ভারতবর্ষে কর: ঈশ্বরকে প্রদত্ত কর থেকে আরো যত কর...
সিন্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকায় বিরাজমান সভ্যতা খ্রিষ্টজন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগেকার। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে সংকলিত বেদ বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ভারতবর্ষে স্বেচ্ছায় কর দেবার একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল– এক ধরনের কর রাজাকে এবং এক ধরনের কর ঈশ্বরকে প্রদান করা হতো। রাজাকে প্রদত্ত করের বিনিময়ে রাজা নিরাপত্তা দিতেন, শত্রুর হাত থেকে রাষ্ট্র ও নাগরিককে রক্ষা করতেন। আর বলিদানে সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর খরা, বন্যা, ঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মানুষকে বাঁচাতেন।
সংস্কৃত শব্দ বলির অর্থ সাধারণভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি, নিবেদন বা উৎসর্গ। পশুবলি থেকে শুরু করে সন্তান বলির নজিরের কমতি নেই। ক্ষুব্ধ দেবতা ও দেবীর ক্রোধ প্রশমনে বলিই উত্তম প্রতিকার বলে বিচিত হয়েছে। নরবলি হচ্ছে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে বা ঈশ্বরের অনুগ্রহ পেতে বা ক্ষুব্ধ দেবতাকে শান্ত করতে মানুষ হত্যা। বিভিন্ন সভ্যতায় এই প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল। নরবলি সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত মানুষ হত্যা, যা দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জন নিশ্চিত করত বলে বিশ্বাস করা হতো। কেবল ভারতে নয়, ইউরোপের কৃষিভিত্তিক সমাজেও নরবলির প্রচলন ছিল। রাজাকে সন্তুষ্ট করতে কর আর ঈশ্বর বা দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে নরবলি বা পশুবলি, করের ইতিহাস এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। রাজার পক্ষে কর আদায় করত রাজ কর্মচারী, ঈশ্বরের পক্ষে ধর্মশালার পুরোহিত।
কলকাতায় শিশুবলি
তিন ধরনের প্রদেয় আদায়ের কথা বলা হয়েছে: ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে 'বলি'; ভূমি ইত্যাদির আয় থেকে 'কর' এবং যুদ্ধ ও অনুরূপ প্রয়োজনে রাজার প্রাপ্য 'ভাগ'। বলি, কর, ভাগ এসবই সমার্থক।
খ্রিস্টজন্মের ৬ শত বছর আগে ভারতের গান্ধারা ও কম্বোডিয়া যখন পারস্য সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন ভারতবর্ষকে সাড়ে ৯ টন স্বর্ণরেণু কর দিতে হতো, অধিকন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পারস্যের সেনাবাহিনীর অঙ্গীভূত করা হয়, এই সেনা সেবা নিরাপত্তা প্রদায়ক এক ধরনের কর তো বটেই।
বুদ্ধযুগ (খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৪২৪ থেকে ৩২১ অব্দ) ছিল নন্দ রাজবংশের শাসনাধীন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭-৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশ দখল করে নেন। তিনি চলে যাবার পর তার গ্রিক ভাবশিষ্যরা দখল অব্যাহত রাখে। সে সময় নন্দরাজের শেষ শাসক চামড়া, বৃক্ষ এবং পাথর অধিকারের উপরও ট্যাক্স আরোপ করলে জনজীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। এ সময় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গ্রিক দখলদারদের প্রতিহত করতে করতে শেষ পর্যন্ত নন্দ রাজবংশের অবসান ঘটান, নাগরিকগণ কর থেকে নিষ্কৃতি পেতে চন্দ্রগুপ্তকে সমর্থন করেছে এবং তাদের সমর্থনেই মৌর্য শাসন (খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৭-১৮০ অব্দ) সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।
চানক্য বা কৌটিল্য (৩৫০-১৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) অর্থশাস্ত্র রচনা করে রাষ্ট্র সংহত করার পরামর্শ চন্দ্রগুপ্তকে দিয়েছেন। এর অন্যতম বিষয় ছিল আর্থিক নীতি ও বিধিবিধান এবং কর। রাজা কোনো অধিকার বলে নয় বরং প্রজাদের প্রতি তার দায়িত্ব পালনের জন্য কর আদায়ের কিছু অধিকার পাবেন, আর তা আদায় হবে প্রজাদের আয় থেকে।
মনু শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ এবং বাণিজ্যিক পণ্য ও স্বর্ণের এক-দশমাংশ রাজার জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এটা অধিকারে পরিণত হতে থাকে। রাজা আমাদের রক্ষা করেন, তাই তার কর প্রাপ্য।
আবার এই ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে– জমির চূড়ান্ত মালিক রাজা, সুতরাং খাজনা বা কর শেষ পর্যন্ত তারই প্রাপ্য। আধুনিক সরকারের আর্থিক নীতির লক্ষ্য আয়কর এবং অন্যান্য আদায় থেকে রাজকোষ পূর্ণ করে কল্যাণকর কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজা যদি রাজ্য রক্ষা করতে যুদ্ধের জন্য বড় অঙ্কের কর আদায় করেন, তাতে পাপ হবে না, কিন্তু যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কর বাড়ালে রাজা মৃত্যুর পর নরকবাসী হবেন এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত ভয়ংকর শাস্তি তার প্রাপ্য হবে।
অর্থশাস্ত্র রাজার দায় নির্ধারণ করেছে: এতিম, বৃদ্ধ, পীড়িত, অসহায় গর্ভবতী নারী ও তার সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ রাজাকে করতে হবে।
যুদ্ধের সময় পর্যাপ্ত বৃষ্টির সুফলা এলাকার প্রজাদের কাছ থেকে রাজা এক-চতুর্থাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ শস্য কর হিসেবে আদায় করতে পারবেন। যদি ফসল ভালো না হয়, আদায় করা যাবে না।
দুর্গ নির্মাণ, সেচসুবিধা বৃদ্ধি ও খাল খনন, বাণিজ্যিক রুট সৃষ্টি, পতিত জমিনে উপনিবেশ সৃষ্টিকরণ, কাঠ ও হাতির জন্য ফরেস্ট রিজার্ভ তৈরি ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় কল্যাণকর কাজ রাজাকে কর আদায়ের অধিকার দেয়। বাস্তচ্যুত মানুষকে জমিন, গরু, ছাগল এবং শস্য প্রদান করে নতুন বসতি স্থাপনে রাজাকে সহায়তা করতে হবে। নতুন বসতি স্থাপন করা মানুষের উৎপাদিত পণ্যের এক-চতুর্থাংশ রাজা নগদ মূল্যে ক্রয় করবেন।
বিভিন্ন রাজত্বে করের বোঝা বিভিন্নভাবে অনুভ'ত হয়েছে। যুক্তিসংগত শাসকের আমলে প্রজা করের ভার অনুভব করলেও তার অধিকারে পর্যাপ্ত উৎপাদন রয়ে যাবার কারণে অসন্তুষ্ট হয়নি। কিন্তু লোভী শাসকের আমলে করের ভার কখনো এতটাই তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে যে প্রজা সব ফেলে কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। কর আদায়কারীকে ফাঁকি দিতে দূরে কোথাও চলে গেছে। কখনো কখনো তারা প্রতিবাদী ও হিংস্র হয়ে উঠেছে, তার একতাবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে, রাজদরবার থেকে প্রাপ্ত আদেশে অবাধ্য ধরনের কর আদায়কারীকেই তাদের হিংস্রতার মুখোমুখি হতে বাধ্য করা হয়েছে। ক্ষুব্ধ প্রজারা তাদের কাউকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। করারোপ বড় ধরনের বিদ্রোহের কারণ হয়েছে।
করের ক্ষেত্রে ভারতীয় বর্ণপ্রথার একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। শুরুতে বিশ্বাস করা হয়েছে, দানবের মাথা থেকে মুখ, কান পর্যন্ত অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ব্রাহ্মণ, কাঁধ থেকে বাহু পর্যন্ত অংশ থেকে হয়েছে ক্ষত্রিয়, কোমর ও পা থেকে বৈশ্য এবং পায়ের পাতা থেকে শূদ্র। বর্ণের বাইরেও অস্পৃশ্য সম্প্রদায় ছিল।
খ্রিষ্টজন্মপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে বর্ণপ্রথা বিস্তার লাভ করে। অর্থশাস্ত্র কেবলমাত্র বৈশ্যদের উপর করারোপ করেছে। তারা ব্রাহ্মণদের ভিক্ষা ও উপহার দেবে, ক্ষত্রিয়দের কর দেবে এবং তারা শূদ্রদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। বৈশ্যরা কৃষিকাজ ও বাণিজ্য করবে, তারা সুদের ব্যবসাও করতে পারবে। বৈশ্য কৃষকরা শস্যের ভাগ খাজনা হিসেবে দেবে, কামার-কুমার প্রমুখ শিল্পীরা মাসে ১-২ দিন বিনে পয়সায় কাজ করবে অথবা নির্ধারিত অর্থ কর হিসেবে দেবে। বৈশ্যরা ব্যবসা করে অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেও তাদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটত না।
ব্রাহ্মণরা সকল ধরনের কর এবং ফৌজদারি কার্যক্রম আওতার বাইরে থাকত। তবে তাদের কিন্তু সম্পদ অধিকার করার সুযোগ ছিল না, তাদের ভিক্ষা ও অনুদানের উপর জীবন ধারণ করত, উদ্ধৃত্ত অংশ তারাও আবার ভিক্ষা হিসেবে দিয়ে দিত। এমনকি রাজাও ব্রাহ্মণের অনুশাসন মানতেন। শূদ্রদেরও সম্পদ অধিকার করার সুযোগ ছিল না, তারা করমুক্ত ছিল। শিক্ষার্থী, নারী ও শিশু তাত্ত্বিকভাবে করের আওতাবহির্ভূত ছিল।
করের যৌক্তিকতার একটি উদাহরণ: 'অত্যাচারীর হস্ত হইতে দুর্বলের রক্ষা প্রভৃতি প্রধান রাজকর্তব্য পালনে অক্ষম নন্দবংশীর রাজন্যবর্গের লাম্পট্যে ও অত্যাচারে দেশে যে অরাজকতার সৃষ্টি হইয়াছিল, চন্দ্রগুপ্তের মতে প্রভাবশালী ও ন্যায়বান রাজার শাসনে তাহা দূরীভূত হইয়াছে।' কাজেই চন্দ্রগুপ্ত প্রজামঙ্গলের জন্য কর আদায় করতেই পারেন।
অর্থশাস্ত্রে সেনাপতি, পন্যাধ্যক্ষ, শুল্কাধ্যক্ষ, নাব্যধ্যক্ষ বিভিন্ন ধরনের রাজকর্মচারীর বিবরণ রয়েছে। কর আদায়ের জন্য রাজকর্মচারী নিযুক্ত হতো। এই বিভাগের সর্বপ্রধান কর্মচারীর পদবি ছিল 'সমাহর্ত্তা'। কর্মচারীগণ নিজ নিজ বিভাগ হতে কর, রাজস্ব সংগ্রহ করে সমাহপ্তার নিকট প্রেরণ করতেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের সৃষ্টি কালেক্টরেটই 'সমাহর্ত্তালয়' কর আদায়কারীর কার্যালয়। রাধাকুমুদ বন্দোপাধ্যায়ের রচনা থেকে সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি:
ক) তাহারা কর আদায় করিতেন ও বিভিন্ন উপজীবিকার উপর দৃষ্টি রাখিতেন।
খ) তাহারা রাজপথ নির্মাণ করাইতেন।
গ) তাহারা শিল্পসামগ্রী প্রস্তুতি তত্ত্বাবধায়ন করিতেন।
ঘ) কেবলমাত্র কর আদায়ের জন্য নহে, যাহাতে জন্ম ও মৃত্যু সমন্ধে রাজসরকার সমস্ত সংবাদ পাইতে পারেন, তাহার জন্য তৃতীয় বিভাগের কর্মচারিগণ কাহার কখন জন্ম হইল এবং কখন কিভাবে কাহার মৃত্যু হইল তাহার অনুসন্ধান করিতেন।
ঙ) (কর আদায়কারী) কর্মচারিবর্গ ব্যবসায় বাণিজ্যাদির তত্ত্বাবধান করিতেন। ইহারা দ্রব্যের ওজন ও পরিমাণাদির উপর দৃষ্টি রাখিতেন। (কম ওজনে দ্রব্য বিক্রয়, নিম্নমানের দ্রব্য গছিয়ে দেওয়াসহ নৈতিক বিষয়সমূহের উপর কর আদায়কারীর সজাগ দৃষ্টি থাকত।)
জলসেচনের প্রণালি অনুযায়ী জলকর নির্ধারিত হতো:
হস্তপ্রাবর্ত্তিম বা হস্তদ্বারা জলসেচন: এক-পঞ্চমাংশ
স্কন্ধপ্রাবর্ত্তিম বা স্কন্ধে বহন করে জলশেচন: এক-চতুর্থাংশ
স্রোতযন্ত্রপ্রাবর্ত্তিম বা স্রোতধারা নিয়ন্ত্রণ করে যন্ত্রের সাহায্যে জলসেচন: এক-তৃতীয়াংশ
নদী সরোবর হতে উত্তোলিত জলসেচন: এক-চতুর্থাংশ
আরও কয়েকটি করের উদাহরণ:
১. দস্যুতস্করাদির অথবা বন্য জন্তুর ভয়ে নিজ নিজ গাভি পালনে অক্ষম প্রজা রাজকীয় সেনা অধ্যক্ষের সহায়তা গ্রহণ করিত। এরূপ অবস্থায় তদুৎপন্ন দ্রব্যাদির দশমাংশ রাজসরকারকে পণস্বরূপ দিতে হইত। এই প্রথার নাম ছিল ভাগানুপ্রবিষ্টত।
অর্থদণ্ডও করের মতো রাজকোষে জমা হতো। উদাহরণ হিসেবে পশুপালন বিবেচনা করা যেতে পারে। কোনো অসুস্থ পশু যদি পশু চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় আরও বহু গুণ পীড়িত হতো, তাহলে তাকে চিকিৎসা ব্যয়ের দ্বিগুণ অর্থদণ্ড দিতে হতো। আর যদি মৃত্যু হতো, তাহলে পশুর মূল্যের সমান অর্থদণ্ড দিতে হতো।
পশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ: ছোট চতুষ্পদকে লাঠি দিয়ে আঘাত করলে দুই পণ অর্থদণ্ড, রক্তপাত হলে চার পণ অর্থদণ্ড। দুগ্ধবতী গাভিকে ক্লেশ প্রদান করলে বড় অঙ্কের অর্থদণ্ড।
যে সকল হিংস্র পশু, পক্ষী বা মৎস্য অপরাপর প্রাণীদিগকে হত্যা করত, তাদের ধরা বৈধ ছিল; তবে এ ক্ষেত্রে এক-দশমাংশ বা ততধিক সরকারকে শুল্ক হিসেবে প্রদান করতে হতো।
রাজকীয় হস্তি প্রতিপালনের জন্য কর আদায় করা হতো। হস্তিপালনে ১১ পদের কর্মচারীকে বেতন ও আহার দিয়ে রাখা হতো:
চিকিৎসক
অনীকস্থ (হস্তি প্রশিক্ষক)
আহোরক (মাহুত)
আঘোরণ (হস্তির পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রক)
হস্তিপক (হস্তির রক্ষক)
ঔপচারিক (পরিচারক)
বিধাপাচক (খাদ্য রন্ধনকারী)
যাবসিক (তৃণ সরবরাহকারী)
পাদপাশিক (হস্তির পায়ে শিকল পরিধানকারী)
কুটীরঙ্গ (প্রহরী)
উপশায়িক (নৈশ পরিচর্যাকারী)
হস্তির সেবাযত্নে ত্রুটি হলে কর্মচারীর বেতন কাটা যেত, চাকরি চলে যেত। একই ধরনের বিধান অশ্বের জন্যও প্রযোজ্য ছিল। এসব ব্যয় নির্বাহ হতো রাজার নির্ধারিত প্রজার কাছ থেকে আদায়কৃত কর থেকে।
পথ নির্মাণের জন্য যে কর আদায় করা হতো, তা যথারীতি পথ নির্মাণেই ব্যয় করা হতো। আবার এসব রাস্তা নষ্ট করলে বা খনন করলে নির্ধারিত অর্থদণ্ডও আদায় করা হতো:
পথের নাম-দণ্ডের পরিমাণ
ক্ষুদ্র পশুপথ ও মনুষ্যপথ– ১২ পণ
মহাপশুপথ– ২৪ পণ
হস্তিক্ষেত্রপথ– ৫৪ পণ
শ্মশানপথ ও গ্রামপথ– ২০০ পণ
দ্রোণমুখ পথ– ৫০০ পণ
সেতুপথ ও জনপথ– ৬০০ পণ
রাষ্ট্রপথ– ১০০০ পণ
[প্রাচীন হিন্দু দণ্ডনীতি: নরেন্দ্রনাথ লাহা (১৯২৩)]
আদায়কৃত করের যথার্থ ব্যবহারের সাক্ষ্য দিয়েছেন মেগাস্থিনিস: তার ভারত সফরকালে হাসপাতালসমূহের ভৈষজ্যাগারে অধিক পরিমাণ ঔষধ সংগ্রহ করে মজুত রাখা হতো। চিকিৎসকগণ রোগীকে কুচিকিৎসা দিলে তাদের অর্থদণ্ডও হতো। নারদমুণির ভাষ্য, কুচিকিৎসার ফলে মৃত্যু ঘটলে কুচিকিৎসক বড় শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন।
দুর্ভিক্ষ, বন্যা, অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি রাজাকে অধিক হারে কর আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করত। দুর্ভিক্ষের সময় রাজভান্ডারের অর্ধেক সংরক্ষিত রেখে বাকি অর্ধেক ক্ষুধার্ত মানুষকে ভিক্ষা দেওয়া হতো।
দুর্ভিক্ষ নিবারণ ও জনগণের ক্লেশমোচনের জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো, তার মধ্যে রয়েছে: দুর্গতকর্ম (দুর্গত মানুষকে অর্থ দিয়ে কাজ করানো); রাজভিক্ষা (রাজভাণ্ডার হতে ভিক্ষা); দেশনিক্ষেপ (অন্য কোনো সক্ষম রাজার হাতে দেশ সমর্পণ); মিত্র সহায়তা (মিত্র রাজাদের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণ); দুর্ভিক্ষ ভান্ডার (ধনী প্রজারা করের বাইরে দান করবে)। স্থানান্তরণ (অধিক শস্য উৎপাদনকারী অ লে সাময়িকভাবে গমন) উপনিবেশ গঠন (হ্রদ, সমুদ্র ও নদীর তীরে প্রজাদের উপনিবেশ স্থাপনে সহায়তা।
মনুর অনুশাসনে অবস্থা, প্রয়োজন উৎপাদন ভেদে রাজার জন্য যথাক্রমে এক-ষষ্টাংশ, এক-অষ্টমাংশ এবং এক-দ্বাদশাংশ শস্য কর হিসেবে গ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। স্বর্ণ ও মূল্যবান ধাতুর বেলায় কুড়ি ভাগের এক অংশ। তবে কিঞ্চিত অধিকারী (এখনকার হিসেবে ৩-৪ গ্রাম) করমুক্ত থাকবে। ক্ষুদ্র ও পেশাজীবী শিল্পীরা করের পরিবর্তে বিনে পয়সায় সেবা প্রদান করত।
মনুর কয়েকটি সতর্কবাণী রাজার জন্য আরোপিত: যে রাজা নিজের প্রাপ্য কর উঠিয়ে নেবেন কিন্তু তার রাজত্বে চোরদের শায়েস্তা করবেন না, তিনি স্বর্গ হারাবেন। যে রাজা নিজে প্রাপ্য কর আদায় করে নেবেন কিন্তু করের অর্থ দিয়ে প্রজাদের রক্ষা করবেন না, তিনি শিগগিরই নরকে ডুবে যাবেন।
যে রাজা শস্যের ছয় ভাগের এক ভাগ তুলে নিয়েছেন কিন্তু প্রজাদের কল্যাণ করেনি, তার উপর সকল প্রজার বিষ্ঠা নিক্ষিপ্ত হবে।
মনুর অনুশাসনে রাজাকে প্রজাদের প্রতি পিতার মতো আচরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ভারত সাম্রাজ্য ভেঙে অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ফার্সিভাষী যাযাবররা দখল করে নেয়; কিন্তু তারাও ধরে রাখতে পারেনি। মুসলমানরা এসে ভারতবর্ষ দখল করে নেয় এবং মধ্যযুগ সূচিত হয়।
রাষ্ট্রকে হোক কী ঈশ্বরকে হোক– কর প্রদানকারী প্রজা বিশেষ 'করদ মর্যাদা' ভোগ করত।