যেভাবে পেতে পারেন পিডিএফ থেকে ছাপা বই
নিমাই ভট্টাচার্যের রাজধানীর নেপথ্যে বইয়ের সন্ধানে নীলক্ষেতে ছোটখাটো একখানা চিরুনি অভিযান চালালাম গত সপ্তাহে। কিন্তু অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না বইটি। অথচ নিমাইবাবুর জনপ্রিয় বই মেমসাহেব দেখা গেল প্রায় প্রত্যেকটি দোকানেই। কোনো কোনো দোকানে গোধুলিয়া কিংবা তোমাকেও দেখলাম। কিন্তু অলি থেকে গলি, আগা থেকে মাথা—রাজধানীর নেপথ্যে কোত্থাও নেই, যেন উবে গেছে।
আজকের দিনের নীলক্ষেত
বাংলাদেশের অনেক পাঠকের ধারণা, নীলক্ষেতে খুঁজলে এমন বই নেই যা পাওয়া যাবে না। সেই ধারণা আমারও ছিল। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেল, খানিকটা অ-জনপ্রিয়, চিরাচরিত ধারা থেকে আলাদা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ডের বাইরে থাকা বই খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল।
ফুটপাতের রাশি রাশি বই একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ইট এন্ডস উইদ আস, ইট স্টার্টস উইদ আস, ফিফটি শেডস অব লাভ ঘরানার রোমান্টিক বই বেশি। পাশাপাশি রয়েছে মোটিভেশনাল বইয়ের ছড়াছড়ি। ক্লাসিক ঘরানার কিছু বইও নীলক্ষেতে দেখা যায়, তবে সেগুলোও বহুল আলোচিত।
কিন্তু এমন বই, যা খুব আলোচিত নয় অথচ ভালো গল্প কিংবা মানসম্মত লেখা রয়েছে, তা খুঁজতে গিয়ে হোচট খেতে হয় বৈকি! আলোচিত বইয়ের পাঠক যেমন আছে, তেমনি অন্তরালে পড়ে থাকা বইগুলোরও পাঠক কম নয়। তাই চিরুনি তল্লাশির পর সেই বই না পেলে বইপ্রেমী পাঠক হতাশ হবেন না কেন?
রাজধানীর নেপথ্যে বইখানা কয়েকটি অনলাইন শপ এবং প্রকাশনীতে অর্ডার দিয়েও পাওয়া গেল না। নীলক্ষেত অভিযানও ব্যর্থ হলো। এমনকি খোদ কলকাতার কলেজস্ট্রিটেও খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বইটি প্রিন্ট আউট। এবার তাহলে উপায়? কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, পিডিএফ পড়ে নিলেই তো হয়।
কিন্তু কেউ যেমন ডিম ভাজার বদলে ডিম পোচ পছন্দ করেন, তেমনি কিছু পাঠক ছাপা বইয়ের গন্ধে স্নায়ু শান্ত রাখেন। শীতের সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ছাপা বই পড়তেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। পিডিএফের (পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরম্যাট) কথা শুনলেই তারা নাক সিটকান।
অবশেষে অনেক চেষ্টায় খোঁজ পাওয়া গেল প্রিন্ট আউট বই পুনরুদ্ধারের উপায়। কেমন করে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ গেট পার হয়ে ডান দিকে মোড় নিলে নিউমার্কেট থানা। না, আপনাকে থানায় যেতে বলছি না। একটু ধৈর্য ধরুন। নিউমার্কেট থানা থেকে কিছুদূর এগোলে গাউসুল আজম মার্কেট। সেখানে প্রিন্টিং ও বাঁধাইয়ের অজস্র দোকান। এর মধ্যে কিছু দোকান পিডিএফ থেকে বই প্রিন্টের কাজ করে থাকে। খরচের চিন্তা করছেন? খরচ সীমিত।
পিডিএফ থেকে ছাপা বই
গাউসুল আজম মার্কেটের নিচতলার তিনটি গলির মধ্যে মাঝখানের গলি ধরে ঘোরাফেরা করছিলাম। একেবারে উদ্দেশ্যহীনভাবে নয়, পিডিএফ থেকে বই প্রিন্টের দোকান খুঁজছিলাম।
কিছু দোকানের গায়ে 'পিডিএফ থেকে প্রিন্ট বই' পোস্টার চোখ এড়াল না। ভিড় এড়িয়ে একখানা ছোট দোকানে ঢুকলাম। এক চিলতে জায়গা, নেমপ্লেটে লেখা 'উচ্চাশা ডিজিটাল প্রিন্টিং হাউজ'।
রাজধানীর নেপথ্যে বইটির পিডিএফ দেওয়ার পর দোকানের মালিক জানালেন, বইটি প্রিন্ট করা সম্ভব। পিডিএফ থেকে প্রিন্টের রহস্য এবার উন্মোচিত হলো। পিডিএফ থেকে পৃষ্ঠাগুলো ফটোকপি করা হয়, এরপর বাঁধাই আর মলাটের কাজ।
ডায়েরি সাইজের বইয়ের ক্ষেত্রে এক পাতাকে দুটো ভাগ করে দুই পৃষ্ঠা ছাপানো যায়। এতে খরচ কমে। বইয়ের পাতা সংখ্যা, কাগজের মান ও মলাটের ডিজাইনের ওপর বইয়ের দাম নির্ভর করে।
উচ্চাশা প্রেসের স্বত্বাধিকারী মজিবুল হক ভূঁইয়া। গ্র্যাজুয়েশনের পর ১৯৯৮ সালে এলিফ্যান্ট রোডের একটি প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক ডিজাইন শেখেন। পরে নন্দিনী প্রিন্ট শাড়ি কোম্পানিতে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন।
চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১২ বছর আগে গাউসুল আজম মার্কেটে নিজের দোকান শুরু করেন। প্রেসের কাজের পাশাপাশি বছর দুয়েক ধরে পিডিএফ থেকে বই তৈরির কাজ করছেন।
মজিবুল বলেন, 'অনেক সময় পিডিএফ লক থাকে। আনলক করতে না পারলে প্রিন্ট সম্ভব হয় না। তবে এটা কঠিন কিছু নয়, কম্পিউটারে কারিগরি দক্ষতা থাকলেই হয়।'
এ কাজের জন্য খুব বেশি দক্ষতার দরকার নেই। তবে বই বাঁধাই ও মলাটের ডিজাইনের জন্য নান্দনিকবোধ জরুরি। যারা বই প্রিন্ট করাতে আসেন, তারা মলাটে নিজেদের পছন্দ ও রুচির ছাপ রাখতে চান। ভালো মানের কাগজও চান।
হলুদ রঙের এক ধরনের কাগজ এখন জনপ্রিয়, তবে রঙ হলুদ হলেই কাগজের মান ভালো হয় না। অনেক সময় সব কাগজকেই কর্ণফুলী কাগজ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। মজিবুল বই ছাপানোর জন্য পারটেক্সের কাগজ ব্যবহার করেন।
পিডিএফ থেকে বই করতে চান এমন কাস্টমার সংখ্যায় খুব বেশি নন। মাসে ১২-১৫ খানা বই ছাপানোর কাজ পান মজিবুল। ১০০ টাকায় একেকটা বই বিক্রি করেন দোকানিরা।
মজিবুল মনে করেন, দাম দিয়ে বই কাস্টমাইজ করে বানানো পাঠক এখনো খুব বেশি নেই। তবে বছর বিশেক আগেও বাজারে বই প্রিন্টআউট হয়ে গেলে তা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হতো, এখন সেই ছবি একেবারে বদলেছে।
পিডিএফ থেকে বই ছাপানোর কাজ আজকাল বিভিন্ন অনলাইন বইয়ের দোকানও পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছে পাঠকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে।
ফেসবুকে অন্যতম জনপ্রিয় বুকশপ বইনগর ও বুক বাজার বিডি। এ বুকশপগুলো কাস্টমারের চাহিদার ভিত্তিতে পিডিএফ থেকে বই ছাপিয়ে দিয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, ফেসবুকে অনেক ক্লোজড গ্রুপেও পিডিএফ থেকে বই ছাপানোর কার্যক্রম চলে।
গাউসুল আজম মার্কেটের পেছনের দিকে আছে বেশ কিছু দোকান যেগুলোতে দেখা মিললো প্রেস মেশিনের। এসব প্রেস মেশিনে চলে ভিজিটিং কার্ড, মেমো, পাশবই কিংবা পোস্টার ছাপানোর কাজ।
এমন একখানা দোকান হাসান বুক বাইন্ডিং। দোকানটির কর্মচারী জানালেন, এ মেশিনে বইও ছাপানো যায়। তবে বইয়ের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে অর্ডার নেওয়া হবে কি না। দুই-এক কপি বই ছাপালে যে আর্থিক লেনদেন হয়, তাতে ক্রেতা এবং পাঠক দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
নীলক্ষেতের ফুটপাতের বইগুলো গাউসুল আজমের এসব প্রেস মেশিনের মাধ্যমেই ছাপা হয়ে থাকে।
কেন অজনপ্রিয় বই নীলক্ষেতে মেলে না
রবার্ট টি. কিয়োসাকি ও শ্যারন লেখটারের রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড, শিব খেরার ইউ ক্যান উইন-এর মতো বইগুলোর অনেক বেশি রিভিউ দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। বই নিয়ে ফটোগ্রাফির মাধ্যমেও কিছু কিছু বই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
ইতিবাচক পর্যালোচনা আর নিউজফিডময় সেই বইয়ের ছবি দেখে প্রভাবিত হয়ে যান বেশিরভাগ মানুষ। বই না পড়লেও বই দিয়ে ঘর সাজানোর একটা প্রবণতাও ইদানিং চালু হয়েছে। আর তাই এ ট্রেন্ডিং বইগুলো কম দামে কিনতে চান অনেকে।
পাঠকের এ সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে নীলক্ষেতের বই ব্যবসায়ীরা জনপ্রিয় বই ৫০০ কিংবা এক হাজার কপি করে ছাপিয়ে ফেলেন, পাইরেসির তোয়াক্কা না করেই। খুব বেশি সময় লাগে না এসব বই বিক্রি হতে।
নীলক্ষেতের এক বই বিক্রেতা সাইফুল জানালেন, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পাঠক হয়তো ১০০ জনে ৫ জন। এ বই ছাপালে লস হবেই। তাই কেউ এ ধরনের বই রাখতে চায় না।
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো একেবারে দুষ্প্রাপ্য নয়, কিন্তু বিক্রিবাট্টা অত বেশি হয় না। সেক্ষেত্রে বই গোডাউনে রাখা থাকে। পাঠক চাইলে ১০-১৫ মিনিটে এনে দেওয়া সম্ভব।
'আর যে বই মানুষ কেনে, সেগুলোই সামনে সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করি। তাতে করে মানুষ হেঁটে যেতে যেতেও অনেক সময় পরিচিত নাম, চেনা প্রচ্ছদ দেখে কিনে নিয়ে যান।'
এছাড়া পিডিএফ কপি না পাওয়া কিংবা বই বাজারে প্রিন্ট আউট হওয়ার কারণেও দুষ্প্রাপ্য বই দেখা যায় না।
কেমন ছিল পুরোনো দিনের নীলক্ষেত
১৮৪৭ সালের দিকে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল। বর্তমান নীলক্ষেত এলাকায় কোনো বসতি ছিল না। ধারণা করা হয়, সেই নীলকুঠির নীল থেকেই নীলক্ষেতের নামকরণ।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৬ সাল থেকে নীলক্ষেত এলাকায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই কেনাবেচা শুরু হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্র বললেন, '৭০-এর দশকের নীলক্ষেতে মিলত দুষ্প্রাপ্য বই। এছাড়া সাধারণ বই পাওয়া যেত কম দামে। যেজন্য বইপ্রেমী আর গরিব ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হতেন অনেকটাই।
এছাড়া নীলক্ষেতে ভারতীয় (অ্যাকাডেমিক কাজে লাগে এমন) বইও কেনা যেত তিনগুণ দামে, আবার কোনো কোনো সময় স্বল্পমূল্যে। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে বাংলাদেশি ১০০ টাকার সঙ্গে ভারতীয় ২৮/৩০ টাকার বিনিময় হার ছিল।
দোকানিকে বললে অরিজিনাল ইন্ডিয়ান প্রিন্টের বই যোগাযোগ করে এনে দিত কলেজ স্ট্রিট থেকে। সময় সেক্ষেত্রে একটু বেশি লাগত।
আশির দশক থেকে নীলক্ষেত আরও জমজমাট হতে শুরু করে। এরপর থেকে এখনো অব্দি নীলক্ষেত কোলাহলমুখর।
তবে যুগের চাহিদা আর পাঠকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নীলক্ষেতের অনেক কিছুই বদলেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো টিকে থাকতে গেলে এর থেকে আরও চমকপ্রদ বদল আনতে হবে নীলক্ষেত বই ব্যবসায়ীদের।
তবে প্রযুক্তি যখন অনেক জিনিসের প্রবেশাধিকার আমাদেরকে দিয়েছে, সেখানে কাজে লাগাতে ক্ষতি কী?
কোনো নামিদামি অনলাইন শপে যেখানে ডেলিভারি চার্জ ৮০-১০০ টাকা, তার ওপর বইয়ের দামটাও থাকে অনেকটা বেশি (অরিজিনাল প্রিন্ট), সেখানে অনেক মধ্যবিত্ত পাঠকের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে পিডিএফ টু প্রিন্টের দৌলতে। পিডিএফ পড়বার আগের জেনারেশনের অনেক বয়স্ক পাঠক, যারা চোখে ভালো দেখেন না কিংবা প্রযুক্তি সম্পর্কে অতটা ওয়াকিবহাল নন, তাদের কাছে এ তো এক সুবর্ণ সুযোগই বটে।
ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী/টিবিএস