শার্লট অব চিটাগং: ১৭৯২
১৭৯৬ সালের ঘটনা। কলকাতায় নির্মিত ৪০০ টনের ননসাচ (Nonsuch) নামের একটা ফ্রিগেটের কাঠে পচন ধরলে সেটার কারণ খুঁজে বের করার জন্য চট্টগ্রামের এক জাহাজ নির্মাতা মি. হোয়াইটের মতামত চাওয়া হলো। কলকাতা তখনো বড় জাহাজ নির্মাণের জন্য তেমন উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। জাহাজটি ছিল ১৭৮১ সালে কলকাতায় নির্মিত প্রথম বড় জাহাজ, যা এশিয়াজুড়ে কোম্পানির বাণিজ্য পণ্য বহন করা ছাড়াও ইউরোপে ফ্রান্সের সাথে চলমান যুদ্ধে ফ্রিগেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
হোয়াইট সাহেব কলকাতায় গিয়ে জাহাজের আগাপাছতলা পরীক্ষা করে জানালেন, '...জাহাজটির ফ্রেম বাদে বাকি অংশ সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি। কিন্তু যে কি-লক বা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেই কাঠ ভালো ছিল না। সেই কাঠ পচে গিয়ে অন্য কাঠেও সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আমার মনে হয়, ৭৪ কামানের বড় জাহাজ কলকাতায় তৈরি করাটা বাস্তবতাবিবর্জিত সিদ্ধান্ত। কারণ, ওখানে জাহাজ নির্মাণের জন্য যথাযথ মাপের উপযুক্ত কাঠের অভাব আছে; যেটা চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে হয় না। চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মাণের জন্য যে কোনো আকৃতির গাছ পাওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো কাঠের নাম হলো লাল জারুল। লাল জারুল তিন রকমের হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে মজবুত হলো কাঁটা জারুলগাছ...।'
এই বিবরণটুকু পড়ে বোঝা যায়, অষ্টাদশ শতকে জাহাজ নির্মাণের সক্ষমতায় কলকাতার তুলনায় চট্টগ্রাম অনেকখানি এগিয়ে ছিল। বস্তুতপক্ষে জাহাজ নির্মাণের উপযুক্ত কাঠের প্রাচুর্যের কারণেই প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মাণশিল্প গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেগুন, জারুল, শালজাতীয় গাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। সেই কাঠ দিয়ে স্থানীয় কারিগরেরা শত শত বছর ধরে জাহাজ তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করে আসছিল।
গ্রিক সভ্যতার সময়েও চট্টগ্রামের জাহাজ আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে রপ্তানি হয়েছে, সে রকম কিংবদন্তিও আছে। যদিও সেই প্রাচীন যুগের কোনো জাহাজের উদাহরণ আমাদের কাছে নেই। এমনকি মোগল যুগে তৈরি জাহাজের রেকর্ডপত্রও নেই। ব্রিটিশ নির্মাতারাই চট্টগ্রামে তৈরি জাহাজের তালিকা রাখতে শুরু হয়েছিল।
চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন শুরু হবার পর স্থানীয়দের পাশাপাশি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণশিল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। বড় বড় জাহাজগুলো ব্রিটিশ নির্মাতাদের অধীনে তৈরি হতো। আদিকাল থেকে তৈরি হওয়া সেসব জাহাজের কোনো হিসাব রাখেনি কেউ। প্রথমদিকে ব্রিটিশ নির্মাতারা যখন এই খাতে স্বল্প পরিসরে বিনিয়োগ শুরু করে, তখনো জাহাজগুলোর কোনো হিসাব রাখা হতো না। কারণ, তখন কলকাতার তুলনায় চট্টগ্রাম নিতান্তই অখ্যাত শহর।
চট্টগ্রাম বন্দরের সমৃদ্ধি অতীত হয়ে গেছে মোগল যুগের আগেই। আরাকান পর্তুগিজ যৌথ দুর্বৃত্তপনায় এই অঞ্চল বাণিজ্যরহিত হয়ে পড়ে। মোগল আমল থেকে এটি মূলত আরাকান সীমান্তের একটা বাফার জোন হিসেবে ছিল। কোম্পানির কাছে স্টেশন হিসেবে চট্টগ্রামের গুরুত্ব একটা মফস্বল শহরের মতো। কিন্তু জাহাজ নির্মাণশিল্পটা কোনোভাবে টিকে ছিল। ব্রিটিশরা এই শহর অধিকার করার পর থেকে সেই শিল্প আবারও চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করে। চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজগুলোর তালিকা পাওয়া যায় ১৭৯৪ সাল থেকে। সেই তালিকায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এবং উনিশ শতকের প্রথম দুই দশকে চট্টগ্রাম থেকে ছোট-বড় কয়েক শ জাহাজ রপ্তানি হয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জাহাজ:
Thetis (1794): 498 ton
Margaret (1794): 300 ton
Union (1794): 350 ton
Ceres (1796): 400 ton
Hellen (1802): 450 ton
Harriett (1803): 450 ton
Forbes (1803): 530 ton
Hibernia (1810): 450 ton
Orient (1812): 579 ton
Alexander (1812): 660 ton
Frances Sherburne (1814): 450 ton
Thalia (1815): 641 ton
Percy (1815): 650 ton
Victory (1816): 677 ton
Dorah (1816): 695 ton
Alfred (1818): 681 ton
এই তালিকার সবচেয়ে পুরোনো জাহাজটি হলো থেটিস (Thetis)। ১৭৯৪ সালে নির্মিত হয়েছিল ৪৯৮ টনের এই জাহাজ। লয়েডস রেজিস্টার থেকে জানা যায়, জাহাজটি ১৮৩৯ সালের পরও চালু ছিল। তালিকায় থেটিস সবচেয়ে পুরোনো জাহাজ হলেও তার আগেও চট্টগ্রামে চমৎকার সব জাহাজ তৈরি হতো। তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি বলে সেই জাহাজগুলোর কথা হারিয়ে গেছে। চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মাণের সেই স্বর্ণযুগে বছরে গড়ে ৮-১০টি বড় জাহাজ রপ্তানি হতো। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তৈরি জাহাজগুলো হিসাব করলে সংখ্যাটা আরও বেশি হবে। সেই জাহাজগুলো এশিয়া ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকার বন্দরগুলোতেও যাতায়াত করত।
ওপরের তালিকার মধ্যে ১৮১৮ সালে নির্মিত ৬৮১ টনের Alfred জাহাজটি ছিল সবচেয়ে খ্যাতিমান। জাহাজটি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সারা পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশে চলাচল করেছে। জার্মান নৌবাহিনীতে যুক্ত হবার পরে নতুন নাম হয়েছিল Frigate Deutchland। অচল হয়ে যাবার পরও জাহাজটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল মেরিটাইম জাদুঘরে। ২০১৮ সালে জাহাজটির খোঁজ পেয়েছিলাম জার্মানির ব্রেমারহেভন মেরিটাইম জাদুঘরের সূত্র থেকে।
ততটা বিখ্যাত না হলেও চট্টগ্রামে তৈরি আরেকটি জাহাজের খোঁজ মিলেছে সম্প্রতি। জাহাজটির নাম 'শার্লট অব চিটাগং'। ওপরের তালিকায় জাহাজটির নাম নেই, কারণ তালিকা রাখা শুরু হয়েছিল আরও দুই বছর পর থেকে। রেজিস্টারে নাম না থাকলেও জাহাজটির ছবি এখনো ঝোলানো আছে লন্ডনে-পৃথিবীর সময়কেন্দ্র বলে পরিচিত গ্রিনউইচ মানমন্দিরের পাশের ন্যাশনাল মেরিটাইম জাদুঘরে। শুধু ছবি নয়, ছবির সাথে একটা বিস্তারিত বিবরণীও ঝোলানো আছে।
গ্রিনউইচ মেরিটাইম মিউজিয়ামের বিবরণীতে জাহাজটি সম্পর্কে লেখা হয়েছে:
এই ছবিতে কলকাতার হুগলী নদীতে নোঙর করা স্নো জাতের জাহাজ 'শার্লট অব চিটাগং'- এর দুটি দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ছবির বাম দিকে ইস্টার্ন ভিউ দেখা যাচ্ছে, যেখানে জাহাজের নামটা লেখা আছে। মাঝখানে প্রশস্ত অংশে পুরো জাহাজটা দৃশ্যমান; যেখানে ব্রিটিশ পতাকা উড়ছে। পেইন্টিংটার তারিখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই সময়ে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল; এখান থেকে যেসব জাহাজ চলাচল করে, তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকে, যেটা রাজকীয় নেভাল জাহাজের মতো দেখায়।
বড় বড় যাত্রীবাহী জাহাজগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের মালামাল এবং কর্মচারীদের পরিবহন করার কাজে ব্যবহার করত এবং ভারতের বিভিন্ন নদীপথ এবং সমুদ্র উপকূলে চলাচল করত। এসব বাণিজ্য নিঃসন্দেহে লাভজনক ছিল বলে শার্লটের মতো পুবে তৈরি দেশীয় মালিকানাধীন ছোট ছোট জাহাজগুলোকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এশিয়ার বিভিন্ন বন্দরে মালামাল আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করত। ইউরোপিয়ানরা ভারত মহাসাগরে পা দেওয়ার শত শত বছর আগে এই ধরনের সমুদ্র বাণিজ্য এই অঞ্চলে চালু ছিল।
জাহাজটিকে নোঙর করা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। জাহাজের উপরিভাগে ছায়া দেবার জন্য একটা শামিয়ানা টাঙানো আছে, সেখানে পাগড়ি পরা কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। জাহাজের মধ্যভাগে এক নারীকে দেখা যাচ্ছে। আলোর স্বল্পতা এবং মেঘের পেছনে সোনালি রঙের আভা দেখে মনে হচ্ছে এটা সূর্যোদয়ের সময়। ছবিতে খুব বেশি জনসমাগম দেখা যাচ্ছে না। যেকোনো পশ্চিমা শিল্পী ভারতীয় শহরগুলোর ক্ষেত্রে এ রকম জনবিরল দৃশ্য এঁকে থাকে। ছবিটার মধ্যে একটা শান্ত নীরবতা বিরাজ করছে এবং ছবির নিম্নভাগে জলের প্রতিবিম্বের মধ্যে সেটা প্রতিফলিত হয়েছে। কলকাতার দালানকোঠার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে পশ্চিমা প্রভাব ফুটে উঠেছে উদিত সূর্যের সোনালি আভার মতো। ডান দিকে যে ব্রিগ ধরনের ইয়ট দেখা যাচ্ছে, সেটা নৌবাহিনীর নয়। দূরে ডান দিকে দেখা যাচ্ছে জেটির পাশে কয়েকটা ষাঁড় একটা গরুর গাড়িকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনে পেছেনে হেঁটে যাচ্ছে দুই ভদ্রলোক।
ছবিটা এঁকেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী বালথাজার সলভিন। তিনি ১৭৮৯ সালে ভারতে এসেছিলেন। তখন তিনি ভারতীয় নৌযান নিয়ে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন; যে ছবিগুলো পরবর্তীকালে 'Pleasure Boats and Boats of Landing' নামে একটা গ্রন্থে যুক্ত করেছিলেন।
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চট্টগ্রামে তৈরি জাহাজের মধ্যে এ কথা বলা যায়- তিনিই প্রথম চট্টগ্রামের নাম যুক্ত করেছিলেন। যেহেতু ১৭৯২ সালে জাহাজটির ছবি আঁকা হয়েছে, তাতে নিশ্চিত বলা চলে জাহাজটি সেই বছর কিংবা তার অল্প কিছুকাল আগে নির্মিত হয়েছিল। জাহাজের নির্মাতা হিসেবে ইংরেজ নাবিক জর্জ পালভাসের নাম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এই জাহাজটির ইতিহাস বেঁচে আছে বিখ্যাত শিল্পী বালথাজার সলভিনের কারণেই। তিনি ১৭৯২ সালে হুগলী বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় জাহাজটিকে দেখে একটি ছবি এঁকেছিলেন। সেই ছবিটাই সংরক্ষণ করেছে লন্ডনের ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এটি অনেকটা প্রমোদতরি ধরনের জাহাজ ছিল।
তবে ভিন্ন একটি সূত্রে জানা যায়, এই জাহাজটি ১৭৯৪ সালে চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশকারী বার্মিজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে কর্নেল এরস্কিনের অভিযানের সময় রসদ পরিবহনের কাজেও ব্যবহার করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন- 'শার্লট অব চিটাগং'। শিল্পী একই ফ্রেমে জাহাজের দুই দিকের ছবি এঁকেছেন, যাতে পেছন দিকে খোদাই করা জাহাজের নামটা পড়া যায়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে জাহাজের পেছন দিকে খোদাই করা আছে: CHARLOTTE OF CHITTAGONG.
চট্টগ্রামের সমৃদ্ধ জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ধীরে ধীরে ভাটা নেমে আসতে থাকে কারণ, কর্ণফুলী নদীর চেয়ে হুগলী নদী পথ; নদী বন্দর অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়া। কোম্পানির কাছে হুগলী নদীতে জাহাজ নির্মাণ সুবিধাজনক ছিল। বিশেষ করে ১৮০৩ সালে কলকাতার খিদিরপুর ডক নির্মিত হবার পর কলকাতার জাহাজ নির্মাণশিল্প নতুনভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। তবে সেখানে পুরোদমে জাহাজ নির্মাণ শুরু হতে আরও কয়েক দশক লেগেছিল। তা হবার আগপর্যন্ত চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি জাহাজ তৈরি করা হতো।
১৮৩৪ সালের পর থেকে চট্টগ্রামের চেয়ে কলকাতায় নির্মিত জাহাজের সংখ্যা বেড়ে যায়। উনিশ শতকের শেষভাগে চট্টগ্রামের ব্রিটিশ মালিকানাধীন জাহাজ নির্মাণের কারখানাগুলো কমে আসতে থাকে। একসময় চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জাহাজ নির্মাণশিল্প ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নেয়।
তথ্যসূত্র:
1. National Maritime Museum, Greenwich, London.
2. A Collection of Papers Relative to Ship Building in India. John Phippy (Calcutta, 1840)
3. অতীত চিত্রে চট্টগ্রাম: শেখ শওকত কামাল
4. Accounts and Papers of East India (For House of Commons), Vol-34 (1845)