নোবেলজয়ী হান কাংয়ের সাক্ষাৎকার
২০২৪ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী প্রথম কোরিয়ার ফিকশন লেখক হান কাং। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে জানুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায় লেখক ক্রিস লি ও হান কাংয়ের কথোপকথন অনূদিত হলো।
প্রশ্ন: আপনি কেমন করে লেখক হলেন সেই বৃত্তান্ত আমাদের বলবেন? ব্যাপারটা কি এরকম যে, আপনি সেই অল্প বয়স থেকেই লেখক হতে চেয়েছেন?
উত্তর: আমি সবসময়ই সাহিত্যিক প্রভাববলয়ের মধ্যে ছিলাম। জানেন তো, আমার বাবাও সাহিত্যিক ছিলেন। আমরা একটা সাধারণ ঘরে বাস করতাম, আমাদের তেমন বেশি আসবাবপত্র ছিল না, আমাদের অনেক জায়গায় বসবাস করতে হয়েছে। বাবা বই সংগ্রহ করতে ভালোবাসতেন, কাজেই স্বাভাবিকভাবে এসব বই আমাকে ঘিরে রাখত। মেঝের ওপর বই, ঘরের প্রতিটি কোনাকাঞ্চিতে বই। কেবল দরজা আর জানালা ছাড়া ঘরের সমস্তটাই বইয়ে আবৃত। এই পাঠাগার বেড়ে উঠতে থাকে। আমার মনে পড়ে, আমরা সবসময়ই অনুভব করতাম, বই হচ্ছে প্রসারণশীল, মানে অবিরাম বেড়ে চলেছে, সবসময়ই এতটা পর্যাপ্ত যে, যখন আমি আমার বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম, বুঝতে পারতাম এসব বাড়িতে বইয়ের এত অভাব।
আমি স্বাধীনভাবে পড়ে গেছি, ভাষা আত্মস্থ করেছি, বাবা-মা আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, যাতে আমার ইচ্ছেমতো চ্যালেঞ্জিং সব উপন্যাস পড়তে পারি। আমি আবিষ্কার করলাম, আমি পড়তে ভালোবাসি। লেখালেখির ব্যাপারটাও প্রাকৃতিকভাবেই চলে এলো। আমি যখন টিনেজ বয়স পার হচ্ছি, অস্তিত্ব-সংক্রান্ত সাধারণ সব প্রশ্ন আমার মনে ভিড় জমাত: আমি কে? আমার কী উদ্দেশ্য? মানুষকে মরতে হবে কেন? তারপর মানুষ কোথায় যাবে? এসব প্রশ্ন ভারী বোঝার মতো মনে হতো, কাজেই আবার আমি বইয়ের কাছে ফিরে যাই, কারণ আমি বিশ্বাস করতাম আমার শৈশবের অনেক প্রশ্নের জবাব বইতে রয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো উত্তর ছিল না। এটাই পরিহাস যে, আমার উৎসাহ এখান থেকেই। এটাই আমাকে দেখিয়ে দেয় যে, আমিও লেখক হতে পারব—যাদের প্রশ্ন আছে কিন্তু উত্তর নেই, তাদের জন্য লেখক হওয়া।
প্রশ্ন: ভিস্যুয়াল আর্ট—দৃশ্যমানতার যে অনুভূতি তা আপনার লেখায় খুব প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে। আমার জানতে ইচ্ছে করে ছবিতে এই আগ্রহ কোথা থেকে এলো? আপনার দ্য ভেজেটারিয়ান এবং ইয়োর কোল্ড হ্যান্ডস-এ চিত্রশিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলেন কেমন করে?
উত্তর: আমি যখন ছোট ছিলাম আমার একজন আন্ট চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করতেন, তিনি কিছু সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তার কক্ষটি ছিল ছবিতে ভরা। আমি প্রায়ই তার জন্য মডেলও হতাম।
সত্যি বলতে কি স্থির হয়ে থাকা একটি কঠিন কাজ। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের বিষয় বুঝতে সাহায্য করেছে। আমি নিজে কখনো ছবি আঁকাআঁকির দিকে এগোইনি। আমি যখন আইওয়া ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে যোগ দিই, ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমাকে স্টাইপেন্ড দেওয়া হয়। আমেরিকার নতুন শহরগুলো দেখতে যখন বের হয়েছি, আমি একাই গিয়েছি, কাজেই স্বাভাবিকভাবেই আমি মিউজিয়ামগুলোতে অনেক বেশি সময় কাটিয়েছি। আমার বয়স যখন বিশের কোঠায় বলতে পারেন, তখন শিল্পকলা সম্পর্কে আমি অনেকটা সচেতন হয়ে উঠি। আমার মনে হয়, আমি সেসব অভিজ্ঞতা শুষে নিতে পেরেছি এবং আমার লেখায় তা প্রতিফলিত হয়েছে।
পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের জন্য আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আবিষ্কার করতে পছন্দ করি। যেমন কালো কোটের ওপর তুষারপাতের দৃশ্য। এক সেকেন্ডের কম সময়ের জন্য এটা প্রায় ষড়কৌণিক রূপ ধারণ করে। ভিস্যুয়াল আর্টেও এটা ধরা কঠিন। কোনোকিছুকে গভীরভাবে দেখা এবং ভেতরটাকে দেখাটাই আমি মনে করি সাহিত্যের ভুবনের একটি বড় অংশ। তবে সম্প্রতি আমি ছবি আঁকতে শুরু করেছি। এভাবে শিল্পের সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল, কাজেই সচেতন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া আমি স্বাভাবিকভাবেই লেখালেখিতে শিল্পের কথা বলে থাকি।
প্রশ্ন: আমি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মন্তব্যটির কথা বলছি—নির্জনতা বরাবরই তাঁর লেখার বিষয়, যা বিভিন্ন কাঠামোতে তাঁর লেখায় ফিরে এসেছে। লেখক হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, বিভিন্ন ধরনের ভাব ও আবিষ্টতা আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আপনার কি এমন কিছু আছে, যা আপনি বারবার আবিষ্কার করতে চান, যার কাছে ফিরে যেতে চান, যা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়?
উত্তর: আপনি যেভাবে বলেছেন, আমার অনুভূতি সেরকমই। আমি কী লিখছি সে-সম্পর্কে অতিসচেতন না হয়েই আমার প্রথম উপন্যাসটি লিখেছি। আমার ভেতরের কিছু একটা আমাকে বাধ্য করেছে। ভেতর থেকে উথলে উঠেছে আর আমি লিখতে পারি বলেই লিখেছি। কিন্তু যখন লেখালেখি চালিয়ে গেলাম, একসময় বুঝতে পারলাম, কিছু বিষয় রয়েছে, যা আমাকে বিচলিত করে, সে-কারণেই তা আমার লেখার বিষয় হয়েছে, যা আমি আঁকড়ে ধরেছি, অন্যগুলো চালিয়ে গেছি। আমি মনে করি না কেবল নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের কাছে আমি ফিরে এসেছি। আমি প্রায়ই ফিরে আসি মানুষের সহিংসতার প্রশ্নের কাছে। যেমন আমার উপন্যাস দ্য ভেজেটারিয়ানে একজন নারীকে তুলে ধরা হয়েছে, যে সর্বত্র বিরাজমান ও দৈবাধীন সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এমনকি নিজের জীবনের বিনিময়ে। আমার অন্য একটি উপন্যাসে প্রধান চরিত্র যে নারী, সে ভাষার সহিংসতা শনাক্ত করে সব ভাষাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি যদিও সরাসরি এই অভিজ্ঞতা লাভ করিনি, আমার শৈশব ও যৌবনের বড় ধরনের সহিংসতা আমাকে প্রভাবিত করেছে।
প্রশ্ন: আপনি কি গোয়াঙ্গজু ম্যাসাকারের কথা বলছেন? [এটি মে ১৮-এর গণতান্ত্রিক উত্থান নামেও পরিচিত। এতে জিওনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ বহু নাগরিক ১৯৮০ সালে চুন দু হিউয়ান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার সময় সরকারি বাহিনীর হাতে আহত ও নিহত হয়।]
উত্তর: সহিংসতা মানুষেরই অংশ। আমি সেই মানুষদের একজন, এটা কেমন করে গ্রহণ করি। এ ধরনের ভোগান্তি আমাকে সবসময় তাড়া করে। হ্যাঁ, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যে সহিংসতা বিরাজ করছে আমার চিন্তা সেদিকেও সম্প্রসারিত। মাংস খাওয়া, মাংস রান্না—সবকিছুতেই সহিংসতার প্রকাশ ঘটেছে, যার স্বাভাবিকীকরণ হয়েছে।
প্রশ্ন: এমনকি মাটিতে পা ফেলাও সহিংসতা, কারণ ঘাসেরও তো প্রাণ আছে।
উত্তর: হ্যাঁ, এটা সত্য। তবে এ-সহিংসতা মানুষ নিজের মধ্যে আত্তীকৃত করে নিয়েছে। মানুষের নিজেরও সহিংসতা মোকাবিলা করার কিংবা ভিন্ন পথে চলে যাওয়ার একটি অন্তর্গত সহজাত প্রবৃত্তি রয়েছে। আমি সেদিকে বেশি এগোচ্ছি। গোয়াঙ্গজু ম্যাসাকার নিয়ে আমার বই হিউম্যান অ্যাক্টস লেখার পর থেকে আমি মানুষের মর্যাদা ও শক্তিকে আরো গভীরভাবে দেখতে চাই।
প্রশ্ন: স্থান হিসেবে সিউল কিংবা কোরিয়া নিজে আপনার লেখাকে কতটা প্রভাবিত করে?
উত্তর: আমার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার শৈশবে আমাকে বহু জায়গায় ঘুরতে হয়েছে, আমি পাঁচটি প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। এখন আমি যেখানেই যাই, আমি জানি খাপ খাইয়ে নিতে পারব। আমি যেসব শহরে বসবাস করেছি আমার লেখায় অবশ্যই তার ছাপ পাওয়া যাবে। সিউলে চলে আসার আগে আমি নয় বছর গোয়াঙ্গজুতে বসবাস করেছি। সেই ছোট শহরের ছাপ আমার অন্তঃকরণে রয়ে গেছে। এটাই সেই শহর, যা আমার অনেক উপন্যাসে উঠে এসেছে। ১৯৮০-এর জানুয়ারিতে আমি যখন সিউল চলে আসি, আক্ষরিক অর্থেই দক্ষিণের উষ্ণ আবহাওয়ার তুলনায় এটি আমার কাছে শীতল মনে হয়েছে। আপনি কখন কোরিয়া থেকে আমেরিকা যান?
আমার বেলায় এটা ঠিক তুলনা করা যায় না—তবে এটা আমার জন্য একটি বড় পরিবর্তন। গোয়াঙ্গজু উষ্ণ শহর, শীতে সেখানে ফুলের সমারোহ। আমরা জানুয়ারিতে যখন সিউল এলাম শহরটা ভীষণ ঠান্ডা। পুরু সোয়েটার ও মোজা পরে বিছানায় থাকার সময়ও আমি শীতে কেঁপেছি। তখন আমি নিজেকে শুনিয়েছি এখানে আমার জন্য জীবন হবে খুব শীতল। শহরের বিশালত্ব এবং শীতল নিস্পৃহতা অমঙ্গলজনক মনে হয়েছে—সিউলে আমার জীবন কেমন হবে? আমি যদিও নতুন কোনো জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারে শঙ্কিত নই—আমি সেই ধরনের মানুষ যে সংগ্রাম করে, সর্বত্রই প্রশ্ন করে। আমি তাদের সঙ্গে থাকি, সব শুষে নিই এবং সব জায়গার ছাপ আমার লেখায় রয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার একজন সুপরিচিত সমালোচক ও ভক্ত বলেছেন, আপনার বই পড়ার আগে পাঠককে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে হবে। এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উত্তর: আমার বিশ্বাস এর কারণ, আমার উপন্যাস সরাসরি মানুষের ভোগান্তিকে তুলে আনে। ভোগান্তি থেকে সরে না গিয়ে আমি এর ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করি। এটাই আমার প্রবণতা, আমি সবসময়ই ব্যক্তির পেছনের সত্যিকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি। কাজেই আমি যখন গোয়াঙ্গজু হত্যাযজ্ঞ নিয়ে লিখলাম—এই ট্র্যাজেডির এত যে ভোগান্তি, আমার হাতে যখন এসব বিষয়, তিনি সম্ভবত এটাই বলেছেন—এই অভিজ্ঞতালাভের জন্য, এই যন্ত্রণা অনুভব করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার কাজে আমি দেখতে পাই শব্দকে দেখার একটি নিজস্ব পদ্ধতি আপনার রয়েছে—দৃশ্যমান চিত্রকল্প বিবেচনা করেন। আপনার গ্রিক লেসনস উপন্যাসের (২০১১-তে প্রকাশিত) আগাগোড়া শব্দ চয়নে আপনি সতর্ক সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। আপনার কাজের বেলায় ভাষার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে আমাদের কৌতূহল রয়েছে।
উত্তর: আমি একটি কাব্যগ্রন্থও রচনা করেছি, কুড়ি বছর ধরে লেখালেখিতে একইভাবে শব্দ ও চিত্রকল্পের নিরীক্ষা চালিয়ে আসছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ভাষা একটি অত্যন্ত জটিল হাতিয়ার, এটাকে ব্যবহার করা খুব কঠিন একটি কাজ। কখনো-কখনো অসম্ভব একটি কাজ। অন্য সময় আমি যা বলতে চাই ভাষা তা বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ করতে পারে—তবে এটাকে সফল হয়েছে বলাটা যথার্থ হবে না। অধিকন্তু আমাকে তো লিখেই যেতে হবে, এমনকি যদিও আমি জানি এটা ব্যর্থ হবে। কিন্তু এটাই তো আমার হাতের একমাত্র হাতিয়ার। এটা এক নিরন্তর দ্বন্দ্ব, যার অভিজ্ঞতা বহু কবির হয়েছে। বিশেষ করে আমার গ্রিক লেসনসে প্রধান চরিত্র কথা বলতে পারে না। এর বদলে কবিতা লেখে। ভাষায় প্রতিটি বাক্যের সৌন্দর্য আছে, কালিমা আছে, শুদ্ধতা আছে, আবর্জনাও আছে, সত্য আছে, মিথ্যেও আছে। তা সত্ত্বেও আমাদের কথা বলা, লেখা ও পড়া চালিয়ে যেতে হবে। যখন লেখালেখিতে একটু ঢিলে দিই, আমি একটু বিরতি নিই। আমি বলি, কুড়ি বছর ধরে তো লিখছিই, দু-এক বছর ক্ষান্ত দিই।
প্রশ্ন: আমরা উপন্যাসের প্রশ্ন নিয়ে কথা বলেছি, আপনি অনুধাবন করেছেন লেখকের হাতে সব প্রশ্নের উত্তর নেই। শেখভ একবার বলেছিলেন, সাহিত্যের কাজ প্রশ্ন উত্থাপন করা। আপনি যখন উপন্যাস লেখেন আপনি কি নির্দিষ্ট কোনো প্রশ্নের ওপর আলোকসম্পাত করে এগোন, নাকি উপন্যাস লেখার প্রক্রিয়ায় জৈবিকভাবেই তা চলে আসে?
উত্তর: অবিরাম দু-এক বছর লেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন কাজ। ইয়োর কোল্ড হ্যান্ডস (২০১২) লিখতে আমার সবচেয়ে কম সময় লেগেছে, আনুমানিক এক বছর আর অন্য একটির জন্য সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে—চার বছর। প্রতিটিই ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। সারাক্ষণই আমার ভেতর প্রশ্নের উদ্গিরণ হচ্ছে! লেখাটি যখন উপন্যাস হয়ে উঠতে থাকে প্রশ্নের গুরুত্ব বদলাতে থাকে। একটি উপন্যাসের পেটে যে-প্রশ্ন ঝলকে ওঠে প্রায়ই তা দিয়ে শুরু হয় পরের উপন্যাসটি। প্রশ্ন ও উপন্যাসের মধ্যে অনুক্ষণ মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকে। যেমন দ্য ভেজেটারিয়ান উপন্যাসে আমি মানুষের সহিংসতা নিয়ে প্রশ্ন করেছি, মানুষের পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার শক্তি নিয়ে প্রশ্ন করেছি। আমাদের সবার পক্ষে গাছ হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আমরা এমন সহিংস পৃথিবীতে কেমন করে বসবাস করব? গ্রিক লেসনসে ধরে নেওয়া হয়েছে পৃথিবীতে বসবাস করা সম্ভব—যেক্ষেত্রে মানুষের প্রকৃতির উৎস কী হওয়া উচিত? উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একজন নারী তার করতলে যখন কিছু লিখতে যায় তার আঙুলের নখ সামান্য কেটে যায়। এতে সে কোনো ছাপ রেখে যেতে পারে না। অন্য একটি দৃশ্যে সে তার দুই করতল একত্র করে, সেখানে একটি অর্থবহ শব্দের সৃষ্টি হয়। আমি এরকম একটা অনুভূতি সঞ্চার করতে চেয়েছি, ছোট-ছোট অনেক জিনিসই মানুষ গড়ে তোলে, এখানে নিহিত অর্থবহতার শক্তি।
প্রশ্ন: আমি জানি আপনি নিজেই একসময় নিরামিষাশী ছিলেন। আপনার উপন্যাস দ্য ভেজেটারিয়ানে এর কি ছাপ পড়েছে?
উত্তর: আমার বয়স যখন মধ্য কুড়িতে আমি নিরামিষাশী হয়ে পড়েছিলাম। আমার চারপাশের সবাই আমাকে মাংস খাওয়ানোর ব্রত নিয়েছিল। কোরিয়ান সমাজে ব্যাপারটা কেমন বুঝতেই পারেন। এটা একটা সংঘবদ্ধ সমাজ। আমি যে-ই হই একজনের পক্ষে ভিন্নভাবে খাওয়া খুব কঠিন কাজ। আমার চিকিৎসক যখন আমার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন এবং পুনরায় একটু-একটু করে মাংস শুরু করতে বললেন, আমার খাবারে মাংস ফিরে এলো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রভাব অবশ্য দ্য ভেজেটারিয়ানে রয়েছে। আমি নিরামিষাশী হয়ে যাওয়ায় আমার চারপাশের সবার যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা বিশেষভাবে কৌতূহলোদ্দীপক। এটা খানিকটা লজ্জার ব্যাপারও।
দ্য ভেজেটারিয়ান উপন্যাসের উৎস আমার একটি ছোটগল্প 'ফ্রুটস অব মাই ওমেন' (২০০০)। গল্পটি যখন প্রকাশিত হয় আমার বয়স ২৬ বছর। গল্পের চরিত্র একজন পুরুষ ও একজন নারী। একদিন দিনের কাজ সেরে পুরুষ যখন বাড়ি ফিরে আসে দেখে তার স্ত্রী একটি বৃক্ষ হয়ে গেছে। তখন সে স্ত্রীকে একটি টবে স্থাপন করে পানি ঢালে এবং বৃক্ষ পরিচর্যা করে। ঋতুবদলের সঙ্গে-সঙ্গে বৃক্ষের শক্ত বীজ ছড়িয়ে পড়ে। স্বামী যখন বীজগুলো ব্যালকনিতে নিয়ে যায় সে ভাবে, বসন্তে তার স্ত্রী ফুল ফোটাতে পারবে তো? সব মিলিয়ে গল্পটি তেমন বিষণ্নতার নয়। জাদুকরী। কিন্তু গল্পটি লেখার পর আমি ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপট থেকে গল্পটি লিখতে চেয়েছি। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে দ্য ভেজেটারিয়ান একটি 'ডার্ক' উপন্যাস এবং ভিন্ন ধরনের।
প্রশ্ন: দ্য ভেজেটারিয়ান ২০০৭ সালে কোরিয়াতে প্রকাশিত হয়, তার পর আপনি তিনটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। আমার মনে হয় লেখকরা তাঁদের প্রতিটি উপন্যাসেই নতুন কিছু শেখেন। আর এটা বুঝতে পারার কারণেই আমরা লেখাটা চালিয়ে যাই। আপনার লেখা আপনাকে কীভাবে বদলায়?
উত্তর: দ্য ভেজেটারিয়ান লেখার সময় আমি বদলে গেছি। শুরুতে আমি তিন খণ্ড লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম এবং প্রধান চরিত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র সম্পর্কে আরো কিছু প্রকাশ করার কথা ভেবেছিলাম। আমি যখন প্রধান চরিত্র ইয়োঙ্গ হি-র মানে তৃতীয় খণ্ডের শেষে এসে পৌঁছলাম, বুঝতে পারলাম, আমি শেষ করে এনেছি। এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন; কিন্তু আমি কোনোভাবে বুঝতে পারলাম উপন্যাস লেখার প্রক্রিয়ায় আমিও শক্তিশালী হয়ে উঠছি।
প্রশ্ন: কোরিয়ার সাহিত্যবাজারের সঙ্গে আমার পরিচিতি নেই, তবে আমি এটা বুঝতে পেরেছি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লেখকদের একই রকম মর্যাদা দেওয়া হয়, যা অন্য অনেক দেশে দুর্লভ ব্যাপার। কোরিয়াতে আগের পরিস্থিতি বদলে গেছে। আমি কি বিষয়টি ঠিকভাবে ধরতে পেরেছি, না এ ব্যাপারে আপনার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা আছে?
উত্তর: এটা সত্যি, তবে এটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপকও। নারী হওয়ার কারণে আমি কখনো লেখক হিসেবে বৈষম্যের শিকার হইনি। এটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং কোরিয়া তা মেনে নিয়েছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, কোরিয়াতে মেধাবী নারী-লেখকের সংখ্যা অনেক, তাঁদের বাদ দিলে কোরিয়ার সাহিত্য-জগৎ অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। এ-বিষয়ে আমি আগেও ভেবেছি এবং দেখেছি, অধিকাংশ দেশের তুলনায় লিঙ্গ-সাম্যের প্রশ্নে কোরিয়ার অবস্থান অস্বাভাবিক রকম ভালো; আর এটাই কোরীয় সাহিত্যের একটি বড় শক্তি। তবে শিল্পের অন্যান্য অঙ্গনে পরিস্থিতি ভিন্ন। যেমন স্থানীয় চলচ্চিত্রশিল্প অত্যন্ত রক্ষণশীল। পুরুষ চিত্রপরিচালকরাই কোরীয় চলচ্চিত্রশিল্পের প্রায় পুরোটা দখলে রেখেছেন। এটা নিয়ে ভাবা দরকার।