প্রাইভেসি! প্রাইভেসি! অর্থহীন চিৎকার
আমি দিগম্বর হয়ে আছি অথচ আমার শরীরের সংবেদনশীল কোন কোন অংশ কে কে দেখে ফেলল, এ নিয়ে চেঁচামেচি করছি। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কাছে আমরা যারা আত্মসমর্পণ করে আছি, আমাদের প্রাইভেসি প্রাইভেসি চিৎকার অনেকটা এ রকমই।
সংবেদনশীল মানুষ একদিকে গোপনীয়তা রক্ষা করার গুরুত্বের ওপর খুব জোর দিচ্ছে, আবার সেসব প্রযুক্তিগত সামগ্রী হুমড়ি খেয়ে কিনছে যা তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করে সকল গোপনীয়তা ফাঁস করে দিতে পারে।
আপনার গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রধান অন্তরায় আপনার হাতের ফোনটি। এটি যত স্মার্ট, আপনার উন্মোচিত কিংবা এক্সপোজড হয়ে যাবার সম্ভাবনা তত বেশি।
দিগম্বর হয়ে প্রাইভেসি চিৎকার কথাটি প্রযুক্তিবিদ লেহ ক্যাম্ববেল লিখিত 'এসব যদি এখনো আপনার ফোনে থাকে তাহলে কেউ হয়তো আপনার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে' নামের লেখা থেকে নেওয়া।
আপনার সেলফোনে যত বেশি অপশন, সংযোগ স্থাপনের যত বেশি পদ্ধতি, আপনার জীবনটাকে সহজতর করতে এই ফোনটাতে প্রযুক্তির যত বেশি কারিগরি, আপনি তত বেশি সন্তুষ্ট। আপনার যে বন্ধুটির সেলফোন আপনার ফোনের মতো এত সমৃদ্ধ নয়, আপনি সে বন্ধুর দিকে করুণার চোখে তাকান, যেমন করে একসময় ক্যাডিলাক গাড়ির চালক ভক্সহল বা ফোক্সওয়াগনের চালকের দিকে তাকাত।
শুধু করুণার সাথে তাকিয়েই শেষ নয়, কোথায় কোথায় তার দীনতা, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। আপনার ফোনের জাদুকরি অ্যাপসগুলোকে আপনি ভালোবাসেন এবং এগুলোর ওপর নির্ভরও করেন। আপনি প্রাইভেসির কথা ভুলে বাধ্য না হয়েও আপনার গোপনীয় পৃথিবীটাকেই অনলাইনে তুলে দিচ্ছেন। আপনি এটাও জানেন আপনার তথ্যভান্ডারের চাবি তো মাত্র কয়েকটি অক্ষর সংখ্যা কিংবা চিহ্ন। আর এগুলো পেতে রাতভর ঘাম ঝরানোর দরকার হয় না, সামান্য কয়েকটি প্রশ্নের জবাব থেকে জানা যায় সেই চাবির গোপন কোড। তারপর এমনকি আপনার জীবনের সব সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকেও বের করে নেওয়া সম্ভব। আপনার গোপনীয়তা যেসব অ্যাপস রক্ষা করছে বলে মনে করছেন, হয়তো সেইসব অ্যাপস তা হরণ করে নিয়ে আপনার শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছে।
বিপদে পড়ে প্রতিরক্ষা নয়, বিপদের আশঙ্কায় আগে থেকেই প্রতিরক্ষা প্রো-অ্যাকটিভ প্রোটেকশন আপনাকে গোপনীয়তা হারানোর ভয়াবহতার হার্ট অ্যাটাক থেকে রক্ষা করতে পারে। আপনি কি জানেন কোন অ্যাপস আপনি কিনছেন এবং আর কোনটা ডাউনলোড করছেন? এগুলো সম্পর্কে কিছু গবেষণা করা তো আবশ্যক, আপনি কি আদৌ কিছু করেছেন?
আপনার সহজ উত্তর আমার আগে লক্ষ লক্ষ সেলফোন ব্যবহারকারী নিশ্চয়ই এটা কিনেছে, ডাউনলোড করেছে, আমার চিন্তা কিসের।
আপনার ফোনে কি ক্যামস্ক্যানার আছে? যদি থেকে থাকে ধরে নিতে পারেন আপনার গোপনীয়তা বিপন্ন। সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞরা বের করেছেন যে এই অ্যাপটির মধ্যে বিদ্বেষপরায়ণ অংশ লুকায়িত থাকে, যা ট্রোজান ডাউনলোডার হিসেবে কাজ করে এবং রোগগ্রস্ত ফাইল সংগ্রহ করতে থাকে। এ ধরনের অ্যাপ ফোনের ভীষণ ক্ষতি করে, কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডি-ইনস্টল করে ফেলুন। আপনি অনেক বিকল্প নিরাপদ স্ক্যামস্ক্যানার পেতে পারেন।
সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞরা আবহাওয়া অ্যাপস নিয়ে শঙ্কায় আছেন। তারা মনে করেন, এগুলো বিশেষ বিপজ্জনক। ওয়েদার অ্যাপসের সাথে ট্রোজান কিংবা অন্য কোনো ম্যালওয়ার সন্নিবেশিত থাকে। আবহাওয়ার সঠিক খবর অনেক মাধ্যমে আছে, এটা ডি-ইনস্টল করলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না, বরং মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যাবেন।
আপনি যদি আপনার গোপনীয়তা রক্ষা করতে চান, ক্যাভিনি ডিজিটাল সল্যুশনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের র্যাফি জ্যাফারির কথা শুনুন। যদি কোনো অ্যাপ ডিলিট করে আপনার তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চান, তাহলে প্রধান কালপ্রিটকেই করুন—ফেসবুক। ফেসবুকের হাতে অবিশ্বাস্য পরিমাণ ডেটা আছে, 'এমনকি আপনি যদি ফেসবুকের সেবা গ্রহণ না-ও করেন, তবুও ডেটার দুর্বৃত্তায়ন তারা করবে। কাজেই এটাকে ডিলিট করে দিন। ফেসবুক আপনার শত্রুকেও চেনে, চাইলেই তার হাতে সব তুলে দেবে।
হোয়াটসঅ্যাপ কি নিরাপদ? এ প্রশ্ন করলেই শুনবেন দশজন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী এগিয়ে এসে বলছেন কারো বাবারও সাধ্য নেই এর ভেতরে প্রবেশ করা। এ কথা শুনেই আপনি বন্ধুকে ফোন করে সরকারকে গালমন্দ দিতে শুরু করলেন। ওদিক থেকে বন্ধু মন খুলে বলতে শুরু করল সরকারের যত অপকীর্তির কথা। হঠাৎ ধরা পড়ে গেলেন স্পাইওয়ারের মালিক সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। যত অস্বীকারই করুন লাভ নেই, আপনাদের দুজনের কথোপকথনের রেকর্ড শুনিয়ে দেবে। বিব্রত হয়ে তখন স্বীকারোক্তি প্রদান করলেন। স্মার্ট টেলিফোনের যে ভার্সনেই থাকুক হোয়াটসঅ্যাপ আপনার ডেটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। হোয়াটসঅ্যাপের সুবিধা হচ্ছে এটা সহজেই ডিলিট করা যায়।
ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ দুটোর মালিকানাই ফেসবুকের। এটিই দুটো জনপ্রিয় অ্যাপস-এর বেলায় ফেসবুকই বিপন্নতার বড় কারণ।
স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে আপনি কিন্তু ফেসবুকের কাছে খদ্দের নন, আপনি নিজের অজ্ঞাতে তাদের পণ্য।
আপনি কে, কী করেন, কোথায় যান, কার সাথে কথা বলেন এগুলো আপনার কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, অন্যের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রি সার্ভিস পেয়ে আপনি সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছেন। বিনে পয়সায় পাওয়া আপনার তথ্যগুলো বেচে দিয়ে কোম্পানি লাভবান হবে, যদি বেচতে না চায় তাহলে যাদের প্রয়োজন তাদের হাতে হ্যাকড হয়ে যাবেন। বিজ্ঞাপনে যত সুরক্ষার কথাই বলা হবে গোয়েন্দা অ্যাপস ও হ্যাকারের কাছে ভীষণ অসহায় ইনস্টাগ্রাম সাইবার নিরাপত্তার ভয়ংকর এক ঝুঁকি বহন করে।
ফ্লাসলাইট অ্যাপ। এগুলো বিনে পয়সার অ্যাপ তবে সাথে কিছু বিজ্ঞাপন জুড়ে দেওয়া হয়। বিনে পয়সায় এই অ্যাপটিকে ডাউনলোড করার বার্তা এসে যাবে। আপনি অনুমতি দিলেন মানেই ফেঁসে গেলেন। আপনার সম্মতির সাথে সাথে আপনার সঞ্চিত সকল তথ্যও হস্তান্তরিত হয়ে গেল। তারপর আপনি পেতে শুরু করলেন বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন। প্রাইভেসি অ্যান্ড সিকিউরিটি কোম্পানি এক্সপ্রেস ভিপিএন এর বড় কর্তা হ্যারল্ড লি মনে করেন, এখনই ফ্লাশলাইট অ্যাপ ডিলিট করা উচিত এবং কোম্পানি আপনার অজান্তে যে ডেটা নিয়েছে তা-ও ডিলিট করার জন্য অনুরোধপত্র পাঠানো উচিত। তবে যেসব সেলফোন সেটের সাথে ইন-বিকট ফ্লাশলাইট ফাংশন দেওয়া থাকে, সে ক্ষেত্রে অপর কোনো অ্যাপ গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই।
ডেল ও সিআইএর সাথে কাজ করার পর ২০১৩ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেন এনএসএ-এ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাজেন্সি) যোগ দেন। গোয়েন্দাবৃত্তি ও মানুষের গোপনীয় তথ্য সংগ্রহের মতো অনৈতিক কাজ করতে স্নোেেডন একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে যুক্তরাজ্য ছেড়ে হংকং চলে আসেন, এনএসএর চাকরি ছেড়ে দেন বহু গোপনীয় রাষ্ট্রীয় ও করপোরেট তথ্য ফাঁস করে দেন। এনএসএ কেমন করে এসব অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে, তা-ও বর্ণনা করেন। যুক্তরাষ্ট্র ১৯১৭ সালে গোয়েন্দা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করে। তিনি মস্কো পালিয়ে যান, তার পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যায়, তিনি এক মাসের বেশি সময় এয়ারপোর্টেই কাটিয়ে দেন, পরে রাশিয়া তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় এবং ২ ডিসেম্বর ২০২১ আনুগত্যের শপথ নিয়ে রুশ নাগরিকত্ব লাভ করেন। বিশ্বজুড়ে নজরদারি, গোয়েন্দাগিরি ও ডেটা অপহরণের তথ্য তুলে ধরে তিনি একবিংশ শতকের অন্যতম প্রধান হুইসেলব্লোয়ারে পরিণত হন। তিনি সংহারক অ্যাপটির নাম জানান অ্যাঙ্গরি বার্ডস। আপনার ফোনে যদি এই দুষ্ট গেমটি থেকে থাকে, যত দ্রুত সম্ভব ডিলিট করে দিন।
জোম্বি মড গেমস যদি থেকে থাকে, তাহলে এতে আসক্ত হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। অন্তত ৫০ হাজার গ্রাহকের তথ্য পাচারের অভিযোগ এর বিরুদ্ধে অনেক আগেই করা হয়েছে। তবে এটা থাকলে আন-ইনস্টল করাও বেশ জটিল কাজ। আরো যে কটা অ্যাপ ফোন থেকে ডিলিট করার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ডুরডাশ চিল্ডেনস অ্যাপস, ডেটিং অ্যাপস, রিং ডোরবেল অ্যাপ এবং ইভরিটাইম।
যদি শরীরের সম্ভ্রম রক্ষা করতে চান, নিজে থেকে দিগম্বর হয়ে পোশাকের জন্য চেঁচামেচি করবেন না। একইভাবে আপনাকে ন্যাংটো করে সব তথ্য নিয়ে থাকে এমন অ্যাপসের ফাঁদে স্বেচ্ছায় পড়ে প্রাইভেসির চিৎকার দেবেন না।
আপনার গোপনীয়তা কাদের কাছ থেকে রক্ষা করবেন?
সহজ উত্তর: সরকার, গোয়েন্দা এবং হ্যাকার।
আপনি যতই বলুন আপনার লুকোনোর কিছু নেই, তাহলে আপনার হাতের ফোনটা খোলার সিকিউরিটি কোডটা আপনার স্ত্রী কিংবা স্বামীকে দিচ্ছেন না কেন?
প্রাইভেসি বা ব্যক্তির গোপনীয়তা আসলে একটা বহুমূল্য ধারণা, যার স্বীকৃতি এমনকি গোয়েন্দাবৃত্তির সর্বাধুনিক সরঞ্জাম ও অ্যাপস বিক্রেতা ইসরায়েলও শ্রদ্ধার সাথে দিয়ে থাকে। এই প্রাইভেসি রক্ষায় নিত্যনতুন যত আইনই হোক না কেন, স্মার্ট অ্যাপসের যুগে কার্যত আমাদের যা কিছু লুকোনো আছে সবই প্রকাশিত হয়ে গেছে অথবা প্রকাশের অপেক্ষায় আছে: আপনার ফোন আর ফোন নম্বরই সব ফাঁস করে দিচ্ছে। আপনার ফোন, আপনার স্মার্টকার্ড যত কাজেই লাগুক আপনার গোপন কথাটি আর গোপন রাখতে দেবে না। আপনার যে একটি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে, এটা আপনার ফোন অনেককেই জানিয়ে দিয়েছে, আপনার ফোনের সাথে জিপিএস যুক্ত আপনার স্ত্রী জেনে গেছেন নাইট ডিউটির কথা বলে গুলশানের কোন রেস্টহাউসে কার সাথে রাত কাটাচ্ছেন। আপনি দামি দামি ক্যানসারের ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখতে পাচ্ছেন। ঠিকই আছে কারণ আপনার হ্যাক করা স্মার্ট ফোন থেকে পাচার করা যেসব তথ্য ওষুধ কোম্পানিগুলো পেয়ে গেছে, তাতে তারা নিশ্চিত হয়েছে আপনি থাইরয়েড ক্যানসারে ভুগছেন। আপনি জানেন না যে আপনার আর দুই বছরও আয়ু নেই, কিন্তু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি জানে ঠিকই।
একটা উদাহরণ:
ব্যবহারকারীকে বিস্মিত করে দিয়ে দরজায় কফিন মিস্ত্রি হাজির! কফিনের ডিজাইন পছন্দ করতে বলছেন?
আপনি চিৎকার করে উঠলেন, কী পেয়েছেন আপনারা? কফিন কেন?
কফিন মিস্ত্রি বললেন, ফেয়ারওয়েল অ্যাপস তো আর ভুল বলতে পারে না। তথ্য তো আপনিই দিয়েছেন।
আপনি বলবেন, ইম্পসিবল আমি কাউকে কোনো তথ্য দিইনি। কফিন মিস্ত্রি বললেন, ডেটা মাইনিং করে যা পেয়েছে, ফেয়ারওয়েল অ্যাপস তো দিন-তারিখসহ সেটাই জানিয়ে দিয়েছে। নিজের কফিনটা নিজের পছন্দ করাই ভালো।