বাঁকাউল্লার হাতকাটা হরিশ
গৌরাঙ্গ ব্রাহ্মণ হরিশ ভট্টের বয়স তিরিশের মতো। বাঁকাউল্লার সাথে যখন প্রথম দেখা, দুজনই তখন নবদ্বীপে, ব্রাহ্মণের সর্বাঙ্গ তুলভেরা আঙরাখায় ঢাকা, পায়ে লোমশ বিনামা, হস্তে প্রকাণ্ড ষষ্টি। তার সঙ্গে একজন পাহাড়ি ভৃত্য, মিশকালো গাত্রবর্ণ, পুরু ও দীর্ঘ গোফ ওপরের দিকে খাড়া, চোখ ভাটার মতো গোল। পালাপার্বণে ব্রাহ্মণের নবদ্বীপ শ্রীধামে আগমন ঘটে—তিনি সংসারবিবাগী একজন পরিব্রাজক।
হরিশ ভট্টের গল্প শোনার আগে আরেকজন বাঁকাউল্লা, তার কথা জানা দরকার।
ঠগীরা যখন ভীষণ উৎপাত করছে, পথেঘাটে তাদের দমনের জন্য ১৮৩৫ সালে পুলিশকাঠামোতে ভিন্ন একটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। এবং ঠগী দমনে ১৮৩৯ সালে স্লিম্যান সাহেবকে পদোন্নতি দিয়ে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্ব দেওযা হয়। এ রকম একটি সময়ে বাঁকাউল্লা মাদ্রাসা পাঠ শেষ করে দারোগার চাকরিতে যোগ দিলেন।
অধ্যাপক সুকুমার সেনের মতো পণ্ডিতেরাও বাঁকাউল্লাহর প্রকৃতি পরিচিতি নিশ্চিত করতে পারেননি। প্রসেনজিৎ দাসগুপ্ত ও সৌম্যেন পালের ভূমিকাসংবলিত বাঁকাউল্লাহর কিসসাতে তার প্রকৃত নাম বরকতউল্লাহ বলে উল্লেখ করা হয়। আবার অন্যান্য লেখককে উদ্ধৃত করে তা নাকচও করা হয়।
তিনি বাঁকাউল্লাহ কিংবা বরকতউল্লাহ কিংবা অন্য যেকোনো নামের অধিকারীই হোন না কেন, গবেষকেরা প্রায় নিশ্চিত তিনিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম অপরাধ ও গোয়েন্দাবিষয়ক লেখক। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে (প্রকাশকাল অনিশ্চিত) তার সরাসরি অভিজ্ঞতা ও কীর্তির আলোকে বিভিন্ন এপিসোডের সমন্বয়ে বাঁকাউল্লাহর দফতর রচনাও প্রকাশ করেন। ২০২১ সালে রুটলেজ প্রকাশিত শম্পা রায়ের 'ট্রু ক্রাইম রাইটিংস ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল' গ্রন্থে বাঁকাউল্লাহর কাল ও কীর্তি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। কাছাকাছি সময়ের অপর একজন দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ও দুই খণ্ডের দারোগার দফতর লিখে সাহিত্যের অপরাধ ও গোয়েন্দা শাখাটির সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
সে সময় দুবৃত্ত ঠগী দমনে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট উইলিয়াম হেনরি শ্লিম্যান এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে তার নামের মধ্যেই ঠগী শব্দটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়—উইলিয়াম হেনরি ঠগী শ্লিম্যান (১৭৮৮-১৮৫৬); তিনি সাফল্যের সাথেই দায়িত্বটি পালন করেন। এ কাজের জন্যই তিনি ঘুরে ঘুরে হুগলির মুনশি বাঁকাউল্লাসহ কজন যোগ্য দারোগা নিয়োগ করেন। বাঁকাউল্লাহকে দেওয়া হয় গোয়েন্দা বিভাগের দারোগার দায়িত্ব।
'বাংলার পুলিশ; সেকাল একাল'-এর গ্রন্থকার আবদুস শুকুর উল্লেখ করেছেন; 'লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে ২২ নং পুলিশ কোড জারি করলেন, যা বর্তমান থানা ও গোয়েন্দাব্যবস্থার ভিত্তি। কলকাতার জন্য ১৭৯৩ সালে যেসব দারোগা নিয়োগ হলো, তাদের সবাই ছিল মুসলিম, মাত্র একজন ছিল হিন্দু। ১৮৫০ সালে প্রথম ভারতীয় পুলিশ ইন্সপেক্টর নিয়োগ হয়েছিল। প্রথমজন শেখ মোনায়েম জোড়াবাগান থানার অফিসার ইনচার্জ। যেখানে প্রায় সকল চাকরিতে হিন্দুদের একচেটিয়া আধিপত্য, দারাগাগিরিতে মুসলমানদের এগিয়ে থাকার বিষয়টি যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক।
আত্মকথা, বাঁকাউল্লাহর দফতরের সূচনায় দারোগা-লেখক খোলামেলা স্বীকারোক্তি করেছেন, তখন সুশাসনের ধারণাই ছিল না। জোর যার মুল্লুক তার, এই চিরপ্রসিদ্ধ প্রবাদবাক্য তখন দেশের লোকের মধ্যে হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করেছিল, প্রত্যক্ষ প্রমাণও হাতে হাতে মিলিত। চুরি-ডাকাতি, জাল-জুয়াচুরি, খুন, জখমের তো কথাই ছিল না। তখনকার লোক একটা লোকের প্রাণনাশ করিতে মশকনিধনের দ্বিধাটুকুও অনুভব করিত না। ২ জুলাই ১৮৬৮ সালে পুলিশের স্পেশাল ডিউটি ইন্সপেক্টর অব পুলিশ জে এইচ রিলের কটি পত্রে সফল দক্ষ ও পুরস্কার পাবার যোগ্য গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর মুনশি বাঁকাউল্লার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আসা যাক হরিশভট্ট ও বাঁকাউল্লার মূল গল্পে:
গোয়েন্দা দারোগা বাঁকাউল্লাহ পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে প্রয়োজনীয় হুকুমনামা, পরোয়ানা ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে পর্যটকের বেশে নবদ্বীপ যাত্রা করলেন। গৌরাঙ্গভক্তরা মনে করেন সাত রাত নবদ্বীপ প্রবাসে অসীম পূণ্য।
দারোগা বাসা ভাড়া নিলেন শ্রী গৌরাঙ্গ দাস বাবাজির আখড়ায়। সেখানে তার নজর গেল ভৃত্যসমেত সুদর্শ, ব্রাহ্মণ, গৌরাঙ্গ বাবাজির এক অথিতির ওপর। বাবাজি বললেন, এই সংসারবিবাগী পরিব্রাজক ঢাকার সাবেক জমিদার, দ্বিতল বাড়ি পরিত্যাগ করে এসেছেন। কিছু নগদ অর্থ মহাজনের আড়তে জমা রেখেছেন, তার সুদেই ভ্রমণের ব্যয় মিটিয়ে থাকেন। বহু দেশ ভ্রমণ করে তিনি বহুদর্শিতা অর্জন করেছেন। তিনি হরিশ ভট্ট। দারোগা লক্ষ করলেন দিব্যকান্তি ব্রাহ্মণের ডান হাতটি একেবারেই নেই, জামার শূন্যগর্ভ হাত বাতাসে দোল খায়। পরদিন দেখা হলে ব্রাহ্মণ বললেন, পশুপতিনাথ দর্শন করে ফেরার পথে নেপালের জঙ্গলে ডাকাতের সাথে লড়াইয়ে হাত হারিয়েছেন। ডান হাতের কাজ জনসমক্ষে বাঁ হাতে তিনি করতে নারাজ বলে যা কিছু করার গৃহাভ্যন্তরে লোকচক্ষুর অন্তরালেই করে থাকেন।
ব্রাহ্মণের সাথে দারোগার সখ্য স্থাপিত হলো এবং তার কাছ থেকে বিভিন্ন দেশের তীর্থস্থানের অনেক কাহিনি শুনলেন। একদিন বিকেলে আখড়ায় ঢোকার পথে দেখলেন ব্রাহ্মণের সেই ভৃত্য দু-তিনটি চিঠি ডাকবাক্সে ফেলতে ছুটে যাচ্ছে, টানা টানা হাতের লেখা ঠিকানা—আখড়ায় তো লেখার মতো কেউ নেই আর ব্রাহ্মণেরও লেখার হাত নেই। তাহলে কে?
ব্রাহ্মণ হরিশ ভট্ট সে রাতেই নবদ্বীপ যাত্রা করবেন, এমন পূণ্যবান মানুষের সাথে আর সাক্ষাৎ না-ও হতে পারে মনে করে দারোগা বাঁকাউল্লা তার সাথে শেষ মোলাকাত করে নিজ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে থানায় রওনা হলেন। থানার বড়কর্তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সেরে ফেরার পথে বড়বাবু সিপাহি আর লণ্ঠন দিয়ে সাহায্য করতে চাইলেও বাঁকাউল্লার মনে হলো গোয়েন্দা পুলিশের কর্মচারীর কি ভয়ডর থাকলে চলে।
তিনি যখন ফিরছেন আপাদমস্তক ঢাকা, মাথায় পাগড়ি, কেবল চোখ দেখা যায় এমন একজন দীর্ঘদেহী মানুষ তার পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল। তার মনে হলো চোখ দুটো তার চেনা।
বাবাজির ভাড়া ঘরে ঢুকতেই শুনলেন ঢাকার জমিদার প্রস্থান করেছেন।
অভ্যাসগত প্রভাতে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে হাফিজের গজল গাইতে গাইতে বাঁকাউল্লা যখন পদচারণ করছিলেন, তখন খবর এল, কাছেই বইচড়াপাড়ায় রামতারক ভট্টাচার্যের কন্যা বিধুমুখী খুন হয়েছে। বাঁবাউল্লা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলেন কুড়ি-বাইশ বছর বয়সী বিধুমুখী যথেষ্ট সুন্দরী। এবং সকলেরই দৃষ্টি এই নারীর চরিত্রের ওপর। তাদেও ভাষ্য, এই মেয়ে চরিত্রহীন না হলে বাড়ির বাইরে খুন হবে কেন?
পুলিশি তদন্তে বিধুমুখীর চারিত্রিক সমস্যা উল্লেখ করে খুনের ঘটনা অব্যাখ্যাত থাকল। অজ্ঞাত আসামিকে ধরা গেল না।
গোয়েন্দা দারোগা বাঁকাউল্লাও কোনো কূলকিনারা করতে পারল না। তিনি নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর চলে এলেন এবং এক সপ্তাহের জন্য একটা বাড়ি ভাড়া নিলেন। এখানেই অকস্মাৎ হাতহীন ব্রাহ্মণের সাথে দেখা হয়ে গেল। বাঁকাউল্লা অবাক হলেন। হরিশ ভট্ট এখানে কেন? প্রশ্ন্ন জাগল। তার যাওয়ার কথা চন্দ্রনাথ। বিদায়ী আলাপে তাই বলেছিলেন। তাহলে হরিশ শান্তিপুরে কেন আসবেন? বাঁকাউল্লা তাকে অনুসরণ করে দূর থেকে বাসা শনাক্ত করলেন এবং পরদিন ভোরে সেখানে হাজির হলেন। দরজায় প্রহরী হিসেবে পেলেন ব্রাহ্মণ হরিশ ভট্টের সেই ভৃত্যকে, তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো বইচড়াপাড়ার পথে এই চোখজোড়ার অধিকারী ভৃত্যটিকেই তিনি দেখেছেন। তার পাশ দিয়ে ছুটে গিয়েছিল।
ব্রাহ্মণ হরিশ ভট্টকে নিয়ে মনে সন্দেহ গাঢ় হলো বাঁকাউল্লার। হরিশের মুখোমুখি হলেন। হরিশ জানালেন তার চন্দ্রনাথ যাওয়া হয়নি; এখানে এক আত্মীয়ের সাথে সাক্ষাৎ ঘটেছে, তবে গাড়ি প্রস্তুত, আজই রওনা হচ্ছেন চন্দ্রনাথের পথে।
নিবিড় পর্যবেক্ষণে গোয়েন্দা বাঁকাউল্লা দারোগার মনে হলো, ব্রাহ্মণ হস্তহীন নন, হস্তধারী, তার দুহাতই আছে। কৌশলে এক হাত লুকোনো।
দাওয়ায় বসে বাঁকাউল্লা যখন হরিশের সাথে কথা বলছিলেন, তখনি একটা ঘটনা ঘটল: হাত ফসকে ভৃত্যের হাত থেকে বাক্স পড়ে গেলে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল নকল দাড়ি-গোঁফ, পরচুলা, রংতুলি; এ যেন বহুরূপীর এক ঝাঁপি! ব্রাহ্মণ বললেন, এসব দেশ ভ্রমণের সময় রাখতে হয়। সঠিক পরিচয়ে অনেক সময় থাকার জায়গাও মেলে না। দেশাচার বুঝে বেশ ধারণ করতে হয়।
পরদিন সকালেই শুনলেন কাছাকাছি এক বাড়িতে একটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বাঁকাউল্লা দেখতে গেলেন, কম বয়সী একটি মেয়ে খুন হয়েছে। বছর উনিশ বয়স হবে। শশিমুখী নাম, পনেরো বছর বয়স থেকে বিধবা। থানা তল্লাশির পর শশিমুখীর ঘর হতে একটি প্রেমপত্র উদ্ধার হলো; চিঠির ইতিতে লেখা তোমারই ভানু।
পুলিশের তদন্তে বেরোল শান্তিপুরে ভানু নামের কেউ নেই, একজন এই নামের গোয়ালা আছে নিরক্ষর, তার পক্ষে প্রেমপত্র লেখার প্রশ্নই আসে না।
ভানুর সন্ধান মিলল না। জানা গেল শশিমুখী নবদ্বীপের সেই বিধুমুখীর আপন ছোট বোন।
একজন প্রতিবেশী জানালেন, রাতে দুই প্রহর পেরোবার পর তিনি যখন পাশা খেলে বাড়ি ফিরছিলেন, আগাগোড়া কাপড়ে ঢাকা, মাথায় পাগড়ি এমন একজনকে ছুটে যেতে দেখেছেন, তার বড় বড় চোখ, বড় মাপের জোয়ান।
গোয়েন্দা দারোগা বাঁকাউল্লা ততক্ষণে জেনে গেছেন ব্রাহ্মণ হরিশ ভট্ট, গরুর গাড়িতে কালনা চলে গেছেন। বাঁকাউল্লা গাড়োয়ানের বাড়িতে হাজির হলেন; শুনলেন এই গাড়োয়ান মাত্র কালনা থেকে ফিরে এসেছে। কাজেই গরুকে বিশ্রাম না দিয়ে আর যাওয়া সম্ভব নয়, তবে খুব জরুরি হলে তার ভিন্ন এক জোড়া বলদ রয়েছে, সেটা গাড়িতে জুড়ে যাওয়া যাবে। দুই টাকা ভাড়া সাব্যস্ত করে কালনার পথে গরুর গাড়িতে চাপলেন বাঁকাউল্লা। গাড়িতে হঠাৎ চোখে পড়ল কালো একটা কিছু, টেনে বের করে দেখলেন ছদ্মবেশ ধরার নকল দাড়ি।
গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাাঁকাউল্লা জানালেন, গতরাতে গুপ্তিপাড়ার বাগানে যাত্রাবিরতির জন্য থেমেছিল। ওখানে তারা জলযোগ করে নিদ্রা যান। শেষ রাতে ব্রাহ্মণই তাকে ডেকে তুলে আবার যাত্রা করেন। গাড়োয়ান জানায়, যাত্রার সময় বাবুর ভৃত্যের দাড়ি ছিল, কালনায় নামার পর দাড়ি তার চোখে পড়েনি।
কালনায় রাত্রিবাসের সময় মূত্রপাতের জন্য বেরোলে হঠাৎ বাকাউল্লার চোখে পলে সম্পূর্ণ কাপড়ে মোড়া একজন লোক দ্রুতগতিতে চলে যাচ্ছে। তাকে অনুসরণ করছেন, এটা বোঝার পর লোকটি থেমে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছুট দিল, কিন্তু লোকটিকে পরিষ্কার চিনলেন বাঁকাউল্ল। ব্রাহ্মণের সেই পাহাড়ি ভৃত্য। ছুটে গিয়ে বিশালদেহী ভৃত্যকে জাপটে ধরলেও ধরে রাখতে পারলেন না বাঁকাউল্লা। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পশ্চিম দিকে ছুটল। তারপর সামনের এক বুড়ো শিবমন্দিরের কাছে এসে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বাঁকাউল্লা যখন ভৃত্যকে শিবতলায় খুঁজছেন, উত্তরপাড়ায় তখন রব উঠেছে দুর্গাদাস বাড়ুয্যের পুত্রবধূ খুন হয়েছে। তিনি চৌকিদারকে আদেশ করলেন, থানার দারোগাকে বলো সুরতহালের কাজ রেখে এদিকে আসতে, খুনি এখানেই আছে।
অল্প সময়ের মধ্যেই দারোগা বাঁকাউল্লা, বক্সী কনস্টেবল, চৌকিদারসহ লোকজনে বুড়ো শিবতলা ভরে গেল, চিরুনি অভিযানে একটি ভাঙা মন্দিরে লুকোনো ব্রাহ্মণ ও তার ভৃত্য ধরা পড়ল এবং গ্রেপ্তার হলো।
গোয়েন্দা দারোগা বাঁকাউল্লা খুন হওয়া তিন নারীর মৃত্যুর সাথে হাতকাটা হরিশ ও তার ভৃত্য জড়িত অনুমান করলেন। অনুসন্ধান করে জানলেন এখানকার দুর্গাদাস বাড়ুজ্জে, শান্তিপুরের বিশ^রূপ মুখার্জি আর নবদ্বীপের রামতারকা হরিশ ভট্টচার্যের বেয়াই।
রামতারকের চার মেয়ে: বিধুমুখী সবার বড়, বাবার বেশি আদরের, শ^শুরবাড়িতে থাকত না; শশিমুখী বিশ^রূপের পুত্র রামরুপের স্ত্রী, রামরূপ রানী ভবানীর চাকুরে প্রজাবিদ্রোহের সময় নিহত, সুধামুখী দুর্গাদাসের মধ্যম পুত্রবধু; সোনামুখীর বিয়ে হয়নি।
থানার কার্যক্রম শুরু হবার আগে গোয়েন্দা দারোগা বাঁকাউল্লা যখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন, ব্রাহ্মণ হরিশ ভট্ট স্বীকার করে নিলেন তিনি চারটি খুন করেছেন। তার পরিকল্পনা ছিল চতুর্থ খুনের পর আত্মহত্যা করা, এখন আর উপায় নেই, শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে।
কিন্তু চারটি খুন কেন করেন?
হরিশ ভট্টা বললেন, প্রজাবিদ্রোহ ছিল বলে আসল সত্যটা কেউ জানেনি, আমিই শশীর স্বামী রামরূপকে হত্যা করেছি।
কিন্তু কিসের জন্য হত্যাকাণ্ড?
হরিশ ভট্ট রামতারকের আশ্রয়প্রাপ্ত কর্মচারী, বিনিময়ে খোরাক-পোশাক মিলত। তার মেয়ে শশীর সাথে তার প্রেম হয়ে যাওয়া এবং তার বিয়ে করতে চাওয়া রামতারক মেনে নিতে না পেরে তাকে বের করে দেয়। একসময় শশিমুখীর বিয়ে হয়ে যায়। মেয়েদের জন্য গর্বিত রামতারককে জনমের শিক্ষা দিতে হরিশ ভট্ট তার মেয়েদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং শশিমুখীর স্বামীকেও।
গোয়েন্দা দারোগা বাঁকাউল্লা বললেন, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি তিনটি খুনই করেছে তোমার ভৃত্য।
হরিশ বলল, সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। সে বিশ^স্ত ভৃত্য, বিশ^াসীর কাজ করেছে, আমি বিশ^াসঘাতক হব কেন? সে নির্দোষ।
'খুন করিয়াছে পাহাড়ি, হরিশ নিজেই সেই দোষ আপন স্কন্ধে লইতেছে। বিবেচনা করিয়া দেখিলাম সেই ভাল। হাকিমের সম্মুখেও হরিশ আত্মদোষ স্বীকার করল। পাহাড়ি কেবল সহকারিতাকরণ অপরাধে অপরাধী হইল।'
বাঁকাউল্লা প্রথম চাকরির প্রথম অনুসন্ধানে কৃতকার্য হয়ে সুখ্যাতি অর্জন করলেন, পুরস্কার পেলেন, তার উৎসাহ প্রবল হয়ে উঠল।
বাঁকাউল্লা দারোগা পদটি সম্পর্কে লিখেছেন: মানে সম্ভ্রমে বা ক্ষমতা প্রতিপত্তিতে এ পদটি যে অদ্বিতীয়, তাহা দেশের বালবাচ্চা সকলেই জানে; পয়সাও প্রচুর। ঘুষ-ঘাসের একটা সত্য মিথ্যাময় অপবাদ পুলিশের চরিত্রে চিরদিনই আছে সত্য, তথাপি সৎ পথেও পয়সার অভাব ছিল না।
বড় হলে দারোগা হবার আশীর্বাদ এ দেশের মুরব্বিরাই করতেন। বাঁকাউল্লা দারোগা হয়েছেন, লেখকও।