শিয়ালের খোঁজে...
বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের মাথার সিঁদুরের আকৃতির লম্বা চরাঞ্চল, পাশে গ্রাম, নাম চরসিন্দুর। গ্রামের মানুষদের কেউ সন্ধ্যার পর একা চরে যায় না। কারণ, সূর্য অস্ত যাওয়ার পরপরই এই চরাঞ্চল পরিণত হয় শিয়ালের রাজ্যে। একা কোনো মানুষকে পেলে ভয় পাওয়ার বদলে ওরা তেড়ে আসে। রীতিমতো ইঁদুর-বিড়াল খেলা শুরু করে দেয় মানুষকে নিয়ে। আমি নিজে একবার নদী থেকে মাছ ধরে ফেরার সময় ওদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলাম। যখনই বুঝল আমি একা, তখনই ওদের সাহস বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে চারদিক থেকে আমায় ঘিরে ধরল। কেউ কেউ একবার সামনে আসে আবার পেছনে যায়। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে বিষয়টা লক্ষ করছিলাম, একইভাবে ভয়ও পাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম, পাশে একটি শসাখেত। তাতে বাঁশের বেড়া। আমি অকস্মাৎ খুব শব্দ করে চিৎকার দিয়ে উঠলাম, সাথে সাথে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে বেড়া থেকে একটা খাটো বাঁশ তুলে নিলাম হাতে। আর তখনই শিয়ালের পাল রণে ভঙ্গ দিল।
সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে শিয়ালের পাল। হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া শব্দে মাতিয়ে তোলে চরের বুক। এরপর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কেউ কেউ চলে যায় গ্রামের দিকে, আবার কেউ ঘুরে বেড়ায় চরের বুকে। ওদের খাওয়ার কোনো বাছবিচার নেই। মাছ, মুরগি, কাঁকড়া, ইঁদুর, গাব কিংবা কাঁঠাল—কোনোটাতেই এদের অরুচি নেই।
রাতের আঁধারে চরে ঘুরে বেড়ানো শিয়ালেরা কাঁকড়া শিকার করে এক অদ্ভুত কৌশলে। নদীর ধারে থাকা কাঁকড়ার গর্ত খুঁজে বের করে এর ভেতর ঢুকে বসে থাকে। কাঁকড়া লোমশ লেজটাকে শত্রু মনে করে ছিপকাঠির মতো শক্ত হাত দিয়ে চেপে ধরে। আর ঠিক তখনই শিয়াল তার লেজটাকে দ্রুত কাঁকড়াসহ গর্ত থেকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে। তারপর লেজ ঝাঁকিয়ে ওটাকে মাটিতে ফেলে মজা করে খায়।
ধূসর রঙের এই প্রাণীগুলোর আকৃতি কুকুরের মতো। দেখতেও অনেকটা কুকুরের মতোই। কিন্তু অবাক বিষয় এই, কুকুরছানা শিয়ালের অতি প্রিয় খাদ্য। এক বিশেষ উপায়ে এরা কুকুরছানা শিকার করে থাকে। প্রথমে বাচ্চাসহ কুকুরের অবস্থান ঘিরে ফেলে। কুকুর এমনিতেই শিয়াল দেখতে পারে না। আর বাচ্চার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা মা কুকুরের নাকে ঘিরে থাকা শিয়ালের গন্ধ লাগার সঙ্গে সঙ্গে খেপে গিয়ে সে আক্রমণ করে বসে। আর এই সুযোগটাই নেয় ধূর্ত শিয়ালের পাল। কুকুরটা দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে শিয়ালদের লক্ষ্য করে। একবার সে যায় শিয়ালদের দিকে, আবার ফিরে আসে বাচ্চাদের কাছে। একদিকের শিয়ালদের ধাওয়া দিলে অন্যদিকের শিয়াল এসে একটা বাচ্চা নিয়ে যায়। এভাবে কুকুরীকে ওরা এক গোলকধাঁধায় ফেলে একের পর এক বাচ্চা ধরে নিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে কুকুরটি একসময় দৌড়ে এসে দেখে একটি বাচ্চাও আর অবশিষ্ট নেই। তখন কুঁই-কুঁই শব্দে তার সে কী কান্না!
গ্রামের লোকে বলে, 'শিয়ালের সাত ছালা (থলে) বুদ্ধি।' আসলে কি তা-ই? চরের শিয়ালগুলো একবার চাক্ষুষ প্রমাণ দিল এই কথার। গনি মিয়া একদিন তার ছাগলটাকে পাটখেতের পাশের চারণভূমিতে খুঁটি পুঁতে রেখে একটু দূরে বেগুনখেতে নিড়ানি দিতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একদল শিয়াল পাটখেত থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। দলপতি শিয়ালটা সোজা এগিয়ে এসে মাটিতে পুঁতে রাখা বাঁশের খুঁটিটা কামড়ে তুলে ফেলল। তারপর সেটা মুখে নিয়ে ছাগলের গলার রশি ধরে টানতে শুরু করল নির্জন পাটখেতের দিকে। অন্য শিয়ালগুলো পেছন থেকে ধাওয়া দিতে লাগল ছাগলটাকে। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ম্যা ম্যা করে চিৎকার করে উঠল বিপদগ্রস্ত প্রাণীটা। গনি মিয়া ছুটে এসে এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে চমকে উঠলেন। শিয়ালদের তাড়িয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ছাগলটাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন।
আরেকবার গ্রামের সেলিম ভুঁইয়া চরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা খালের পাড়ের গর্ত থেকে একটা শিয়ালের বাচ্চা ধরে নিয়ে আসে। বহুদিন ধরে একটা শিয়ালের বাচ্চা পোষার শখ তার। সেই রাতে বাচ্চাটা খাঁচায় ভরে চৌকির নিচে রেখে ঘুমিয়ে ছিল যুবক। বাচ্চাটা মায়ের জন্য ক্রমাগত কেঁও-কেঁও শব্দে ডেকে চলেছিল। গভীর রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় শিয়ালের সম্মিলিত চিৎকারের শব্দে। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকাতেই যুবকের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। চাঁদের আলোয় শেষ স্পষ্ট দেখতে পেল উঠানজুড়ে শুধু শিয়াল আর শিয়াল। গন্ধ শুঁকে শুঁকে তার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে শিয়ালের পাল। এখন যদি তাকে কাছে পায় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। সে তখন মনে মনে ভাবে, বাচ্চাটাকে এভাবে ধরে আনা মোটেও ঠিক হয়নি। তারপর চৌকির নিচ থেকে খাঁচাটা বের করে বাচ্চাটাকে হাতে নিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে দ্রুত জানালা বন্ধ করে দিল। তারপর বিছানায় এসে রীতিমতো ভয়ে কাঁপতে লাগল। ওদিকে তখন হঠাৎ থেমে গেল শিয়ালের চিৎকার। বাচ্চাটা নিশ্চয়ই মায়ের কাছে ফিরে গেছে। জানালা খুলে সেই দৃশ্য দেখার সাহস হলো না তার। তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
শিয়াল শুধুই বুদ্ধিমান নয়, এরা দলবদ্ধ সুশৃঙ্খল প্রাণীও। একজনকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আসলে কঠিন এক নিয়মে পরিচালিত হয় শিয়ালের দল। দলের প্রয়োজনে ওরা নিজেদের কাউকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তারই প্রমাণ পেয়েছিলাম গত বছরের এক রাতে।
চমৎকার সেই জোছনা রাতে বিছানায় শুয়ে ছিলাম। ঘুম আসছিল না। এখনই হঠাৎ বাড়ির নিচ থেকে খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ ভেসে এল। বুঝলাম ঝগড়া করতে করতে এগিয়ে চলছে চরের একদল শিয়াল। প্রায়ই এমন হয়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝগড়া থেমে যাবে। কিন্তু না। ক্রমেই বাড়তে লাগল খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দের মাত্রা। বুঝলাম কোনো একটা গন্ডগোল আছে, এ কোনো সাধারণ ঝগড়া নয়। টর্চ হাতে দরজা খুলে বাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই বুঝলাম বাড়তি আলোর দরকার নেই, ফকফকা জোছনায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম সামনের নিচু জমিটাতে একটা শিয়ালকে ঘিরে রেখেছে পুরো দল। একটু পরপর একেকজন এসে দ্রুত কামড় দিয়ে ফিরে যাচ্ছে।
বিষয়টা আমাকে দারুণ চিন্তায় ফেলে দিল, এ তো কোনো পারস্পরিক ঝগড়া নয়। পরিকল্পিতভাবে সবাই মিলে শুধু একজনকেই আক্রমণ করছে। বিষয়টা কী? এদিকে ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে আক্রমণরত শিয়ালের বৃত্ত। খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ যেন রূপান্তরিত হচ্ছে হিংস্র গর্জনে। অবশেষে সবার আক্রমণের মুখে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারল না অসহায় শিয়ালটা। আমি রীতিমতো তাজ্জব বনে গেলাম। তবে এটুকু বুঝলাম, কোনো কারণে দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল প্রাণীটা। তাই ওকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সবাই।
শিয়াল অনেকটা সর্বভুক প্রাণী। তবে এরা যে প্রয়োজনে নিজেদের মাংসও খেতে পারে, তা জানা ছিল না। এক ঝড়ের রাতে বাইক নিয়ে ছুটে চলছিলাম বিশেষ কারণে। একপর্যায়ে হেডলাইটের আলোয় হঠাৎ দেখতে পেলাম, সামনে একটা শিয়াল অন্য আরেকটা প্রাণহীন শিয়ালের গলা কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সাথে সাথে বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম; তারপর সে শিকার মুখে নিয়ে রাস্তার পাশের জমিতে নেমে গেল। আমি খুবই অবাক, শিয়াল যে শিয়ালের মাংস খেতে পারে, এটা আমার জানা ছিল না। পরে ঘটনাটা তদন্ত করতে গিয়ে দেখি, একটা শিয়াল মারা পড়েছিল সড়ক দুর্ঘটনায়। অন্য শিয়ালটা বেরিয়েছিল খাবারের সন্ধানে, পেটে তার প্রচণ্ড খিদে। ঘটনাস্থলে এসে তাজা রক্তের ঘ্রাণে সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি। মুখে তুলে নেয় স্বজাতীয় প্রাণীর মৃতদেহটি। একেই মনে হয় বলে মৃত্যুক্ষুধা।
এই লেখা যখন শেষ করছি, তখন উত্তরের জানালার অদূরে শিয়াল ডাকছে—পাতি শিয়াল বা গোল্ডেন জ্যাকেল। ওরা এখন এখানে বেশ ভালোই আছে। বন্য প্রাণীদের এই সংকটময় সময়ে এটা খুব আশার কথা। হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া... তারস্বরে ডেকে চলেছে পাতি শিয়ালের দল। হঠাৎ আমার খুব মনে পড়ে গেল খেঁকশিয়াল বা বেঙ্গল ফক্সের কথা। ওরাও একসময় চরে খুব ভালো সংখ্যায়ই ছিল। কী দুষ্টু-মিষ্টি চেহারা ছিল ওদের! এখন ওদের খুব একটা দেখা যায় না, ডাকও শোনা যায় না। ধূসর-বাদামি, ভীষণ দুষ্টু, আবার খুবই লাজুক—সেই খেঁকশিয়াল আজ শুধু চর নয়, দেশের বুক থেকেই প্রায় বিপন্ন হতে চলেছে।