ব্রাজিলের এক দুঃখভারাতুর ফুটবলার ও তার হৃদয়েশ্বরী: গারিঞ্চা ও সোয়ারেস
ব্রাজিলের মানুষের কাছে দুটো জিনিস খুব প্রিয়। একটি ফুটবল, অন্যটি নাচ-গান। এখন যদি ব্রাজিলের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের ছেড়ে ব্রাজিলের বিনোদন জগতের সবচেয়ে বড় তারকার সাথে প্রেম শুরু করেন, তবে কেমন হয়? গ্যারিঞ্চা আর সোয়ারেসের ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই ঘটেছিল। ক্যারিয়ারের শীর্ষ পর্যায়ে পরিচয় হয় এক তারকার সাথে আরেক তারকার, আর এই পরিচয়ই ডেকে এনেছিল পতনকে, যার সাথে জড়িয়ে আছে দুর্ঘটনা, অ্যালকোহল, গৃহনির্যাতন এবং মৃত্যু। ট্রাজেডি ছাড়া আর কীই-বা বলা যায় একে?
গ্যারিঞ্চা: রিওর ছোট্ট পাখি থেকে জনগণের আনন্দ
গ্যারিঞ্চা জন্মেছিলেন অদ্ভুতভাবে। বাঁপায়ের চেয়ে ডান পা ৬ সেন্টিমিটার ছোট। সাথে দুই পা-ই বাঁকানো, বাঁপা বাইরের দিকে, ডান পা ভেতরে। ডাক্তার দেখে সাথে সাথেই রায় দিয়েছিলেন, এ ছেলে হাঁটতেই পারবে না। কে জানত, সেই ছেলেই পরিচিতি পাবে 'ফুটবল ইতিহাসের সেরা ড্রিবলার হিসেবে? কে ভেবেছিল তার খেলা দেখে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় তাকে উপাধি দেবে 'বাঁকা পায়ের দেবদূত' নামে?
স্থানীয় পাউ গ্রান্দের কারখানায় কাজ করে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মানুয়েল ফ্রান্সিস্কো ডস সান্তোসের। মানুয়েল থেকে মানে। শরীরের আকার-আকৃতি দেখে রিওর ছোট পাখির স্থানীয় নাম 'গ্যারিঞ্চা' নাম দিয়েছিলেন বড় বোন রোজা। পরিচিতি পেয়েছিলেন 'মানে গ্যারিঞ্চা' হিসেবেই। তবে সেটাও ছেঁটে ফেলা হয়, ডাকা শুরু হয় শুধু 'গ্যারিঞ্চা' নামেই।
পেশাদার ফুটবল নিয়ে বহুদিন আগ্রহ দেখাননি গ্যারিঞ্চা। ট্রায়াল দিয়েও স্কাউট আর কোচদের মন থেকে বাঁকা পা নিয়ে সন্দেহ ঘোচানো কঠিন হয়েছিল। তবে শেষমেশ সুযোগ আসে বোটাফোগোতে, তৎকালীন সেরা লেফটব্যাক নিল্টোন সান্তোসের দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে যখন বল চালান করে ক্লাব কর্মকর্তাদের সামনে চোখে 'বেয়াদবি' করেন, সান্তোস নিজেই এসে বলেন, 'একে নিয়ে নাও। এর বিরুদ্ধে খেলার চেয়ে আমি এর সাথে খেলাই পছন্দ করব।'
তারপর বোটাফোগোর জার্সি গায়ে মাঠ মাতানো। জুকা ফৌরির ভাষায়, 'পেলে যদি দর্শকদের পায়ের জাদুতে অবাক করতেন, গ্যারিঞ্চা দর্শকদের দিতেন আনন্দ।' গ্যারিঞ্চার খেলা দেখে দর্শকেরা হেসে উঠত, ইতিহাস ঘাঁটলে ফুটবলের মাঠে গ্যারিঞ্চার মতো 'এন্টারটেইনার' পাওয়ার সম্ভাবনা 'আর নেই'-তার দিকেই বেশি ঝুঁকে থাকবে। 'পিপলস জয়' উপাধিটা এমনি এমনি গায়ে লাগেনি বাঁকা পায়ের এই জাদুকরের।
ডাক পেলেন ১৯৫৮ বিশ্বকাপে। তার ১০ দিন আগে ফিওরেন্তিনার বিপক্ষে এক ম্যাচে সবাইকে কাটিয়ে গোল করার আগে ডিফেন্ডারের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার অপরাধে বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে তাকে বসিয়ে রাখা হলো। কোচের চোখে গ্যারিঞ্চা দর্শকদের 'বিনোদন' নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত ছিলেন। তৃতীয় ম্যাচে বিশ্বকাপের ফেভারিট তকমাধারী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে যখন পেলের সাথে গ্যারিঞ্চাকে একইসাথে নামানো হলো, প্রথম ৩ মিনিটে দুবার বল লাগল ক্রসবারে। ওই তিন মিনিটকে ডাকা হয় ফুটবল ইতিহাসের 'ম্যাচ শুরুর সেরা তিন মিনিট' হিসেবে।
টুর্নামেন্টজুড়ে কোনো গোল না থাকলেও ফাইনাল ম্যাচে দুই অ্যাসিস্টসহ অসাধারণ পারফরম্যান্সে জায়গা পেলেন টুর্নামেন্টের সেরা একাদশে। ওয়েলসের ফুলব্যাক তাকে অভিহিত করলেন পেলের চেয়েও 'কঠিন প্রতিপক্ষ' হিসেবে। গ্যারিঞ্চার হাতে উঠল প্রথম সোনালি ট্রফি।
১৯৬২ বিশ্বকাপেও ডাক পেলেন গ্যারিঞ্চা, তবে কিছুটা ওজন বাড়িয়ে। ততদিনে বুঁদ হয়ে পড়েছেন মদে। দুই বছর আগে মদাসক্ত বাবা মারা গিয়েছেন। মাত্র দশ বছর বয়সে মদ ধরেছিলেন। পাউ গ্রান্দের কিশোরদের কাছে অবশ্য সেটা স্বাভাবিকই ছিল। কাচাচা, মধু আর দারুচিনি দিয়ে বানানো কাচিম্বো খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকতেন। বোটাফোগোর ম্যাচের আগে প্রায়ই হারিয়ে যেতেন, সাংবাদিক বন্ধুদের তাকে ধরে নিয়ে আসতে হতো। গোসল করে কফি খেয়ে যখন মাঠে নামতেন, তখন অবশ্য এর ছিটেফোঁটাও বোঝা যেত না। এদিকে কারখানাশ্রমিক স্ত্রী নায়ারের ঘরে জন্মেছে সাত-সাতজন মেয়ে। পরকীয়ার জেরে আরেকজনের ঘরেও জন্মেছে আরেক সন্তান।
১৯৬২ বিশ্বকাপের ঠিক আগে সাও পাওলোর ব্রাজিল ক্যাম্পে পারফর্ম করতে গিয়েছিলেন এলজা সোয়ারেস। সেখানেই প্রথম চুমুর আদান-প্রদান। গ্যারিঞ্চা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, 'আমি তোমার জন্য হলেও এই বিশ্বকাপ নিয়ে ঘরে ফিরব।' প্রেমের টান হোক বা অন্য যেকোনো কারণ, গ্যারিঞ্চা তার কথাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।
ম্যারাডোনাকে অনেক সময় অভিহিত করা হয় একা বিশ্বকাপ জেতানো খেলোয়াড় হিসেবে। ১৯৬২-এর গ্যারিঞ্চা সম্পর্কে জানলে সে ভুল ভেঙে যাওয়ার কথা। দ্বিতীয় ম্যাচেই পেলে ইঞ্জুরিতে পড়ে সাইডলাইনে ওপাশে চলে যান, দলের মূলদায়িত্ব পড়ে গ্যারিঞ্চার কাঁধে। তৃতীয় ম্যাচেই ম্যাচের শেষ মুহূর্তে দুই অ্যাসিস্ট করে স্পেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে নিয়ে যান কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড এবং সেমিফাইনালে চিলির বিপক্ষে দুই-দুই চার গোল। ফাইনালে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে জ্বর নিয়ে খেলে কোনো গোল না পেলেও তার দায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন। জিতে ফেলেছেন টানা দুই বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের পরই সোয়ারেসের সাথে ঘর বাঁধা শুরু করেন গ্যারিঞ্চা। তবে সোয়ারেসের জীবনও কম নাটকীয় ছিল না। ব্রাজিলের সংগীত জগৎকে নাড়িয়ে দেওয়া সোয়ারেসের জীবনের শুরুও ছিল গ্যারিঞ্চার মতোই।
এলজা সোয়ারেস: ক্ষুধার জগতের সাম্বারানি
আশির দশকে এলজা সোয়ারেসকে লোকজন চিনত 'গ্যারিঞ্চার স্ত্রী' হিসেবে। তবে এলজা কোনোদিক থেকেই গ্যারিঞ্চার চেয়ে কম ছিলেন না।
পাদ্রে মিগুয়েলের দরিদ্র এলাকায় জন্ম নেওয়া এলজাকে মাত্র ১২ বছর বয়সেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। চরম গৃহনির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, এমনকি তাকে মেরে ফেলার জন্য গুলিও ছোড়ে স্বামী। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, কাঁধে গুলি লাগে তার। তবে অভাব-অনটন সত্ত্বেও গানের প্রতি ভালোবাসা টিকে ছিল। এক রেডিও স্টেশনের গানের প্রতিযোগিতায় নাম লেখান, মায়ের কাছ থেকে জামা ধার নিয়ে যান অডিশন দিতে। তার অস্বাভাবিক কম ওজন দেখে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, 'কোথায় থাকো তুমি?' এলজার জবাব ছিল, 'ক্ষুধার গ্রহে।' গানের প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন, তবে সেই পরিমাণ অর্থ তার বিশাল পরিবারের জন্য ছিল অপর্যাপ্ত।
২১ বছর বয়সেই বিধবা হয়ে পড়েন, স্বামী মারা যায় যক্ষায়। তবে স্বামী মারা গেলেও পাঁচ সন্তান রেখে যান, এলজাকে একাই টেনে তুলতে হয় পুরো সংসার। এক সাবানের কারখানায় কাজ শুরু করেন এলজা, তবে প্রায় সময়ই না খেয়ে থাকতে হতো। অনেক সময় বাধ্য হয়েছেন খাবার চুরি করতেও।
কয়েক বছর যাওয়ার পর তিনি আবার গান গাওয়া শুরু করেন বিভিন্ন ক্লাবে, তবে প্রথমদিকে কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে বেশিরভাগ জায়গাতেই বর্ণবাদের শিকার হতেন। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কালো হওয়ার কারণে বেশ কয়েকবার গলাধাক্কা খেতে হয়েছে। ফলে শহরের একটু ভেতরের ক্লাবগুলোতে গিয়ে কাজ খুঁজতে হতো তাকে। ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে শুরু করেন, নামডাক বাড়তে থাকে। বড় বড় জায়গা থেকে গান গাওয়ার অফার আসতে থাকে, শেষমেশ বের করে ফেলেন নিজের প্রথম অ্যালবাম।
ঠিক এই সময়েই চিলিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ। সোয়ারেসের সাথে পরিচয় হয় গ্যারিঞ্চার। দুজনের ক্যারিয়ারেই যে আকস্মিক পরিবর্তন আসতে চলেছে, তা হয়তো দুজনের কেউই ভাবতে পারেননি।
সোয়ারেস এবং গ্যারিঞ্চা: বুনো উন্মাদনা থেকে ট্রাজেডির পথে
গ্যারিঞ্চার জীবনী লেখক রুই ক্যাস্ত্রো দুজনের সংসার নিয়ে বলেছিলেন, 'গ্যারিঞ্চা অতদিন টিকে ছিল কেবল সোয়ারেসের যত্ন-আত্তির কারণেই। কিন্ত অনেকের কাছেই গ্যারিঞ্চার গল্পে সোয়ারেস খলনায়ক বৈ কিছু নয়, যে গ্যারিঞ্চার সংসার ভেঙেছে, গ্যারিঞ্চার ক্যারিয়ারের ক্ষতি করেছে।' কিন্তু গ্যারিঞ্চার জন্য সোয়ারেসের ক্যারিয়ারের যে ক্ষতি হয়েছিল, তা চেপে যান বেশিরভাগই।
বিশ্বকাপের পর গ্যারিঞ্চা যখন সোয়ারেসের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তখন অনেকেই তাকে বলেছিল, 'তুমি খুব বেশি উঁচুতে উঠে গিয়েছ। তোমার খারাপ সময়ে যারা তোমার সাথে ছিল, ভালো সময়ে তাদের ভুলে যেও না।' ব্রাজিলের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরকীয়া ছড়িয়ে পড়েছে, যাদের সামর্থ্য আছে, তারা প্রায়ই স্ত্রী ছাড়াই আরও কয়েকজনের সাথে সম্পর্ক রাখত। একই সাথে পরিবারও টিকিয়ে রাখত। গ্যারিঞ্চা অবশ্য সেদিকে যাননি, সব ছেড়েছুড়ে সোয়ারেসের সাথেই ঘর বাঁধলেন।
ব্রাজিলের জনগণ এতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। গ্যারিঞ্চা পরিবার ছেড়ে চলে আসায় গ্যারিঞ্চাকে 'ফুসলানো'র দায়ে সোয়ারেসকে ডাইনি হিসেবে প্রচার করা হতে থাকে। সংবাদপত্রেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। শেষমেশ বাড়িতে হামলা চালায় জনগণ। মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় সোয়ারেসকে। টমেটো-ডিম ছুড়ে বাড়ির দেয়াল নষ্ট করে ফেলা হয়। গ্যারিঞ্চা-সোয়ারেস জুটি বাধ্য হয়ে আরেক শহরে থাকা শুরু করেন। গ্যারিঞ্চার বন্ধুরাও সোয়ারেসকে মেনে নিতে পারেননি, তারাও 'ডাইনি' হিসেবে অ্যাখ্যা দেয় তাকে।
গ্যারিঞ্চার ক্যারিয়ারের ক্ষতির জন্য সোয়ারেসকে দায়ী করা হলেও বাস্তবে তার আগে থেকেই গ্যারিঞ্চা নিচের দিকে পড়ছিলেন। প্রথমত, মদ। দ্বিতীয়ত, ইঞ্জুরি। হাঁটুতে ইঞ্জেকশন নিয়ে হাসিমুখে বোটাফোগোর হয়ে মাঠে নামতেন গ্যারিঞ্চা, তবে ব্যথা নিয়ে আর কত খেলবেন?
১৯৬৬ বিশ্বকাপেও ডাক পেলেন। প্রথম ম্যাচেই পেলে আর গ্যারিঞ্চার গোলে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়। ওই একটি ম্যাচেই পেলে আর গ্যারিঞ্চা দুজনেই গোল করেছিলেন। পরের ম্যাচটিই ছিল গ্যারিঞ্চার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং ব্রাজিলের জার্সি গায়ে ওই একটি ম্যাচই হেরেছিলেন গ্যারিঞ্চা। পর্তুগালের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে মাঠে নামেননি গ্যারিঞ্চা, ব্রাজিল বাদ পড়ে যায় প্রথম রাউন্ডেই। বিশ্বকাপের পর একেবারেই অনিয়মিত হয়ে পড়েন ফুটবলে, ততদিনে তার বয়স হয়ে গিয়েছে ৩৩।
রাজনীতির সাথেও কিছুটা সংযুক্ত ছিলেন দুজনে। কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন গ্যারিঞ্চা, যদিও অনেকেই তাকে 'বাচ্চাসুলভ' মনে করতেন। সোয়ারেসও রাজনৈতিক র্যালিতে গান গেয়েছেন বেশ কয়েকবার। এর পরিণতিও ভোগ করতে হয় তাদের, ব্রাজিলের আর্মড ফোর্সের অভ্যুথানের পর কিছুদিনের জন্য গ্যারিঞ্চা-সোয়ারেস জুটিকে নির্বাসনে পাঠানো হয় ইতালিতে।
এদিকে গ্যারিঞ্চার মদাসক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে হাঁটুর ব্যথাও। গ্যারিঞ্চার খোঁজখবর রাখতে গিয়ে নিজের শোসহ অন্যান্য প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ কমিয়ে দেন সোয়ারেস। তবে গ্যারিঞ্চার মদাসক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় যখন সোয়ারেসের মা, অর্থাৎ গ্যারিঞ্চার শাশুড়ি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। গাড়ি চালাচ্ছিলেন মদে চুর গ্যারিঞ্চা নিজেই। গ্যারিঞ্চা, সোয়ারেস এবং সোয়ারেসের আগের ঘরের মেয়ে আহত হন। নিজ শাশুড়ির মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেন তিনি, পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন মদের ওপর। বাড়তে থাকে গৃহনির্যাতনও, প্রায়ই বাসায় এসে মারধর করতেন সোয়ারেসকে। সোয়ারেস একবার মদ খাওয়া বন্ধের জন্য বারে গিয়ে গ্যারিঞ্চাকে মদ না খেতে দেওয়ার অনুরোধ করেন বারমালিককে। কথা গ্যারিঞ্চার কানে পৌঁছালে সোয়ারেসকে বেদম প্রহার করা হয়। ১৯৭৭ সালের এমনই এক দিনে, আবারও মারধর করা হলে গ্যারিঞ্চাকে ছেড়ে চলে আসেন সোয়ারেস।
গ্যারিঞ্চার মদাসক্তির পরিণাম হয় তার বাবার মতোই। ১৯৮৩ সালের ২০ জানুয়ারি লিভার সিরোসিসে মারা যান 'পিপলস জয়'। এপিটাফে লেখা হয়, 'এখানে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন জনগণের আনন্দ মানে গ্যারিঞ্চা।' দেয়ালে সাধারণ জনগণ লিখে রাখে, 'পৃথিবীতে আসার জন্য ধন্যবাদ, গ্যারিঞ্চা।' মারাকানার নামকরণ করা হয়, 'এস্তাদিও নাসিওনাল মানে গ্যারিঞ্চা'।
সোয়ারেসের নতুন জীবন
সোয়ারেসের গর্ভে গ্যারিঞ্চার সন্তান ছিল একটিই: নামও রাখা হয়েছিল বাবার নামানুসারে। বাবা মারা যাওয়ার তিন বছরের মাথায় ৯ বছর বয়সী গ্যারিঞ্চা জুনিয়র মারা যায় গাড়ি দুর্ঘটনায়, নানির মতো।
হতাশ হয়ে ব্রাজিল ছেড়ে চলে যান সোয়ারেস। গ্যারিঞ্চাকে সামলাতে গিয়ে গানের জগৎ থেকে বহুদিন দূরে ছিলেন তিনি। তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আবার গানের জগতে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় গান গাওয়া শুরু করেন, শুরু হয় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, তবে খুব বেশি সাফল্য পাননি। ১৯৯৯ সালে সাম্বা গানের জগতের মহারথীদের নিয়ে লন্ডনের রয়্যাল আলবার্ট হলের এক শোতে ডাক পান ৬৯ বছর বয়সী সোয়ারেস। তবে গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তখনো বাকি।
২০০২ সালে আবার ব্রাজিলের গানের জগৎ মাতানো শুরু করেন, তার অ্যালবাম 'ফ্রম টেইলবোন টু দ্য নেক' মনোনীত হয় ল্যাটিন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য। নিজের পুরোনো সাম্বার সাথে ইলেকট্রনিক ডান্স মিউজিক, পাঙ্ক রক, জ্যাজসহ বিভিন্ন জঁরার গান গাওয়া শুরু করেন, জনপ্রিয়তা পান একবিংশ শতাব্দীর তরুণ শ্রোতাদের মাঝেও। ২০১৬ সালে 'দ্য উইমেন অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড' অ্যালবামটি সেরা ব্রাজিলীয় পপ অ্যালবাম হিসেবে ল্যাটিন গ্র্যামি জেতে। ২০১৯ সালে বের হওয়া তার শেষ অ্যালবামের নাম 'প্লানেট হাঙ্গার,' ঠিক যে দুটো শব্দ তিনি ৭৪ বছর আগের অডিশনে তার গান গাওয়ার কারণ হিসেবে বলেছিলেন। বর্ণবাদ, ক্ষুধা, বৈষম্য নিয়ে এই অ্যালবামটিও পায় ল্যাটিন গ্র্যামির মনোনয়ন।
২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি, ৩৯ বছর আগের ঠিক যে তারিখে গ্যারিঞ্চা মারা গিয়েছিলেন, ৯১ বছর বয়সে মারা যান সোয়ারেস।
তার কয়েকদিন পরই ব্রাজিলের ১৯৬২ বিশ্বকাপ জয় এবং সোয়ারেস-গ্যারিঞ্চার জুটির হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে দুজনকে নিয়ে নির্মিত ৪ পর্বের ডকুমেন্টারি 'এলজা অ্যান্ড মানে' মুক্তি পায়। নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিলেও গ্যারিঞ্চার প্রতি ভালোবাসা একবিন্দু কমাননি সোয়ারেস, প্রতিবছরই ২০ জানুয়ারি গ্যারিঞ্চাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট দিয়ে মনে করাতেন গ্যারিঞ্চার স্মৃতি। ঠিক সে কারণেই হয়তো একই দিনে পৃথিবী ছেড়েছেন এই ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি। তবে কিছুটা আক্ষেপও ছিল হয়তো, যে কারণে ডকুমেন্টারিটিতে বলেছিলেন, 'God writes right in crooked lines. Mine was written by crooked legs.'