নদী-সম্পর্কিত
১.
আমাদের বেড়ে ওঠা- পত্রবন্ধুত্বের সময়। কারও প্রতি কেউ আগ্রহী হলে আমরা চিঠি লিখতাম। তেমন এক চিঠি পাই ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর। স্পষ্ট মনে আছে এই তারিখ, কেননা পরদিন বাংলাদেশের প্রায় সব বামপন্থী দল মিলে দেশের স্বার্থে একটি অত্যন্ত সফল পূর্ণ দিবস হরতাল করেছিল। সে চিঠি লেখেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ, ইংরেজিতে সম্মান শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রী। চমৎকার এক বন্ধুত্ব হয়, চিঠিতে। পরের বছর ২৭ এপ্রিল তাঁকে না জানিয়েই তাঁর শহরে যাই, মেল ট্রেনে। ভোরের আকাশ যেন রবিন লিকুইড ব্লু, সামান্য জলে মেশানো, গাঢ় নীল। আমরা, আমি আর আমার বন্ধু চন্দন চলে গেলাম তিতাসপাড়ে। শহরে হাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আগেও এসেছি এমনই ছিল চিঠির অতিজীবিত ভাষা। সেখানে মূলত এক কালভৈরবের মন্দির। অনেক উঁচু এক ফ্রে কাট দাড়ির কালভৈরব। মূর্তিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল একাত্তরে। পরে আরেকটু উঁচু করে নির্মিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। ফ্রে কাট দাড়ির ইতিহাস তো বেশি পুরোনো নয়। অবাক লেগেছিল পৌরাণিক কালভৈরবের এই ফ্যাশন সচেতনতা দেখে। মন্দিরের পাশে দাঁড়ালে দিগন্তখোলা তিতাস নদী। একটু দূরে তখন সূর্য রবীন্দ্রকথিত বিরাট শিশু যেন, হামাগুড়ি দিয়ে উঠছেন আস্তে আস্তে পূর্ব দিকে আর চারদিক আলো হয়ে উঠছে। তখনো কোনো মাঝি দেখিনি। আমরা প্রকৃতি দেখছিলাম দুই চোখ ভরে। অনেক দূরে অন্য পাড় আবছা। অল্প দূরে ঝাকড়া গাছ একটা চরের মতো জায়গায়। একজন মাঝি পেলাম সকাল হলে, তিনি কিন্তু পারাপারের জন্য বিনিময় নেন না। এই তাঁর পুণ্য সঞ্চয়ের কাজ, নিজেই বললেন। ওই ঝাঁকড়া গাছের কাছে বসলাম। বেলা আরও গড়ালে গিয়েছিলাম অদ্বৈত মল্লবর্মণের স্মৃতিবিজড়িত গোকর্ণ ঘাটে, লোকমুখে 'গোপন ঘাট', তবে এমনকি বিভাগীয় গ্রন্থাগারের জুনিয়র গ্রন্থাগারিককে দেখলাম, মৃত অদ্বৈত তো দূরের কথা, তখনো জীবিত আল মাহমুদকে চেনেন না। ছোট ছোট নৌকায় মাছ ধরতে দেখেছিলাম।
২০০৮-এর দিকে শেষবার যাই। দিগন্ত দৃষ্টিসীমার মাঝে নতুন ব্রিজ হয়ে গেছে। অনেক দালানকোঠা। শহরের সেই ফাঁকা ভাব নেই। তিতাসও অত নির্জন নেই আর। খারাপ লেগেছিল। প্রকৃতিকে অক্ষত রেখে উন্নয়ন আমরা এখনো শিখে উঠতে পারিনি।
২.
নদীবিরল এক অঞ্চল নোয়াখালীতে জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছি পাঁচ শতাধিক বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক নৌবন্দর চট্টগ্রামে। কর্ণফুলী নদী থেকে হাঁটা দূরত্বে আদি আবাস। বিকেলে বাবার সাথে ভাইবোন মিলে নৌকায় ঘোরা ছিল প্রিয় অভিযান। তখনও উন্নয়ন কর্ণফুলীর ঘাড় মটকে দেয়নি। প্রায়ই নানা সাইজের শুশুক আমরা দেখতাম মনের আনন্দে পোলভল্ট চর্চা করছে। বিদেশি জাহাজেরা পাহাড়ের আকৃতি নিয়ে অনেক দূরে দূরে স্থির। জলে, আশ্চর্যের এই, তখনো নিজেদের দেখা যেত। এসব দেখছি আর ইতালি বিশ্বকাপ আয়োজন করছে। নিচের দিকে ক্লাসে পড়ি। পাথরঘাটা গির্জার শতাধিক বছরের পুরোনো ঘণ্টার গম্ভীর শব্দে ঘুম ভাঙে। বা মাঝরাতে মাঝনদীর কোনো জাহাজ পগারপাড়ের ভোঁ শব্দে মন উদাস।
এই নদীর বিধ্বংসী চেহারা দেখলাম, ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১। মনে আছে, কোনো কিছু অক্ষত ছিল না। ১০ বছর বয়সে সে ক্ষত আজও মনে লেগে আছে।
আমাদের বয়স বাড়তে বাড়তে নদীদূষণে জল ঘোলা, শুশুকের দল অদৃশ্য, আমরা জলে নিজেদের ছায়া না দেখে স্মৃতিচারণে মুখ লুকাতে থাকি ক্রমে। কোন সে রাজার মেয়ে, কার কানের ফুল হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি এই কর্ণফুলীতে, তা আমাদের আর মনে থাকে না। আমরা দীর্ঘশ্বাস চেপে, এক্সকাভেটরের সারি, বালু তোলার মহোৎসব, নাব্যতা সৃষ্টির নামে টাকা নয়ছয়– এসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ভাবি, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা এই সুন্দরী কর্ণফুলী অতি ধীরে মরে যাচ্ছে। বিনষ্টপ্রায় তার জলজ বাস্তুসংস্থান। আমরা জানি, কর্ণফুলী বিহনে চট্টগ্রামের বেঁচে থাকা কঠিন। কেননা, সভ্যতার আদি বন্ধু নদী। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে আরও সত্যি। পতুর্গিজ দস্যু, বণিকদের চিহ্ন আজও অটুট দেয়াং পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। আর ফিরিঙ্গিদের আসার স্মৃতিতে নদীর কাছেই ফিরিঙ্গিবাজার তো আজও জীবিত।
৩.
২০০৩ সালে জাতীয় স্বার্থে তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির লংমার্চে আমরা ঢাকা থেকে যাচ্ছি খুলনার মোংলা বন্দরে। প্রায় প্রতিদিন গড়ে ২৩-২৪ কিলোমিটার হাঁটতাম। এখনকার মতো আরামের রোডমার্চ নয়। সেবার সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী দেখেছিলাম। যমুনা নদী মানে রাধা-কৃষ্ণের স্মৃতি। আস্ত বৈষ্ণব পদাবলি। যমুনা নামেই একটা চনমনে, জ্যান্ত, চলন্ত ভাব। কিন্তু ওই সময়ে জলের পরিমাণ অল্প ছিল। আবার বাঁধ দেওয়াটাও দেখলাম। অল্প জলে মাছেরা খেলছিল। ছোট ছোট মাছ সব। হাত বাড়ালেই পালায়। ভেবে অবাক লেগেছিল, এই যমুনারই আরেক অংশ আগ্রায়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুই খণ্ডের ধ্রুপদি উপন্যাস 'শাহজাদা দারাশুকো'তে অলোকসামান্য এক বিবরণ আছে যমুনা নদীর পাড়ে তাজমহল গড়ে ওঠার। পাঠকের মনে হবে, তিনি ওই সময়ে বসে দেখছেন নির্মাণশ্রমিকদের আনাগোনা, এমনকি ঘামের বিন্দু। সিরাজগঞ্জে অকাল বন্যার কথা পড়লে মন খারাপ হয়। ওই দিনের স্মৃতি মনে পড়ে।
কিশোরগঞ্জে সাংবাদিক, লেখক রাতুল হরিৎ আমায় দেখিয়েছিলেন বিখ্যাত নদী- ঘোড়াউত্রা। এই নামে একটা প্রকাশনাও আছে। ভালো সব বই করেন তাঁরা। ঢাকা থেকে সিলেটের দিকে যাওয়ার যে নৌপথ, তার মধ্যে ঘোড়াউত্রা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। নৌকায় আমরা চরে গেলাম। অস্থায়ী চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট। আরও নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান। শুনলাম, জোয়ার এলে এসব এলাকা জলের তলায় থাকে। জলের সাথে যুদ্ধ করেই তাঁদের জীবন। অতি ধীরে চলা বড় নৌকা দেখিয়ে বলেছিলেন, ভারী পাথর নিয়ে যাচ্ছে। হাওর অঞ্চলে নদী ব্যবস্থাপনার অমার্জনীয় ত্রুটির জন্যেই কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ – এই পুরো অঞ্চলকে অকাল বন্যার প্রভাবে পড়তে হয়। সম্প্রতি বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ার প্রায় বার্ষিক বিপন্নতার সত্য ঘটনা নিয়ে এক মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে পাশের দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছে। মুহাম্মদ কাইউম পরিচালিত 'কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া' একটি অঞ্চলের নথিচিত্র।
৪.
ফারাক্কা বাঁধের কারণে আমাদের দেশের বন্যা বিপর্যয়ের কথা আমরা অতি অল্প বয়স থেকে শুনছি। আবার তিস্তার জল নিয়ে ফলহীন দর-কষাকষিও কম হলো না। কিন্তু সঠিক ও কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি এই দ্বৈত জটিলতা মীমাংসা করতে পারেনি বা চায়নি। কাগজেপত্রে বারো শতাধিক নদীর নাম পাওয়া গেলেও তার এক-তৃতীয়াংশ নদী সুস্থ দশায় নেই। নদী উদ্ধার, সংস্কার করা, অসংখ্য নদীর দুই পাশে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা, উন্নয়নের নামে স্থানীয় জনজীবন বিপর্যস্ত করা – এসবের অবসান ঘটাতে না পারলে আগামী প্রজন্মের জন্য জলাবদ্ধতার অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আমাদের দেশ নদীমাতৃক, আমরা ছেলেবেলায় পড়ে বই বন্ধ করে রেখেছি; কেননা, আমাদের এক বহতা, স্নেহময়ী, সর্বংসহা, সর্বজয়া, সভ্যতার সমান সময় ধরে আমাদের আশ্রয় দেওয়া মায়ের জন্য আমরা কিছুই করিনি।