আর আছে মাসুদ রানা
রহস্যময় চাঁদ ছিল
দাড়িঅলা ছাগলের দিশেহারা চোখ ছিল
আর ছিল আঁধার।
কার কবিতা?
কবিতা না গদ্য।
কাজী আনোয়ার হোসেনের গদ্য। রশিদ চৌধুরীর নাম-মনে-না-থাকা এক পেইন্টিং-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন। স্পাই থ্রিলারে এই গদ্য সম্ভব?
আয়ান ফ্লেমিং, অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনের গদ্য পছন্দ করতেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সাহিত্যগুণ এবং ডিটেইলের জন্য। 'আমার রহস্য জগৎ' নামে একটা নাতিদীর্ঘ লেখা 'ভোরের কাগজ' দৈনিকে লিখছিলেন। ফ্লেমিং-এর গদ্য তুলে দিয়েছেন, 'পাহাড়ি এলাকা। ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। নির্জন রাস্তায় জেসমিন ফুলের তীব্র গন্ধ। মনে হয়, কী যেন ঘটবে এখানে। শূন্য মঞ্চের রোমাঞ্চ লাগে মনে।'
ফ্লেমিং-এর 'জেমস বন্ড'-এ যা সম্ভব হয়েছিল, তা সম্ভব হয়েছিল 'মাসুদ রানা'য়ও। কাজী আনোয়ার হোসেন যত দিন লিখেছেন। এ অন্য এক জাতের গদ্য। স্মার্ট। ঋজু। রিপোর্টিংয়ের মতো আবার তা না। টানে সবাইকে, বাঁধনে জড়ায়...।
তুমুল জনপ্রিয় 'মাসুদ রানা' সিরিজ। মাসুদ রানা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত দুঃসাহসী স্পাই। গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়...। টানে সবাইকে, বাঁধনে জড়ায় না...।
এই হলো পরিচিতি। স্পাই 'মাসুদ রানা' বাঁধনে জড়ায় না, কিন্তু স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানা সিরিজ?
১৯৬৬ সালে আত্মপ্রকাশ। প্রথম বই 'ধ্বংস-পাহাড়।' পরের পঞ্চাশ বছরও যদি ধরি, কত কোটি পাঠক 'মাসুদ রানা' পড়েছেন? জরিপ-ব্যবস্থা নাই আমাদের দেশে। যা নাই তার জন্য আফসোস করি না। 'মাসুদ রানা' এত দিনে দশ কোটি পাঠক হয়তো পড়েছেন। এগারো কোটি হয়তো। বারো কোটি হয়তো। আরও অনেক পাঠক পড়বেন।
আয়ান ফ্লেমিং-এর 'জেমস বন্ড' সিরিজ। প্রথম বই 'ক্যাসিনো রয়াল'। প্রকাশকাল, উইকিপিডিয়া বলছে এপ্রিল ১১, ১৯৫৩। গ্রিসওল্ড ক্রনোলজি বলছে, মে-জুলাই ১৯৫১ বা মে-জুলাই ১৯৫২। দুই-তিন বছরের ফারাক ব্যাপার না, ব্রিটিশ স্পাই জেমস বন্ডের ১৩/১৪/১৫ বছরের জুনিয়র বাংলাদেশি স্পাই মাসুদ রানা। জুনিয়র তবে ছায়া কি, যে রকম বলা হয়ে থাকে?
গোয়েন্দা সাহিত্যের জগতে উঁকি দিতে হচ্ছে একবার। মসিয়ো অগাস্ত দুপো হলেন আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দা। এডগার এলান পো মসিয়ো দুপোকে নিয়ে 'মার্ডার ইন দ্য রু মর্গ' এবং 'দ্য গোল্ড-বাগ' নামে দুটা গোয়েন্দা গল্প লিখেছিলেন। বলা যায় পরের সকল সাহিত্যিক-গোয়েন্দাই এই মসিয়ো দুপোর কোটের আস্তিন থেকে নানা কালে নানা দেশে নানা পাতে পড়েছেন। সে মহামতি শার্লক হোমস থেকে বাংলার ব্যোমকেশ, কীরীটি, ফেলুদা। তাই বলে মসিয়ো দুপোর ছায়া নাকি হোমস? ব্যোমকেশ, কীরীটি, ফেলুদা?
মাসুদ রানার আগে 'কুয়াশা' সিরিজের দুটা বই লিখে তাঁর সেবা প্রকাশনী, তৎকালীন সেবা প্রেস থেকে প্রকাশ করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। জনপ্রিয় হয়েছিল বই দুটা। কিন্তু সেই বই পড়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের এক বন্ধুর অত পছন্দ হলো না। তার নাম মাহবুবুল আমীন। ইনি একটা বই কিনে উপহার দিয়ে পড়তে প্রলুব্ধ করলেন বন্ধুকে। বইটা হলো 'ডক্টর-নো'-'জেমস বন্ড' সিরিজের ষষ্ঠ বই এটা। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৫৩। অপ্রাসঙ্গিক বা প্রাসঙ্গিক হয়তো, থ্রিলার লিখেছেন সেই মাহবুবুল আমীনও। মাহ্বুব আমীন নামে। বৃশ্চিক সিরিজ। প্রথম বই 'দুঃস্বপ্নের আগে', প্রকাশকাল: ১৯৬৮। পরিবেশক ছিল সেবা প্রেস। কাজী আনোয়ার হোসেন বন্ধুর বইয়ের ব্লার্ব লিখে দিয়েছিলেন।
'ডক্টর নো' পড়ার মুগ্ধতাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল 'মাসুদ রানা' লিখতে, জেমস বন্ডের ধাঁচে মাসুদ রানা, 'এম'-এর ধাঁচে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের চরিত্র সৃষ্টি হয়েছিল, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একাধিকবার এসব বলেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তাতেই কি মাসুদ রানা আর জেমস বন্ড এক হয়ে গেল?
'ক্যাসিনো রয়াল'-এর পর আয়ান ফ্লেমিং আরও তেরোটা 'জেমস বন্ড' লিখেছিলেন। এগারোটা উপন্যাস, ছোট গল্প দুটা। কুসুমাস্তীর্ন অভিযাত্রা। বিস্তারিত আছে ফ্লেমিংকে নিয়ে লেখা 'দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন পেন' বইতে। ফ্লেমিং-এর পর জেমস বন্ডকে নিয়ে আরও থ্রিলার লিখেছেন অন্যরা।
জেমস বন্ডের মতো মাসুদ রানা সিরিজও প্রকাশমাত্রই জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রথম দুটা বই মৌলিক রচনা। 'ধ্বংস-পাহাড়', 'ভারত নাট্যম'। পরে সব বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনে আছে, রচনা: বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে। ক্রমবর্ধমান পাঠকচাহিদা মেটাতে এই পন্থা গৃহীত হয়েছিল।
'রূপান্তরের জন্য অনেকে সমালোচনা করেন হয়তো। তাতে কিছু মনে করি না আমি। বছরে একটি করে উপন্যাস বেরোলে প্রকাশনা চলবে কীভাবে? এ দেশে অ্যাডভেঞ্চার বা রহস্যোপন্যাস লেখার পরিবেশও তো নেই। ওসব অভিজ্ঞতা আমরা পাব কোথায়? কোথায় সমুদ্রতরঙ্গের শীর্ষে কী হচ্ছে, আর্কটিকে আবহাওয়া কেমন, সংঘর্ষ লেগে কঠিন বরফে চিড় ধরে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল-এসব বাঙালি লেখকের অভিজ্ঞতার বাইরে। ...সায়েন্টিফিক বা টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে থ্রিলার লেখা আমাদের পক্ষে দুরূহ'- কাজী আনোয়ার হোসেন।
বাস্তবতা। স্পাই থ্রিলার বাংলা সাহিত্যের ঘরের জিনিস না। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, গোয়েন্দা কাহিনি, পিশাচ কাহিনি এসব ঢের লেখা হয়েছে আগে, বাংলায় স্পাই থ্রিলার লেখার ঝুঁকি কেউ এভাবে নেননি। ঝামেলা আছে। গুপ্তচরবৃত্তির নিন্দনীয়-এটা যেকোনো মিথ বিশ্বাসের মতো। সেই গুপ্তচর দেশপ্রেমিক নায়ক, মানবতা আছে, শিভালরি আছে, পাঠক মেনে নেবে কেন সহজে? কমিউনিকেট করার একটা ব্যাপারও আছে। এসপিওনাজ জগতের কায়-কারবার, আমজনতার চেনা জগৎ না এটা। কোলেতের 'ক্লোডেন'-কে যেমন 'আমি' ভাবা যায় কিংবা হুমায়ূন আহমেদের 'হিমু'কে, স্পাই থ্রিলারের নায়ককে সঙ্গত কারণেই সে রকম ভাবার অবকাশ কম। যে 'কমন' না, সে নায়ক। পাঠকের সব সময়ের নায়ক, যে টানে যে আবার দূরের। পাঠক খুব সহজে তাকে 'আমি' ভেবে নিতে পারে না। পূর্বে অচর্চিত ধারা এ বাংলায়। এ জন্য ঝুঁকির। কাজী আনোয়ার হোসেন ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন এবং পূর্ণমাত্রায় সফল হয়েছিলেন। পাঠক গ্রহণ করেছিল 'মাসুদ রানা'কে। চিরকালের নারদ আমাদের কিছু সুসাহিত্যিক সেটা মেনে নিতে পারেননি। আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন। 'মাসুদ রানা' সিরিজের তৃতীয় বই 'স্বর্ণমৃগ' প্রকাশিত হওয়ার পর 'সচিত্র সন্ধানী' পত্রিকায় তীব্র সমালোচনা বেরিয়েছিল, 'এই লেখককে ডেকে এনে হাতে আগুনের সেঁকা দেওয়া এবং পল্টন ময়দানে বেঁধে জনসমুদ্রে চাবুক মারা দরকার।'-কী নির্মম!
কাজী আনোয়ার হোসেন মামলা করেছিলেন। জিততে পারেননি। সাহিত্য-ব্রাহ্মণদের হাত লম্বা। প্রভাব খাটিয়ে 'স্বর্ণমৃগ' বইটাকেই তারা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করিয়ে দিয়েছিলেন।
'হা হতোস্মি' কথাটার মানে কী? হতাশাব্যাঞ্জক কিছু? তবে এখানে বলি, হা হতোস্মি! যত কথা তখন উঠেছে, সাহিত্য-ব্রাহ্মণরা 'হান্টারওয়ালি' নাদিয়ার হাতের চাবুকটা কেবল হাতে পাননি, পেলে আর দেখতে হতো না। অভিযোগ মাসুদ রানা সিরিজ অশ্লীল, যৌনতাপূর্ণ। বানোয়াট কথা। এখনকার কোনো পাঠক কি সেই প্রাচীন এবং চিরকালীন সাহিত্য-ব্রাহ্মণদের মতো ভাববেন? না মনে হয়। হেজেমজে গেছে সেই সব কুচিন্তা।
ফিকশনের মাসুদ রানার বয়স আটাশ। হাইট ছয় ফুট। সে কি বাস্তবের কোনো চরিত্র? বা লেখার সময় সে রকম কেউ ছিল কি কাজী আনোয়ার হোসেনের মাথায়?
না। শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা' একবার প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল- 'আমি যা হতে পারিনি তাই মাসুদ রানা: কাজী আনোয়ার হোসেন।'
'মাসুদ রানা' নামকরণের ব্যাপারে কেবল জানা যায়, সেই সময় পাকিস্তানের একজন জনপ্রিয় প্লেব্যাক সিঙ্গার ছিলেন মাসুদ রানা। কিন্তু মানুষটা কোনোভাবে নিশ্চয় স্পাই 'মাসুদ রানা'র মতো ছিলেন না। (মাসুদ রানা নামকরণ নিয়ে আরেকটা গল্প চালু আছে, বাংলাদেশের গানের জগতের আরেক মানুষ মাসুদ করিম আর মেবারের রাজা রানা প্রতাপ সিংকে যুক্ত করে। তাদের দুজনের নামের প্রথম অংশ জুড়ে দিয়েই নাকি হয়েছে মাসুদ রানা!)
আর, জেমস বন্ড নিয়ে কথা!
জেমস বন্ডের ছায়া মাসুদ রানা?
ছায়া না, 'মতো' বলা যায়। মাসুদ রানা জেমস বন্ডের মতো। তা-ও না। জেমস বন্ড জেমস বন্ডের মতো। মাসুদ রানা মাসুদ রানার মতো- বাংলদেশের মাসুদ রানা।
রিপিট: রহস্যময় চাঁদ ছিল
দাড়িঅলা ছাগলের দিশেহারা চোখ ছিল
আর ছিল আঁধার।
আর আছে 'মাসুদ রানা'।