বিংশ শতক না লেনিন সেঞ্চুরি!
ইউনিয়ন সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস (ইউএসএসআর) আন্তঃমহাদেশীয় একটি দেশ, এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে, ১৯২২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত দাপটের সাথেই বিরাজ করেছে। রুশ সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি এই দেশটি ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ, ১৬টি রিপাবলিকের একটি ফেডারেশন হলেও সরকার ও অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। একক দল কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়ন ২ কোটি ২৪ লক্ষ ২ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়ানো বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দেশটিকে শাসন করেছে। পৃথিবীর ভূভাগের ছয় ভাগের এক ভাগ নিয়ে একটি দেশ, এমনকি ইউরোপ মহাদেশও এর সিঁকি ভাগের এক ভাগ মাত্র। একদা ঈশ্বরোনুরূপ পূজ্য লেনিনের মূর্তি ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে একটি দেশ ভাঙতে ভাঙতে যখন ১৫টি দেশে পরিণত হলো, তখনো লেনিনের রাশিয়ার অধিকারভুক্ত অঞ্চল ১৭ লক্ষ ৮৯৮ হাজার ২৪২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। তখনো এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ।
১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব রাশান প্রভিশনাল গভর্নমেন্টকে উচ্ছেদ করে জার শাসন ও রুশ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। বলশেভিকদের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে প্রলেতারিয়েত রাজ কায়েমের লক্ষ্যে জার শাসনের অবসান ঘটানো হয়। ১৯২৪ সালে তাদের সংবিধান গৃহীত হয়। নিজ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করেই তারা থেমে থাকার নয়, পুঁজিবাদের পেষণ থেকে অবশিষ্ট পৃথিবীকে মুক্ত করতে বিপ্লব রপ্তানি করার দায়িত্বও তারা নিয়ে নেয়। পুঁজিবাদী বিশ্বের আতঙ্ক লেনিন ও তার অনুসারীগণ।
লেনিনের জন্ম ২২ এপ্রিল ১৮৭০ রুশ শহর সিমবার্সকে। তার বয়স যখন ১১ বছর, জার দ্বিতীয় আলেক্সান্ডারকে হত্যা করা হয়। ১৮৮৭ সালে তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন, ১৮৮৭ সালে লেনিনের ভাই আলেক্সান্ডার উলিয়ানভকে তৃতীয় জার আলেক্সান্ডারকে হত্যা ষড়যন্ত্রের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৮৮৭-এর ডিসেম্বরে কাজান বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ায় লেনিন গ্রেপ্তার হন এবং তাকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ^বিদ্যালয়ের বহিরাগত ছাত্র হিসেবে তিনি আইন পরীক্ষায় ১৮৯১ সালে উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন ওকালতিও করেন। তত দিনে বিশ^ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক অভিঘাত প্রদান করার মতো শক্তিশালী জার্মান সাম্যবাদী চিন্তাবিদ কার্ল মার্ক্সের রচনার প্রতি প্রবল আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন। বলা আবশ্যক, কার্ল মার্ক্স আরও ৮ বছর আগে ১৮৮৩ সালে প্রয়াত হয়েছেন। ১৮৯৫-এর ডিসেম্বরে জারের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৮৯৮-এর ফেব্রুয়ারিতে লেনিনকে ৩ বছরের জন্য সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৮৯৮-এর মার্চে প্রথম মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় ১৮৯৮ সালে নাদেজদা ক্রুপস্কায়াকে বিয়ে করেন। ১৯০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাসন শেষে সেন্ট পিটার্সবার্গ ফিরে আসেন লেনিন।
বলা আবশ্যক, লেনিন পিতৃপ্রদত্ত নাম নয়। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ১৯০২ সালে লেনিন নাম গ্রহণ করেন। তার শাসনাধীন বিপ্লবীরা কর্তৃপক্ষকে হতবুদ্ধি করে রাখতে অনেকেই ছদ্মনাম নিয়েছেন। লেনিনের বয়স যখন ১৬ বছর, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে বাবা ইলিয়া নিকোলাইভিচ উলিয়ানভের মৃত্যু ঈশ^রের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে তার মনে প্রশ্ন জাগায়। বাবা গোড়া রাশান চার্চভুক্ত হলেও লুথারিয়ান খ্রিষ্টান বাবা-মায়ের সন্তান লেনিনের মা সনাতন অর্থে ধার্মিক ছিলেন না। লেনিনের ধর্ম নিয়ে প্রশ্নাবলিতে মায়ের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। ভাই আলেক্সান্ডারের ফাঁসিও তাকে ধর্ম সম্পর্কে নিরুৎসাহিত করে। ১৯১৯ সালে মায়ের মৃত্যুর সময় তিনি বিদেশে নির্বাসিত থাকায় শেষকৃত্যে তার অংশগ্রহণও সম্ভব ছিল না। এ সময় তিনি ডিপ্রেশনে ভোগেন এবং আর বেশি দিন বাঁচবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
লেনিনের বাবা ইলিয়া উলিয়ানভ উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা, বেসামরিক দায়িত্ব পালন করলেও মর্যাদায় ছিলেন মেজর জেনারেলের সমকক্ষ; গোড়া রক্ষণশীল। রক্ষণশীলতাই পারিবারিক বৈশিষ্ট্য। লেনিনের বড় ভাই আলেক্সান্ডার ইলিচ উলিয়ানভ (জন্ম ১২ এপ্রিল ১৮৮৬ মৃত্যু ২০ মে ১৮৮৭) একজন রুশ বিপ্লবী এবং রাজনৈতিক কর্মী। ১৮৮৬ সালে ২০ বছর বযসে তিনি নারদনায়া ভলিয়া (জনগণে প্রত্যাশা) নামক দলের সন্ত্রাসী শাখার সদস্য হিসেবে যোগ দেন। উলিয়ানভ এবং তার কমরেডরা জার তৃতীয় আলেক্সান্ডারকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন। ১ মার্চ ১৮৮৭ দ্বিতীয় আলেক্সান্ডারকে হত্যা করার ষষ্ঠ বার্ষিকীতে ডিনামাইট সংযুক্ত হাতবোমা বহন করছিলেন। তিনি সম্রাটকে বহন করা গাড়ির ওপর বোমা মারতে চেয়েছিলেন। উলিয়ানভ নিজে ছিলেন উপশাখার প্রধান তাত্ত্বিক এবং বোমার কারিগর। গ্রেপ্তার হবার পর আদালতে আনা হলে উলিয়ানভ সেখানেই জারকে হত্যার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন। আদালতে তাদের দলভুক্ত দশজনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। কিন্তু পরে জার তৃতীয় আলেক্সান্ডার তাদের ৫ জনকে ক্ষমা করে দেন। ৮ মে ১৮৮৭ উলিয়ানভ, আন্দ্রেউসকিন, জেনেরালভ, ওসিপানভ এবং শেভিরেভের ফাঁসি কার্যকর করা হয় শ্লিসেলবার্গ কারাগারে। ভাইয়ের এই মৃত্যু লেনিনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
উলিয়ানভের প্রাণভিক্ষার জন্য জারের কাছে আবেদন করতে পরিবার শুরুর দিকে অসম্মতি জানিয়েছে; কারণ, তাদের যথার্থই ধারণা ছিল তাদের সন্তান ক্ষমার শর্ত মান্য করবে না। তবে শেষ পর্যন্ত উলিয়ানভ জারের কাছে একটি অনুতাপহীন পত্র পাঠিয়ে মায়ের প্রয়োজনে তার দয়া কামনা করে। তাতে বলা হয়, 'সম্প্রতি তার মায়ের শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেছে; অধিকন্ত আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর তার জীবন আরও বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।' এ আবেদন কোনো সাড়া লাভে সক্ষম হয়নি।
ফাঁসিতে মৃত্যুর কিছুকাল আগে কার্ল মার্ক্সের ক্যাপিটাল গ্রন্থটি আলেক্সান্ডার উলিয়ানভের হস্তগত হয়। এই বইয়ের বিষয় নিয়ে তিনি তার ভাই ভ্লাদিমির ইলিচের সাথে আলোচনা করেন। শিল্পশ্রমিক ও কৃষকের পাশাপাশি অপ্রমেয় একশক্তি হিসেবে বিরাজ করে মার্ক্সের ক্যাপিটাল। তারপর ভ্লাদিমির ইলিচ চলে যান কাজান বিশ^বিদ্যালয়ে আর আলেক্সান্ডার উলিয়ানভ যান পেট্রোগার্ড। দুই ভাইয়ের আর দেখা হয়নি। লেনিনের উদ্যোগে মার্ক্স হয়ে ওঠেন প্রলেতারিয়েতের অস্ত্র।
লেনিনের বড় বোন আন্না উলিয়ানোভা (১৮৬৪-১৯৩৫) ছিলেন রুশ বিপ্লবী এবং রাজনীতিবিদ। ছোট বোন মারিয়া উলিয়ানোভা (১৮৭৮-১৯৩৭) রাশান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শ্রমিকদের মধ্যে রাষ্ট্রবিরোধী প্ররোচনামূলক বক্তব্য প্রদান এবং বেআইনি প্রচারপত্র ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ১৮৯৯-এর সেপ্টেম্বর। ১৯০১ সালে পুনরায় গ্রেপ্তার করে তাকে নিঃসঙ্গ কারাবাস প্রদান করা হয়। ৭ মাস পর তাকে বহিস্কার করে সামারাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও অনেকবার গ্রেপ্তার হন, কারাবাস করেন, ডিপোর্টেড হন; রুশ বিপ্লবের অন্যতম নেত্রী তিনি।
১৯০২ সালে লেনিন হোয়াট ইজ টু বি ডান প্রকাশ করেন। ১৯০৫ এ লন্ডনে থার্ড-কংগ্রেসে লেনিন আধিপত্য বিস্তার করেন। তারপর বাধ্যতামূলক দীর্ঘ প্রবাসজীবন। ১৯১২ সালে মেনশেভিক-বলশেভিক বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়। লেনিন পোল্যান্ডে স্থিত হবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। ১৯১৪-এ প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি পোল্যান্ড ছেড়ে সুইজারল্যান্ড চলে আসেন।
১৯১৭-এর ৮ মার্চ রুশ বিপ্লবের সূচনা, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লেনিন সেন্ট পিটার্সবার্গ এসে হাজির হন। ১৭ জুলাই পেট্রোগ্রাডে (সেন্ট পিটার্সবার্গের বদলে দেওয়া নাম) সামরিক অভ্যুত্থানের উদ্যোগ হয়, নভেম্বরের ৬-৭ তারিখে বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে নেয়। সাড়ে চার মাস আগে দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রধানমন্ত্রী কেরোনস্কি পালিয়ে গেলেন। ২৪ বছর বয়সী লেনিন মার্ক্সীয় দর্শনভিত্তিক তার প্রথম রচনা হু আর দিজ ফ্রেন্ডস অব দ্য পিপল, অ্যান্ড হাউ দে ফাইট এগেইস্ট দ্য সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটস প্রকাশ করেন। সেকালে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বলতে বিপ্লবী মার্ক্সবাদীদেরই বোঝানো হতো। বৈধ পন্থায় এটি রাশিয়ায় মুদ্রণ ও প্রকাশের অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছিল না, সংগোপনে ১৮৯৪-এর বসন্তকালে পুস্তিকাকারে ছাপা হয় এবং সারা দেশে শত শত কপি হাতে হাতে বিপ্লবীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ ছিল আন্ডারগ্রাউন্ডের কণ্ঠস্বর—এই প্রথম স্পষ্টভাবে রাশিয়াতে প্রলেতারিয়েত বিপ্লবের ডাক শোনা গেল। তারপর একসময় এটি 'আউট অব প্রিন্ট', নয়তো একেবারে 'আউট অব এক্সিস্টেন্স' হয়ে গেল। সফল অক্টোবর বিপ্লবের বহু পর ১৯২৩ সালে পুলিশের আর্কাইভ থেকে একটি কপি উদ্ধার করা হলে সরকারি দপ্তর থেকে তা পুনরায় মুদ্রিত হতে থাকে।
লেনিনের দুই প্রধান কমরেড জোসেফ স্টালিন এবং লিওন ট্রটস্কির সাথে তার এবং তাদের দুজনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে; লেনিন কট্টর বলশেভিক, ট্রটস্কি উদারপন্থী—এই আপাত বিরোধ সত্ত্বেও লেনিনের পর নেতৃত্বের প্রশ্নে লিওন ট্রটস্কি ছিলেন যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত পছন্দ। লেনিনের প্রত্যাবর্তনের আগে বলশেভিক বিপ্লবীদের নিয়ে পেট্রোগ্রাড তিনিই মুক্ত করেছিলেন, লেনিনের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান এবং রেড আর্মির প্রধান লিওন ট্রটস্কির পেছনে ছিল আত্মনিবেদিত দীর্ঘ এক সংগ্রামী জীবন।
অন্যদিকে লেনিনের দলের সেক্রেটারি জেনারেল জোসেফ স্টালিন শেষ দিকে লেনিনের যথেষ্ট বিরাগভাজন হবার পরও কৌশলে কেবল টেকেনইনি, ট্রটস্কিকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করতে সমর্থ হন এবং একপর্যায়ে তাকে দেশছাড়াও করেন। প্রতাপশালী স্টালিন নিয়ন্ত্রিত সোভিয়েত আদালত সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের দোহাই দিয়ে ট্রটস্কির অনুপস্থিতেই বিচার করে তাকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। স্টালিন তার অনুসারী এক বিদেশি চরমপন্থী স্প্যানিশ কমিউনিস্ট পার্টির র্যামন মার্সেদারকে দিয়ে মেক্সিকোতে তার সাময়িক আবাসনের বাইরে বরফ কেটে পাহাড়ে ওঠানামা করার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ট্রটস্কির মাথা গুঁড়ো করে দেন। পরদিন মৃত্যু হয় লেনিনের প্রায় সমমানের একজন নেতার।
এর আগে লেনিনের ইনার সার্কেলের জোসেফ স্টালিনকে ১৯২২-এর এপ্রিলে তিনিই কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ করেন এবং পরে এই বিবেচনার জন্য অনুতাপও করেন। তিনি লিখিতভাবেই জানান, স্টালিন অতিরিক্ত রূঢ়; সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে অসহনীয় হয়ে উঠেছেন; আরও ধৈর্যশীল, আরও অনুগত, আর সম্মানজনক, কমরেডদের প্রতি মনোযোগী এবং খামখেয়ালীপূর্ণ নন এমন কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে হবে।
তত দিনে অসুস্থ লেনিন অনেকটাই অকর্মন্য হয়ে পড়েছেন, পার্টিতে ট্রটস্কি কোণঠাসা, স্টালিন মহাশক্তিমান হিসেবে উত্থিত হয়েছেন। লেনিনের জীবদ্দশায় স্টালিন তার স্ত্রী নাদেজদা স্ক্রুপস্কায়ার সাথে খারাপ আচরণ করেন; পার্টির ত্যাগী নেত্রী নাদেজদা স্বামীর মৃত্যুর পর স্টালিনের সমালোচনা করলে প্রয়োজনে নাদেজাদার বদলে অন্য কোনো নারীকে লেনিনের বিধবা হিসেবে ঘোষণা করা হবে—এমন হুমকিও দেন। লেনিন এবং কমিউনিস্ট পার্টির ওপর ভর করেই প্রায় তিন দশক একনায়কত্ব অব্যাহত রাখেন জোসেফ স্টালিন। অবশ্য বিরোধী দল নিপীড়নে 'লাল সন্ত্রাসের অপখ্যাতি' লেনিনকেও বহন করতে হয়েছে।
লেনিন ক্ষমতা গ্রহণের আগে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও ১৯১৭ নভেম্বরের নির্বাচনে বলশেভিকরা কেবল সিঁকি ভাগ সিট পেলে লেনিনকে তার গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন, তাকেও জনতার দোহাই দিয়ে একালের অগণতান্ত্রিক শাসকদের মতো ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল উদ্ভাবন করতে হয়।
লেনিন যে প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ সৃষ্টির পদক্ষেপও নিয়েছিলেন, এটা পশ্চিমের লেনিন চর্চায় অনুল্লেখিতই রয়ে যায়। অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক মডেলের স্থবিরতা দেখে তিনি 'নিউ ইকোনমিক পলিসি' সামনে নিয়ে আসেন। এতে কৃষকদের মুনাফার জন্য তাদের উৎপাদনের কিছু অংশ বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা শুরুর সুযোগ পান। লেনিনের মৃত্যুর পরও কয়েক বছর এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু তার দলের কট্টর সমালোচকেরা একে পুঁজিবাদের কাছে লেনিনের বিক্রি হয়ে যাওয়া বলে নিন্দা করতে থাকেন।
লেনিন কয়েকবার হত্যা ষড়যন্ত্রের শিকার হন। মস্কোতে একটি জনসভার শেষে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হন। লেনিনকে গুলি করেন প্রতিপক্ষ সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য ফ্যানি কাপলান, তার ঘাড় ও কাঁধে গুলি লাগে। এই আক্রমণ তার প্রতি গণসহানুভূতি বাড়িয়ে দেয়। বেঁচে গেলেও ১৯২১-এ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা মনে করেন, হত্যাচেষ্টার সময় শরীরের ভেতর রয়ে যাওয়া বুলেট থেকে মেটাল অক্সিডেশনের কারণে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। দুই বছরের ব্যবধানে তিনি তিনবার স্ট্রোকের শিকার হন। দুবার ১৯২২ সালে এবং একবার ১৯২৩-এর মার্চে। তৃতীয়বার স্ট্রোকের পর তিনি আর কথা বলতে পারতেন না। ২১ জানুয়ারি ১৯২৪ সালে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান, সেদিনই কয়েক ঘণ্টা পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেনিন শ্রেণিশত্রুর মার্ক্সীয় ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করে যান। এতে যথার্থই শ্রেণিশত্রু যেমন নিধন হয়, তেমনি নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে শ্রেণিশত্রু আখ্যা দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিংশ শতক প্রত্যক্ষ করেছে। লেনিনের অনুমোদনে সৃষ্টি হওয়া রাশিয়ার প্রথম গোপন গোয়েন্দা পুলিশ 'চেকা' বিরোধী দল এবং দলের ভেতর বিরোধীদের দমন ও নিশ্চিহ্নকরণের দায়িত্ব নেয়। লেনিন হত্যাপ্রচেষ্টার পর চেকা শুরু করে 'লাল সন্ত্রাস'। ১৯১৮-এর সেপ্টেম্বরে ও অক্টোবর মাসে প্রায় এক লক্ষ কথিত শ্রেণিশত্রুকে তারা হত্যা করে।
লেনিন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। নবগঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়েই তিনি সম্পূর্ণ বিনে পয়সায় দেশব্যাপী শিশুশিক্ষা চালু করেন। অশিক্ষিত বয়স্কদের জন্য শুরু হয় স্বাক্ষরতা অভিযান। ১৯২২-১৯২৬ সময়ে বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে ৫০ লক্ষ অশিক্ষিত মানুষের স্বাক্ষর ও অনেকটা শিক্ষিত করে তোলা হয়। শিক্ষার প্রশ্নে তিনি নারী-পুরুষ বিভেদ অব্যাহত থাকতে দেননি। শিক্ষার কাজে উদ্যোগী ছিলেন তার স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, শিক্ষার ডেপুটি মিনিস্টার হিসেবে রাশিয়ার নব্য শিক্ষা ধারার নেতৃত্ব তিনিই দিয়েছেন।
মার্ক্সবাদ নিয়ে একটি দলগত আলোচনা চলাকালে একদিন তার ভাবী পত্নী নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার সাথে লেনিনের দেখা। ক্ষয়িষ্ণু উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সুশিক্ষিত কন্যাসন্তান নাদেজদাও কার্ল মার্ক্সের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত। দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও এ নিয়ে তাদের দুজনের কেউই পরস্পরকে চিঠি লেখালেখি করেননি। নাদেজদা লেনিনের চেয়ে এক বছরের বড়। লেনিন গ্রেপ্তার হবার কয়েক মাস পরই ১৮৯৬-এর অক্টোবরে নাদেজদাও গ্রেপ্তার হলেন। দণ্ড হিসেবে লেনিনকে সাইবেরিয়া নির্বাসন দেওয়া হলো। লেনিন নাদেজদার জন্য একটি পরামর্শ পাঠালেন, যদি নাদেজদা কর্তৃপক্ষকে জানান যে তিনি লেনিনের প্রেমিকা; তাহলে তারও লেনিনের সাথে একই নির্বাসনে যাবার সুযোগ হবে। কর্তৃপক্ষ এই শর্তে তার আবেদন মঞ্জুর করল যে লেনিনের সাথে সাক্ষাতের পরপরই তারা বিয়ে করে ফেলবে। এই শর্তের কথা তাদের আর স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজন হয়নি।
১৯১৪ সালে লেনিন নির্বাসনে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের গ্যালিসিয়াতে অবস্থান করছিলেন। জার্মানির মিত্র হিসেবে সাম্রাজ্য ছিল রুশবিরোধী। তত দিনে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সন্দেহভাজন হিসেবে লেনিন গ্রেপ্তার হলেন, কিন্তু লেনিন যখন তার জার বিরোধিতার কথা প্রকাশ করলেন, তখন তিনি ছাড়া পেয়ে গেলেন।
১৯১৩ সালে লেনিন তার স্ত্রী নাদেজদাকে নিয়ে পোল্যান্ডে এসেছেন। তিনি রুশ সাম্রাজ্য নন-রাশিয়ান এথনিক গোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়ে বক্তৃতা করছিলেন। এ সময় এক তরুণ বিপ্লবী তার সাক্ষাৎপ্রার্থী নন। লেনিনের ভাষায় দর্শনার্থী একজন বিস্ময়কর জর্জিয়ান (এখনকার স্বাধীন জর্জিয়া)। সময় গড়াল, এই তরুণ বন্ধু ও বৈরী উভয় ভূমিকায় লেনিনের জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। তিনিই জোসেফ স্টালিন, ভ্লাদিমির লেনিনের সেক্রেটারি জেনারেল এবং প্রায় তিন দশক সোভিয়েত ইউনিয়নের একনায়ক শাসক।
১৯১৮ সালে লেনিন এবং বলশেভিকরা নতুন সোভিয়েত সরকার থেকে মেনশেভিক, সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিজ (এসআর) এবং আরও অনেককে বহিষ্কার করেন। লেনিনের সাথে মতানৈক্য প্রকাশ করতে এসআরের নারী সদস্য ফ্যানি কাপলান পিস্তল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। ৩০ আগস্ট ১৯১৮ তিনি লেনিনকে তিনটি গুলি করেন। মারাত্মক আহত হবার পরও লেনিন বেঁচে যান।
প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুটা ১৯১৪ সালে। লেনিনের অনুগত বলশেভিকরা ছাড়া প্রায় সকল রাজনৈতিক গোষ্ঠীই রাশিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটাকে সমর্থন করছিল। লেনিন যদিও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যুদ্ধের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি শেষ পর্যন্ত জারের পতন ডেকে আনবে; তিনি দেশের ক্ষয়ক্ষতি চাননি। তবে লেনিন যা করেছেন, তা তখনকার রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় দেশদ্রোহের চেয়ে কম কিছু নয়। রুশ সাম্রাজ্যের শত্রুদেশ জার্মানির কাছ থেকে লেনিন আর্থিক সহায়তাও গ্রহণ করেছেন। ১৯১৭-এর মার্চে রুশ সাম্রাজ্যের অরাজক পরিস্থিতিতে, মুদ্রাস্ফীতি যখন তুঙ্গে, খাদ্য সরবরাহের আশঙ্কাজনক পতন ঘটেছে, সেনাশক্তি ছিন্নভিন্ন, দ্বিতীয় জার নিকোলাস তখন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এপ্রিলে জার্মান সরকারের সরবরাহ করা একটি গোপন সিল করা রেলকারে লেনিন রাশিয়াতে ফিরে এলেন। সেই নভেম্বরেই লেনিনের নেতৃত্বে সাধিত বিপ্লব প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেয়, বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম দিনের অফিসেই তিনি জমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটান, জার্মানির সাথে যৌথ চুক্তির আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। শান্তি স্থাপনের বিনিময়ে ফিনল্যান্ড, ইউক্রেন এবং তিনটি বাল্টিক রাজ্যের একাংশের ভূসম্মত্তি জার্মানির কাছে হস্তান্তরে সম্মত হন। কিন্তু ১৯১৮ সালে মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির হাতে জার্মানির পরাজয় ঘটলে লেনিন চুক্তি বরখেলাপের সুযোগ পেয়ে যান এবং এককভাবে চুক্তির অবসান ঘোষণা করেন। কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিশ্রুত সমুদয় ভূখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
ভ্লাদিমির লেনিনের উত্থানে জার্মান ভূমিকা বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। জার্মানি চেয়েছে রাশিয়াকে মিত্রশক্তির পক্ষে লড়াই করা থেকে বিরত রেখে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ওপর সমরশক্তির প্রয়োগ ঘটাবে। সেই লক্ষ্যেই রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা ভ্লাদিমির লেনিনকে ব্যবহার করে প্রভিশনাল গভর্র্নমেন্টকে উৎখাত করতে চেয়েছে জার্মানি। প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট লেনিনের ভাষায় ছিল একটি বুর্জোয়া একনায়কত্ব, আর তার লক্ষ্য কৃষক মজদুরের শাসন প্রলেতারিয়েত একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। পরিপূর্ণ জার্মান নিরাপত্তা গ্যারান্টিতে রাশিয়াতে ফিরে এসে লেনিন যুদ্ধ নয়, শান্তি, জমিন ও রুটির গ্যারান্টি চাইলেন। তার দাবি এমনকি রুশ সৈনিকদেরও আকৃষ্ট করল। অস্ত্রস্বল্প রাশিয়াতে তরুণ কৃষক ও মজদুরদের অনেককেই খালি হাতে মহাযুদ্ধের রণাঙ্গণে যেতে হয়েছে। যাদের হাতে অস্ত্র ছিল, তাদের মেনে নিতে হয়েছে বুলেট রেশনিং। চাহিদা শত বুলেটের হলেও পাবে দশটা, তারা হয়ে উঠবে শত্রুর কামানের 'ফডার'; সেই সব হতোদ্যম সৈনিকেরাও লেনিনের ডাক শুনতে এগিয়ে আসে এবং লেনিনের অক্টোবর বিপ্লবকে সফল করে তোলে। রুশ ইতিহাস গবেষকদের মতে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অব্যবস্থাপনায় দেরিতে হলেও জারের পতন ঘটত, তবে প্রথম মহাযুদ্ধ এবং জার্মান আশীর্বাদপুষ্ট ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন তা অনেকটাই ত্বরাণি¦ত করেছেন। লেনিনের অন্যতম সাফল্য রুশ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক বিস্তার এবং স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা।
কার্ল মার্ক্সভক্ত ভ্লাদিমির লেনিন মার্ক্সের বিবিধ তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতেন, তাকেই তিনি সবচেয়ে বিশ^স্ত ও নির্ভরযোগ্য মনে করবেন। লেনিনের এই ব্যাখ্যাকেই বিপ্লবী ও মেনশেভিক নেতা জুলিয়াস মার্টভ ১৯০৪ সালে লেনিনিজম বা লেনিনবাদ নাম দেন এবং অনুসারীদের পুনঃ পুনঃ ব্যবহারে নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
১৯১৭-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে স্বৈরতান্ত্রিক জার শাসনকে প্রতিস্থাপন করে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট। লেনিনের নেতৃত্বে সকল ক্ষমতা সোভিয়েত জনগণের এই দাবিতে আন্দোলন রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের উৎখাতের দাবি জানায়। ৭ নভেম্বর ১৯১৭ বলশেভিক রেড গার্ডরা ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ অবরোধ ও দখল করে নেয়, অন্তবর্তীকালের সরকারের নেতাদের গ্রেপ্তার করে লেনিন ঘোষণা করেন, ক্ষমতা সোভিয়েতের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। এই বিজয়ই গ্রেট অক্টোবর বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অন্তর্দ্বন্দ্ব, গণযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের কারণে ১৯২১-১৯২২ সময়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, অবশ্য এই পরিসংখ্যানকে পশ্চিমের বানোয়াট হিসাব বলেও সমাজতন্ত্রীরা উল্লেখ করে থাকেন। বেশ কয়েক দফা সমঝোতা চুক্তির পর ৩০ ডিসেম্বর ১৯২২ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন অঞ্চলসমূহের একীভূত সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক সৃষ্টির ঘোষণা দেন। এ সময়ের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত নেতা লিওন ট্রটস্কি ও জোসেফ স্টালিন।
সোভিয়েত নেতৃত্ব ১৯২২-১৯৯১
১. ভ্লাদিমির লেনিন (১৮৭০-১৯২৪): ৩০ ডিসেম্বর ১৯২২ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৪; শাসনকাল ১ বছর ২২ দিন।
২. জোসেফ স্টালিন (১৮৭৮-১৯৫৩): ২১ জানুয়ারি ১৯২৪ থেকে ৫ মার্চ ১৯৫৩; শাসনকাল ২৯ বছর ৪৩ দিন।
৩. গ্রেগরি ম্যালেনকভ (১৯০২-১৯৮৮): তার নেতৃত্ব ত্রয়ী শাসন পলিটব্যুরোর চাপ এক মাসও টিকে থাকেনি।
৪. নিকিতা ক্রুশ্চেভ (১৮৯৪-১৯৭১): ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ থেকে ১৪ অক্টোবর ১৯৬৪; শাসনকাল ৯ বছর ২৬৬ দিন।
৫. লিওনিদ ব্রেজনেভ (১৯০৬-১৯৮২): ব্রেজনেভ ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত আলেক্সি কোসিগিন ও নিকোলাই পদগর্নির সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছেন, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত ব্রেজনেভ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন।
৬. ইউরি আন্দ্রোপভ (১৯১৪-১৯৮৪): ১০ নভেম্বর ১৯৮২ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪; শাসনকাল ১ বছর ৯১ দিন।
৭. কনস্ট্যানটিন চেরনেনকো (১৯১১-১৯৮৫); তিনি অসুস্থতা ও পর্যাপ্ত সমর্থনহীনতার কারণে ১১ এপ্রিল ১৯৮৪ থেকে ১০ মার্চ ১৯৮৫ পর্যন্ত আদ্রে গ্রোমিকো ও দিমিত্রি উস্তিনভের সহযোগিতায় ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। এটি দ্বিতীয় ত্রয়ী শাসন।
৮. মিখাইল গর্বাচেভ (১৯৩১-২০২২): ১০ মার্চ ১৯৮৫ থেকে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১; শাসনকাল ৬ বছর ২৯০ দিন। লেনিনসৃষ্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সময়ই ভেঙে ১৫টি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি একটি নিঃশব্দ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন।
লেনিন অনুসারীদের আনুগত্য প্রশংসনীয়, লেনিনের নিজের রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের টিকে থাকতে না পারার দায় তারা ফেলেন পুঁজিবাদী বিশ্বের ষড়যন্ত্রের ওপর, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা তারা বরাবরই উপেক্ষা করেছেন, তারা লেনিনের সগৌরব ফিনিক্সীয় পুনরুত্থানের কথাও বলছেন, আবারই তাদেরই নেতৃবৃন্দ মার্ক্স-লেনিন বিস্মৃত হয়ে সন্তানদের আয়েশী জীবন নিশ্চিত করতে তাদের ধনতন্ত্রের পীঠস্থান যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছেন এবং তাদের গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির সাফল্যে গৌরব বোধ করছেন; আর দেশীয় নেতৃত্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষমতাশীন দলের লেজুড় হয়ে তাদের করুণায় আপ্লুত হচ্ছেন। তারা যা-ই করুন, পুঁজিবাদের পাপ তো আর অনস্বীকার্য নয়, লেনিনের প্রাসঙ্গিকতাও তাই কখনোই ফুরোবার নয়।