হাওড়া গার্লস কলেজ: তবুও আশ্চর্য সব আশাশীল মানুষের আলোড়ন…
'আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?' জি। 'আমি বনলতা সেন...।' শুনে বিস্মিত হই এবং বাকরুদ্ধ হয়ে কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে থাকি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে একগাল হেসে বললেন, 'আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি বাংলাদেশের নাটোরে। কী আশ্চর্য দেখুন, সেই নাটোরের মেয়ে ঘুরতে ঘুরতে জীবনানন্দের সবশেষ কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে এলাম।'
কলকাতার হাওড়া গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ রুমা ভট্টাচার্য। একটা জরুরি মিটিংয়ে ছিলেন। বাংলাদেশে থেকে এসেছি এবং জীবনানন্দকে খুঁজছি জানার পর মিটিং সংক্ষেপ করেন। জানালেন, এই কলেজে প্রতি বছর জীবনানন্দের জন্মমৃত্যু দিবস বেশ উৎসাহের সাথে পালন করা হয়। কলেজের লাইব্রেরিতে জীবনানন্দের একটি আবক্ষ মূর্তিও রয়েছে। শিক্ষকরুমের পাশেই কলেজের হলরুমটির নাম 'জীবনানন্দ সভাঘর'। শিক্ষকরুমে জীবনানন্দের একটি ছবিও শোভা পাচ্ছে।
মৃত্যুর পরের বছর ১৯৫৫ সালে এই কলেজ থেকে জীবনানন্দের স্মরণে যে সংকলনটি (গার্লস কলেজ পত্রিকা) প্রকাশ করা হয়, সেখানে তার সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের আবেগঘন স্মৃতিচারণই বলে দেয়, এখানকার সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা জীবনানন্দকে কতটা ভালোবাসতেন। ৯০ পৃষ্ঠার এই সঙ্কলনটি সম্পাদনা করেন জীবনানন্দের সহকর্মী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এটি ছাপা হয় হাওড়ায় ২৫৯/এ নেতাজী সুভাষ রোডে কুইন প্রিন্টিং প্রেসে। জীবনানন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশ তার কাছে থাকা পত্রিকার একটি মূল কপি থেকে আমাকে ফটোকপি করে দেন। এই পত্রিকায় জীবনানন্দের সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের বাইরে জীবনানন্দকে নিয়ে 'আমার দাদা জীবনানন্দ দাশ' নামে স্মৃতিচারণমূলক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন তার ভাই অশোকানন্দ দাশ।
হাওড়া গার্লস কলেজে জীবনানন্দের সময়কালের কোনো রেজিস্ট্রি খাতা পাওয়া গেল না। জীবনানন্দ অন্তঃপ্রাণ শিক্ষক অজয় মণ্ডল জানালেন, তিনি জীবনানন্দের স্মৃতি খুঁজেছেন। বিশেষ করে তিনি শিক্ষকদের যে হাজিরা খাতায় সই করেছেন, তার কোনো একটা পাওয়া যায় কি না, অনুসন্ধান করেছেন; কিন্তু পাননি।
হাওড়া গার্লস কলেজের বর্তমান নাম বিজয় কৃষ্ণ গার্লস কলেজ। অবস্থান কলকাতার হাওড়া সেতুর ওপারে৫/৩ মহাত্মা গান্ধি রোডে। কলেজটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। কলকাতা শহর থেকে হাওড়াগামী বাসে উঠে হাওড়া সেতুর পরে রেলস্টেশন। এর পশ্চিমে বাকল্যান্ড ব্রিজ থেকে নেমে হাতের ডানেই এই কলেজ। ক্যাম্পাস খুব বড় নয়। গেট পেরিয়ে ঢুকতেই একটা ছোট মাঠ। অনেক গাছপালা পুরো ক্যাম্পাসেই। মাঝখানে একটা পুকুর। পাশেই হাওড়া ময়দান।
চাকরির জন্য নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, বিরক্ত এবং অবসন্ন জীবনানন্দ জীবনের শেষদিকে এসে 'দুদণ্ড শান্তি'র সন্ধান পান এখানে এসে। যদিও এই শান্তির স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র বছর দেড়েক। এই কলেজে অধ্যাপনাকালীন হার মানেন মৃত্যুর কাছে। সহকর্মী হেরম্ব চক্রবর্তীর (জীবনানন্দকে যেমন দেখেছি, গার্লস কলেজ পত্রিকা, জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১৯) ভাষায়, 'মানবজীবনে কবি স্বস্তি খুঁজে পেয়েছেন কি না সন্দেহ। সিটি কলেজ-বাগেরহাট-বরিশাল-স্বরাজ পত্রিকা-খড়্গপুর-বড়িশা ঘুরে হাওড়ায় এলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। বরিশাল থেকে ছেদ-বিযুক্তি বলয়িত হয়ে সংযুক্ত হল এখানে। কবির জীবনেও কি বরিশাল-বড়িশা বৃত্ত গার্লস কলেজে এসে সমাপ্ত হলো?' বলছেন, 'নতুন সাক্ষাতের প্রথম দিনেই তার মুখে দেখলাম তৃপ্তির স্নিগ্ধ হাসি। একটু বিস্মিত হলাম কিন্তু আলাপে বুঝলাম যে, এখানে তার মনে আশ্বাস ও আস্থা এসেছে।'
আরেক সহকর্মী অজিত কুমার ঘোষের (জীবনানন্দ প্রসঙ্গ: জীবন-নদীর তীরে, গার্লস কলেজ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ৬৪) ভাষায়, 'গোটা জীবন ধরে জীবনানন্দ মনের মতো একটা পরিবেশ খুঁজেছেন যেখানে তিনি তার সর্বোত্তমকে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন। জীবনের উপান্তভূমিতে সে বাসনা পূর্ণ হলো। হাওড়া গার্লস কলেজের পরিবেশে তিনি পেলেন তার রম্য সুর, কাম্য সহযোগ। অধ্যাপনায় যে এত রস আছে কলেজের আঙিনায় নবীন জীবন প্রবাহের সান্নিধ্য যে এত প্রাণবন্ত তা উপলব্ধি করলেন নতুনভাবে।' বোধ হয় এই কলেজের শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের নিয়েই তিনি লিখেছিলেন—'চারিদিকে ব্যর্থ মৃত্যুশীল তবুও আশ্চর্য সব আশাশীল মানুষের আলোড়ন'। 'আকাশে রাত' শিরোনামের এই কবিতাটি জীবদ্দশায় কোথাও ছাপা হয়নি। মৃত্যুর পরে ছাপা হয় প্রতিক্ষণ পত্রিকায় বৈশাখ ১৩৯২ সংখ্যায়। কবিতাটি ঠিক কোন সময়ের লেখা তা জানা যায় না। এটি কি হাওড়া গার্লস কলেজে যোগদানের পরে নাকি আগে লেখা তাও পরিস্কার নয়।
হাওড়া গার্লস কলেজ
১৯৪৬ সালের পয়লা আগস্ট পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় হাওড়া গার্লস কলেজ। শুরুতে ৮ জন ছাত্রী ও ৪ জন শিক্ষকসহ মোট ১২ জন ১৪৩ নম্বর শিবপুর রোডে পান্নালাল মুখোপাধ্যায়ের বৈঠকখানায় মিলিত হতেন। বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন অধ্যক্ষ বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্য। তিনি পড়াতেন তর্ক ও পৌরনীতি। সরোজরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াতেন ইংরেজি, সন্তোষকুমার দাশ ইতিহাস আর অমরেন্দ্র মজুমদার পড়াতেন সংস্কৃত ও বাংলা। তবে শিক্ষানুরাগী বিজয় কৃষ্ণর উদ্যোগে এই অনাড়ম্বর আয়োজনের অব্যবহিত পরেই একটি আঘাত আসে। কলকাতা ও হাওড়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন প্রার্থনাও স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তী জানুয়ারি মাসে ছাত্রীদের কাছ থেকে পুনরায় ক্লাস শুরুর অনুরোধ আসে। ফলে পুনরায় ক্লাস শুরু হয়। অধ্যাপক হরিপদ ভারতী তর্কনীতির এবং ভোলানাথ দত্ত ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে কলেজে যোগদান করেন।
এরপর কলেজটি স্থানান্তরিত হয় শিবপুর ভবানী বালিকা বিদ্যালয়ের ঘরে। পান্নালাল মুখোপাধ্যায় এককালীন ৮হাজার টাকা অনুদান এবং তদানীন্তন কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক সতীশচন্দ্র ঘোষের পরামর্শে কলেজটি প্রতিষ্ঠার পথে অনেকখানি এগিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায় কলেজটি। এর পরের বছর এই কলেজের ৮ জন ছাত্রী প্রাইভেট হিসেব আইএ পরীক্ষা দেন। ১৯৪৯-৫০ সালে কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায় এবং পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে (গার্লস কলেজ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ৭৫)।
যেভাবে চাকরি হলো
হাওড়া গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সাথে সখ্য ছিল 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার সহকারী সম্পাদক গোলাপচন্দ্র রায়ের (পরবর্তীতে জীবনানন্দের অন্যতম জীবনীকার)। হাওড়া গার্লস কলেজে জীবনানন্দের চাকরির প্রসঙ্গে তিনি (জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ১২৭) জানান, একদিন হাওড়ার ডিউক লাইব্রেরি অ্যাসেসিয়েশন সভায় বিজয়কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তার কলেজে ইংরেজির কোনো অধ্যাপক লাগবে কি না। তখন বিজয়কৃষ্ণ জানান, গার্লস কলেজে একজন নেয়া হতে পারে। তবে নিশ্চিত না। এ কথা শোনার পরদিনই জীবনানন্দের বাসায় হাজির হয়ে 'দেশ' ও 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় তার শিক্ষাবিষয়ক যে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আসেন। পরদিন পত্রিকাগুলো নিয়ে গোপালচন্দ্র হাজির বিজয়কৃষ্ণর বাড়িতে। জীবনানন্দ কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং এরকম একজন চিন্তাশীল মানুষ তার কলেজে যোগ দিলে কেন তার উপকার, তা সবিস্তারে বললেন। কথা শুনে জীবনানন্দকে একদিন আসতে বললেন অধ্যক্ষ। ১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল কলেজ পরিচালন সভায় স্থায়ী অধ্যাপক পদে জীবনানন্দের নিযুক্তির প্রস্তাব গৃহীত হয়। এভাবে বিনা আবেদনেই হাওড়া গার্লস কলেজে তার চাকরিটা হয়ে যায়।
গ্রীষ্মের ছুটির পর ১৯৫৩ সালের পয়লা জুলাই তিনি কাজে যোগ দেন। শুধু তাই নয় তাকে ইংরেজি বিভাগের প্রধানও করা হয়। ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ৩০৯) জানাচ্ছেন, চার-পাঁচজনকে ডিঙিয়ে জীবনানন্দকে বিভাগীয় প্রধান করা হয়। এমনকি তাকে ভাইস প্রিন্সিপ্যাল করার কথাও বিবেচনা করছিলেন অধ্যক্ষ বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্য। জীবনানন্দ সর্বসাকুল্যে মাইনে পেতেন দেড়শো টাকা। এর সাথে দৈনিক ভাতা (ডিএ) ৫০ টাকা এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আরও ৫০ টাকা। সর্বমোট আড়াইশো টাকা। এক বছর পরে বেতন ২০ টাকা বাড়লে মোট মাইনে দাঁড়ায় ২৭০ টাকা। ১৯৫৩ সালের পয়লা জুলাই থেকে পরের বছর মৃত্যু (২২ অক্টোবর ১৯৫৪) পর্যন্ত এক বছর তিন মাস এই কলেজে অধ্যাপনা করেন জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দের সময়ে এই কলেজে বাংলার বিভাগীয় প্রধান ছিলেন অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখছেন (তাঁকে সহকর্মী হিসেবে দেখেছি, কোরক, শারদ ১৯৯৪ সংখ্যা), 'অধ্যক্ষ বিজয়কৃষ্ণের মানুষ চিনবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তিনি সহজেই জীবনানন্দের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন। জীবনানন্দ ইংরেজি গদ্য-প্রবন্ধ পড়াতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্কলিত সেই গদ্যগ্রন্থটি অতিশয় নিরস। কিন্তু ছাত্রীদের কাছে শুনেছি নিরস গদ্যও নাকি তার পড়ানোর গুণে কবিতার মতো স্বাদু হয়ে উঠতো।' শেষদিকে বাসার যন্ত্রণা তীব্র হয়ে উঠলে একদিন অসিতকুমারকে বলেছিলেন, হাওড়ায় বাড়ি পেলে এখানে বসবাস করবেন। কলকাতা অসহ্য হয়ে উঠেছে।
কলেজে আসা-যাওয়া এবং এই সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ:
কলকাতা শহরের কাছে বলে প্রতিদিনই ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়া-আসা করতেন জীবনানন্দ। শেষদিকে শরীরও ভেঙে গিয়েছিলো। ডায়াবেটিসও আক্রমণ করে। ফলে কলেজ থেকে ফিরেই হাঁটতে বেরোতেন। তবে অর্থকষ্ট কিছুটা কমায় এবং সহকর্মীদের ভালোবাসায় দীর্ঘদিন যে মানসিক পীড়নে ছিলেন, তা থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পান।
অজিত কুমার ঘোষ (গার্লস কলেজ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ৫৮) বলছেন, 'এক কলেজে কাজ করতেন বলে নিকটেই থাকতেন, তাই নিবিড় হওয়ার সুযোগ ছিল। কলেজে রোজ দেখা হত। ফাঁকে ফাঁকে গল্প হত। কখনও বা কলেজ শেষে একসঙ্গে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে বালীগঞ্জের বাসে উঠতাম। কিন্তু তাতে আশ মিটত না। তার পাশে গিয়ে বসতাম ফাঁক পেলেই। কখনও দুপুরে, কোনোদিন বিকালে, কদাচিৎ সকালেও জীবনানন্দ আমার ঘরে আসতেন কোনো সন্ধ্যায়, সকালে। চলার পথে হঠাৎ দেখা হলে অবসর মতো রাস্তায় ঘুরেছি। নিরিবিলি পেলে রেস্তোরাঁয় ঢুকে এক কোণে বসে গল্প করেছি সময়ের খেয়াল না রেখে।'
হাওড়া গার্লস কলেজ পত্রিকায় চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী প্রীতি চট্টোপাধ্যায় (শেষ দেখা, গার্লস কলেজ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ৪৬) লিখেছেন, 'অবাক হয়ে গেলাম তার পড়ানোর পদ্ধতিতে, প্রতিটি কথাকে তিনি বিভিন্ন ইংরেজিতে সাত কি আটবার বলছেন আমাদের বোঝনোর জন্য। অপূর্ব তার পড়ানো, চেষ্টা করেও কেউ অন্যমনস্ক হয়ে যেতে পারবে না। তার আকর্ষণীয় বাকভঙ্গি সরিয়ে আনবে তাকে অন্যমনস্কতা হতে।' (যদিও জীবনানন্দ শেষদিকে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। ধীরগতির ট্রামের নিচে পড়ে যাওয়া এই অন্যমনস্কতারই কারণ বলে মনে করা হয়।)
প্রীতি আরও লিখছেন, 'ক্লাসে পড়াবার সময় তিনি হাতের একটি বিশেষ ভঙ্গি করতেন। সেই বিশিষ্ট ভঙ্গির মাঝে তার অন্তরের অপরিসীম শক্তি ফুটে উঠত। সেই বিশিষ্ট ভঙ্গিমা আমি আর কারুর দেখিনি। আর বিস্মিত হতাম তার বক্তৃতা দেবার ক্ষমতায়, তার সুগভীর স্বর যখন সমস্ত ক্লাসের মাঝে ছড়িয়ে গিয়ে আবার তা প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অপূর্ব রহস্যময় আবহাওয়ার সৃষ্টি করতো।'
কলেজের সবাই জানতেন জীবনানন্দ দাশ একজন বিশিষ্ট কবি। সঙ্গত কারণেই ক্লাসে অনেক সময় ছাত্রীরা কবিতা শোনার, বিশেষ করে তার নিজের কবিতা শোনার বায়না ধরতেন। তিনি সরলতার সাথে বলতেন, তিনি কবিতা লিখতে পারেন, কিন্তু পড়তে পারেন না। তবে কলেজে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে 'বলাকা' ও 'তপোভঙ্গ' কবিতা দুটি পড়েছিলেন।
সহকর্মী জীবনানন্দ সম্পর্কে অসিতকুমার আরও জানাচ্ছেন, বেশি কথা বলতেন না বলেই হয়তো তিনি সহজেই অন্তরঙ্গ হতে পারতেন। সবাই মিলে চা খেতেন। অধ্যাপক বিনিতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার সঙ্গে রসিকতা জুড়ে দিতেন। একদিন সহকর্মীদের নাকি বলেছিলেন, কলকাতায় বসবাস তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। হাওড়ায় বাড়ি পেলে থাকবেন। সহকর্মীদের কেউ কেউ বলেছিলেন, পুজোর ছুটির পরে স্বল্প ভাড়া হাওড়ায় তাকে বাড়ি খুঁজে দেবেন। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয়নি। জীবনানন্দ নিজেই চিরদিনের মতো ছুটি নিয়ে চলে গেছেন।
শিক্ষকতাকে জীবনানন্দ যে খুব ভালোবেসে গ্রহণ করেছিলেন তা নয়। এই পেশার প্রতি তার বিরক্তি বা অভিমানের কথা নানা সময়ে তার চিঠিপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও হাওড়া গার্লস কলেজের ছাত্রীরা শিক্ষক জীবনানন্দের যে বর্ণনা দেন, তাতে তাকে একজন আদর্শ, সংবেদনশীল, দায়িত্ববান শিক্ষক হিসেবেই গণ্য করা উচিত। গার্লস কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী বকুল মজুমদার (মহাপ্রয়াণে কবি জীবনানন্দ দাশ, গার্লস কলেজ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ২৮) লিখছেন: 'প্রয়োজনের বেশি একটি কথাও তিনি কোনোদিন বলেননি। ক্লাসে পড়া বোঝাবার সময় কোনো ছাত্রী মনে হয় এতটুকুও অন্যমনস্ক হত না; জানি না এটা তার ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শের গুণ নাকি তাকে শ্রদ্ধা করার জন্য। তিরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা, এমনকি উপদেশের নীরস নীতিকথাও তার কাছ থেকে কেউ কোনোদিন পায়নি।'
জীবনানন্দের ছাত্রী অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের (ছাত্রী সম্পাদিকার দপ্তর, গার্লস কলেজ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ৬৮) ভাষায়, 'জীবনানন্দকে আমরা কবি হিসেবে জেনেছি অল্পই; কিন্তু তাঁর ব্যক্তিমানুষকেউপলব্ধি করেছি এবং দৈনন্দিন জীবনে গ্লানির স্পর্শ হতে দূরে থাকার সংকল্প তাঁকে আমাদের আদর্শের সামনে বসিয়েছে। এ জীবন যে 'পদ্মপত্রজল'—এই নিদারুণ সত্য শেষে তাঁর জীবনের মধ্যে এত রুঢ়ভাবে প্রতিফলিত হল—এটাই আমাদের চরম দুর্ভাগ্য।'