিক বাহিনী এই ঘাতক ভাইরাসটি তৈরি করেছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনুযায়ী এটাও ল্যাবরেটরিতে তৈরি। তবে তা ক্যাপ্টেইন ট্রিপ এর মতো এতো বিধ্বংসী নয়, গত এগার মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৬ কোটি মানুষ, তার মৃত্যুবরণ করেছে ১৫ লক্ষ। করোনা মৃত্যুর মিছিলে বাংলাদেশও আছে।
ইনফার্নো:
পৃথিবীর সীমিত সম্পদে সকলকে নিয়ে মোটামুটি ভালো জীবনযাপন করতে হলে লোকসংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ৪ বিলিয়নে আনতে হবে। কিন্তু কেমন করে? ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন আফ্রিকাতে বিনে পয়সায় কনডম দিচ্ছে, কিন্তু কনডম সেখানকার সন্তান উৎপাদনক্ষম মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে না, আবর্জনার স্তুপে, মাটি ভরাট করার জঞ্জালের উপর পড়ে আছে সহস্র অব্যবহৃত কনডম। এমন সময় দ্য প্রিন্স গ্রন্থখ্যাত ম্যাকিয়াভেলি এসে হাজির হয়ে বললেন, প্লেগই এর সমাধান (তারই বিখ্যাত কথা: রাজাকে সিংহের মতো সাহসীও শেয়ালের মতো ধূর্ত হতে হবে), ২০১৩ সালে ড্যান ব্রাউন দান্তের দ্য ডিভাইন কমেডি-র প্রথম অধ্যায় ইনফার্নো থেকে ধার করে দান্তের ফ্লোরেন্স শহরে জেনেটিক সায়েন্টিস্ট বার্ট্রান্ড জোবরিস্ট ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানকে সমাধান খোঁজার জন্য বসিয়ে দিলেন। জোবরিস্টেও হাতেই তৈরি হলো জলবাহিত ভাইরাস ইনফার্নো। পানির সংস্পর্শে তার অন্ডস্ফোটন বা ইনকিউবেশন হয়। তার আগে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় চতুর্দশ শতকের ভয়াবহ প্লেগের কথা। এই ভাইরাস দ্রুত বর্ধাশীল ও দ্রুত প্রজননক্ষম। বায়ুবাহিত ভাইরাস যখন অবমুক্ত হলে এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং এনে দেবে কাঙ্খিত সমাধান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি রক্ষা পাবে মানুষ?
লেটুমোসিস:
মারিসা মেয়ারের দ্য লুনার ক্রনিকলস-এর রোগটি পৃথিবীতে সৃষ্ট নয়। সৃষ্টি হয়েছে মহাকাশের ভিন্ন আবাসন লুনাতে। কিন্তু যারা সেখানকার অধিবাসী অর্থৎ লুনার, তাদের অল্প ক'জন কেবল আক্রান্ত হয়েছে। সেখানকার কিছু মানুষ অবৈধভাবে পৃথিবীতে অভিবাসী হয়েছে। তাদেরই কেউ এই রোগ পৃথিবীতে সংক্রমিত করেছে। ১১৪ সালের মে মাসে প্রথম রোগটি ধরা পড়ে। রোগটির চারটি পর্ব, প্রথম পর্বে ইনকিউবেশন, বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না; দ্বিতীয় পর্বে শরীর দৃশ্যমান ফোড়া, ত্বক লালচে নীল, তৃতীয় পর্বে রোগী মাথা তুলতে পারে না কথা বলতে কষ্ট হয়, চতুর্থ পর্ব মাত্র একদিনের সেদিনই মৃত্যু।
কোনেবোগেট ভাইরাস:
১৮ মাস আগেও কেউ এই ভাইরাসের নাম শোনেনি অথচ এখন তা সবার মুখে মুখে। এখনও অনেক ভাইরাস মানুষের উপর চড়াও হবার অপেক্ষায় আছে। যুক্তরাজ্যে এই ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা একশত ছুঁয়েছে। একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কেনোবোগেট ভাইরাস সহজে যাবার নয়। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রন করা হবে। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস থেকে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে, তাতে লিখা, আপনারা আচরণ বদলান।
ডেরেক জেস এনজেস-এর সায়েন্স ফিকশনটির নাম দ্য নেক্সট বিগ ওয়ান। কোনেবোগেট উজবেকিস্তানের কারাকালপাকের একটি স্থান।
লেখক এই ভাইরাসটিকে বাস্তবজগতের ইবোলা, রেবিস ও অন্যান্য ভাইরাসের মতোই বর্ণনা করেছেন। আশঙ্কা হচ্ছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আক্রান্ত মানুষ ভিন্ন আচরণ করতে শুরু করবে।
এমডিএস বা মেটারনাল ডেথ সিনড্রম:
জেইন রজার্সের দ্য টেস্টামেন্ট অব জেসি ল্যাম্প উপন্যাসের এই রোগটি নারীদেহে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। নারী গর্ভবতী হওয়া মাত্রই তা সক্রিয় হয়, মস্তিষ্কের অবক্ষয় ঘটাতে শুরু করে এবং মা ও গর্ভস্থ শিশু উভয়ের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরো কিছু অসুখও ফিকশনাল ভাইরাসের নাম উল্লেখ করছি। জর্জ মার্টিনের ওয়াইল্ড কার্ড উপন্যাসে ব্ল্যাক ট্রাম্প ভাইরাস, ডেভিড গেমেল-এর দ্য লিজেন্ড অব ডেথওয়াকার-এ কলিন্স সিনড্রম, এমিলি জন ম্যান্ডেলের স্টেশন ইলাভেন এ জর্জিয়া ফ্লু, জিম ডেভিসের গারফিল্ড-এ হাওয়াইয়ান ক্যাট ফ্লু, ডিসি ওয়ান মিলিয়ন-এ হুরমান ভাইরাস, ওয়ারহ্যামার-এর লাইফ-ইটার ভাইরাস, ডগলাস অ্যাডামসের-এর দ্য হিচ হাইকার্স গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি-তে শেইম, জোজো'স বিজার অ্যাডভেঞ্চার-এ স্ট্যাড ভাইরাস। আরো আছে ক্রিপিন ভাইরাস, কার্নোসর ভাইরাস, ম্যাকগ্রেগর সিনড্রৌম ইত্যাদি।
নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগোর উপন্যাসে মানুষ ক্রমাগত অন্ধ হয়ে আসছে এবং কর্তৃত্ববাদী সরকার নির্মমভাবে এ অন্ধত্বের মোকাবেলা করতে চেষ্টা চালাচ্ছে।