ভাষারা যখন মরে: বাংলা কোন পথে!
প্রিয়জন যখন হারিয়ে যায়, তখন কাউকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাওয়া দায়। কিন্তু শব্দেরা যখন মরে যায়, খোদ ভাষাই তখন হারিয়ে যায়! সে হারানোর বেদনা প্রকাশের ভাষা কী হবে? আমাদের জিভ খুঁজে ফিরবে কোন জবান? আর এভাবেই কি চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে একটি জবান? চলতি কথায় 'জবান বন্ধ' হওয়া মানে মরণাপন্ন হওয়া বা মৃত্যুকে বোঝানো হয়, সে কথা আমরা সবাই জানি।
ভাষার মৃত্যু বলতে কী বোঝায়, সে প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাওলী মাহবুব টিবিএসকে জানান, "ভাষাতত্ত্বে ভাষার মৃত্যু বলতে সেই বিশেষ পরিস্থিতিকে বোঝানো হয়, যখন কোনো ভাষা তার শেষ 'নেটিভ স্পিকার' বা 'স্থানীয় বক্তা'কে হারিয়ে ফেলে, অথবা নিজস্ব ভাষার সাথে অন্য একটি ভাষা ব্যবহার করেন এমন দ্বিতীয়-ভাষী কথককেও আর খুঁজে পাওয়া যায় না এবং সেই ভাষার কোনো লিখিত কাঠামো থাকে না, তখন সেই ভাষার মৃত্যু ঘটেছে বলে মনে করা হয়।"
ভাষার মৃত্যু বা 'জবান বন্ধ' হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনার কোনো তুলনা মানব ইতিহাসে চলে না। আজও বিশ্বের বেশিরভাগ ভাষার বিবরণ তুলে ধরতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তাই একটি ভাষার মৃত্যু ঘটলে মানবজাতির ক্ষতি কত গভীরে পৌঁছায়, তা সঠিকভাবে বোঝার কোনো উপায়ও নেই। 'হোয়েন ল্যাংগুয়েজেস ডাই' বইয়ের সূচনায় কে ডেভিড হ্যারিসন ভাষার মৃত্যুপ্রক্রিয়া নিয়ে আপেক্ষ করতে গিয়ে বলেন, অজানা এবং আটপৌরে বিষয়, সময়, ঋতুসমূহ, সামুদ্রিক প্রাণীবর্গ, পুষ্পরাজি, গণিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পৌরাণিক কাহিনি, সংগীত, আবর্তন-বিবর্তন ও অসীমকে নিয়ে মানুষের বহু শতাব্দীর চিন্তাভাবনা-কল্পনার সুবিশাল জ্ঞান ভান্ডার সহসা বিলীন হতে চলেছে।
দ্বিতীয় সহস্রাব্দের অন্তিমকালে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে দুনিয়াজোড়া ৬৯১২টি ভাষায় কথা বলা হতো। অনেক ভাষাবিদ আশঙ্কা করছেন একবিংশ শতাব্দী শেষ হতে হতে ২১০১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে স্বতন্ত্র এসব ভাষার প্রায় অর্ধেকটি মুখের ভাষা হয়ে থাকবে। বাকি 'জবান বন্ধ' হয়ে যাবে। ভাষাবিদদের আশঙ্কার বরাত দিয়ে আরও বলা যায়, যে গতিতে ভাষার মৃত্যু ঘটছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে প্রায় প্রতি ১০ দিনে একটি করে ভাষা মরে যাবে। হারাধনের শেষ ছেলেটি তবু মনের দুঃখে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বনের ধারে চলে গিয়েছিল। কিন্তু একটি ভাষার মৃত্যু ঘটার পর তাতে ভেউ ভেউ করারও কেউ আর থাকে না।
ধারণা করা হয়, আগামী শতকের মধ্যেই পৃথিবীতে কথা বলা হয় এমন মোটামুটি ৭০০০ ভাষা হয়তো বিলীন হয়ে যাবে। বা এসব ভাষাভাষী নিজেদের মাতৃভাষা ত্যাগ করবে। তারা ইংরেজি, ম্যান্ডারিন বা স্প্যানিশ ভাষাকে নিজ ভাষা হিসেবে গ্রহণ করবে। আরও আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী শত বছরের মধ্যে সব ভাষারই ৯০ শতাংশ মিলিয়ে যাবে।
ভাষার জীবন নেই। ভাষা কোনো প্রাণী নয়। তারপরও ভাষা কীভাবে 'মরে যায়' বা 'বিলুপ্ত' হয়। ভাষার জগতে 'মৃত্যু'র স্বরূপ একটু ভিন্নতর। বড় ভাষা এসে ছোট ভাষাভাষীদের জিবকে দখলে নিয়ে নেয়। বড় ভাষায়ই আলাপ-আলোচনা, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রয়োজন এবং বিনোদনের সব পর্যায় চলতে থাকে। ফল হয় এই যে ছোট ভাষা মানুষের জিব থেকে ছিটকে পড়তে থাকে। কমতে থাকে সে ভাষার ব্যবহার। এক সময় সে ভাষায় কথা বলার বা সে ভাষাকে ব্যবহার করার মানুষগুলো হারাধনের ছেলের মতো হারিয়ে যেতে থাকে। যে ভাষা 'স-জিব' নয়। সে ভাষা সজীবও নয়।
ভাষার মৃত্যুর কারণ তুলে ধরতে গিয়ে অধ্যাপক শাওলী মাহবুব বলেন, "ভাষা মৃত্যুর সাথে যে প্রক্রিয়াগুলো যুক্ত, তা হলো 'ল্যাংগুয়েজ মেইনটেনেন্স' বা ভাষা রক্ষণাবেক্ষণ এবং 'ল্যাংগুয়েজ শিফট' বা ভাষার স্থানান্তর। এই দুটো প্রক্রিয়া শুরু হয় আসলে এক ভাষার সাথে অন্য ভাষার সংস্পর্শ এবং আধিপত্যের কারণে। যার অপরিহার্য ফলাফল হলো ভাষার মৃত্যু। পাশাপাশি, একটি গোষ্ঠী যদি তার নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করার তাগিদ অনুভব না করে বা ভাষা ব্যবহারের কারণসমূহ হারিয়ে ফেলে, তবে সেই ভাষার মৃত্যু ঘটে। এসবের সাথে কিছু প্রাকৃতিক কারণও যুক্ত। যেমন মহামারি, রোগ বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে কখনো কোনো গোষ্ঠী যদি হারিয়ে যায়, তাহলেও সেই গোষ্ঠীর ভাষার মৃত্যু হতে পারে। ভাষার মৃত্যু হলে সেই ভাষা আর কখনো ফিরে পাওয়া যায় না, যদি না সেই ভাষার কোনো লিখিত কাঠামো থাকে।"
ভাষার মতো জটিল জ্ঞান-ব্যবস্থাকে মানুষ পরিত্যাগ করে। এ পরিত্যাগ করাকে বোঝানোর মতো উপযুক্ত প্রযুক্তিগত শব্দ এখন আমাদের ভাষার ভান্ডারে নেই। অভাব কাটানোর জন্য ভাষাবিদকেও নিতে হয় রূপকের আশ্রয়। এ কারণেই 'ভাষার মৃত্যু', 'ভাষার স্থানান্তর', 'হুমকির মুখে ভাষা', 'বিলুপ্ত হওয়া', 'শেষ শব্দ', 'বিলীয়মান স্বর'-এর মতো কথাগুলো শুনতে হয়।
গত পাঁচশ বছরে বিশ্বে পরিচিত ভাষার প্রায় অর্ধেকসংখ্যক মরে গেছে। মইট্রুস্কান, সুমেরীয় এবং মিসরীয়র মতো প্রাচীন সাম্রাজ্যের বেশ কয়েকটি ভাষা কয়েক শতাব্দী আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে যাওয়া সেসব ভাষার কিছু কিছু শিলালিপি টিকে আছে আজও। বিস্মৃত মানুষের ক্ষীণ স্মারক ও সব। সেসব ভাষাভাষীর সংস্কৃতি চিহ্ন হয়তো আর নেই। নেই তাদের ভাষাও।মেরোইটিক এমনি একটি ভাষা। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত সুদানে একই নামের একটি সাম্রাজ্যের সরকারি ভাষা ছিল এটি। এখন শুধু শিলালিপিতে টিকে আছে। আজও সেসব শিলালিপির পাঠোদ্ধার হয়নি। ব্রিটেনের একটি প্রাচীন ভাষা কুমব্রিয়ার মাত্র তিন শব্দ টিকে আছে। আরও অনেক ভাষা আছে, যার কোনো লিখিত শিলা বা চর্মলিপি নেই। সেসব ভাষা কিংবা ভাষাভাষী মানুষ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। ইংরেজি ভাষাভাষীদের হাতে গোনা কয়েকজন হয়তো আজ জানেন, প্রায় ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আইরিশ ভাষার শক্তিশালীভাবে বিস্তার ঘটছিল। লাতিন ও গ্রিকের পরই ইউরোপের প্রাচীন সাহিত্য রয়েছে এ ভাষায়। কিন্তু এরপরও এ ভাষা মরছে। ভাষা পণ্ডিতেরা মনে করেন, এখনকার তুলনায় বরং ৬০ বছর আগে এ ভাষার ভবিষ্যতে অনেক ভালো ছিল।
বিশ্বব্যাপী ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। এমন বিপর্যয়ের নজির নেই মানব ইতিহাসে। ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার পর্যায়কে এখনো বিপন্ন প্রজাতির জৈবিক বিলুপ্তির সাথে একই পাল্লায় মাপা যাবে না। বরং তার চেয়েও অনেক দ্রুততর চলছে এ ঘটনা। প্রজাতির বিলুপ্তির হার সে তুলনায় তুচ্ছ বলেই মনে হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের আনুমানিক হিসাবের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পৃথিবী গ্রহের ৪৮৪ প্রাণীর প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। লোপ পেয়েছে ৬৫৪ প্রজাতির উদ্ভিদ। এ হিসাবকে কম বলেই মনে করা হচ্ছে। তারপরও এ সংখ্যা আমাদের মোট পরিচিত প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের ৭ শতাংশ। এর সাথে তুলনা করলে অন্তত ৪০ শতাংশ ভাষা বিপন্ন হয়ে উঠেছে। পরিসংখ্যানটি হতবাক করে দেওয়ার মতো বলেই গণ্য করতে হবে। পাখির মধ্যে ১১% হুমকির মুখে পড়েছে বিপন্ন বা বিলুপ্ত হয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে এমন পর্যায় পড়েছে ১৮%। মাছ ৫%, উদ্ভিদ ও গাছপালা ৮%। এসবের চেয়ে ভাষা পড়েছে অনেক বেশি হুমকির মুখে।
ভাষা মরে গেলে বিলুপ্ত হয় একটি বিশেষ ধারার বিশ্ববীক্ষণ। মরে যায় বিশ্ব ও মানবীয় অভিজ্ঞান ব্যক্ত করার প্রকাশভঙ্গি। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত বিপদাপন্ন অনেক ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন ভাষাবিদ কেন হেল। তিনি এক সাংবাদিককে বলেন, একটি ভাষা হারালে সাথে সাথে হারাতে হবে একটি সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, শৈল্পিক তৎপরতা। বরং এটি হলো প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভের মতো জাদুঘরের ওপর বোমা ফেলার মতো ঘটনা।
প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্ত হওয়া বোঝাতে জীববিজ্ঞানীরা সেসব শব্দ প্রয়োগ করেন, লুপ্ত হওয়া, মরে যাওয়া প্রভৃতি শব্দ ভাষাবিদরাও ব্যবহার করেন। ভাষাকে বিলুপ্ত হওয়া বোঝাতে একই ধরনের শব্দের আশ্রয় নেন তারাও। এ ছাড়া 'ভাষা হত্যাকারী', ভাষার স্বাভাবিক মরণ হয়নি বোঝাতে 'ভাষার আত্মহত্যা'-এর মতো শব্দও ব্যবহার হয়। তবে এসব শব্দ অনেকটাই অদ্ভুত শোনায়। এ ছাড়া শব্দের এমন প্রয়োগকেও যথাযথ মনে করেন না অনেক ভাষাবিদ। গ্লানভিল প্রাইস বলেন, ইংরেজি হলো একটি ঘাতক ভাষা। বলা হয় আইরিশ ভাষার মতো অনেক ভাষাকেই হত্যা করেছে এ ভাষা। এটি একটি 'ঘাতক ভাষা'।
ভাষাকে যতই প্রাণের ভাষা বলি না কেন, ভাষার সত্যিকার অর্থে কোনো প্রাণ নেই। প্রজাপতি, পাখি অন্য যেকোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ জন্ম নেয়, মরেও যায়। ভাষার কিন্তু জন্ম হয় না বা মৃত্যুও ঘটেও না। বয়সকালের রোগব্যাধিতে ভোগে না। জরা বা বার্ধক্য নেই। সত্যিকার অর্থে ভাষার ভৌত কোনো অস্তিত্ব নেই। ভাষার বাসা মানুষের মনে। ভাষা স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো সত্তা নয়। ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী থাকলেই ভাষারা বাঁচে। মানুষের সাথে ভাষার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সংযোগ রয়েছে সংস্কৃতির সাথে।
নেহাত প্রাণ রক্ষার দায়ে ভাষার ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা আছে। এমনই এক ঐতিহাসিক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে লাতিন আমেরিকার দেশ আল সালভাদরে। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের কথা। দেশটিতে কৃষক বিদ্রোহের জের ধরে নিগ্রহ ও হত্যালীলা চালানো হয় ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচিত ভূমি-সন্তানদের ওপর। পোশাক-পরিচ্ছেদ বা কথাবার্তা ও আচার-আচরণে ইন্ডিয়ান হিসেবে চিহ্নিত হলেই তাদের পাকড়াও করত সালভাদর সেনারা। তারপর তাদের হত্যা করা হতো। এভাবে প্রায় আড়াই লাখ মানুষকে খুন করা হয়। তিন বছর পরেও আরও বিদ্রোহ ঠেকানোর জন্য পত্র-পত্রিকা এবং বেতারে একযোগে ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করার আহ্বান জানান অব্যাহত থাকে।
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ হতে থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় অনেকেই নিজ মুখের ভাষায় কথা বলা বন্ধ করে দেয়। দেশটিতে কোনো ইন্ডিয়ান নেই বলে সরকারিভাবে দাবি চলতে থাকে সে সময়।
উবিখ জনগণের ওপর চালানো গণহত্যার চূড়ান্ত পরিণামে একইভাবে উবিখ ভাষা বিলুপ্ত হয়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সোচি (আবখাজিয়ার উত্তর-পশ্চিম) এলাকায় কৃষ্ণসাগরের পূর্ব তীরজুড়ে জীবন যাপন করেছে এই জনগোষ্ঠী। রাশিয়া ১৮৬০-এর দশকে মুসলমান জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত উত্তর ককেশাস জয় করে নেয়। আগ্রাসনের মুখে পড়ে সে সময় গোটা উবিখ জনগোষ্ঠী নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যায়। হাজার হাজার উবিখকে বহিষ্কার করা হয়। তুরস্কে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন অনেকে। নিঃসন্দেহে প্রচুর প্রাণহানি হয়েছিল। বেঁচে থাকা হতভাগ্য মানুষগুলো তুরস্কজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়।
ককেশাসে রাশিয়ার বিজয়ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। ফলে চেচেনদের মতো জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোর জীবন, জীবনধারা এবং ভাষা পড়েছে হুমকির মুখে। এদিকে তুরস্কের নিজেরই রয়েছে কুর্দিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ ইতিহাস। কুর্দি ভাষা সরকারি কাজে ব্যবহারের ওপর রয়েছে বিধিনিষেধ।
এ পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে অস্ট্রেলিয়ায়। দেশটিতে ভূমিসন্তানদের প্রায় আড়াইশ ভাষার মধ্যে ৯০ শতাংশই বিলুপ্তির পথে। কেবল ৫০টি ভাষায় আজও কথা বলা হয়। এর মধ্যে কেবল ১৮টি ভাষার ৫০০ ভাষাভাষী রয়েছেন। পরবর্তী শতাব্দীতে এসব ভাষার দুই বা তিনটি হয়তো টিকে থাকবে বলে আশঙ্কা।
ব্যবহৃত হয় এমন আদিবাসী ভাষা সবচেয়ে বেশি রয়েছে আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশে।এই দুই মহাদেশেই ইউরোপীয় ভাষাগুলো গত ২০০ বছর ধরে ছড়িয়ে পড়েছে। আফ্রিকায় ভাষার মৃত্যুর বিষয়টি খতিয়ে দেখার একটি প্রচেষ্টা সম্প্রতি চালান হয়। তাতে দেখা যায়, এ মহাদেশের সব দেশেই ভাষার মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শেষ পর্যন্ত মনে করা হয়, ৫৪টি ভাষা এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে বা মরে গেছে। আরও ১১৬টি ভাষা এই একই পথ ধরেছে। মাঠভিত্তিক জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং আফ্রিকান ভাষাগুলোর বিরাজমান সাহিত্য এবং গবেষকদের কাছে পাঠানো প্রশ্নমালার ভিত্তিতে এসব তথ্য পাওয়া যায়। কাজেই বিলুপ্ত ভাষা নিয়ে সঠিক নয় বরং কম তথ্য পাওয়া গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
আফ্রিকা মহাদেশে কেনিয়াই একমাত্র দেশ, সেখানে ভাষা লুপ্ত হওয়া নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে। এরই মধ্যে দেশটির আটটি ভাষা হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে নাইজেরিয়ায় সর্বাধিকসংখ্যক ভাষা রয়েছে, সেখানেও সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিলুপ্ত এবং বিপন্ন ভাষাও দেখা যাবে। রয়েসয়ে হিসাব কষে বলা হচ্ছে দেশটিতে ১০টি ভাষা হারিয়ে গেছে। আর ১৭টি বিলুপ্ত হওয়ার পথ ধরেছে।
দ্য সামার ইনস্টিটিউট অব লিংগুইসটিক বা এসআইএসর এথনোলোগ তথ্য থেকে জানি, দুনিয়ার ৯০ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বা জনপ্রিয় ভাষা হয়েছে মাত্র ১০০টি ভাষা। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বিশ্বের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করেন অন্তত ৬০০০ ভাষা। আলাস্কা নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারের ভাষাবিদ মাইকেল ক্রাউস মনে করেন, যেসব ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে যে সকল ভাষাভাষীর সংখ্যা এক লাখের বেশি, সেসব ভাষাকে নিরাপদ হিসেবে ধরা যায়। এ রকম নিরাপদ ভাষার সংখ্যা মাত্র ছয় শর মতো হবে। অর্থাৎ ৬০০০ ভাষার মধ্যে এই ৬০০ ভাষাকেই নিরাপদ হিসেবে মনে করা যায়। অন্য কথায়, বিশ্বের সিংহভাগ ভাষাই রয়েছে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে।
বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে অধ্যাপক শাওলী মাহবুব বলেন, "প্রায় তিনশ মিলিয়ন মানুষের নিজস্ব ভাষা এবং আরও প্রায় সাঁইত্রিশ মিলিয়ন মানুষের দ্বিতীয় ভাষা হলো বাংলা ভাষা। বিশ্বে যেসব ভাষায় সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয়, সেই মাপকাঠিতে বাংলাভাষা সপ্তম অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, আসামের কিছু অংশে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে বাংলা একটি বহুল প্রচলিত ভাষা। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর সব ভাষাই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। ফারসি ভাষা একসময় বাংলাদেশের দাপ্তরিক ভাষা ছিল, সে ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, একই রকমভাবে ইংরেজি ঔপনিবেশিকতা বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের আসনকে পাকাপোক্ত করেছে। বিশ্বায়নের ফলে বাংলাভাষাভাষী মানুষ অন্য ভাষাভাষী মানুষের সাথে মেলামেশা করছে, ফলে বাংলা শব্দভান্ডারে অন্য ভাষার শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটছে। এছাড়া বর্তমানে বিদেশি অনেক পণ্যই এখন বাংলাদেশের বাজারে বহুল প্রচলিত, যেগুলোর সাথে সাথে সেসব দেশের ভাষা অবাধে প্রবেশ করছে। সেই সাথে আছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, যা কোনো ভাষার অর্থ পরিবর্তন করছে এবং শব্দগুলোকে সংক্ষিপ্তও করে তুলছে।"
এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে উচ্চ পদের জীবিকায় বাংলা ভাষার কোনো গুরুত্ব নেই বলেই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ দোদুল্যমান।
বাংলাভাষা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কথা তুলে ধরতে গিয়ে শাওলী মাহবুব প্রথমে ভাষা রক্ষণাবেক্ষণ বলতে কী বোঝানো হয়, তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একটি আঞ্চলিক এবং সামাজিকভাবে আরও শক্তিশালী ভাষার প্রতিযোগিতার মুখে একটি ভাষার অব্যাহত ব্যবহারকে ভাষা রক্ষণাবেক্ষণ বলা হয়। তিনি আরও জানান, ভাষা রক্ষণাবেক্ষণের সব অধ্যয়নে দেখা গেছে, যেখানে সংখ্যালঘু ভাষাভাষীদের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার দিকে সরে যাবার প্রবণতা প্রবল, কোনো গোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থা তার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে, একটা আরেকটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলেই তারা তাদের ভাষাকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
ভাষা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনসংখ্যাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সবশেষে সাংস্কৃতিক এবং সাংগঠনিক সব ক্ষেত্রে যখন ভাষাটি ব্যবহৃত হবে, তখন তার উপযোগিতাও বাড়বে। কাজেই পাঁচটি উপাদান, যেমন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, সামাজিক গুরুত্ব, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বহুল জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা এবং ভাষার প্রতি সুপ্রসন্ন মনোভাব ভাষার রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বাংলাভাষাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হলে এই বিশেষ অবস্থাগুলো বিবেচনায় আনতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
মুখের ভাষা 'কাইড়্যা' নিতে চাওয়া এক জিনিস আর ভুলে যাওয়া আরেক জিনিস। মানুষ কী সত্যিই নিজের মুখের ভাষা ভুলে যেতে পারে? আন্তর্জাতিক দত্তকগ্রহণকারীদের নিয়ে চালানো গবেষণায় উঠে আসে যে ৯ বছর বয়সী শিশুকে নিজ জন্মভূমি থেকে সরিয়ে নেওয়া হলে শিশু তার মুখের ভাষা পুরোপুরি ভুলে যেতে পারে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে চরম পরিস্থিতিতে ছাড়া প্রথম বা মুখের ভাষা পুরোপুরি ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রায়ই নেই। কয়েক বছর বিলেতে থাকার পর এক ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের সাথে ভুলভাল ইংরেজিতে দেদার কথা বলছিলেন। আর থেকে থেকে বলছিলেন, কী মুশকিল কী মুশকিল বাংলা তো প্রায় ভুলেই গেছি। জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেন, হ্যাঁ, মুশকিলই বটে, বাংলাটা ভুলে গেছো, কিন্তু ইংরেজিও শেখোনি।
বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি এখন অভিবাসী। এদের অনেকেই রেমিট্যান্স যোদ্ধা নামে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। অভিবাসীদের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার অবস্থাও তুলে ধরেন অধ্যাপক শাওলী মাহবুব। তিনি জানান, "২০২১ সালে ইরানে অবস্থানরত বাংলাভাষাভাষী তিনটি দলের ওপর পরিচালিত নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমার করা গবেষণাটিতে বাংলাভাষার অবস্থাটি তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম দলটিতে সেসব বাঙালি ছিলেন, যারা ইরানি নাগরিককে বিয়ে করে ইরানে স্থায়ী হয়েছেন। গবেষণায় দেখা যায়, এই বাঙালিদের ভাষা পুরোই বদলে গেছে। তারা ফারসি ভাষাকে মূল ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যেসব বাঙালি স্বল্পমেয়াদি ভিসা নিয়ে ইরানে উচ্চমানের চাকরি করছেন, তারা মূলত দুটো ভাষা, যেমন বাংলা এবং ফারসি ভাষায় পারদর্শী।
"তবে দীর্ঘকাল ইরানে বসবাসের ফলে তারাও ফারসি ভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পাশাপাশি তারা ইংরেজি চর্চাও করেন। বাংলা এখনো টিকে আছে ইরানে কর্মরত বাঙালি সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, শ্রমিক শ্রেণির দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা ওপরের দুই দলের তুলনায় বেশি। অভিবাসী শ্রমিকেরা পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে রেখে ইরান গমন করেছেন, ফলে তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসতে হবে। বাংলাদেশের সাথে তাদের যোগাযোগও তাই অন্যদের তুলনায় বেশি। এ কারণেই তারা বাংলা ভাষাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। অভিবাসনের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তনটি দেখাই এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল। বিশ্বে বাংলাভাষার অবস্থান এবং তার পরিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে এ ধরনের গবেষণা আরও হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।"