‘আমি মনে করি পুতিন এ কাজ করেছে’
বুধবার সকালে যখন আলেক্সেই নাভালনি সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য ডার স্পিগেলের বার্লিনস্থ সম্পাদনা অফিসে এসে উপস্থিত হন, তখন ঘড়িতে সকাল ছয়টা বাজে। অফিসটি শারিট বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরে অবস্থিত, যেখানে নাভালনি প্রায় এক মাস ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থেকেছেন।
নাভালনি মাত্র গত সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তিনি নভিচক বিষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে।
সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য সেখানে আসার সময় উনার সাথে এলকেএ (স্টেইট অফিস অফ ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশান) এর চারজন এজেন্ট ছিলেন। কিছুদিন আগেও নাভালনি চলৎশক্তিহীন অবস্থায় ছিলেন। তবে আজ তিনি সিঁড়ি ভেঙ্গেই এখানে উঠে এসেছেন, লিফট ব্যবহার করেননি।
আলেক্সেই নাভালনি (বয়স ৪৪) হচ্ছেন রাশিয়ার সবচেয়ে বিশিষ্ট বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ। গত ২০শে আগস্ট, সাইবেরিয়ার শহর টমস্কে উনার প্রাণনাশের প্রয়াস ব্যর্থ হবার পর থেকেই তিনি আন্তর্জাতিক স্পটলাইটে রয়েছেন। জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের প্রচেষ্টায় তিনি রাশিয়া ত্যাগ করে জার্মানীতে এসে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার অনুমতি পান। নাভালনিকে যে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তা শুধুমাত্র রাশিয়ান সরকারী গবেষণাগারে পাওয়া যায়, তাই ব্যাপারে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনের দায়বদ্ধতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রাশিয়ায় বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের জীবননাশের এটাই প্রথম প্রয়াস নয়, কিন্তু এবারই প্রথম ঘটনাপ্রবাহ সুষ্পষ্টভাবে ক্রেমলিনের সংযুক্তির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করছে।
আক্রান্ত হবার পর ডার স্পিগেলের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারটিই ছিল প্রথম। তিনি সাক্ষাৎকার প্রদানের পুরোটা সময় জুড়ে সপ্রতিভ ছিলেন, এবং তিনি অনেক কিছুই মনে করতে পারছিলেন—কিন্তু তারপরেও উনার ওপর বিষক্রিয়ার প্রভাবটি প্রচ্ছন্নভাবে টের পাওয়া যাচ্ছিল। তার গলার কাছের ক্ষতস্থান দেখে বোঝা যাচ্ছিল কিভাবে উনাকে ভেন্টিলেটরের সাথে ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছিল। যখন তিনি বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢালছিলেন, তখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে এটুকু কাজ করতেই উনার যথেষ্ঠ কষ্ট হচ্ছে, এবং দু'টি হাত ব্যবহার না করে উনি তা করতে পারছিলেন না। কিন্তু তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন "চিকিৎসক বলেছেন আমার সব কাজ নিজে করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে"।
পূর্বের যেকোন বৈঠকের তুলনায় সেদিন নাভালনিকে বেশি উৎকণ্ঠিত হতে দেখা যায়। তার চেহারা মলিন এবং শরীর বেশ রুগ্ন হয়ে গিয়েছিল প্রায় ১২ কেজি ওজন হারানোর কারনে। কিন্তু তার গলার কন্ঠ আগের মতই ছিল, এবং সাথে তার হাস্যরস এবং বিদ্রুপগুলোও ছিল অপরিবর্তিত। তার পাশেই ছিলেন মুখপাত্র কিরা ইয়ারমিশ; যিনি ২০শে আগস্টে তার সাথে একই প্লেনে ছিলেন, যখন প্রথম তার মাঝে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হবার লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিল।
বৈঠকটি শুরু হবার আগে নাভালনি কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন।
নাভালনিঃ এটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার যে এই সাক্ষাৎকারটি জার্মান প্রেসে ছাপা হচ্ছে। আমি কখনো জার্মানীর সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করিনি। আমি এখানে প্রায় কাউকেই চিনি না। আমি একজন রাজনীতিবিদকেও চিনতাম না। কিন্তু কম্পিত কন্ঠে জানাচ্ছি যে, আমি খুবই আবেগী হয়ে পড়েছি,কেননা জার্মান রাজনীতিবিদগণ এবং এঞ্জেলা মার্কেল আমার কথা ভেবেছেনএবংআমার জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শারিট এর ডাক্তারগণ আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে তারা আমার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ফিরিয়ে এনেছেন। সুতরাং আমি প্রথমে যে কথাটি বলতে চাই সেটা হল যে আমি সকল জার্মানদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞতা অনুভব করছি। যদিও এটা শুনতে একটু অতিরঞ্জিত মনে হবে, তবুও বলছি, জার্মানী আমার জন্য একটি বিশেষ দেশে পরিণত হয়েছে। আগে আমি এখানে অল্প কিছু মানুষকে চিনতাম, আর আমি শুধুমাত্র একবারই বার্লিন শহরে এসেছিলাম, আর সেটাও তিন বছর আগে! আর এখন এত মানুষের কাছ থেকে মানবিক সহানূভুতি পাচ্ছি যা অতুলনীয়।
ডার স্পিগেল: আমাদের পাঠকেরা বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। আপনি কেমন আছেন, জনাব নাভালনি?
নাভালনি: তিন সপ্তাহ আগে যেরকম ছিলাম, তারচেয়ে এখন অনেক ভাল আছি, আর প্রতিদিনই আমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। অল্প কিছুদিন আগেও আমি সিঁড়ির দশ ধাপের বেশি উঠতে পারতাম না, কিন্তু এখন আমি পাঁচতলা পর্যন্ত অনায়াসে হেঁটে উঠতে পারি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে আমার মানসিক সক্ষমতা ফিরে এসেছে। তবে এই সাক্ষাৎকার চলাকালীন সময়ে হয়তো আমার এই ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হবে (একথা বলে হেসে উঠলেন নাভালনি)।
স্পিগেল: আপনি ইন্সটাগ্রামে লিখেছেন যে এখন আর আগের মত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না।
নাভালনি: এখন আবার পারছি। আমার পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একপায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাকে সামনের দিকে প্রসারিত করা, যেটি করার জন্য আমি প্রতিদিন ব্যায়াম করছি। এসব ব্যায়াম নব্বুই বছর বয়সী লোকজন করে থাকে, পার্কে গিয়ে, কিন্তু এখন এটা আমার জন্য অবশ্য করণীয় হয়ে গিয়েছে।
স্পিগেল: আপনার ঘুম ভাল হচ্ছে?
নাভালনি: এটাই এই মুহুর্তে আমার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমি আগে ঘুমের সমস্যায় জর্জরিত মানুষদেরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতাম, কারণ আমার নিজের কখনো এরকম কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু এরপর আমি কোমায় গেলাম, আর শুরু হল এনেস্থেশিয়া এবং বিভিন্ন ধরণের বেদনানাশকের সন্নিবেশযুক্ত জীবন; একটা দীর্ঘ সময় গিয়েছে যখম আমি ঘুমিয়েও ছিলাম না, আবার জেগেও ছিলাম না। সে সময় থেকে আমি ঘুমানোর বড়ির সাহায্য ছাড়া ঘুমাতেই পারছি না।
স্পিগেল: জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত আপনি রাশিয়ার রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। যখন আপনি জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখন আপনি একজন বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে জেগে উঠলেন। এমন কি চ্যান্সেলর মার্কেলও আপনাকে দেখতে এসেছিলেন হাসপাতালে। আপনারা কি নিয়ে কথা বলেছিলেন?
নাভালনি: সেটা গত সপ্তাহের ঘটনা। খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল ব্যাপারটা। হঠাৎ দরজা খুলে গেল, এবং আমার ডাক্তার প্রবেশ করলেন রুমে—এবং তার সাথে মার্কেল। তখন আমি আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছিলাম—আমার সাথে আমার স্ত্রী ইউলিয়া এবং পুত্র জাহার ছিল। আমি আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারবো না, কিন্তু আমরা কোন গোপন কিংবা চাঞ্চল্যকর বিষয় নিয়ে কথা বলিনি। এটি ছিল একটি সৌজন্য সাক্ষাত। রাশিয়া এবং আমার সম্পর্কে উনার গভীর জ্ঞানের ব্যাপারে জানতে পেরে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলাম। এসব বিষয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে আমার চেয়েও উনার জ্ঞান অনেক গভীরে। সব মিলিয়ে রাশিয়ায় কি চলছে তা তিনি খুব ভাল করেই জানেন। যখন আপনি উনার সাথে কথা বলবেন, তখন খুব সহজেই বুঝতে পারবেন কেন তিনি জার্মানীর শীর্ষপদে আসীন রয়েছেন এতদিন ধরে। উনার সকল প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম, যার প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন "আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র"।
স্পিগেল: হাসপাতাল ছাড়ার পর থেকে আপনার দৈনন্দিন জীবন কেমন হয়েছে? আপনি এখন কোথায় থাকছেন?
নাভালনি: আমি আমার স্ত্রী এবং সন্তানের সাথে থাকি এখানে। আমার কন্যা স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়েছে। আমরা একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। আমার দৈনন্দিন জীবন খুবই একঘেয়ে। আমি প্রতিদিন ব্যায়াম করি—এটাই আমার নিয়মিত কাজ এখন। সকাল বেলায় আমি পার্কে হাঁটতে যাই, যা আমার জন্য চাকুরীতে যাওয়ার মত। সেখান থেকে ফিরে এসে ডাক্তারের সহায়তায় বাকি ব্যায়ামগুলো করি। সন্ধ্যায়, আমি আবারো হাঁটতে যাওয়ার চেষ্টা করি। দিনের বেলায় আমি কম্পিউটারে কিছু কাজ করার চেষ্টা করি। ডাক্তাররা বলছেন যে আমি আমার পূর্বের সক্ষমতার শতকরা ৯০ ভাগ পর্যন্ত ফিরে পেতে পারি। এমনকি ১০০ ভাগও ফিরে পাওয়া সম্ভব, কিন্তু কোন কিছুই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না। মূলত, আমি একজন ল্যাবরেটরির গিনিপিগের মত, কেননা খুব কম মানুষকেই পর্যবেক্ষণে রাখার সুযোগ পাওয়া গিয়েছে, যারা এরকম ভয়াবহ, নার্ভ এজেন্টের শিকার হবার পরেও বেঁচে আছেন। হয়তো কোন এক পর্যায়ে আমাকে নিয়ে মেডিক্যাল জার্নাল লেখা হবে। আমি খুশী মনেই আমার অভিজ্ঞতাগুলো সবার সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। রাশিয়ার নেতৃত্ব মানুষকে বিষপ্রয়োগ করার ব্যাপারে এতটাই মনোযোগী হয়েছে যে সহসা এই ব্যাপারটি বন্ধ হচ্ছে না। আমার চিকিৎসা সংক্রান্ত ইতিহাস হবে ভবিষ্যতের ভুক্তভোগীদের জন্য শিক্ষামূলক।
স্পিগেল: সোশাল মিডিয়াতে আপনার দেয়া পোস্টগুলো দেখে মনে হলো যে হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে আপনি প্রায়ই বিছানা থেকে উঠে গিয়ে হাঁটাচলা করতেন।
নাভালনি: শারিটের ডাক্তার এবং নার্সেরা হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে সহনশীল মানুষ। আমি খুবই ঝামেলাপ্রদ রোগী ছিলাম। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় প্রায়শই আমি রাতের বেলায় উঠে যেতাম। একবার আমি আমার শরীরের সব টিউব ছিড়ে ফেলেছিলাম, যার দরুন রক্তপাত শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে, আমি যখন সজাগ হলাম এবং আশেপাশের মানুষদের চিনতে ও তাদের সাথে কথা বলতাম, তখন আমার হিস্টিরিয়া হোত। আমি দাবী করতাম যে আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি, এবং আমি হোটেলে গিয়ে থাকতে চাই। কিন্তু বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে আমি টের পাই যে আমার এই অদ্ভুত আচরণগুলো ছিল বিষক্রিয়ার প্রভাব।
স্পিগেল: আসুন আমরা পর্যালোচনা করি, আপনার সাথে ঠিক কি ঘটেছিল, এবং আমরা তা শুরু করবো জ্ঞান হারানোর আগে আপনার সর্বশেষ স্মৃতি দিয়ে। মনে করুন আজ আগস্ট মাসের ২০ তারিখ, সকাল ৮টা বাজে। আপনি টমস্ক থেকে মস্কোগামী একটি বিমানে বসে আছেন। আপনি সাইবেরিয়াতে কিছুদিন থেকেছেন। সে মুহুর্তে আপনার মাথায় কি চিন্তা ছিল?
নাভালনি: সেদিনটি চমৎকার ছিল। আমি নিজের শহরে ফিরে যাচ্ছিলাম একটি কর্মমূখর এবং সফল ভ্রমণকে পেছনে ফেলে। আমরা আঞ্চলিক নির্বাচণী প্রচারণার জন্য ভিডিও করছিলাম, এবং সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল। আমি আরামদায়ক ভঙিমায় আমার সিটে বসে শান্তিপূর্ণ ফ্লাইটটি উপভোগ করছিলাম, আর কি সিরিজ দেখবো সেটা ভাবছিলাম। আমিও আরো ভাবছিলাম যে মস্কোতে ফিরে আমার সাপ্তাহিক ইউটিউব শো ধারণ করবো, এবং তারপর সপ্তাহের শেষ দু'টি দিন পরিবারের সাথে নির্বিঘ্নে কাটাবো। আমার খুব ভাল লাগছিল, যেমনটি লেগেছিল এয়ারপোর্টে থাকা অবস্থাতেও। আর তারপর কি হল…সেটা বর্ণনা করা দুষ্কর, কারণ এর সাথে তূলনা করার মত কোন অনুভূতি নেই।
ফসফরাসযুক্ত জৈব যৌগ আপনার স্নায়ুতন্ত্রকে কম্পিউটারের DDOS (ওয়েবসাইট হ্যাক করার জন্য হ্যাকারদের উদ্ভাবিত এক ধরণের সমন্বিত সাইবার আক্রমণ)আক্রমণের মত করে আক্রমণ করে, যা একজন মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। আপনি কোন কিছুতে মনঃসংযোগ করতে পারবেন না। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম যে কোন একটি সমস্যা হয়েছে। আমার সারা গা ঘামে ভিজে গিয়েছিল। আমার পাশে বসে থাকা কিরার কাছে আমি টিস্যু চাই। তখন আমি তাকে বলি, আমার সাথে কথা বল। আমার কোন একটি কন্ঠস্বর শোনা প্রয়োজন—আমার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি একটা পাগল, এবং অনর্গল কথা বলতে লাগলো।
স্পিগেল: এরপর কি হলো?
নাভালনি: আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার সাথে কি হচ্ছে। ট্রলি নিয়ে স্টুয়ার্ডরা এগিয়ে এলো। আমি প্রথমে তাদের কাছে পানি চাইবো বলে ভেবেছিলাম, কিন্তু আমি মত বদলে বল্লামঃ "না, আমার কিছু লাগবে না, আমি বাথরুমে যাচ্ছি।''
আমি ঠান্ডা পানি দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করলাম, তারপর আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর আবারো নিজেকে ধুয়ে নিলাম। এরপর আমার মনে হলো, ঠিক এখুনি যদি এখান থেকে বের হতে না পারি, তাহলে আর কখনোই বের হতে পারবো না। আমার কাছে তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি ছিলঃ "তুমি কোন ব্যথা অনুভব করছো না, কিন্তু তুমি জানো যে তুমি মারা যাচ্ছ। এবং আমি জানি, ঠিক এই মুহুর্তে ব্যাপারটা ঘটছে; যদিও আমি কোনো ধরণের ব্যথা অনুভব করছিলাম না"। আমি বাথরুম থেকে বের হলাম, এবং স্টুয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে সাহায্য চাওয়ার পরিবর্তে, নিজেকে বিস্মিত করে দিয়ে বলে উঠলাম "আমাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে, আমি মারা যাচ্ছি"। আর আমি তখন মারা যাওয়ার উদ্দেশ্যে তার সামনে শুয়ে পড়লাম। তার চেহারাটাই আমার দেখা শেষ দৃশ্য—একজন মানুষ আমার দিকে সামান্য বিহ্বলতা এবং এক চিলতে হাসি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সে বলে উঠলো "আপনাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে?", এবং এই কথা দিয়ে সে সম্ভবত এটা জানতে চেয়েছিল যে আমাকে বাসী মুরগী পরিবেশন করা হয়েছে কি না।
মাটিতে শায়িত অবস্থায় আমার কানে আসা শেষ কথাটি ছিলঃ আপনার হ্রদযন্ত্রে কোন সমস্যা আছে কি? কিন্তু আমি হৃত্পিন্ডে কোন ব্যথা অনুভব করছিলাম না। আমি কোন ধরণের ব্যাথাই টের পাচ্ছিলাম না। আমি শুধু জানতাম যে আমি মারা যাচ্ছি। তখন শব্দগুলো আস্তে আস্তে কমে আসছিল, আর আমি শুনতে পেলাম "আমাদের ছেড়ে যেও না! আমাদের ছেড়ে যেও না!" আর তারপর সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি ধরে নিয়েছিলাম আমি মারা গিয়েছি। পরে বুঝতে পারি যে সেটা আমার ভুল ধারণা ছিল।
স্পিগেল: একজন যাত্রীর তোলা ভিডিওচিত্রে প্লেনে থাকাকালীন অবস্থায় আপনার আর্তচিৎকারের শব্দ শোনা যায়। সেগুলো শুনতে খুবই ভয়ংকর লাগে; মনে হয় যেন সেটি একটি পশুর গুঙানি।
নাভালনি: আমি দেখেছি সেটা—ইন্টার্নেটে ভিডিও "নাভালনি ব্যাথায় চিৎকার করছেন" নামে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেটি ব্যথা ছিল না। অন্যকিছু ছিল, আরও খারাপ ধরণের কিছু। ব্যথা আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে আপনি জীবিত আছেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে মনে হয়েছিল যেন এটাই সবকিছুর শেষ।
স্পিগেল: পুরো ব্যাপারটা কতক্ষণ ধরে চলেছিল?
নাভালনি: সম্ভবত ৩০ মিনিটের মত; আমি প্রথম যখন টের পাই যে কিছু একটা ঠিক নেই, তখন থেকে শুরু করে আমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। এসব কিছুই হয়েছিল আমরা টেইক অফ করার পরেই।
স্পিগেল: আপনি এর আগের রাতটি টমস্ক শহরের হোটেল জ্যান্ডারে কাটিয়েছিলেন। সেখানেই সম্ভবত আপনি বিষের সংস্পর্শে আসেন। আপনার কি মনে আছে, আপনি কি ছুঁয়েছিলেন?
নাভালনি: একটি পানির বোতলে বিষের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয় যে আমি প্রথমে বিষাক্ত কোন একটি বস্তুর সংস্পর্শে আসি, এবং তারপর বোতল থেকে কিছুটা পানি পান করে সেটাকে আবার আগের জায়গায় রেখে হোটেল রুম থেকে বের হয়ে যাই। আমরা ধরে নিতে পারি যে আমার শরীরে বিষটি প্রবেশ করেছিল গায়ের চামড়ার মাধ্যমে। হোটেল ত্যাগ করার আগে আপনি অনেক কিছু স্পর্শ করেন—যেমন শাওয়ার, টয়লেট, কাপড় রাখার র্যাক এবং ব্যাগের হ্যান্ডেল। নিশ্চিত ভাবেই আপনি কিছু না কিছু স্পর্শ করবেন। এজন্যেই আমার কাপড়গুলোকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখাটা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেকোন ব্যক্তিগত কাপড়ে খুব সহজেই বিষ প্রয়োগ করা সম্ভব।
স্পিগেল: আপনি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর কাপড়গুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এবং সেগুলো কখনোই আর ফিরিয়ে দেয়া হয়নি।
নাভালনি: আমার কোন সন্দেহ নেই যে কাপড়গুলো একটি বড় ট্যাংকে গরম পানি ও ব্লিচ সহযোগে চুবানো আছে এক মাস ধরে, যাতে সব ছাপ মুছে যায় (এ কথা বলে তিনি হেসে উঠলেন)। আমি হয়তো মরেই যেতাম, কিন্তু দৈবক্রমে বেঁচে যাই। ওমস্ক শহরে জরুরী অবতরণ করেন বিমান, এবং বিমানবন্দরে একটি এমবুল্যান্স অপেক্ষমান ছিল আমার জন্য। সবচেয়ে ভাল যে ব্যাপারটি হয়েছিল তা হচ্ছে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই আমাকে এট্রোপিন দেয়া হয়েছিল, যে কারণে আমার মৃত্যু ঘটেনি। পরিকল্পনাটি খুবই চাতুর্য্যপূর্ণ ছিল; আমি টেক অফ করতাম, ফ্লাইট চলাকালীন সময়ে আমার মৃত্যু ঘটতো এবং এবং ওমস্ক কিংবা মস্কোর কোন একটি মর্গে আমার স্থান হোত। এবং সেক্ষেত্রে কেউ নভিচকের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারতো না, কেননা মর্গে স্পেকট্রোমিটার থাকে না। তাছাড়াও, তারা আমার মৃতদেহের উপর পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালানোর আগে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতেন। ততদিনে ব্যাপারটা শুধু একটী সন্দেহজনক মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই থাকতো না।
স্পিগেল: আপনি তো হোটেলেও মারা যেতে পারতেন।
নাভালনি: কেউ কেউ সন্দেহ করছে যে আমাকে ঘুমের মধ্যে মেরে ফেলাই ছিল মূল পরিকল্পনা। তবে সত্য বলতে কি, আমার ধারণা, বিষক্রিয়ার প্রভাবের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর আমি ঠিকই জেগে উঠতাম। হোটেলের সিকিউরিটি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্য ব্যাপারটা বেশ কৌতুককর হোত; আমি অন্তর্বাস পরিহিত অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি হলঘরের মধ্য দিয়ে, আর আমার মধ্যে বিষক্রিয়ার সকল প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি বাজী ধরে বলতে পারি যে এত কিছুর পরেও আমি আমার শক্তির শেষ বিন্দুটি খরচ করে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসতাম। আমাকে হোটেলের মধ্যে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হলে সেটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হোত। হোটেলকর্মীরা এম্বুল্যান্স ডাকতে পারতো।
স্পিগেল: এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখা কি, যে আর কেউ এই বিষ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি? যখন সাবেক এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল ব্রিটেনের স্যালিসবারিতে, তখন আরও অন্যরাও আহত হয়েছিলেন।
নাভালনি: আমার ধারণা তারা স্ক্রিপালের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, কেননা সেখানে ৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং একজন মহিলা মারাও গিয়েছিলেন। এজন্যেই এমন কোন বস্তুতে বিষ প্রয়োগ করা উচিত নয়, যেটা আমি নিশ্চিতভাবে ব্যবহার নাও করতে পারি—যেমন, শাওয়ার। কিংবা মোবাইল ফোন, যেটি আমি কিরাকে দিতে পারতাম, এবং সেক্ষেত্রে, একটি নয়, বড়ং দু'টি সন্দেহজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো। এক্ষেত্রে আমি শুধুই আমার ধারণাগুলো জানাচ্ছি। অবশ্যই আমরা আরো অনেক জটিলতর পন্থা নিয়ে পর্যালোচনা করছি, এবং এমন কিছুতেই বিষ লাগানো হয়েছিল যা শুধু আমিই ব্যবহার করি।
স্পিগেল: পানির বোতলে পাওয়া বিষের চিহ্ন নিয়ে আপনি কি বলবেন?
নাভালনি: সেগুলো ক্ষতিপূর্ণ ছিল না। সেখানে খুবই সামান্য পরিমাণ বিষ পাওয়া গিয়েছে। যে কেউ সেটি ধরতে পারতো কোন রকম ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হয়েই।
- [চলবে]