‘আমি এক সুখী বুড়ো বালিকা’
২৪ ফেব্রুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিলেন পণ্ডিত, লেখক, অনুবাদক, মতামত নির্মাতা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। আনজুম ক্যাতালের সাথে তার আলাপচারিতার প্রথম অংশ পরিবেশন করা হলো এখানে। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন সৈয়দ মূসা রেজা।
শুরুতেই একটি বিশ্লেষণ হয়ে যাক: তারিখটি ২৬ জানুয়ারি, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস, দেশটি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করছে। বিখ্যাত 'উত্তর-ঔপনিবেশিক' পণ্ডিত অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের নিজ নগরী কলকাতায় অবস্থান করছেন আনজুম ক্যাতাল। গায়ত্রী নিউইয়র্ক সিটির এক হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন। তিনি হাঁটু প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার থেকে সেরে উঠছেন সেখানে।
ক্যাতালের সাথে গায়ত্রীর এ সাক্ষাৎকার হচ্ছে কম্পিউটারের পর্দার মাধ্যমে। প্রমিত নীল (বিশ্বজনীন) গাউন পরিহিত গায়ত্রীর গায়ে চাপানো রয়েছে ঝাড়খণ্ডের সীমানাবর্তী রাজনগর জেলার এক ব্লক কর্মকর্তার উপহার দেওয়া হাতের কাজ করা শাল। গায়ত্রী সেসব বিদ্যালয়ের সাথে কর্মসূত্রে সম্পৃক্ত, সেগুলো রয়েছে এই এলাকাজুড়ে। পেছনে দেখা যাচ্ছে নিজ প্রিয় এলাকার একটি বিদ্যালয় ভবনের ডিজিটাল ছবি।
এমন নাটকীয় এক পরিমণ্ডলে আসন্ন ৮০তম জন্মদিন উদযাপনের প্রস্তুতি সেরেছেন তিনি। নিজ জন্মদিনের অনেকগুলো উদযাপনের প্রথমটির জন্য এটিই তার প্রস্তুতি। ক্যাতালকে তিনি বলেন, ৮০ বছরে পা দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম উদযাপন করছি তোমার সাথে। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছে এ ভেবে যে এই দীর্ঘ সময় ধরে আমি টিকে আছি। তোমার তো জানা আছে, সাধারণত আমি জন্মদিন পালন করি না। তবে এবারে আমি নিজের জন্যেই জন্মদিন উদযাপন করছি। মনে হয় কাজটি ঠিকই করেছি, ৮০-তে পা দিয়েছি। আজ যেখানে আছি, তা সুন্দর একটি পূর্ণ বয়স। জীবনের বিসর্পিল পথে, অপ্রত্যাশিত বাক ঘুরে যাওয়া, অর্জন, অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি নিয়ে পুরোপুরি জীবনযাপনের সিদ্ধান্তই আমরা নিয়েছি। তিনি বলেন, মনে করি আমরা মুক্ত এবং সহজ হতে পারি, তুমি তো জানো, তুমি আমাকে নিয়ে চলো, আমিও তোমাকে নিয়ে চলব। আর এভাবেই চলব।
প্রশ্ন: শুধু ভাবছিলাম, সৌভাগ্যক্রমে এটাই যথেষ্ট যে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে নিচ্ছি এ সাক্ষাৎকার। আর আপনি বয়সে স্বাধীন ভারতের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। সত্যি আপনি প্রাক্-মধ্যরাতের শিশু... আমরা কি সেখান থেকে শুরু করব? আপনার শিশুকালের কথা দিয়েই কি শুরু হবে?
গায়ত্রী: পিছু ফিরে তাকালে আজ বুঝতে পারি আমার শিশুকাল সবদিক থেকেই নিখুঁত ছিল। আমাদের ছিল বিশাল পরিবার। আমার মা-বাবা তাদের সন্তানদের প্রতি পুরোপুরি উৎসর্গিত ছিলেন। বানার্ড উইলিয়াম নৈতিক সৌভাগ্যের ধারণা ব্যক্ত করেছেন। ওরকম মা-বাবা পাওয়া সত্যিই নৈতিক সৌভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। জীবনে যা কিছু অর্জন করেছি তার সবই সেই ভালোবাসাময় শিশুকালেরই সুফল।
আমার শৈশবের মধ্য দিয় বর্ধিত পরিবারের সমাপ্তি ঘটে, তাই না? আমার মামাবাড়ি (জ্ঞান মজুমদারের বাড়ি) সত্যিই আমাদের বাড়ি ছিল। আমার জন্ম বড় মামা প্রতুল মজুমদারের বাড়িতে, ৬ আয়রনসাইড রোড, যা এখন জ্ঞান মজুমদার সরণি। আমার ঠাকুরমা, দুদুন, রাজেশ্বরী দেবী, পরিবারের প্রধান হিসেবে সেখানে ছিলেন। এটা দারুণ অবাক করা কাণ্ড।
অন্য আরেক দিন বড়দিনে আমার বোনের সাথে কথা বলি। আমি তাকে গান করে শোনাই, 'ঈশ্বর তোমাকে আনন্দিত করুন'—কারণ, আমাদের দুজনেরই আরাম এবং আনন্দের প্রয়োজন ছিল। এরপরে আমরা একটি গান গাই, আমার ঠাকুরমা, যিনি ক্রাইস্টচার্চ স্কুলে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে শিখেছিলেন। অতঃপর আমরা অনেক গান গেয়েছি। সেসব সংগীত আমাদের এমন শিশুতে পরিণত করেছিল, যারা ভয়ংকর ঈশ্বরের নির্দেশনায় জীবনযাপন করে। অথচ এটি আমাদের পরিবারের পথ থেকে একদম আলাদা।
আমাদের পরিবার মোটেও ধর্মমুখো ছিল না। আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের পরিবারের এখানে এবং সেখানে পূজা-পার্বণ হতো। কিন্তু তারপরও ধর্মমুখিতা ছিল না। কিন্তু পরিবারের মধ্যে এ গানটি গাওয়া হতো—'সাবধান, ছোট হাত, যা ধরো।' আমি নিউইয়র্কে এবং আমার বোন দিল্লিতে বড়দিনে এই গান গাইতে শুরু করি। গানটি ১০০ বছর পেছনে নিয়ে যায়। এক অর্থে এসবই আমার শিশুবেলা।
এবং তারপরে, এল স্বাধীনতা, যা আমাদের জন্য দাঙ্গা এবং দুর্ভিক্ষের সমাপ্তি নিয়ে আসে। দুর্ভিক্ষের সমাপ্তি কাগজে-কলমে ঘটে। কিন্তু কাগজে-কলমে দুর্ভিক্ষের সমাপ্তি কিন্তু আসলে দুর্ভিক্ষের শেষ নয়। দুর্ভাগ্যবশত, আমার স্বাধীনতার অভিজ্ঞতায় রয়েছে দাঙ্গা এবং দুর্ভিক্ষ। উভয়ই স্মৃতিতে জলজ্যান্ত এবং হিংস্র ছিল...
প্রশ্ন: আপনার বাবা ছিলেন ডাক্তার এবং দাঙ্গার সময়ে তিনি সহায়তা করেছেন বলে আপনি উল্লেখ করেছেন। আমি কী সঠিকভাবে কথাটা মনে করতে পেরেছেন?
গায়ত্রী: জি। বাবা বাড়ির গেটখুলে দিয়েছিলেন, যাতে মুসলমানদের সবাই, যাকে এখন স্বল্প আয়ের আবাসন বলা হয় কিন্তু সত্যিকার অর্থে হলো বস্তি (সেখানে বসবাসকারী), আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পারে। আমাদের বাড়ি তখন বেশ ছোট ছিল, তাই আমার মনে আছে গোটা বাড়ি মানুষে ভরে গিয়েছিল। নিচে নারী ও শিশুরা এবং ছাদের ওপরে পুরুষেরা ছিল।
বাবা পুরোপুরি অহিংস মানুষ, জীবনে কখনো বন্দুক ছুড়েননি। কিন্তু কোনো কারণে হাদু মামার (রাজেন মজুমদার, পরে কলকাতার মেয়র) একটা দোনলা রাইফেল আমাদের বাড়িতে ছিল। বাবা এই রাইফেল নিয়ে ওপরে ছিলেন, যদিও তিনি গুলি চালাতে জানতেন না, বলেছিলেন, 'যতদিন পরেশ চক্রবর্তী বেঁচে আছে, কেউ আপনাকে স্পর্শ করতেও পারবে না।' এটি নেহাতই প্রতীকী হুমকি ছিল...
প্রশ্ন: তারপরও বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
গায়ত্রী: হ্যাঁ। বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: আমরা স্কুলের গঠনমূলক অভিজ্ঞতার নিয়ে আলাপচারিতা করি। প্রথমে (সেন্ট জোনস) ডায়োশেসান গার্লস স্কুল যান স্পিভাক। তার জন্য এটি 'একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা' ছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক যেএকজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে তিনি সেসব নারী শিক্ষক, যাদের তিনি শ্রদ্ধা ও প্রশংসার সাথে স্মরণ করেন, স্মৃতিজুড়ে থাকবেন তারা।
গায়ত্রী: আমি শুধু বিনয় মজুমদার সম্পর্কে একটি লেখা পড়ছিলাম, সেখানে আমাকে নিয়েও কিছু কথা বলা হয়েছে। আমাকে 'কনভেন্ট বালিকা' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি 'ডায়ো (শেসান) বালিকা' হওয়ার থেকে একেবারেই আলাদা। তবে বিদ্যালয়টি মোটেও কনভেন্ট ছিল না। আমাদের সকল শিক্ষক ছিলেন বাঙালি, খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। সমাজের নিচুস্তর থেকে উঠে আসা মানুষ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
আমার মা-বাবা বেশ চৌকস ছিলেন। তারা ধরে নিয়েছিলেন, এসব মানুষ অসাধারণ শিক্ষক হবেন। সত্যিই তারা অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। তাদের কাছে উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং উঁচু পর্যায়ের অবস্থিত অভিজাত মুসলমানদের শিক্ষাদানের সুযোগ পাওয়া একটি অসাধারণ সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তারা এমনভাবে শিক্ষাদান করেছেন যে আগামীকাল বলে যেন কিছু নেই।
যখন আমি পেছনে তাকাই—সর্বোপরি, আমি এখন অনেক দশক ধরে শিক্ষক ছিলাম—তখন আমি বুঝতে পারি যে তারা শিক্ষক হিসেবে কতটা অসাধারণ ছিলেন। ভালো শিক্ষাদানের ওপর তাদের জীবন কতটা নির্ভর করত। আর মিস চারুবালা দাস, যিনি আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তিনি আমার কাছে আরও বেশি আদর্শ স্থানীয় হয়ে ওঠেন। তাঁর কোমরে ঝোলানো থাকত বাঁশি, যা ফুঁকে তিনি গোটা স্কুলকে একসাথে জড়ো করতেন। তাঁর বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব ছিল। ডায়োশেসান এমন একটি অভিজ্ঞতা, যা আমাকে আমি হিসেবে গড়ে তুলতে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। আমি প্রায়ই বলি—আমাকে গড়ে তুলেছে ডায়ো।
তারপর লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ। আমাদের প্রথম বছরে আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হতে পারিনি, তৃতীয় বছর থেকে এর দরজা খুলে যায়। আমাদের দল স্নাতক হওয়ার পর প্রথম বছর থেকেই নারীদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় এর দ্বার। ব্র্যাবোর্নেও আমার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর কারণটি হলো, সব শিক্ষকই ছিলেন দারুণ অনুপ্রাণিত নারী শিক্ষক। কিন্তু এর মধ্যে আমার কাছে সবার চেয়ে আলাদা যিনি ছিলেন, তিনি হলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। তিনি আমাদের ইংরেজি শেখাতেন, পরবর্তী জীবনে তিনি শেখাতেন সংস্কৃত।
তুমি জানো, তিনি সংস্কৃতে ঈশানবৃত্তি পাননি, কারণ তিনি ছিলেন খ্রিষ্টান, সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট। আর তাই একধরনের অবজ্ঞার সাথে পেলেন দ্বিতীয় ঈশানবৃত্তি, তা-ও ইংরেজিতে! আমি এমন এক নারীর কাছে ইংরেজি শেখার অভিজ্ঞতা কখনই ভুলব না, যিনি প্রথমত একজন মহান, আত্মবিশ্বাসী এবং নিজের সৌন্দর্যের প্রতি যত্নহীন। তার সৌন্দর্য ছিল দারুণভাবে আকর্ষণীয় কিন্তু তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় ছিল যে তিনি একে কোনো গুরুত্বই দেননি। আপনি বলতে পারেন যে তিনি তার বাহ্যিক রূপের বিষয়ে ছিলেন পুরোই উদাসীন। অভ্যন্তরীণ জীবন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এই সুকুমারীদিই আমাকে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বিতর্কের জন্য পাঠান। তিনি বলেন, আমি জানি না ও বিতর্ক করতে পারে কিনা, তবে ও খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারে; ওকে পাঠান। তাই আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে গেলাম এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি বিজয়ী হলাম। আমার বয়স ১৪। আমি বিশাল কফি টেবিল বই পেয়েছিলাম, মনে আছে। আমি বইকে জড়িয়ে ধরি, মনে আছে। এবং আমার মনে আছে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে বাস থেকে নেমে নিজের সাথে কথা বলেছিলাম, 'হি হি! প্রথম হয়েছি! আমি প্রথম হয়েছি!' আমি কোথায় থাকি, এটা জানার জন্য কোনো একজন আমার পেছনে পেছনে গিয়েছিল। সেই এ ঘটনা বলেছে। সে দেখতে পেয়েছে আমি বইকে জড়িয়ে ধরছি এবং নিজে নিজে আনন্দের চোটে বকবক করছি। (হাসি) উহ! সে দিনগুলো সত্যিই চমৎকার ছিল।
প্রশ্ন: কিশোর বয়সে সেকালের সেরা বিদ্যাপীঠ প্রেসিডেন্সি কলেজে মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে এবং দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি জীবন পথে বারবারই ঘটেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি নিয়ে পড়াটাও তেমনি এক ঘটনা আপনার।
গায়ত্রী: আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হতে চেয়েছিলাম। ভর্তি পরীক্ষায় পদার্থবিদ্যায় পাস করলাম কিন্তু গণিতে ফেল মারলাম। কাজেই পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হওয়া হলো না। তখন মনে হলো মাধ্যমিকে ইংরেজিতে প্রথম হয়েছিলাম। ইংরেজিতে আমাকে ভর্তি করতে তারা অসম্মত হবে না। কাজেই ইংরেজিতে ভর্তি হলাম সুকুমারদির জন্যেই। ইংরেজিতে স্নাতক হলাম। দুই সপ্তাহ ক্লাস করার পরই বুঝতে পারলাম যে সত্যিই ইংরেজিই আমার জন্য উপযোগী।
প্রশ্ন: সেখানকার শিক্ষক হিসেবে কাদের কথা আপনি মনে রেখেছেন?
গায়ত্রী: জি, অবশ্যই তারকনাথ সেন। আমি তাকে নিয়ে সম্প্রতি কিছু লিখেছি। সবাই তাকে পছন্দ করত। কিন্তু সেই শীতল যুদ্ধের মতাদর্শগত বিভ্রমের জন্য তার কাছে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যে বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছেন, কেউ তার সমর্থনে দাঁড়াচ্ছেন না। আমার ধারণা, এ বিষয়টি আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি। আমি সবেমাত্র তার কিছু লেখা আবার পড়েছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি তিনি কতটা অবস্তুমুখী মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক উপায়ে সত্যিই আমাদের পাঠ করতে শিখিয়েছেন।
এবং তারপরে সুবোধ বাবু ছিলেন, সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত, এমন এক বুদ্ধিজীবী যিনি তাঁর বার্নার্ড শর সাথে সংস্কৃত চর্চা করতেন। এবং অমল বাবু ছিলেন—অমল কুমার ভট্টাচার্যজী—আমরা তখনো শিক্ষকদের দাদা বলিনি, তারা সবাই বাবু। এবং তারাপদ বাবু—তারাপদ মুখোপাধ্যায় অসাধারণভাবে শেক্সপিয়ারের শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন।
অত্যুৎকৃষ্ট শিক্ষকদের নিয়ে উষ্ণ এসব স্মৃতি সত্ত্বেও অন্য আরেকটি বিষয় এই মহান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরেকটি ন্যক্কারজনক অধ্যায়ও রয়েছে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১, ১৬ থেকে ১৯ বছর অবধি এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। ভালোবাসাময় একটি পরিবার এবং বিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা এক কিশোরীকে মেয়ে হয়ে জন্মানোর নেতিবাচক দিকগুলোর মুখোমুখি হতে হয়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে জীবনে প্রথমবারের মতো লিঙ্গ অবমাননার মুখোমুখি হতে হয়। বারবার আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে শিক্ষকেরা আমাকে ভালোবাসেন কারণ আমি দেখতে সুদর্শনা। কিন্তু তাদের কাছে সত্যিই মেধাবী হিসেবে গৃহীত হয়েছে এসএস, অন্য এক ছাত্র। সে একজন পুরুষ। আমি বাড়িতে এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করিনি।আমার মা নিজেও ছিলেন এক পূর্ণাঙ্গ বুদ্ধিজীবী ।
কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ আমাকে এতটাই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনিরাপদ করে তুলেছিল এবং আমি এখনো সেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এটা অযৌক্তিক—আমি দেখতে ভালো বা খারাপ বলতে পারব না, কিন্তু আমার নিরাপত্তাহীন হওয়ার কোনো কারণ নেই! তবুও নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি। আজও আমি তা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
প্রশ্ন: আমি কৌতূহলী গায়ত্রীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলেজের বছরগুলো নিয়ে, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে যার শুরু। কলকাতার এই তরুণীর জন্য ক্যাম্পাস জীবন কেমন ছিল? এটি একটি উত্তেজনাপূর্ণ সময় ছিল। জন এফ কেনেডি সবেমাত্র প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। নাগরিক অধিকার আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠে এবং স্কুল এবং কলেজের ক্যাম্পাসগুলো জাতিগত বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। বার্লিন প্রাচীর তৈরি করা হচ্ছিল, সে বছরই বে অব পিগস ঘটনাবলি ঘটে, ভিয়েতনামে আমেরিকান সামরিক উপস্থিতির সূচনা হচ্ছিল। সব মিলিয়ে যে কেউ ভাবতে পারে গায়ত্রীর মতো একজন উজ্জ্বল তরুণীর জন্য এটি অবশ্যই একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী সময় ছিল। কিন্তু তিনি জানান,'তুমি জানো,এমটা নয়।'
গায়ত্রী: লিন্ডন জনসনের অভিবাসী কোটা এবং বিদেশি নিবন্ধন বা এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি চালু করার চার বছর আগে। তথাকথিত সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কোনো ঐতিহ্য ছিল না। অভিবাসীরা কত, কীভাবে যন্ত্রণা ভোগ করেছে ইত্যাদি নিয়ে সুন্দরভাবে লেখা কোনো উপন্যাস ছিল না। রেমন্ড উইলিয়ামস যেমন বলতেন, উপন্যাসগুলো অনুভূতির কাঠামো স্থাপন করে। তাই আমি ভাবতাম, সব জানি। আমি টাইম ম্যাগাজিন পড়তাম! আমার কোনো সমস্যা ছিল না। আমার বয়স মাত্র ১৯ বছর।
প্রশ্ন: আরও ঘটনাবলি—অথবা যদি আপনি পছন্দ করেন, নৈতিক সৌভাগ্য গায়ত্রীর পিছু নিল এবং তাকে তার শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠার দিকে পরিচালিত করল। এটিই তাকে তার দুর্দান্ত একাডেমিক খ্যাতির দিকে পরিচালিত করে। এই ঘটনাপ্রবাহ তাকে তুলনামূলক সাহিত্যে এবং সেখান থেকে জাঁক দেরিদার মূল ফরাসি থেকে অনুবাদের দিকে নিয়ে যায়।
গায়ত্রী: আমি কর্নেলে যাই, তখন আমার বয়স মাত্র ২০। আমাকে কোনো আর্থিক সহায়তা বা শিক্ষা সহায়কের পদ দেওয়া হয়নি, কারণ আমি ইংরেজিভাষী ছিলাম না। পল ডি ম্যান নতুন তুলনামূলক সাহিত্য কর্মসূচির পরিচালক নিযুক্ত হলেন। তিনি আর্থিক সাহায্য বরাদ্দের একটা বাদে সব কোটা পূরণ করেন। তিনি নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এবং যদি তিনি সমস্ত আর্থিক সাহায্যের কোটা পূরণ করতে না পারেন, তবে তার জন্য এটি কোনো কৃতিত্বের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে না। পাশাপাশি তিনি বরাদ্দকৃত তহবিলও হারাবেন, তুমি জানো।
এবং তাই, চিন্তাভাবনা করে, সন্দেহ নেই, আমাকে একটা ভালো ঝুঁকি হিসেবে নেওয়া হলো। যদি আমি সঠিকভাবে কাজ না করি, তবে সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কথা বলে বিদায় করা যাবে। কর্মসূচির পরিচালক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমি আর্থিক সহায়তাটি চাই কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ, অবশ্যই! আমার কোনো কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট ছিল না, আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা ছিল না, আমাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানোর তোড়জোড় চলছিল। এ অবস্থায় আমি বললাম, হ্যাঁ চাই। এভাবেই আমি তুলনামূলক সাহিত্য বা কম লিট-এর দিকে এগিয়ে গেলাম।
এবারে তিনি জানতে চাইলেন যে কোন কোন বিদেশি ভাষা জানি। আমি বললাম, ইংরেজি এবং তিনি বললেন না, একে বিদেশি ভাষা হিসেবে গণ্য করা হবে না। ঠিক আছে, আমি বলেছিলাম যে আমি কলকাতার অ্যালায়েন্স ফ্রাঙ্কাইসে ফরাসি ভাষার একটি সেমিস্টার নিয়েছিলাম এবং একজন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার জার্মান স্ত্রী মিসেস ভাদুড়ির সাথে আমি তিন মাস জার্মান প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম...
প্রশ্ন: এখানে আবার সেই নৈতিক ভাগ্য সহায়তা করে, যেহেতু, এখন ফরাসি ভাষায় ভালো পারদর্শী, তখন ঘটনাক্রমে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির লেখা কৌতূহলী শিরোনামের বই হঠাৎ করে তার নজরে এল।
গায়ত্রী: আমি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক থাকার সময়ে হঠাৎ করেই খুব আকর্ষণীয় শিরোনামযুক্ত একটি বই দেখতে পাই। দে লা গ্রামাটোলজি বা ব্যাকরণবিদ্যা এবং লেখককে খুব অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল। আমি আবেগের বশে বইটি কিনে নিই।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের কথা। আমার বয়স তখন মাত্র ২৫। বইটি খুব কঠিন ফরাসি ভাষায় লেখা। আমি জানি না, কীভাবে বুঝতে পারি যে এটি খুব ভালো বই। এ বই নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা হলো। কিন্তু আমি জানতাম যে একজন অচেনা সহকারী অধ্যাপক একজন অচেনা লেখকের বই সম্পর্কে লিখছেন—আমি দেরিদা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না—সে পুস্তক চলবে না। কী করব তাই আমি ভাবছিলাম।
তারপর শুনলাম ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস প্রেস অনুবাদ প্রকাশ করার পরিকল্পনা করছে। আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, আমাকে বইটি অনুবাদ করার সুযোগ দেওয়া হোক। ঠিক করলাম, আমি তাদের বলব যে অনুবাদ করব যদি তারা আমাকে বইয়ের বিষয় নিয়ে বিস্তারিত ভূমিকা লেখার অবকাশ দেয়। তাই যা ভেবেছি, তাই করেছি। আমার কথায় তারা খুশি হলো। এবং আমাকে বইটি অনুবাদের সুযোগ করে দিল। এভাবেই শুরু হলো। আমি জানতাম না দেরিদা কে এবং কেউ জানতই না যে আমি তাকে অনুবাদ করতে যাচ্ছি।
আমার লেখা বইটির ভূমিকা ধ্রুপদি হিসেবে বিবেচিত হলো। অবশ্য আমি নিজেও এটা মনে করি না। আমি মনে করি যে বইটির কিছু কিছু জিনিস বাদ পড়ে গেছে। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ ইংরেজি পাঠক তা বুঝতে পারেননি। যেহেতু আমি দেরিদাকে পরিচয় করিয়েছিলাম। তাই আমি অনুভব করি যে ভূমিকাটি দুর্ভাগ্যজনক ছিল; কিন্তু এটি আইকনিক হয়ে ওঠে। এর নিজস্ব জীবনপথ আছে। আর আমি বিশ্বাস করি, আমি নিশ্চিত নই যে ভূমিকাটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে কিনা (হাসি)।
প্রশ্ন: এবং আপনি কখন লেখকের সাথে দেখা করেছিলেন? তার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা কী মনে আছে?
গায়ত্রী: হ্যাঁ, আমি তার সাথে দেখা করি চার বছর পর, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে। তার বয়স ছিল ৪১ এবং আমার ২৯। আমাদের দেখা হয়েছিল জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। হিলিস মিলার আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি বললেন, গায়ত্রী, তোমার এই লোকের সাথে দেখা করা উচিত। আমি বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই, আমারও তাই ইচ্ছা। হিলিস আমাকে একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং দেরিদা সেখানে আসেন। আমার ধারণা ছিল না যে তিনি আমার শ্রোতাদের মধ্যে বসে ছিলেন। আমি তাকে চিনতে পারিনি, কারণ আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি। হিলিস আমার জন্য ভোজসভার আয়োজন করলে তখনই কেবল দেরিদার কথা জানতে পারি।
প্রশ্ন: সে কেমন ছিল? তার সাথে সামনাসামনি দেখা হওয়ার ঘটনা?
গায়ত্রী: আমি মনে করি, তিনি আমাকে দেখে খানিকটা অভিভূত হয়েছিলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে তার অনুবাদক সত্যিই এতটাই উদ্ভট হবেন। তখনকার দিনে শাড়ি পরা বৈশ্বিক বুদ্ধিজীবী নারীদের দেখা মিলত না। আমি কী বলতে চাচ্ছি, তা তুমি বুঝতে পারছে।একবার আলাপ-পরিচয় হওয়ার পর বোঝা গেল আমি ততটা উদ্ভট নই। তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন এবং আমরা ভালো বন্ধু হয়েছিলাম।
প্রশ্ন: তারপর আপনি শিক্ষাজগতে নক্ষত্র হয়ে উঠলেন। 'বিশ্বের অন্যতম বহুল উচ্চারিত পণ্ডিত হলেন আপনি।'
গায়ত্রী: ওহ হো! আমি না (হাসি), দেরিদা অনুবাদ করে এবং তার ওপর মুখবন্ধ লিখে আমি বিখ্যাত হয়ে উঠি।
প্রশ্ন: আমি মনে করি, এটি একটি অতি সরলীকরণ। আপনার কাজ ভালো না হলে তা প্রত্যাখ্যাত হতো। আমি জানি আপনি কত কঠোর পরিশ্রমী পণ্ডিত। আপনার কাজ সততা ও বিশুদ্ধতার সর্বোচ্চ স্তর ছুঁয়েছে।
গায়ত্রী: হ্যাঁ, আমি মনে করি, আমি সততার দাবি করতে পারি। আমি খুব বেশি পণ্ডিত নই, তবে বড় কথা আমি যা করি তাতে মিথ্যা কিছুই নেই। এত বছর পার করে এসে আমি এ দাবি করতেই পারি।
প্রশ্ন: বেশি পণ্ডিত নন? তিনি কী তার নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কথা বলছেন? তাকে মানবিকীর অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী বলে মনে করা হয়, এমন একটি খ্যাতি, যা একটি নিরেট কাজের ভিত্তিমূলের ওপর নির্ভর করে দাঁড়ায়। মানুষ তার মধ্যে যদি কিছু পেয়ে থাকে, তা হলো অধিক বুদ্ধিজীবীসসুলভ আচরণ, অসূক্ষ্মাগ্র, ঘন, দুর্ভেদ্য।
কিন্তু এই অকপট এবং সমালোচনামূলক মূল্যায়ন তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য; তিনি তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ যাত্রার পরবর্তী পর্বে চিন্তাভাবনা করার সময় এটি পুনরুত্থিত হয়, দুটি অংশ—থ্রি উইমেনস টেক্সটস (তিন নারীর রচনা) এবং ক্রিটিকস অব ইমপেরিয়ালিজম (সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা) এবং ক্যান দ্য সাবলটার্ন স্পিক? (প্রান্তিক মানুষেরা কী কথা বলতে পারে?)—যা তাকে খ্যাতিএনে দিয়েছে, 'যা কেবল দেরিদাকে নিয়ে করা কাজ থেকে উৎসারিত হয়নি।'
গায়ত্রী: তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। একটি মহানগরবাসী প্রবাসীসমালোচক গোষ্ঠীর জন্য এগুলো এক সাধারণ সংকট বিন্দু (আমি এখনো একজন ভারতীয় নাগরিক, কিন্তু একজন ব্যক্তি কাগজপত্রের ভিত্তিতে প্রবাসী হয়ে যান না। তেমনি একজন নাগরিকও কেবল কাগজের ভিত্তিতে হন না )। আমার সংকট ছিল যে আমি বিদেশি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছিলাম।
থ্রি উইমেনস টেক্সটে অনেক কিছুই নজরে এল। এসব রচনা ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন আমি আগে বহুবার পড়েছি। দাসত্বের চিহ্ন আমার নজর এড়িয়ে গেছে, আমি লক্ষ করিনি। জেন আয়ার ছিল কেন্দ্রীয় রচনা। রচেস্টার জ্যামাইকায় আখ প্ল্যানটেশনের মালিক এবং হাজার হাজার ক্রীতদাস এবং আমি যদি সেই সময়ে ব্রিটেনের ইতিহাসের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকাতাম, তবে কেবল ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন নয়, আমি সে চিহ্নটিও দেখতে পেতাম।
আমি এখন বড় দুঃখ বোধ করছি যে দাসত্বের অধ্যয়ন থেকে ঔপনিবেশিকতার অধ্যয়ন পুরোপুরি আলাদা হয়ে গেছে; কিন্তু নিজের জটিলতা না দেখা এবং শুধু 'ওরা খারাপ, আমরা ভালো' বলা সম্ভব হওয়ায় সে রচনাটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এটি এখনো এতটাই উদ্ধৃত করা হয়েছে যে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে এটিই আমাকে সাবল্টার্ন স্টাডিজ সার্কিটে নিয়ে গেছে এবং আমাকে এমন এক খ্যাতি এনে দিয়েছে, যা দেরিদার জন্য করা আমার কাজকে ছাড়িয়ে গেছে।
ক্যান সাবলটার্ন স্পিকের বেলায় সংকট ছিল আরও বেশি। কীভাবে আমি ফরাসি তত্ত্ব এবং বিনির্মাণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠি। আমি এ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি। আমার দাদির বোন ভুবনেশ্বরী ভাদুড়িকে বেছে নিয়ে এ থেকে বেরিয়ে আসি। আমি এটি পাঠিয়েছি—এ এমন এক গল্প, যা অনেকবার বলেছি, আমার সম্পাদককে বলেছি লেখাটা খুব দীর্ঘ, খুব কঠিন, দয়া করে আমাকে এটি কাটছাঁট করতে সাহায্য করুন। তারা কিছুই করেননি। যেমন ছিল সেভাবেই কেবল তারা রচনাটি প্রকাশ করেন। মানুষের অভিযোগ যে লেখাটা অতিরিক্ত বড় এবং খুব কঠিন!
সত্যিই এতে সম্পাদকীয় বাধ্যবাধকতাকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করা হয়। যদিও এ নিয়ে ব্যাপক ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এর কারণ হলো লেখাটিখুবই দীর্ঘ এবং বেশ কঠিন। আমি এতে কী বলতে চাইছি, লোকেরা তা বুঝতে পারে না। অন্যান্য রচনার সাথে এটিও আমাকে খ্যাতির পথে ঠেলে দেয়, যদিও এর সাথে দেরিদার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না।এবং একই সময়ে, অবশ্যই, আমি তাদের মধ্যে দলভুক্ত হয়েছি দেরিদিয়ানরা সে সত্যটি পছন্দ করেনি। এর কারণ হলো, আমি ফরাসি পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলাম না। আমি আগন্তুক। তাই তারা আমাকে 'তৃতীয় বিশ্ব' হিসেবে তুলে ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
প্রশ্ন: তাই এখানে তিনি হয়ে ওঠেন, একজন 'অদ্ভুত' বিনির্মাণবাদী, একজন বিকাশমান উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচক, এছাড়া মহাশ্বেতা দেবীর বাংলা কথাসাহিত্যের অনুবাদক। তিনি অনুবাদ সম্পর্কে কেমন অনুভব করেন? তিনি কী আরও অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন?
গায়ত্রী: অনুবাদ খুবই শ্রমসাধ্য বিষয়। এই উপলক্ষে আমার ৮০তম জন্মদিনে তারা আমার অনুবাদের ওপর একটি বই, রচনাবলি, একসাথে সংকলন করেছেন। আমি বারবার বলি, এটি পাঠের নিবিড় কাজ। এটি এমন নয়, যা আপনি কেবল ইচ্ছে করলেই করতে পারেন। তাই দেরিদার পরে আমি মহাশ্বেতা দেবীর রচনা অনুবাদ করলাম। কিন্তু রণজিৎ গুহ আমাকে দ্রৌপদীর অনুবাদ করতে বলেছিলেন।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)