ক্রিকেট, ক্রিকেট
আমাদের ছেলেবেলায় অনেক হরতাল হতো। অর্ধদিবস, পূর্ণ দিবস। রাস্তাঘাট থাকত ফাঁকা। তখনকার বিরোধী দলের আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। হরতালে গাড়ির কোনো ব্যাপারই ছিল না, দুই-চারটি রিকশা বড়জোর। আমরা থাকতাম কোতোয়ালির মোড়ে সাধু মিষ্টি ভান্ডারের ওপরে। আমাদের উল্টো দিকে সিডিএ বিল্ডিং, চলতি কথায় লোকজন একে ডাকত চোর-ডাকাতের আড্ডা, কেন? ওটা ছিল চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কার্যালয়। বড় হয়ে খানিকটা বোধহয় বুঝতে পেরেছি! আমাদের চট্টগ্রামে এখনো যে জলাবদ্ধতা নিরসন হয়নি, ছেলেবেলার সেই লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া কথা মাথায় অন্য অর্থ তৈরি করে দেয়। আমাদের বাসার উল্টো দিকে পুরোনো এক মসজিদ, মসজিদের উল্টো রাস্তায় একটা মাজার আর পাশেই ওই ভবন। এই চারটে স্থাপনার মধ্যেখানে একটা বেশ বড়সড় জায়গা। সেখানে হরতালের দিন আমরা ক্রিকেট খেলতাম। আমরা মানে আমি আর এলাকার কয়েকজন ছোট ছেলে। প্লাস্টিক বল প্লাস্টিক ব্যাট। তুমুল উত্তেজনা ছিল খেলায়। জুতো স্তূপ করে উইকেট, সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে নাজুক উইকেট। এইভাবে বেড়ে উঠছিলাম আনন্দে আর উত্তেজনায়। বেশ অল্প বয়সেই আমার একটা অপারেশন হয়েছিল, তাই ছোটাছুটি ছিল বারণ। ফলে আউটডোর খেলা বলতে ওইটুকুই। আনন্দমেলা শারদে ছিল মতি নন্দীর ক্রীড়া সাহিত্য। কলাবতী নামে এক বাচ্চা মেয়েকে কেন্দ্র করে একের পর এক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যে মতি নন্দী আনপ্যারালাল। অন্তত খেলাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য নির্মাণে। চোখের সামনে যেন খেলাটা দেখতাম আমরা।
টেলিভিশনে খেলা দেখতাম। শচীন টেন্ডুলকার ছিলেন প্রিয়তম। মেহেরাব অপিকে খুবই ভালো লেগেছিল। পত্রিকার ছবি কেটে খাতায় জমিয়েছিলাম। মনে আছে, সাতানব্বই সালে পয়লা বৈশাখের আগের দিন বিশাল মিছিলের কথা। বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন, দুই বছর পর স্বপ্নের বিশ্বকাপে খেলবে। নিউমার্কেটের মোড়ের সেই মিছিলে আনন্দিত কুকুরের মতো চিৎকার করেছিলাম দলবেঁধে; গলা ভেঙে গিয়েছিল পরে ভাত খাবার সময়, কুকুরের মতোই কুঁই কুঁই গলার আওয়াজ। কী উত্তেজনা তখন! কিশোর ভুবন, কিশোর তারকালোক, ছোটদের কাগজ—সব কিশোর পত্রিকার প্রচ্ছদে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। নিয়মিত এইসব পত্রিকা পড়তাম বলে মনে আছে। আর মনে আছে কলকাতা থেকে কিশোর পত্রিকা আনন্দমেলায় এসব কিছুই ছিল না। আমরা শচীন টেন্ডুলকার, আজহারউদ্দিনকে নিয়ে কত আনন্দই না করি; কিন্তু ওই বয়সে দেখেছি আমাদের খেলোয়াড়দের নিয়ে তাদের কোনো আনন্দ নেই। এইভাবে কচি বয়সে খেলার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতিও শিখছিলাম। আরও বড় হতে দেখলাম, খেলার সাথে রাজনীতি মিশিয়ে খেলার আনন্দটা কোথাও একটা বিষিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলা হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ চলে আসছে, সম্পূর্ণ অকারণ। তখন অরুন্ধতী রায়ের 'কাম সেপ্টেম্বর' প্রবন্ধটা মনে পড়ত। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, যে আমেরিকানরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন, এমনকি মিছিল করেছেন, তাদের কি আমরা ঘৃণা করব? নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানের মানুষদের আমরা ঘৃণা করব? এই সূত্রেই মনে হয় উর্দু ভাষায় যারা চর্চা করেন, বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্রাত্য করে রাখার কথা। উর্দু ভাষার কবি আহমেদ ইলিয়াস, নওশাদ নূরীর কথা। কিন্তু এসব কথা থাক। আমরা অন্য প্রসঙ্গে যাই। সত্যিই খেলার মধ্যে রাজনীতি না মেশাতে চাইলে জনরুচি বিপন্ন হবে হয়তো। মেশানোই ঠিক হয়তো, যেমন করে শাসিত সেনেগাল শাসক ফ্রান্সকে সামনে পেলে উদ্বোধনী ম্যাচেই বুবা দিউফের কল্যাণে গোল দিয়ে দেয়। আহা বুবা দিউফ—তুমি অমর হও।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম দল প্রথম দুই বিশ্বকাপে পরপর চ্যাম্পিয়ন, অথচ তারা এই বিশ্বকাপে নেই। তাদের এই পরিণতি কেন হলো, এই বিষয়ে আলোচনা আমার বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠবে না; আমি বরং অমর কথাসাহিত্যিক ভি এস নাইপলের কিছু কথা স্মরণ করি, যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের আদি চেহারা কিছুটা হলেও বোঝা যাবে। ঈষৎ সংক্ষিপ্ত। উত্তম পুরুষে লেখা, মানে নাইপলের স্মৃতিচারণা এটি।
২.
'পৃথিবীর সবচেয়ে মহৎ ক্রিকেটার কে?'—১৯৪০-এর একদিন, সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষায় প্রশ্নটি এল। পোর্ট অব স্পেনের ট্রাংকুইলটি বয়েজ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়বার সময় প্রশ্নটির মুখোমুখি হই। দেখে মনে হয় ফাঁদে ফেলার প্রশ্ন। যদিও তাকে কোনো দিন খেলতে দেখিনি এবং রিপোর্ট থেকে জানি, তিনি ইংল্যান্ডে থাকেন। লিয়ারি কনস্টান্টিনের চেয়ে ভালো কাউকে চিনতাম না। নিয়মিত ত্রিনিদাদ গার্ডেন পত্রিকায় তার একটাই ছবি দেখতাম: ঘেমে যাওয়া শরীর, হাসছেন, ব্যাট হাতে প্যাভিলিয়নের দিকে দৌড়াচ্ছেন। আমার কাছে ব্যাটটা ছিল সোনালি। কনস্টান্টিন, আগের এক সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষায় 'সোনার ব্যাট হাতে মানুষ' প্রমাণিত হয়েছিলেন যেমন, আরেকটু আগে তিনি ছিলেন 'সোনালি বল হাতে মানুষটি'; কিন্তু এখন মহত্তম ক্রিকেটার? আমি লিখেছিলাম, 'ব্র্যাডম্যান', ভুল উত্তর ছিল; পেন্সিল দিয়ে খাতা কেটে দেয়া হয়েছিল, কেটে দেয়ার দাগ ছিল বিরাট আর রেগে যাওয়ার টানে। কনস্টান্টিন এই প্রশ্নের উত্তরও।
শিক্ষকটি ছিলেন নিগ্রো (কৃষ্ণাঙ্গ), বাদামি ত্বকের, কিন্তু এটি পরবর্তী বিবেচনা এবং সম্ভবত ভুলভাবে ভাবা, আমার কাছে তখন এবং পরের কিছু সময়েও, জাত আর রং, শিক্ষকদের গুণাবলি ছিল না। এখন কনস্টান্টিনের জন্য প্রচারণার ব্যাপারটিকে বর্ণবাদ বা জাতীয়তাবাদের ধরন হিসেবে ভেবে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই ভাবনা হবে আংশিক সত্য। জাতিগত গর্ব বিশুদ্ধ এবং সরল, জো লুইসের বিজয়ের পক্ষে, হ্যাঁ। কিন্তু আমার শিক্ষকের কনস্টান্টিনের জন্য নিবেদন এর চেয়ে অধিকতর জটিল। এবং এটি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জটিলতার উন্মোচনসহ যে বিষয়ে রাজনীতিবিদ, প্রচারপত্র বিতরক, ইতিহাসবিদ, ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানের প্রাক্তন ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট সি এল আর জেমস সচেতন ছিলেন। তিনি তার কাজ চমৎকারভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন।
পঞ্চাশের দশক থেকে সংবাদপত্রেরা লর্ডের ক্যালিপসো সংগীতের সাথে আমাদের পরিচিত করে তুলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের জন্য, যেমন লিখেছেন একজন ক্রিকেট সাহিত্যিক, খেলাটা হচ্ছে একটা কার্নিভ্যাল। কিন্তু কার্নিভ্যালের জন্য কোন খেলাটাকে পছন্দ করা হলো! এটি অলস, কঠিন, প্রশংসার জন্য জটিল, এই খেলার উত্তেজনা কখনো লুপ্ত করে দেয়া হয়, কখনো দুম করে পর্দা নামিয়ে দেয়া। খেলোয়াড়রা চা খাওয়ার জন্য বিরতিতে যায়। অন্যদিকে ফুটবল বা সকার, দ্রতগামী সংক্ষিপ্ত, নিষ্ঠুর। কিংবা বেসবল অথবা ষাঁড়ের লড়াই অনেক কার্যকর, এখন এখানে উপসংহারটি হচ্ছে, আমরা অবশ্যই সুস্পষ্টতার চেয়ে বেশি কিছু নিয়ে কাজ করছি। ভেবে দেখুন, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের কাছে ক্রিকেট কী। ত্রিনিদাদে আট লাখ মানুষের মধ্যে হাজার ত্রিশেক মানুষ টেস্ট ম্যাচ দেখতে যায় একদিন। মিশ্র জনসংখ্যার কথা ভাবুন। ১৯১০ সালে মিস্টার জেমস তার স্কুলের ক্রিকেট মাঠের বর্ণনা দিচ্ছেন–
'আমরা ছিলাম বিচিত্র, বহুবর্ণ মানুষ। কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ অফিশিয়ালদের ছেলেমেয়ে এবং সাদা ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত কৃষ্ণাঙ্গ এবং বর্ণ সংকর চৈনিক ছেলেরা—যাদের কারও কারও বাবা-মা এখনো ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলে। ভারতীয় ছেলেরা, যাদের বাবা-মা একেবারেই ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না এবং কিছু দরিদ্র কালো ছেলেরা, যারা কোনো প্রদর্শনীতে জিতে এসেছে বা যাদের বাবা-মা এখনো উপোস করে আর কৃষিজমিতে কঠোর শ্রম দেয়। নিজেদের কষ্টার্জিত পয়সা পরিবারের বড় ছেলেকে পড়ানোর কাজে লাগায়। আমরা দ্রত শিখছি কেমন করে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মানতে হয়, টিমের সাথে খেলা শিখছিলাম আমরা।
জাতিগত সাধারণীকরণ—কিছু নির্দিষ্ট মানুষ বলের খেলায় ভালো করে, এমন ভেবে নিলে চলবে না। এখানে কোনো ওয়েস্ট আফ্রিকান ক্রিকেটার ছিল না, একমাত্র উপস্থিত চৈনিক ক্রিকেটাররা এসেছিল ত্রিনিদাদ থেকে এবং যদিও একটা তথ্য কদাচিৎ চোখে পড়ে, সাদা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা জনসংখ্যার সাপেক্ষে প্রতি হাজারে অধিক প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড়ের জন্ম দিয়েছে অন্যত্র যেকোনো জনপদের তুলনায়।
দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস ভাবা যাক এবার। ক্রীতদাসত্ব ১৮৩৪ পর্যন্ত, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ১৯১৭ অবধি আর তারপর ভাবুন ক্রিকেট কোড ভদ্রজনসুলভতা, সুন্দর খেলা, দলগত কাজ—এইসব শব্দেরা ক্লান্তিকর এবং ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পরিস্থিতিতে বীভৎস, অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু তারা একটা প্রয়োজন মিটিয়েছে দ্বীপপুঞ্জের, যা কিনা সুনির্দিষ্ট হিংস্রতার জন্য পরিচিত ছিল। ক্রিকেট এবং এই খেলার কোড একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় বিশ্রাম আর সমাজের অস্বীকার করা মুক্তি ফিরিয়ে এনেছে। দক্ষতা, সাহস, শৈলী আর আভিজাত্য বদলে যাওয়া দুনিয়ায় খেলাটাকে প্রাচীন করে তুলেছে। খেলার সাথে চলে আসা কোড সবাই মানতে বাধ্য—যেকোনো জাতি বা শ্রেণির মানুষ, এ ব্রিটিশ পাবলিক স্কুল কোড: 'আমি শিখছিলাম এবং মান্য করছিলাম—এক একটা কোড শিখছিলাম। ইংলিশ পাবলিক স্কুল কোড। ব্রিটিশ লোকজন কী জানত, তারা সেখানে কী করছে! খুবই অল্প। উপনিবেশের মানুষজন সুনির্দিষ্টভাবে বললে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা তখনো পর্যন্ত কিছু জানে না বললেই চলে।'
মিস্টার জেমস ষাট অতিক্রান্ত, ট্রটস্কির পরিচিত অনুসারী, মার্ক্সবাদী পড়াশোনা ছিল। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ রক্তে। তিনিই প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অভিবাসী লেখক। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত প্রথম বই 'দ্য কেস ফর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সেল্ফ গভর্নমেন্ট'। সেলফ গভর্নমেন্ট কথাটা কমবেশি ওয়েস্ট ইন্ডিজে খাটে। স্যার লিয়ারি কনস্টান্টিন লন্ডনে ত্রিনিদাদ হাইকমিশনার হয়েছিলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমবারের মতো কালো মানুষের অধিনায়কত্বে অনেক কিছু করেছিল অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৬০-৬১ সালে। লক্ষাধিক মানুষের এক-চতুর্থাংশ মেলবোর্নের রাস্তায় নেমেছিল ক্রিকেটারদের বিদায় জানাতে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের সুন্দরতম মুহূর্ত। মিস্টার জেমস দেখেছেন আরও বেশি কিছু, 'ব্যাট আর বল দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করা।' এটি সাফল্যের গল্প। এই ভূমিতে, ভিন্ন অনেক ভূমির মানুষেরা একসাথে আছেন। শতাব্দীজুড়ে একটি ব্যবস্থার ফল হিসাবে বর্ধিত হয়েছে অন্য একটা মাটিতে এসে। গ্রীষ্ম আবাসের ফুল আর আশ্চর্য ফলেদের যেমন করে ফলিয়ে তোলা হয়। স্টোলমেয়ার, গোমেজ, পিয়ারে, ক্রিস্টিয়ানি, চ্যাং ছুন, রামাধীন—ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারদের নামই এর যথার্থ প্রমাণ। জাতীয়তাবাদী হতে হলে মিস্টার জেমস বলেছিলেন, আপনার জাতি থাকতে হবে। আফ্রিকা আফ্রিকানদের জাতি ছিল, যেমন এশিয়া ছিল এশিয়ানদের। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা তার কমিউনিটি যা-ই হোক, ছিল কেবল এই 'ব্যবস্থা' এবং আমার চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষক পৃথিবীতে তার অবস্থানের কতিপয় সংজ্ঞায়ন অনুভব করতে পেরেছিলেন মাত্র কনস্টান্টিনের প্রতি আত্মনিবেদনের মাধ্যমে।