জিম করবেট ও পচাব্দী গাজী হওয়ার দিন শেষ
দিন বদলে গেছে। বাঘ শিকার দূরে থাক, কোথাও বসে হরিণ শিকারের চাপাবাজিও করতে থাকেন, নিশ্চিত থাকুন আপনি বেআইনি কাজ করছেন। প্রাণী সুরক্ষা আইন ও প্রাণীর প্রতি নির্মমতা আইনে আপনি মামলার আসামি হতে যাচ্ছেন। তবে আপনার দাদা কবে বাঘ শিকার করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, জিম করবেট কটা মানুষখেকো মেরেছেন, বা এ দেশের পচাব্দী গাজী হবার সুযোগ আর নেই। দু-একটা বুলেট ছোড়ার পর নির্ঘাত কারাবাস। মানুষ খুন করে পার পাবার সুযোগ থাকলেও প্রাণী শিকার করে নিরুপদ্রব জীবনযাপনের কোনো উপায় নেই।
পচাব্দী গাজীর দাদা ইসমাইল গাজী এবং বাবা মেহের গাজী দুজন সাহসী শিকারিই বাঘের থাবায় মৃত্যুবরণ করেছেন। পচাব্দী গাজী (১৯২৪-১৯৯৭) বাঘিনীর ডাক নকল করে মিলনোন্মুখ বাঘকে সাদরেই আমন্ত্রণ জানাতেন, তারপর গুলি করে মারতেন। তার শেষ ও ৫৭তম শিকার ১২ ফুট দীর্ঘ তালপট্টির ভয়ংকর বাঘ। তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের শিকার-সঙ্গী হয়েছিলেন।
জিম করবেট (১৮৭৫-১৯৫৫) ভারতের নৈনিতালে আরণ্যক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষখেকো বাঘ মারার রেকর্ড তারই। শিকার সাহিত্যে অসামান্য অবদান তার। জিম করবেট লিখেছেন :
'পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একজন তরুণী প্রিন্সেস শিকারের উদ্দেশ্যে একদিন গাছে উঠলেন এবং বললেন এটা তার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পরদিন তিনি যখন গাছ থেকে নামলেন, তখন কুইন-ঈশ^র তার সহায় হন।' তারিখটা ছিল ৫-৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, প্রিন্সেস এলিজাবেথ জিম করবেটের ট্রি-টপ মাচানে উঠলেন, খবর এল তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা গেছেন। সুতরাং তিনিই তার স্থলাভিষিক্ত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ৭০ বছর ধরে তিনি সিংহাসন আঁকড়ে আছেন।
কী সর্বনাশ! ১৬১৭ সালে এক বছরেই সম্রাট জাহাঙ্গীর ৮৭টি বাঘ শিকার করেছিলেন। বাঘ এখন দুর্লভ বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী।
মৃগনাভি বনাম ভায়াগ্রা
৯৩ শতকের শেষ দিকে যখন ম্রিয়মান পুরুষের পৌরুষ জাগিয়ে তুলতে ওষুধ সাম্রাজ্যবাদী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইসন্স ভায়াগ্রা ট্যাবলেট বাজারজাত করল, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তখনকার মহাপরিচালক ক্লদ মার্টিন ওষুধটিকে স্বাগত জানালেন। এই ওষুধের এত ভিআইপি সমাদর থাকতে ক্লদ মার্টিন কি সেধে তার পৌরুষ-ঘাটতির কথা জানিয়ে দিলেন? ঠিক তা নয়, তিনি স্বাগত জানিয়েছেন বাঘ, রাইনো কোবরাসহ বিভিন্ন বুনো প্রাণীর মঙ্গল সম্ভাবনা বেড়ে যাবে এই ভরসায়। যৌনশক্তির ঘাটতি যদি সিলডেনফিল সাইট্রেট নামের ভায়াগ্রা ব্র্যান্ডের ট্যাবলেট মেটাতে পারে, তাহলে আফ্রোডিয়াসকে সরবরাহকারী প্রাণী শিকারির হাত থেকে অনেকটাই রেহাই পাবে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়:
ভিয়েতনামের হাইপং বন্দরের বিশেষ খাবার ঘর থ্রং কাচে ভিয়েতনামের অভিজাতরা তো আসেনই, বিত্তবান পর্যটকেরাও এখানে ভিড় জমান। এখানে একটি বিশেষ ধরনের সুরা রেস্তোরাঁর মেন্যু আলোকিত করে রেখেছে। কুকুর ও হরিণের প্রজনন অঙ্গ কেটে সাপের মাংসের সাথে মেশানো হয়। তারপর গাজানো ভাতের সাথে মিশিয়ে সুঘ্রাণ মসলা দিয়ে ধন্বন্তরি সুরা তৈরি করা হয়। সাথে দেওয়া হয় লিজার্ড সস, টিকটিকির চাটনি এবং ডেজার্চ হিসেবে ছাগলের রক্তের পুডিং।
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে পৌরুষ জাগিয়ে তোলার স্যুপ বিক্রি হতো, প্রতি বাটি পাঁচ শ ডলার। দাম বেশি হবারই কথা। এতে ব্যবহার করা হয় মালয়ান ভালুকের থাবা এবং এশীয় পুরুষ বাঘের প্রজনন অঙ্গ। জাভার রাইনোসোরাসের শিংয়ের চাহিদা পৃথিবীর সর্বত্র। এই প্রাণীর শিংয়ের গুঁড়ার পেস্ট দিয়ে বানানো ট্যাবলেট উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে যাবে। বিশ্লেষকেরা তখন বলেছেন, ভায়াগ্রা সর্বত্র পৌঁছে গেলে রাইনো, ভালুক, বাঘ, কোবরা, হরিণ প্রভৃতি প্রাণী কম হলেও রেহাই পাবে। হরিণের নাভি মৃগনাভি বহুল কাঙ্খিত।
সুতরাং ভায়াগ্রাকে সহজলভ্য করলে ভোক্তার সন্তুষ্ট অর্জন করতে ব্যবসায়ীদের আর শিকারির পেছন পেছন ছোটার দরকার হবে না।
বাঘ মেরে খান বাহাদুর
মৃত বাঘের পাশে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সেই ছবির গুণে নাকি কোনো এক জোতদার খান বাহাদুর খেতাবও পেয়েছিলেন। বাঘটা অবশ্য তিনি মারেননি।
বাঘ শিকারের কৃতিত্বগাথা খুব দ্রুত ছড়িয়ে যেত। আমার মাঠপর্যায়ে চাকরিকালে বন্দুকের লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টিও দেখতে হতো। ভাঙারির দোকানও প্রত্যাখ্যান করতে পারে এমন একটি বন্দুকের লাইসেন্স নবায়ন করতে এলেন এক বৃদ্ধ।
আমি বললাম, এটা সারেন্ডার করুন। রিনিউ করতে যে খরচ হচ্ছে, বেচেও তা পাবেন না। তিনি হেসে বললেন, এটা পিতার নির্দেশ। পিতা ছিলেন নায়েব। শখের বশেই বন্দুক কিনেছিলেন। গ্রামে একটি বাঘের উৎপাত শুরু হওয়ায় তিনি বন্দুকটা কাজে লাগালেন। গুলিবিদ্ধ বুড়ো বাঘ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলে উৎসাহী যুবকেরা পিটিয়ে মেরে ফেলে।
বাঘ মারার খবর ইংরেজ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কানেও পৌঁছে। তিনি নায়েবকে তার সাহসী কাজের জন্য প্রশংসা করে মালখানা থেকে একটি বন্দুক এনে উপহার দেন।
প্রায় ষাট বছর এটি নিজের হেফাজতে রাখার পর (ব্যবহার করার আর সুযোগ পাননি) মৃত্যুর আগে ইংরেজ ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের স্মৃতি ধরে রাখতে এটি পুত্রের হাতে হস্তান্তর করেন।
১৯৭১ সালেই অকেজো বন্দুকটি একটি পুকুরে ডুবিয়ে দেন। বাহাত্তরে অনুসন্ধান করেও পুকুর থেকে উদ্ধার করতে পারেননি। তবে তিয়াত্তরে পুকুরে খননকাজ চালাবার সময় এটি উদ্ধার হয়।
১৯৮৪ সালে আমি লাইসেন্স নবায়নপত্রে সম্ভবত শেষ সই দিই, কারণ, শিকারির বৃদ্ধ পুত্র বললেন, এত দূর পথ পেরিয়ে ডিসি অফিস পর্যন্ত আর হয়তো আসতেও পারব না।
একালের বন্য প্রাণী প্রেমিক ও পরিবেশবাদীদের মনে খটকা লাগারই কথা, যদি বলি বন্য প্রাণী নিধনের জন্য সরকার-নির্ধারিত পুরস্কার ধার্য ছিল। শতবর্ষ আগের পরিস্থিতি তুলে ধরছি।
১৯১৫ সালের বাংলায় বন্য প্রাণী নিধনের রেকর্ড ভালো নয়—২৭৬৯টি, আগের বছরের চেয়ে কম। তবে বাঘ ও চিতার বেলায়, যথেষ্ট সাফল্য রয়েছে। ১৯১৪ সালে বাঘ মারা হয়েছে ২০৫টি আর চিতা ৪৩৯টি। এতে ১৯১৫ সালে নিহত বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৫টি আর চিতা ৪৯৬টি।
বন্য প্রাণী শিকারের পুরস্কার
১৯১৪ সালে বন্য প্রাণী হত্যার জন্য ১৭৪৭৭ টাকা ২ আনা এবং সাপ মারার জন্য ১৫৭ টাকা সাড়ে ৫ আনা পুরস্কারের অর্থ বাবদ ব্যয় হয়েছে। ১৯১৫ সালে পুরস্কারে অর্থ বন্য প্রাণীর জন্য ১৭৯৭৭ টাকা ১২ আনা এবং সাপের জন্য ১৭৮ টাকা ১৩ আনা। তারপর বন্য প্রাণীর সংখ্যা যেমন কমতে থাকে, পুরস্কারের অর্থও তেমনি কমে আসে। এ তো গেল মানুষের হাতে প্রাণী হত্যা, এবার প্রাণীর হাতে মানুষ হত্যার হিসাবটাও দেখা দরকার।
১৯১৪ সালে বন্য প্রাণীর হাতে নিহত হয় ৩৪২ জন, তাদের মধ্যে ১২৮ জনের ভাগ্য নির্ধারিত হয় হাতি, বাঘ, ভালুক ও একটি চিতার হাতে। ১৯১৫ সালে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৩; হাতি, বাঘ, ভালুক ও চিতার হাতে প্রাণ যায় ২০৫ জনের।
সাপের কামড়ে মৃত্যুর হিসাবটি আলাদা
১৯৯৬ সালে বন্য প্রাণীর হাতে মৃত্যু ঘটে ৩৬৭ জনের আর সাপের কামড়ে ৪১১৪ জন। ১৯১৭ সালে বন্য প্রাণী কেড়ে নেয় ৩৪১ জনের প্রাণ আর সাপের কামড়ে ৪১১৪ জন। ১৯১৭ সালে বন্য প্রাণী কেড়ে নেয় ৩৪১ জনের প্রাণ আর সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় ৪৩৯৩ জনের।
সফল তরুণ বন্য প্রাণী শিকারিদের পুরস্কারের বাইরেও বন বিভাগের আওতায় বিভিন্ন রেঞ্জে বনপ্রহরী পদে চাকরি পাবার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে উঠত।
শিকার সভ্যতার আকর, ইতিহাসের অনিবার্য অংশ
প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগে প্রাচীন মানুষ ক্ষুধা নিবারণের জন্য শিকারে নামে, তখন থেকেই দীর্ঘ প্রলম্বিত শিকার জমানা মানবসভ্যতার অনিবার্য অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বিশদ পরীক্ষার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন শিকারলব্ধ মাংস খাওয়া অভিব্যক্তিবাদে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে—যেমন মানুষের মেরুদণ্ড বড় হয়েছে।
ধ্রুপদি ও রেনেসাঁকালে যেমন শিকার করার জন্য মানুষ অস্ত্র হাতে প্রাণীর পেছনে ছুটত, প্রাথমিক যুগে প্রক্রিয়াটি তেমন ছিল না। মানুষ গাছে উঠে অপেক্ষা করত এবং গাছের নিচ দিয়ে আসা-যাওয়া করা প্রাণী বধ করত। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্রই শিকারের প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠে তির-ধনুক। ব্লোপাইপ এবং ব্লোগান সেকালের মারাত্মক অস্ত্র। অস্ট্রেলিয়ানরা শিকারের জন্য বুমেরাং ব্যবহার করত।
প্রাচীনকালে শিকারে একধরনের নৈতিকতা রক্ষা করা হতো, সেই সাথে আজকের যে সাসটেইনেবিলিটি বা টেকসই রাখার দর্শন, তা-ও অনুসরণ করা হতো। যেমন তাদের শিকারের আওতায় কোনো শিশু বা তরুণ জন্ত এসে পড়লে তাকে হত্যা না করে তাড়িয়ে দিত। পূর্ণবয়স্ক প্রাণী শিকার করত। বৃদ্ধ প্রাণীর প্রতি তারা সদয় ছিল, শিশুটির মতো তাকে ছেড়ে দিত।
১১ হাজার বছর আগে যখন কৃষিযুগের সূচনা হলো, শিকারের গুরুত্ব কমে আসতে থাকল, শিকারিরা খাদ্যশস্য উৎপাদনকে গুরুত্ব দিতে শুরু করল। কার্যত তারা তাদের পেশাটাই ছেড়ে দিল। তবে দক্ষিণ আমেরিকার রেইনফরেস্ট কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলে এখনো সুষ্ঠু চাষাবাদ করা সম্ভব নয় বলে সেখানকার শিকারি জনগোষ্ঠী রয়েই গেছে।
নব্যপ্রস্তর যুগে শিকারসহায়ক প্রাণী হিসেবে কুকুরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সূচনায় শিকার সহায়তার জন্য ঘোড়া পালন শুরু হয়। প্রাচীন মিসরে শিকারিরা একটি বিশিষ্ট ভিন্ন সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত ছিল, তারা সেখানকার নোবলম্যান ও অভিজাতদের জন্য শিকার করত, নিজেদের জন্যও করত। সম্ভবত মিসরেই শিকারের জন্য প্রথম কুকুরের ব্যবহার শুরু হয়।
শিকারও খেলা
মধ্যযুগে শিকার ধনী সম্প্রদায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবে বিবেচিত হতো। শিকারের জন্য ধনীদের নিজস্ব মালাকানাধীন অরণ্য ছিল। শিকারের একটি প্রক্রিয়া ছিল প্রাণীটিকে তাড়া করে একটি আবদ্ধ পরিসরে ঢুকিয়ে স্বল্প আয়েশে হত্যা করা। অন্য দিকে ইউরোপিয়ান বেশ কিছু গোত্র ও ক্রীতদাস সম্প্রদায়ের জন্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল, তারা অস্ত্র হাতে নেবার অনুমতি পেত না।
১৬ শতকে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে শিকার শুরু হয়। ১৫১৫ সালে ফরাসি সরকার চাষিদের জন্য শিকার ও প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করে দেয়। যদি কোনো নোবলম্যানের আরণ্যে কোনো চাষি শিকার করতে গিয়ে ধরা পড়ত, তাহলে কুকুর দিয়ে তাড়া করে হত্যা করা হতো।
শিকারে দক্ষতা প্রদর্শন রাজার জন্য পায় অনিবার্যই ছিল। রাজা তার রাজ্যের অভিজাত ও নোবলম্যানদের এটা দেখাতেন। কাজটা সহজ করার জন্য রাজাকে অরণ্যে ছুটোছুটি করতে না পাঠিয়ে শিকারের জন্তু তার কাছে আনা হতো; তিনি নিরাপদ দূরত্বে থেকে গুলি করে হত্যা করতেন এবং প্রচুর প্রশংসা পেতেন।
রানি প্রথম এলিজাবেথ বাজপাখি শিকারে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। একটি প্রশিক্ষিত বাজপাখি প্রকৃতপক্ষে রানির নির্দেশে শিকারকে আক্রমণ করত।
রাজকীয় ভোজে বন্য শূকর ছিল অন্যতম খাবার। অনেক সময় রাজা নিজেই শূকর বধ করতেন।
ফরাসি বিপ্লব পৃথিবীতে পরিবর্তন এনেছে, এরপরই হঠাৎ মানুষ শিকলমুক্ত হয়ে পড়ায় নিজেরাই শিকারি হয়ে ওঠে এবং প্রাণিজগৎ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। শেয়াল শিকার অভিজাতদের খেলায় পরিণত হয়। নেকড়ে হত্যার ব্যাপারে কোনো বাধা ছিল না। যে যেভাবে পারে শিকার করতে পারত।
অতিরিক্ত শিকারের কারণে ১৭৭০-এর পর থেকে নেকড়ে নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। ইউরোপে শিকারের জন্য ডাবল ব্যারেল বন্দুকের চেয়ে মারাত্মক কোনো অস্ত্র ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না।
আফ্রিকায় সিংহ শিকারের পুরস্কার শ্রেষ্ঠ ট্রফি, দ্বিতীয় স্থানে চিতাবাঘ। বয়স ৬৫ বছর হয়ে গেলে খেলা হিসেবে শিকারে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না।
আনন্দের শিকার—মানবাধিকার অস্বীকার
প্রাণীর প্রতি নির্মমতার বিষয়টি না হয় উত্থাপিত না-ই হলো। তখন বাইসনের সংখ্যা এমনিতেই দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
১৮০০ শতকে সভ্য আমেরিকার শিকারিরা বাইসন হত্যা করতে শুরু করে। আনন্দের জন্য নয়, ট্রফির জন্যও নয়। রেড ইন্ডিয়ানরা যাতে তাদের আবশ্যকীয় বাইসনের মাংসের সরবরাহ পেতে না পারে, সে জন্য তারা দল বেঁধে নেমে বাইসন হত্যা করত।
বিশেষ করে ট্রেন চলাচল শুরু হবার পর চলন্ত ট্রেন থেকে গুলি চালাত। মৃত বাইসনের কাছে কাউকে আসতে দিত না, এলেই গুলি। বাইসনের মাংস পচানো হতো যেন ইন্ডিয়ানরা খেতে না পারে।
নাৎসিদের বিস্ময়জাগানো প্রাণিপ্রেম
সভ্যতার ইতিহাসে যে কটা বড় সরকার অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণিবান্ধব ছিল জার্মান নাৎসিরা। তারা অ্যানিম্যাল রাইটস নিয়ে কেবল কথা বলেনি, আইনানুগভাবে বাস্তবায়ন করেছে। শিকার ও প্রাণীর প্রতি অন্য ধরনের সকল নির্মমতা নিষিদ্ধ করেছে।
নাৎসিরাই প্রথম ঘোড়াকে লোহার জুতা পরানো নিষিদ্ধ করে। পৃথিবীতে তারাই প্রথম যেকোনো গবেষণাগারে জীবিত প্রাণীর দেহ ব্যবচ্ছেদ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। জার্মান নাৎসিদের এই প্রাণী-পছন্দ আচরণের প্রধান উৎসাহদাতা গোয়েরিং। তিনি ছিলেন একজন ঘোষিত অ্যানিম্যাল লাভার।
শিকারি মানেই প্রাণীর শত্রু নয়
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ছিলেন উঁচুমানের শিকারি। তার হাতেই গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফরেস্ট এবং ২৩০ মিলিয়ন একর সংরক্ষিত বনভূমি, যা বন্য প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়।
শিকারের জন্য ট্রফি—ট্রফি হান্টিং
বড় শিকারের জন্য ট্রফি পুরস্কার চালু হয় ইংরেজদের হাতে। তারা যত উপনিবেশ সৃষ্টি করেছে, তার বনাঞ্চল তছনছ করে ফেলেছে। শিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ট্রফি হান্টিং—ট্রফি শিকার।
ট্রফির জন্য প্রতিবছর গড়ে ১ লক্ষ ২৫ হাজারের বেশি প্রাণী হত্যা করা হয়। ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১০ বছরে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ১২ লক্ষ ৬০ হাজার ট্রফি আমদানি করা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১৭ এই দশ বছরে আফ্রিকান হাতি শিকারের জন্য ৪০ হাজার, চিতাবাঘের জন্য ৮ হাজার এবং আফ্রিকান সিংহের জন্য ১৪ হাজার ট্রফি রপ্তানি করা হয়।
ট্রফি হান্টাররা বিগ ফাইভ নির্ধারণ করেছিল: সিংহ, বাঘ, রাইনো, হাতি এবং কেইপ বাফেলো। এর সবই আফ্রিকার জন্য। ট্রফি-শিকারিদের শীর্ষে একসময় ব্রিটেনই ছিল, পরে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে ট্রফির লোভে নয় শিকারের প্রয়োজনে মেক্সিকোর আদিবাসীরা যেভাবে প্রাণী ধরত: শিকারের জন্তুটি শনাক্ত করার পর এর পেছনে ছুটতে থাকে তারা, তির-ধনুক ব্যবহার না করে, গুলি না করে, লাঠিপেটাও না, শুধু তাড়া করে দীর্ঘ পথ ছোটার পর জন্তুটি ক্লান্ত ও অবসন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করত। এটাই ছিল তাদের শিকারের পন্থা।
চম্পাবতের বাঘিনী
টাইগ্রেস চম্পাবতীর রেকর্ড ৪৩৬ জন মানুষ হত্যা। তারপর যখন দলবদ্ধভাবে অভিযান চালিয়ে চম্পাবতীকে হত্যা করা হয়, দেখা যায় এর পেছন দন্ত ভাঙা। ফলে এই বাঘিনী তার স্বাভাবিক শিকার করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়।
পেশাদার শিকারি ও লেখক পিটার বার্নি লিখেছেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বেঙ্গল টাইগার বংশোদ্ভূত এই বাঘিনী পশ্চিম নেপালের রুপাল গ্রামে প্রথম আক্রমণ চালায়। তাকে বধ করার জন্য শিকারিদের পাঠানো হয়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। বাঘিনীর উৎপাত অব্যাহত থাকে।
তারপর এই হিংস্র বাঘিনীকে হত্যা করার জন্য নেপালি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সুসংগঠিতভাবে সৈন্যরা বনের চারপাশে ঢোলশহরৎ করতে থাকে যাতে বাঘিনী পালানোর পথ না পায়। তারা সশস্ত্র হলেও বাঘিনীর টিকিটির নাগালও পায়নি, নেপাল ছেড়ে চলে আসে ভারতের কুমায়ুন জেলার অরণ্যে। এখানে শুরু হয় তার হত্যাযজ্ঞ।
বাঘিনীর সন্ত্রাস মানুষকে ত্রস্ত করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ১৯০৭ সালে ভারতে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ শিকারি জিম করবেট তাকে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেন।
সর্বশেষ ১৬ বছর বয়সী এক তরুণীকে হত্যা করার পর বনের অভ্যন্তরে ঢুকে যায় চম্পাবতী। তার পদচিহ্ন ধরে ধরে জিম করবেটও এগোতে থাকেন। তাকে সহায়তা করেন একজন তহসিলদার আর ৩০০ গ্রামবাসীর একটি দল। তারা বন ঘিরে টিন পেটাল।
দুপুরের দিকে জিম করবেট বাঘিনীকে পেয়ে যান। প্রথম গুলি বুকে ও কাঁধে লাগে, আরও গুলি করেন, শেষ গুলিটি করেন তহসিলদারের বন্দুক দিয়ে, যখন আহত বাঘিনী তার দিকে ছুটে আসছিল। গুলি বাঘিনীর পায়ে লাগে এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়।
৪৩৬টি প্রাণনাশের পর গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ড তাকেই সাফল্যের শিরোপা দেয়। জিম করবেট তার কাহিনি লিখে গেছেন 'মেনইটার্স অব কুমায়ুন' গ্রন্থে।