মৃত ভাষার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী
ভাষার মৃত্যু কীভাবে হয়? ভাষা কি হুট করে মারা যায়? নাকি পুরো বিষয়টাই ঘটে খুব ধীরে? দুটো উদাহরণই অবশ্য দেওয়া যায়। ১৮১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সুম্বাওয়া দ্বীপে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে তাম্বুরান ভাষাভাষী সব অধিবাসীর মৃত্যু হয়। সেইসঙ্গে হুট করে হারিয়ে যায় গোটা তাম্বুরান ভাষা। শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, গণহত্যার শিকার হয়েও ভাষার মৃত্যু ঘটে। ক্যালিফোর্নিয়ায় বসতি স্থাপনকারী শ্বেতাঙ্গরা ইয়াহি ইন্ডিয়ানদের হত্যা ও উচ্ছেদে মত্ত হলে হারাতে বসে ইয়ানা ভাষা। ১৯১৬ সালে সর্বশেষ ইয়াহি আদিবাসী ইশির মৃত্যুর সঙ্গে ইয়ানা ভাষার কাজও ফুরায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের কবলে অনেক ভাষাই বিলুপ্ত হয়। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার ৭৫ বছরের মধ্যে তাসমানিয়ার আদিবাসীদের সঙ্গে হারিয়ে যায় তাদের ভাষাও। কোনো ভাষাবিদ নয়, বরং কখনো চিকিৎসক, কখনো জরিপকারী, আবার কখনো পাদ্রিরা কাঁচা হাতে বিলুপ্তপ্রায় এসব ভাষার সামান্য কিছু শব্দ সংগ্রহ ও নথিভুক্ত করে রাখেন। কিছু কিছু ভাষার আবার পুনরুত্থানও ঘটে। ধারণা করা হতো ডলি পেনট্রিথের মৃত্যুর পর ১৭৭৭ সালে করনিশ ভাষা হারিয়ে যায়। কিন্তু এরও প্রায় এক শ বছর পর ১৮৭৫ সালে ষাটোর্ধ্ব ছয় ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়, যারা কর্নিশ ভাষা জানতেন। সুতরাং কোনো ভাষা মৃত কি না, নিশ্চিতভাবে সেই সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তাই ভাষার মৃত্যু হুট করে হচ্ছে, না ধীরে ধীরে- সেই পার্থক্য নির্ণয়ও সহজ নয়।
তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দৈনন্দিন কাজে কোনো ভাষার নিয়মিত ব্যবহার কমে আসলে বলা যায়, সেটি ধীরপায়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো ভাষা দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার দরুণও মানুষ ধীরে ধীরে সেটি ভুলতে বসে। অনেক সময় পুরোনো রীতিনীতি চর্চা এমনকি জীবনযাপনের ধরণ বদলে যাওয়ায় পুরোনো অনেক শব্দও হারিয়ে যায়।
১৯ শতকের শুরুতে কয়েকজন ভাষাবিদের দাবি ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো কালের বিবর্তনে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। বিষয়টিকে স্রেফ কাকতালীয় নয়, বরং ভাষার এই আধিপত্যকে 'সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট' হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তারা। ঔপনিবেশিক সরকার ও মিশনারিরা আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা ও জ্ঞানকে সমপর্যায়ের গণ্য করত না। আর তাই ফরাসি বা ইংরেজির মতো ইউরোপীয় ভাষাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় রূপ নিতে থাকে, যার জাঁতাকলে পড়ে শুরু হয় ভাষার মৃত্যু।
অস্ট্রেলিয়ার ডিয়ারবাল ভাষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অ্যানেট স্মিথ দেখেন ১৫ বছরের কম বয়সীদের কেউই ডিয়ারবাল ভাষায় পুরো একটি বাক্য গঠন করতে পারে না। এমনকি ১৫-৩৯ বছর বয়সী যারা ভাষাটি জানে, তাদের ভাষাও মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে পূর্ববর্তী দুই প্রজন্মের বলা ভাষার থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন। নতুন কোনো শব্দের ব্যবহারও তাতে নেই। আমরা সাধারণত দৈনন্দিন কাজে গুটিকয়েক রপ্ত বাক্যই বেশির ভাগ সময় ব্যবহার করি। যেমন 'কেমন আছেন?', 'ধন্যবাদ' ইত্যাদি। এই বাক্যগুলো আমাদের মুখস্ত। তবে যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো ভাষায় কথা বলতে জানেন, তারা সাধারণত সহজেই নতুন সব বাক্য গঠন করতে পারেন। মৃতপ্রায় ভাষায় কথোপকথনে সাধারণত এই স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না।
কিন্তু ভাষা বা শব্দের বিলুপ্তিতে ক্ষতি কোথায়? শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, গাছ বা মাছকে অন্য কোনো নামে ডাকলেই বা কী? তাতে কি তার অর্থ বদলে যাবে? শেক্সপিয়ারের সেই বক্তব্য থেকে অনেকে ভাবতে পারেন ভাষা বা শব্দ হারালেই কী? কেউ গোলাপ ডাকতে না জানলে, সেটাকে রোজই ডাকুক না হয়। তাতে আর কী হবে?
কিন্তু ভাষা এত ঠুনকো নয়। পুরোনো ভাষাগুলো শুধু কিছু শব্দভান্ডার নয় বরং বহু স্থানীয় জ্ঞানের সংকলন। এমন বহু প্রজাতির গাছপালা বা মাছ আছে, যাদের পরিচয়-বৈশিষ্ট্য পশ্চিমের বিজ্ঞানব্যবস্থা এখনো নির্ণয় করতে পারেনি। জীববিজ্ঞানীদের বহু আগেই সামুদ্রিক জলজ প্রাণীদের জীবন ও আচরণ সম্পর্কে মৌখিক জ্ঞান অর্জন করেছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা। বিজ্ঞানীদের অনেকে বলেন, ১৭৭৮ সালে ক্যাপ্টেন কুক যখন প্রথম হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে আসেন, তখন এখানকার বাসিন্দারা জলজ জীবন সম্পর্কে যত গভীরভাবে জানতেন, বর্তমান বিজ্ঞানীরা তার সামান্যতমও জানেন না। তাদের দুই হাজার বছর ধরে সঞ্চিত জ্ঞানভান্ডারের কাছে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা কিছুই না।
টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৯১ সালের 'লস্ট ট্রাইবস, লস্ট নলেজ' শিরোনামের একটি কভার স্টোরিতে বলা হয়, যখন স্থানীয় সংস্কৃতিগুলো হারাতে শুরু করে, তখন বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাসংক্রান্ত জ্ঞানভান্ডারও বিলুপ্তির মুখে পড়ে। সংস্কৃতি সঞ্চালিত হয় ভাষার মাধ্যমেই। জ্ঞান হারানোর পেছনে সংস্কৃতির ক্ষতিকে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়, ভাষার বিলুপ্তিকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আদিবাসী ভাষাকে আদিম ও পশ্চাৎমুখো বলে উড়িয়ে দিয়ে বর্তমান বিশ্বে হয়তো পশ্চিমা ভাষা ও সংস্কৃতিকে উন্নয়ন ও আধুনিকতার শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতার কারণে অনেকের ধারণা বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর শব্দসংখ্যা হয়তো মাত্র কয়েক শ। সত্যি কথা হলো চর্চা ও সংকলন না থাকায় এসব ভাষার শব্দভান্ডারও কালানুক্রমে সংকুচিত হয়ে এসেছে।
কোনো ভাষার শব্দভাণ্ডার হলো সেই সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের এক বিশাল তালিকা। সেই সংস্কৃতির মানুষ শুধু কোন ভাষায় কথা বলছে তা না, বরং তাঁরা এই পৃথিবীকে কীভাবে দেখছে এবং কীভাবে নিজেদের আশপাশের জগৎ ঘিরে বাস্তুসংস্থান তৈরি করেছে, সেসব রহস্যও লুকোনো থাকে এই ভাষাতে। পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের বিমূর্ত ধারণাকে রূপ দেয় এই ভাষা। একেক সংস্কৃতির মানুষ নিজেদের সৃজনশীলতা, চিন্তাধারা অনুসারে একেকভাবে বিমূর্ত সব ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে পৃথিবীকে অর্থবহ করে তোলে। আর এ কারণেই একেকটি ভাষা হারানোর অর্থ একেকটি পৃথিবী, পৃথিবীকে দেখার একেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলা। কালের বিবর্তনে জানা-অজানা কত ভাষার সঙ্গে হাজার বছরের পুরোনো সঞ্চিত কত জ্ঞান যে হারিয়েছে, তার হিসাব নেই। তবে এসব জ্ঞান পুনরুদ্ধারে মানুষকে যে আরও বহু বছর অতিবাহিত করতে হবে, তা একরকম নিশ্চিত।