লস্কর: ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় জাহাজে দেশি নাবিকদের দুর্বিষহ জীবন
১৬ থেকে ২০ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপীয় জাহাজগুলোতে ভারতবর্ষের মানুষদের নাবিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। লস্কর নামে পরিচিত এ নাবিকদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। তাদের শ্রমের মূল্য ছিল নিতান্তই কম, তাই ইউরোপীয় মালিকেরা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন, মানুষ হিসেবে গণ্য করতেন না এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কোনো রোগ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতেন না।
জাহাজে ইউরোপীয় নাবিকদের বরাদ্দে যে পরিমাণ জায়গা থাকত, লস্করেরা তার অর্ধেকও পেতেন না। জাতের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হতো। ইউরোপীয় ডাক্তারেরা লস্করদের প্রতি 'পুরোপুরি অসহানুভূতিশীল' ছিলেন বলে অভিযোগ থাকলেও তারা অবশ্য সেটা অস্বীকার করেছেন। ভারতীয় কোনো নাবিক অসুস্থ হয়ে গেলে তার চিকিৎসার খরচ তার মাইনে থেকেই কাটা হতো।
মহাসমুদ্রে দুই জাতের নাবিকদের মধ্যে পার্থক্য করার আরেকটি উপাদান ছিল খাবার। লস্করদের খাবারের জন্য বেশি পয়সা খরচ করত না ইউরোপীয় জাহাজ কর্তৃপক্ষ। ইউরোপীয় নাবিকদের তুলনায় লস্করদের খাবারের জন্য অর্ধেক ব্যয় করার প্রবণতা ছিল তাদের মধ্যে। লস্করদের খাবারের মধ্যে প্রধানত থাকত ভাত, লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা মাছের তরকারি, ডাল ও ঘি। অন্যদিকে ইউরোপীয় বা আমেরিকান নাবিকদের খাবারে থাকত মাংস, মটর, লবণ দেওয়া শূকর, নরম রুটি ইত্যাদি।
পশ্চিমা নাবিকদের চেয়ে লস্করদেরকে বেশি খেতে হয় না — এমন ধারণাই বহন করত সবাই। দ্য ব্রিটিশ ফ্রেন্ড অভ ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন-এর ১৮৪৩ সালের ইস্যু থেকে জানা যায়, জাহাজ কোন সামুদ্রিক অঞ্চলে অবস্থান করছে তার ওপর নির্ভর করে লস্করদের রেশন বরাদ্দ করা হতো।
যেমন, জাহাজ যদি 'অতি উষ্ণ' কোনো অঞ্চল দিয়ে যেত, তাহলে লস্করদের রেশনের মধ্যে থাকত ভাত, মটর, মাখন, তেল, তরকারি রাঁধার বিভিন্ন মসলা (যেমন হলুদ, তেঁতুল, আদা, রসুন, মরিচ, ভিনেগার, ধনেপাতা ও জিরা) এবং সবজি (যেমন কুমড়া, মিষ্টি আলু, ও গোল আলু)। আর উষ্ণ অঞ্চলের বাইরে জাহাজ থাকলে মাংস, বিস্কিট, গম, ও জরানো আম রেশনের তালিকায় যুক্ত হতো।
ইউরোপীয় নাবিকদের কাছে ভারতীয় নাবিকেরা ছিলেন কৌতূহলের অফুরন্ত উৎস। তাদের অনেকেই ডায়েরিতে লস্করদের নিয়ে নিজেদের অনুভূতি লিখে গিয়েছেন।
স্কটিশ লেখক জেমস কর্ডিনার তার আ ভয়েজ টু ইন্ডিয়া (১৮২০)-এ লস্করদের খাবারদাবারের আচরণগুলো লিখেছিলেন। লস্করেরা খাওয়া শুরু করার আগে এক বা দুই হাতা ভাত সমুদ্রে নিক্ষেপ করতেন। ভাত ফেলার সময় মুখ দিয়ে তারা কিছু শব্দও উচ্চারণ করতেন।
কর্ডিনারের লেখা থেকে আরও জানা যায়, লস্করেরা সবাই এক জায়গায় গোল হয়ে খেতে বসতেন। তাদের মাঝখানে থাকত ভাতের বড় পাত্র — সেই ভাতের মাঝখানে মাছের তরকারির আরেকটি পাত্র।
লস্করেরা ডান হাত দিয়ে পাত্র থেকেই সরাসরি ভাত খাওয়া শুরু করতেন। মাঝেমধ্যে মাছের তরকারির সঙ্গে ভাতের দলা মিশিয়ে খেতেন, আবার কখনো সরাসরি ভাত চালান করে দিতেন পেটের ভেতরে।
লস্করেরা ছিলেন মূলত হিন্দু ও মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী। তাই তারা শূকর বা গোমাংস কোনোটিই খেতেন না। জাহাজে তাদের নিজস্ব রাঁধুনি থাকত। তিনিই আচার মেনে সবার জন্য রাঁধতেন।
জনৈক ক্যাপ্টেন চার্লস পোর্টার লো তার স্মৃতিকথা সাম রিকলেকশনস (১৯০৬)-এ লিখেছেন, তিনি একবার এরকম এক নেটিভ রাঁধুনিকে দিয়ে নিজেদের জন্য রান্না করিয়েছিলেন। সে রান্না খেয়ে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন।
এ রাঁধুনিদেরকে ভান্ডারি বলা হতো। তারা জাতপাত মেনে জাহাজে রান্না করতেন। কোনো কোনো জাহাজে লস্করেরা একাধিক ভান্ডারি নিয়ে উঠতেন। সাধারণত, ইউরোপীয় খাবারদাবার থেকে তাদের খাবারগুলো আলাদা স্থানে সংরক্ষণ করার অনুরোধ করতেন লস্করেরা।
ধর্মীয় বিভিন্ন বিশ্বাসের কারণে লস্করদের সঙ্গে অনেক সময়ই ইউরোপীয় অফিসারদের দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। ইউরোপীয় নাবিকরা বাসনকোসন সামলাতে বা লস্করদের পিপা থেকে পানি খেতে গিয়ে কোনো ভুল করে ফেললে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানাতেন লস্করেরা — এমনটাই লিখেছেন চার্লস নর্ডহফ নামক একজন মার্কিন সাংবাদিক।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ জাহাজ ইনভেস্টিগেটর-এর কমান্ডার জন ক্রফোর্ড তার ডায়েরতে লিখেছেন, মুসলিম লস্করেরা কচ্ছপ খেতে অপারগতা দেখাচ্ছে দেখে তিনি যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। তখন জাহাজে অনেকেই স্কার্ভিতে আক্রান্ত হচ্ছিলেন, খাবারেরও সংকট — তারপরও নিজেদের আচার ভঙ্গ করতে রাজি হননি ওই লস্করেরা।
অনেক জাহাজের কমান্ডার তাদের ডায়েরিতে অভিযোগ করেছেন, লস্করেরা রমজান মাসে রোজা রাখতেন বলে তাদের কাজ করার ক্ষমতা কমে যেত।
খাবার নিয়ে লস্করদের মধ্যে মারামারির কথাও উল্লেখ রয়েছে অনেক বয়ানে। ইতিহাস লেখক ম্যালকম রাসেল তার বই মাডলার্ক'ড: হিডেন হিস্টোরিজ ফ্রম দ্য রিভার টেমস-এ লিখেছেন, একবার আবদুল্লাহ নামক জনৈক লস্করের বিরুদ্ধে আরেক লস্করকে খুনের অভিযোগ উঠেছিল।
রান্না করা একটি গোল আলু নিয়ে কোনো ঝগড়ার জেরে আবদুল্লাহ ওই লস্করকে খুন করেছে বলে অভিযোগ উঠে বলে ম্যালকম তার বইয়ে উল্লেখ করেন। পরে খুনের প্রমাণ পাওয়ার পর আবদুল্লাহকে এক শিলিং জরিমানা ও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অনেক ইউরোপীয় জাহাজের অফিসারেরা খাবার ব্যবহার করে লস্করদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন। অনেকেই মুসলিম লস্করদের জোর করে শূকর খেতে বাধ্য করেছেন।
১৮ শতকের মুঘল কূটনৈতিক মির্জা আবু তালিব খান লিখেছেন, একবার একদল লস্করকে উল্টো করে ঝুলিয়ে জোর করে শূকর খাইয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই লস্করেরা জাহাজ ত্যাগ করে জঙ্গলে পালিয়ে যান। পালানোর আগেও জাহাজের ইউরোপীয় প্রভুরা তাদের ওপর আরও অত্যাচার চালিয়েছিলেন।
শ্বেতাঙ্গ অফিসারেরা মনে করতেন, খাবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখলে তারা লস্করদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। অনেক সময়ই শাস্তি হিসেবে লস্করদের কেবল ভাত আর পানির ওপর রাখা হতো। প্রায়ই লস্করদের খুবই অল্প অথবা পঁচা খাবার সরবরাহ করা হতো।
ইউরোপীয় প্রভুদের এ ধরনের অমানবিক আচরণে শেষতক বাধ্য হয়ে অনেক লস্কর জাহাজ থেকে সমুদ্রে লাফ দিতেন। এ ধরনের লস্করদের বেশিরভাগ সিলেটে অঞ্চলের ছিলেন বলে জানা যায়। সমুদ্রে লাফানোর পর সাঁতার কেটে তীরে উঠতেন তারা।
এ লস্করেরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় — রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর থেকে শুরু করে সাউদাম্পটন, নিউ ইয়র্ক — অনেক কষ্টে জীবনধারণ করতেন। সিলেটের এ লস্করেরা পরে অনেকেই যুক্তরাজ্যে থিতু হয়েছিলেন, নিজেদের খাবার দেশটিতে জনপ্রিয় করেছেন।
মূল লেখা: প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি