রক্তের টানে ফিরে আসা নীলগাই
বিগত কয়েক বছর ধরে একটি বিশেষ প্রাণী প্রায়ই পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনুপ্রবেশ করছে। কিছু সংবাদমাধ্যম একে হরিণজাতীয় প্রাণী বলে উল্লেখ করে থাকে। আসলে এরা হচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে বৃহদাকারের অ্যান্টিলোপ-জাতীয় প্রাণী। হরিণের সঙ্গে অ্যান্টিলোপদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে পুরুষ হরিণদের শিং বছর বছর পরে গিয়ে আবার নতুন করে গজিয়ে ওঠে। কিন্তু আন্টিলোপদের শিং স্থায়ী। আবার হরিণের শিং শাখা-প্রশাখা যুক্ত, কিন্তু অ্যান্টিলোপদের শিং শাখাবিহীন।
বেশ কিছুদিন ধরেই মাথায় এই বৃহৎ অ্যান্টিলোপের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। নাম তার নীলগাই। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের আরও দুটি স্থলসীমা থাকতে বারবার কেন এরা উত্তরবঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। এর কি কোনো বিশেষ কারণ রয়েছে?
বন্য প্রাণীরা তো দেশের সীমারেখা চেনে না। পাসপোর্ট-ভিসা কী জিনিস, তা-ও এদের জানা নেই। মাঝেমধ্যেই তাই ওরা এক দেশ থেকে অন্য দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের ভূখণ্ডে চলে আসা নীলগাইদের স্থানীয় লোকজন কীভাবে গ্রহণ করে? বিষয়টা একদিকে বেদনাদায়ক অন্যদিকে বেশ লজ্জাজনক, যতবারই ওরা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে, শত শত মানুষ তার পিছু ধাওয়া করেছে, দৌড়ে নিয়ে গেছে মাইলের পর মাইল। কেউ জবাই হয়েছে মানুষের হাতে, কারও মৃত্যু হয়েছে প্রচণ্ড ভয়ে হার্ট অ্যাটাকের কারণে। সমস্ত শরীরজুড়ে অসংখ্য রশি দিয়ে বেঁধে, হাজার হাজার মানুষ তার তামাশা দেখেছে। তবে এর মধ্যেও একটা সুখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) বারবার ছুটে গেছে অসহায় নীলগাইদের উদ্ধারে। একবার সীমান্তরেখা পেরিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলায় ঢুকে পড়ে একটি নীলগাই। স্থানীয় লোকজন সেটাকে ধরে জবাই করার প্রস্তুতি নেয়। ঠিক তখনই খবর পেয়ে কান্তভিটা বিওপির বিজিবি সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়, নীলগাইটির গলায় তখন ছুরি বসিয়ে দিয়েছে লোকজন। সেই অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় একজন ভেটেরিনারি অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে প্রাথমিকভাবে নীলগাইটির গলায় সেলাই দেওয়া হয়। তারপর দীর্ঘ দুমাস বিজিবির তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার পর পুরুষ নীলগাইটি সুস্থ হয়ে ওঠে। তত দিনে এসে তাদের পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে যায়। অসহায় বন্য প্রাণীর প্রতি এই বিশেষ বাহিনীর মমত্ববোধ এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
অনুপ্রবেশকারী নীলগাইদের বিষয়ে বন বিভাগও যথেষ্ট তৎপর। যখন যেখানে খবর পেয়েছে দ্রুত তারা ছুটে গেছে ঘটনাস্থলে।
এবার নীলগাই সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। ইংরেজিতেও এরা 'Nilgai' নামে পরিচিত। যদিও তারা গরু কিংবা গাভি নয়। তবে আকারে অনেকটা গরুর মতো। পুরুষ নীলগাই যখন ছুটে চলে, তখন ঘোড়ার সঙ্গে এক বিশেষ সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Bosephalus tragocamelus.
নীলগাইদের গায়ের রং কিন্তু একেবারে নীল নয়। পুরুষ নীলগাইদের গায়ের রং 'আয়রন গ্রে'। প্রজনন ঋতুতে পুরুষদের গায়ের রং আরও ঝলমলে হয়ে ফুটে ওঠে। তখন দূর থেকে এই সুদর্শন প্রাণীটিকে দেখলে মনে হয় নীল রঙের কোনো গরু চরে বেড়াচ্ছে। মাদি নীলগাইয়ের রং পুরুষদের মতো নয়। এদের গায়ের রং বাদামি। আর বাচ্চা অবস্থায় সব নীলগাইয়ের গায়ের রং থাকে বাদামি। বাচ্চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে গায়ের রঙের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মাদি নীলগাইয়ের মাথায় শিং থাকে না। প্রায় ৪০০ কেজি ওজনের দেহের তুলনায় পুরুষ নীলগাইয়ের মাথার শিং আকৃতিতে খুবই ছোট। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ নীলগাইয়ের শিং সর্বোচ্চ ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের লেজও দেহের তুলনায় বেশ ছোট। মাদী এবং মর্দা উভয়ের গলার নিচে সাদা দাগ রয়েছে। এরা দল বেঁধে থাকতে পছন্দ করে। একটি দলে চার থেকে দশটি পর্যন্ত নীলগাই থাকে। মাদী নীলগাই একসাথে দুটি বাচ্চা প্রসব করে। এরা জঙ্গলের ভেতরে নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে চলতে পছন্দ করে। নীলগাই খুবই দ্রুতগামী প্রাণী।
নীলগাইয়ের বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা বহুদিন পানি না খেয়ে থাকতে পারে। এমনকি গরমের দিনেও বহু সময় এরা কোনো ধরনের জল পান না করে কাটিয়ে দেয়।
১৯৪০ পর্যন্ত বাংলাদেশের জঙ্গলে নীলগাইয়ের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেছে। এর পরবর্তী সময়ে দেশের কোনো স্থানে আর এদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। যুগ যুগ ধরে শিকারিরা সুন্দর চামড়া ও সুস্বাদু মাংসের লোভে এদের গুলি করে হত্যা করেছে। প্রকৃতিতে টিকে থাকা শেষ নীলগাইটিকে শিকারির গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
একসময় উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুরের শালবনে প্রচুর পরিমাণে নীলগাই ছিল। দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গল থেকে সমভূমির শালবন ছিল ওদের প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র। তখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিকারিরা উত্তরবঙ্গে ছুটে যেতেন নীলগাই শিকারের জন্য। খ্যাতনামা লেখক প্রয়াত আবুল খায়ের মুসলেউদ্দিন একবার উত্তরবঙ্গে নীলগাই শিকারে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই শিকারকাহিনিটি উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে (১৯৯১-৯২) স্থান পেয়েছিল।
এবার বর্তমানের দিকে ফিরে তাকানো যাক। বাংলাদেশের বর্তমানে একটিও নীলগাই বন্য অবস্থায় টিকে নেই। সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত এক প্রাণী আর প্রকৃতি থেকে কোনো প্রাণীর চিরতরে হারিয়ে যাওয়া পরিবেশের জন্য অত্যন্ত অশুভ এক লক্ষণ। আমরা ওদের ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশটি পেরেছে। এখনো ওখানে প্রায় লক্ষাধিক নীলগাই রয়েছে।
তাই মাঝেমধ্যে ওরা ছুটে আসে পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থানের দিকে। আর আমরা ওদের অচেনা প্রাণী মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ি আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে। কারও মনে একবারও এই প্রশ্ন আসে না, এত সুন্দর একটা প্রাণীকে নিজেরা ধরে রাখতে পারেনি, এটাই তো কত লজ্জার কথা!
বন্য প্রাণীদের সাধারণ মানুষের আকস্মিক আক্রমণ থেকে কী করে রক্ষা করা যায়? এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বন্য প্রাণী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা মনোভাবের পরিবর্তন। একসময় বন্য প্রাণীদের মানুষ নিছক উপদ্রব বলে মনে করত, যাকে দেখলেই মেরে ফেলার ইচ্ছা জাগত মনে। সেই আদিম বোধ এখনো অনেকের মনে জাগ্রত। এর পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে নীলগাইয়ের মতো আরও অনেক বন্য প্রাণী এগিয়ে যাবে বিলুপ্তির পথে।
কীভাবে মানুষের এই মনোভাবের পরিবর্তন ঘটানো যায়? উত্তর একটাই, বন্য প্রাণী এবং বন্য প্রাণীর উপকারিতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা।
সেদিনই এ দেশে বন্য প্রাণীরা নিরাপদ হবে, যেদিন সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসা কোনো নীল গাইকে দেখে কেউ একটুও অবাক হবে না, বলবে, 'আরে এটা তো সেই সুন্দর প্রাণী, যে একসময় আমাদের দেশেও ছিল।'