ফুটবলের বাইরের আরেক ম্যারাডোনা!
১.
শেষবার প্রকাশ্যে ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনাকে দেখা গিয়েছিল ভাঙাচোরা দশায়, দুই হাজার বিশের অক্টোবর ত্রিশে, শনিবারে। ভক্তদের উদ্বেগে ফেলে সেই দৃশ্য। অল্প কয়েক দিন পরেই, বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টানবেন তিনি। অনেকেই এই পরিণতির জন্যে দায়ী করেন একাকীত্বকে। পাঁচ সন্তানের জনক, অসংখ্য রমণীর রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই চিরযুবকের জীবনের শেষ ঘণ্টাগুলো ছিল অত্যন্ত একা।
শেষ সময়ে বিহ্বল দূরত্ব আর অনেকটাই দুশ্চিন্তা সম্পর্কে কালো মেঘের বিস্তার ঘটালেও ক্লদিয়া ভিলাফেইন তাঁর প্রথম প্রেম। দুজনের বয়স যখন সুবর্ণ সতেরো, পরস্পরের প্রেমে পড়েন। ডালমা আর জিয়াননিনা—দুই সন্তানের জন্মের পর, তাঁরা বিয়েটিকে আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দেন ১৯৮৯ সালে। ম্যারাডোনার অন্য নারী আসক্তির বাড়াবাড়িতে বিয়ে ভেঙে যায়। কোর্টে মুখোমুখি দ্বৈরথের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটে।
ভালোবাসা আর রোমাঞ্চ ম্যারাডোনা জীবনেরই অঙ্গ। ভেরোনিকা ওজেদা তাঁর হৃদয়ে স্থান করে নেন। ক্লদিয়ার দুই কন্যা কর্তৃক গভীর ঘৃণা আর স্নায়ুক্ষয়ী তর্কের শিকার হলেও তিনি আটটি সুদীর্ঘ বছর এই তারকার সাথে কাটান। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র দিয়েগুইতো ফেরনান্দোর পৃথিবীতে এসে পড়া এই সময়ের ব্যালান্সশিট। কেউ কেউ বলেন, ম্যারাডোনার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের আর নেশা থেকে বহু যোজন দূরবর্তী সময় ছিল অর্ধযুগের অধিক এই আট বছর।
২০১০ সালে, রোকিও অলিভা—এক সুন্দরী তন্বী—ত্রিশ বছরের বয়সের দূরত্বে এই মহানায়কের শরীরে ও মনে সম্মোহনের জোয়ার বইয়ে দিলেন। তাঁদের সম্পর্কেরও মেয়াদ আট বছর। দীর্ঘ একটা সময় দুবাইয়ে কাটান এই জুটি। শেষটি শুরুর মতো রূপকথাপ্রতিম ছিল না। অলিভা তাঁর কিংবদন্তি প্রণয়ীর জীবনে বাজে প্রভাব আনয়নের অভিযোগে চিহ্নিত হন। রোকিও, জীবনের শেষের দিনগুলোতে তাঁকে ব্যবহার করে ছোবড়া করায় অভিযুক্ত হন এবং বিচারকের সামনে পরিষ্কার করে বলেন, তিনি কোনোভাবেই কোনো কিছুর জন্যে অভিযুক্ত হতে পারেন না। 'কেউ ভালোবাসার জন্যে মরে যায় না। তাঁর মৃত্যুর সাথে আমার লেনাদেনা নেই।'—এই ছিল সপাট উত্তর।
২.
ক্রিস্টিনা সিনাগারা, ম্যারাডোনার জীবনের মৌলিক অংশ। ডিয়েগো জুনিয়রের জননী তিনি, নিজের পিতৃত্বের স্বীকারোক্তি দেন বহু বছর পরে। এবার আসা যাক, সবচেয়ে বিতর্কিত প্রেমের বিষয়ে। ম্যাভিস ইভারেজ, কিউবান তরুণী। কিউবায় অবস্থানকালে সম্পর্কে জড়ান ম্যারাডোনা। ম্যাভিস এক আবেগঘন সাক্ষাৎকার দেন। এতে ডিয়েগো সিনিয়রের চরিত্রের একটি দিক উন্মুক্ত হয়।
'আমার বয়স তখন ষোলো। পুচকে ছিলাম। জীবন আমায় এই সুযোগ দেয় এবং আমি গ্রহণ করি।' তিনি আরও যুক্ত করেন, 'তিনি নানারকম পার্টিতে আমায় যেতে বলেন। বলেন, গেলে আমার ভালো লাগবে। হয়তো তাঁর জন্য এটি খুব উত্তেজক ছিল। অন্য মেয়েদের সাথে আমার অবস্থান তিনি পছন্দ করছিলেন। প্রস্তাব ভালো লাগায় আমি যাই।' স্বীকারোক্তি ম্যাভিসের।
তাঁর জন্যে ডিয়েগো ছিলেন আশ্রয়। পরিবারের অসহ দারিদ্র্য আর অভাবের মাঝখানে দেবদূতপ্রতিম আবির্ভাব ঘটে তাঁর। 'আমি ছিলাম পিচ্চি। নির্মল আর সহজ। তিনি বিদেশি, পয়সাওয়ালা এবং আমাতে তাঁর নজর পড়েছে। আমি না বলতে পারিনি। তাঁর সহচরী হতে পারা মস্ত সুযোগ আমার কাছে।'
চার পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষে তিনি যুক্ত করেন, 'জীবনের এই পর্বটির জন্যে নিজের কাছেই লজ্জিত থাকি।' পরে আরও অভিজ্ঞতা জীবন আমায় উপহার দিয়েছে। আমি দেখলাম, জীবন কেমন করে কাটাব, তা পছন্দ করতে পারি না, আমরা কেবল তার অংশ হতে পারি।
৩.
ম্যারাডোনার নারীদের কথা আরেকটু খোলাসা করে লিখি এইবার। আদুরে নাম—ফ্লাফি, ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনার। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়ে মাত্র ষাট বছর বয়সে অন্যলোকে যাত্রা করেছিলেন। তাঁর একাধিক নারীপ্রাণতা, প্রেম বিশ্ব মিডিয়ার চর্চার বিষয় ছিল, আছে, থাকবে। সংখ্যাতীত নারী তাঁর হৃদয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। মাত্র তিনজন নারী অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ফুটবল ম্যাজিশিয়ানের জীবনালোচনায় অনিবার্য।
জীবনের শেষ পর্যায়ে ম্যারাডোনার অন্দরমহল প্রত্যক্ষ করেছিলেন মাত্র এক নারী। এই আর্জেন্টিনিয়ান মাঠে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন কিন্তু প্রতিবেশীরা তাঁর পানাসক্তি, মাদক এবং নারীকেন্দ্রিক যে জীবন যাপন, তার আলোচনায় ব্যস্ত থেকেছে অহর্নিশ। গভীর প্রেমে লিপ্ত এই মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন নারী—ক্লদিও ভিলাফেইন, ভেরোনিকা ওজেদা এবং রোকিও অলিভা। ডালমা (৩৪) এবং জিয়াননিনা (৩১) প্রথম স্ত্রী ক্লদিয়ার; ডিয়েগো জুনিয়র (৪৪) এবং জানা (২৪)—দুজনই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ফলাফল। ডিয়েগো ফার্নান্দো (১৭), ভেরোনিকা ওজেদার সাথে সম্পর্কের সন্তান।
ক্লদিয়া তাঁর দুই সন্তানের জননী। নিজেও ভুগেছেন তাঁর নারী আসক্তি এবং মাদক সমস্যার কারণে—এই ভোগান্তি তাঁকে সারা জীবন তাড়া করেছে। এই সম্পর্কে থাকাকালে ম্যারাডোনা এমনকি একবার মৃত্যুর অতি নিকট থেকে ফিরে এসেছিলেন।
চৌদ্দ বছরের বিবাহিত জীবনের পর ২০০৩ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। আইনি বিচ্ছেদ এবং মন থেকে বিদায় দেওয়া সম্পূর্ণ আলাদা। নাহলে তার পাঁচ বছর পর হোর্হে তাইয়ানার সাথে সম্পর্ক শুরুর খবরে তিনি কেন কষ্ট পাবেন! তাইয়ানা ছিলেন একজন প্রযোজক। ম্যারাডোনা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন। সম্পর্কে থাকা অবস্থায় মায়ামিতে বাড়ি কেনা, আয়কর জালিয়াতি, একত্রে থাকাকালীন সম্পদের অপব্যবহার—এসব অভিযোগে তিনি ক্লদিয়াকে আদালতে তোলেন।
এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হয় 'ফ্লাফি'র প্রতিশোধ হিসেবে। কেননা, ক্লদিয়া ছিলেন শ্রেষ্ঠ প্রেম। তাই বিচ্ছেদের পর নতুন জীবন শুরু করতে যাওয়ায় প্রাচীন পুরুষোচিত প্রথায় তিনি হিংস্র হয়ে ওঠেন। কে না জানে তীব্র ভালোবাসার উল্টো পিঠেই গভীর বিদ্বেষ আড়ালে থাকে।
ভেরোনিকা ওজেদা, আগেই বলেছি, ডিয়েগো ফার্নান্দোর জননীকে ম্যারাডোনা গর্ভাবস্থায় ছেড়ে চলে যান রোকিও অলিভার সাথে সম্পর্ক পাতাতে। পরে ভেরোনিকার সাথে প্রচুর ঝগড়া ঘটে সন্তানকে কেন্দ্র করে। ফার্নান্দো ছিল বিশেষভাবে সক্ষম শিশু। ম্যারাডোনা এই নারীকেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্তানের ছবি দেয়ার 'অভিযোগে' আদালতে তোলেন।
রোকিও অলিভা, ম্যারাডোনার শেষ জ্ঞাত পার্টনার, একজন ফুটবল প্লেয়ার। জিমনাসিয়া ওয়াই এসগ্রিমা দে লা প্লাতা ক্লাবের নারী ফুটবল দলের ম্যানেজার পদে সাবেক ফুটবলার ম্যারাডোনাকে যুক্ত করেন তিনি। ফুটবল তাঁদের যৌথ প্যাশনের বিষয় ছিল। কিন্তু যেহেতু সবকিছু একদিন ভেঙে পড়ে, এই সম্পর্কটিও টেকেনি। ঘড়ি, কম্পিউটার, টেলিফোন আর জুয়েলারি চুরির অভিযোগে ছয় বছরের জন্যে কারাদণ্ড চেয়ে ম্যারাডোনা অলিভার বিরুদ্ধে মামলা করেন। তিনি বিবৃতিতে জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাতে যৌথ বসবাসের সময় অলিভা এইসব অপকর্মে সজ্ঞানে যুক্ত ছিলেন।
এই তরুণীও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন তিনি। একটি আর্জেন্টিনিয়ান টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, আমাদের সুপুত্রটি তরুণীর সাথে উদ্ধত, অসভ্য আচরণ করছেন। অলিভার ফোন বাতাসে ছুড়ে ফেলার কথা ম্যারাডোনা স্বীকার করেন। কিন্তু কোনো নারীর সাথে কোনোরকম হিংসাত্মক আচরণ কখনোই করেন নাই বলে বিবৃতি দেন।
৪.
ডিয়েগো জুনিয়রের মা, ইতালিয়ান ক্রিস্টিনা সিনাগারকে অনেক বছর পর জনক ম্যারাডোনা স্বীকার করে নেন। ভ্যালেরিয়া সাবালেইন, তাঁর অবৈধ কন্যা জানার মা। কন্যা জানার সাথে ম্যারাডোনার সাক্ষাৎ হয় অনেকদিন পর, ২০১৩ সালে। এই কন্যার পিতৃত্বের স্বীকৃতিতেও তিনি অনেকটাই দেরি ঘটান।
আর্জেন্টিনার বিখ্যাত দ্বৈত সংগীতদল পিম্পিনেলার একজন লুমিয়া গালান, বছর আটেক আগে জানান দেন, ১৯৮২ সালে এই ফুটবলারের সাথে প্রণয় ছিল তাঁর। তখন লুমিয়া ভাই জোয়াকিনের সাথে গানের ক্যারিয়ার মাত্র শুরু করেছেন আর ম্যারাডোনার ঘরে ক্লদিয়ার সাথে বিবাহজনিত জটিলতা, বাইরে ইউরোপিয়ান ফুটবলের স্টার হিসেবে মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।
আদোনেই ফ্রুটো—ম্যারাডোনার কিউবান বান্ধবী হিসেবে পরিচিত। ফ্রুটোর মায়ের জবানিতে জানা যায়, কিউবান ক্লিনিকে ভর্তি থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালে তাঁদের দেখা হয়। তখন তিনি তেতাল্লিশ আর ফ্রুটো সদ্য উনিশ। এই সম্পর্কটি বিষয়ে কখনোই নিশ্চিত করা যায়নি। আর্জেন্টাইন মিডিয়ার বরাতে জানা যায়, একটি গুজব ওঠে ফ্রুটো গর্ভবতী হয়েছেন, কিন্তু তন্বী মিসক্যারেজের শিকার হন।
২০১৪ সালের জুনে, এক টেলিভিশন শো জানিয়ে দেয়, নৃত্যশিল্পী গ্র্যাসিয়েলা আলফানোর সাথে ম্যারাডোনার রোমান্সের কথা। তখন তিনি প্রথম স্ত্রী ক্লদিয়ার সাথেই ছিলেন। অর্থাৎআমরা দেখতে পাচ্ছি আজকালের ভাষায় 'ডবল টাইমিং', যা কি না তাঁর জন্যে জলভাত।
২০২০ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে আসেন ম্যারাডোনা। সফল অপারেশনের পর সেরে ওঠেন। সেরে ওঠার সময়ে এই নারীবৃত্তে আরেকজনের প্রবেশ ঘটে, যদিও রোমান্স ছিল না সে অর্থে।
আর্জেন্টাইন টেলিভিশন প্রোগ্রাম ইন্ট্রুসোস উন্মোচন করে আগুস্তিনা কসাচেভ-সম্পর্কিত সকল ঘটনা। তাদের মতে,'এই নারী, ডিয়েগোর সবচেয়ে কঠিন জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছিলেন, তাঁর মাথায়।' কসাচেভ একজন সাইকোথেরাপিস্ট, সাইকোফার্মাকোলজির অধ্যাপকও বটে। তাঁর গবেষণার বিষয়: ওষুধের প্রভাব ও উদ্দীপনা মানুষের মস্তিষ্ক আর বাকি স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে কেমন আচরণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, তিনি মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাঁকে সাহায্য করেন এবংম্যারাডোনা তাঁকে শুনতেন। তাঁর বিশ্বাস অর্জন করা একজন নারী, তিনি যদিও এই তথ্যটি সেলফ এভিডেন্ট অর্থাৎ নারীটিরই সরবরাহ করা—আর্জেন্টিয়ান টেলিভিশন প্রোগ্রামের সঞ্চালক উপসংহার টেনেছিলেন।
৫.
ম্যারাডোনা দেবতা নন। তিনি রক্তমাংসের মানুষ। প্রেম ও লাস্যে, নিয়ম আর অনিয়মের এক অপূর্ব দোলাচলে নাতিদীর্ঘ জীবনটি কাটিয়েছেন। সারাজীবন শোষিতের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, আমরা যারা খেলার সাথে রাজনীতি মেশাই। আর ইতিহাসে হিরের অক্ষরে খোদাই করা তাঁর ফুটবল সাফল্য তো আছেই!